মেহেরপুর মুজিবনগর উপজেলায় পরিবেশ দূষণ করে যত্রতত্র ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে। নেই বৈধ লাইসেন্স ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র । বাজার, স্কুল ও আবাসিক এলাকা ঘেষে গড়ে উঠেছে এসব ইটভাটা। প্রভাবশালী ইটভাটা মালিকদের চাপে দীর্ঘদিন আটকে আছে এসব অবৈধ ইটভাটায় অভিযান।
তাছাড়া মোনাখালি ইউনিয়নের ভবানীপুর প্রাইমারি স্কুলের সাথে রয়েছে দুটি ইটভাটা,ভাটা মৌসুমে চিমনি দ্বারা ব্যবহৃত কালো ধুমোই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোমলমতি বাচ্চাদের হতে হচ্ছে বিভিন্ন রোগের শিকার। জেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, ইট পোড়ানোর লাইসেন্স, ফায়ার সার্ভিসের সার্টিফিকেটসহ কোন অনুমোদন ছাড়াই ইটভাটার মালিকেরা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে নির্বিঘ্নে এসব ভাটায় বছরের পর বছর ইট পোড়ানো হচ্ছে। উপজেলার ৪টি ইউনিয়নে সরকারি নীতিমালা অমান্য করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার ও আবাসিক এলাকায় ফসলি জমি নষ্ট করে অবৈধভাবে ভাটার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে তারা। সবুজ বনায়ন কেটে ইটের ভাটায় দেদারছে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে।
ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় পথচারী, স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রী এবং আবাসিক এলাকার জনস্বাস্থ্য মারাত্মক ভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে, এছাড়া ফলদ বৃক্ষ, প্রাণী, জীববৈচিত্র ধ্বংস ও পরিবেশ দূষণের হুমকির মুখে পড়েছে। সরকারী বিধিমালা অনুযায়ী ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) ২০১৩ আইন অনুযায়ী, আবাসিক এলাকা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কৃষিজমির এক কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা স্থাপন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এ আইনের তোয়াক্কা না করে মুজিবনগর উপজেলায় গড়ে তোলা হয়েছে ১৫টি ইটভাটা। মেহেরপুর মুজিবনগর হাইওয়ে সড়কের পাশে ফসলি জমি ঘেঁষে ,এম এন সি ব্রিকস, শাপলা ব্রিকস, মুন ব্রিকস, এল এল এম ব্রিকস, ডালিম ব্রিকস, মুকুট ব্রিকস, ইয়ান ব্রিকস, হিরা ব্রিকস, বিবিএ ব্রিকস, গাজী ব্রিকস ও জবা ব্রিকস ও চাঁদ আলীর সি এ বি ব্রিকস নামের ইটভাটাগুলোতে ইট পোড়ানোর জন্য জ্বালানি হিসেবে কাঠ ও কয়লা পোড়ানো হচ্ছে। যেগুলোর অধিকাংশরই নেই পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রসহ জেলা প্রশাসনের লাইসেন্স। তবুও ভাটার ব্যবসা চলছে রমরমা। ফলে চুল্লি থেকে বের হওয়া কালো ধোঁয়ায় এলাকার পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। ইট পোড়ানোর জন্য ভাটার চারপাশে শত শত মণ আম, জাম, কাঁঠাল, রেইনট্রি, কদম, নারিকেল, বাঁশের মাথা ও খেজুর গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছের কাঠ মজুদ করা হয়েছে।
এছাড়াও ফসলি জমির টপসয়েল কেটে পাহাড় সমান মাটির স্তুপ করা হয়েছে। উপজেলার অধিকাংশ ইটভাটা জনবসতির খুব কাছাকাছি অবস্থিত। ভাটাগুলোর ১০০ থেকে ১৫০ গজের মধ্যে রয়েছে বিপুল সংখ্যক ফলদ গাছ, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শতাধিক বাড়িঘর। কাঠ পোড়ানোর বিষাক্ত ধোঁয়ায় গাছের পাতা পুড়ে যাচ্ছে। ভাটা এলাকা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকায় স্থানীয় লোকজন বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। ইটভাটা নির্মাণের কারণে কৃষি জমির পরিমাণও দিন দিন কমতে শুরু করেছে।
ইট ভাটার শ্রমিকরা জানান, নিম্নমানের এসব ভাটায় কয়লা ব্যবহারের কোন সুযোগ নেই তাই কাঠ দিয়েই ইট পোড়াতে হয়। স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, ফসলি জমির পাশে ইটভাটা গড়ে তোলার কারণে জমির উর্বরতা শক্তিহৃাসসহ ফসল উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এদিকে ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইনে ইটভাটার মাটি সংগ্রহের জন্য জেলা প্রশাসকের অনুমতি নেয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু কোন রকম অনুমতি ছাড়ায় মুজিবনগর উপজেলায় প্রতি মৌসুমে ভাটার মালিকরা এক শ্রেনীর মাটি খেকো দালালদের মাধ্যমে কৃষি জমির উপরিভাগের টপসয়েল কেটে ইটভাটায় স্তপ করে থাকেন। ফলে ফসলি জমির উর্বরতাশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। অথচ এসব ইটভাটার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেনা প্রশাসন। বিনিময়ে ইটভাটা থেকে বাৎসরিক আদায় করা হচ্ছে কোটি টাকার মাসোহারা। এদিকে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আছে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি ইটভাটার। বাকীগুলো চলছে প্রশাসন কে ম্যানেজ করে। তবে এসব ইটভাটা মালিকরা সরকারকে রাজস্ব দিচ্ছেন বলে জানান। জনমনে প্রশ্ন উঠেছে উর্বর তিন ফসলি জমি ও লোকালয়ে যে ইটভাটাগুলো গড়ে উঠেছে সেগুলো ডিসি অফিস থেকে লাইসেন্স পাওয়ার আগে পরিবেশগত ছাড়পত্র বা অনাপত্তিপত্র পেল কিভাবে?
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ভাটা মালিক বলেন, প্রতিবছর এলআর ফান্ডে মোটা টাকা দিয়ে ইটভাটা মালিকরা যে লাইসেন্সটি নিয়ে থাকে তা দেখার আগে দেখতে হবে পরিবেশ অধিদপ্তর পরিবেশগত যে ছাড়পত্রটি দিয়েছে সেটি অফিসে বসে দিয়েছে নাকি ইটভাটার অবস্থানটা সরেজমিনে পরিদর্শন করে দিয়েছে?
অভিযোগ রয়েছে বছরে দু-একবার ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে দায় সারছে পরিবেশ অধিদপ্তরসহ উপজেলা প্রশাসন। ভাটা মালিকদের বক্তব্য, তারা বৈধভাবেই ব্যবসা করতে চান কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে ছাড়পত্র ও লাইসেন্স পাচ্ছেন না। তাই নিরুপায় হয়ে চাঁদা দিয়ে চালাতে হচ্ছে এসব ইটভাটা। বৈধতা না থাকলেও প্রতি বছর ইট পোড়ানোর মৌসুমে পাঁচ লাখ টাকা রাজস্ব দিতে হচ্ছে সরকারকে। ভাটা মালিকেরা জানিয়েছেন, কৃষিজমি ও আবাসিক এলাকার ১ কিলোমিটারের মধ্যে ইটভাটা করা যাবে না। একই সাথে ইট পরিবহনের জন্য সরকারি পাকা সড়কও ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু এই আইন মানা আমাদের জন্য খুবই কঠিন। তাই আমরা পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না পেলেও ভাটা স্থাপন করেছি। তারা আরও জানান, ভাটাগুলোর বৈধ কাগজপত্র না থাকার কারণে প্রশাসনের উৎপাতও বেশি। প্রশাসন ঝামেলা করছে অনবরত। তাদের অনেককেই টাকা দিয়ে ম্যানেজ করতে হচ্ছে। মুজিবনগর উপজেলার অধিকাংশ ইটভাটার কোনো লাইসেন্স ও অনুমোদন নেই। কীভাবে চলে এমন প্রশ্ন করা হলে ইটভাটার মালিকরা জানান, জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন, বন বিভাগ এবং পরিবেশ অধিদপ্তরসহ প্রতিটি সেক্টর ম্যানেজ করেই ভাটা পরিচালনা করা হচ্ছে। আর এসব ম্যানেজ করছেন উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক তসলিমুল ইসলাম সজল।
এদিকে ভুক্তভোগী বাসিন্দাদের অভিযোগ, সবকিছু জেনেও নীরব পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন। তাদের দাবি, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় কঠোর অভিযান চালাতে হবে।
তবে মুজিব নগর উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি মশিউর রহমান বলেন, প্রাথমিক অবস্থায় ইট পোড়াতে জ্বালানী হিসেবে ও কয়লার দাম বৃদ্ধির কারণে ভাটাগুলোতে কাঠ পোড়ানো হচ্ছে। বেশির ভাগ ইটভাটার ২০১৫ সালের পর থেকে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র ও নবায়ন নেই। কেনো নবায়ন নেই এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, প্রতি বছর ইটভাটাগুলোর মালিকেরা এলআর ফান্ডসহ আয়কর ও ভ্যাট দিচ্ছেন কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকায় জেলা প্রশাসকের লাইসেন্স নবায়ন করা সম্ভব হচ্ছেনা। আগের সরকারের আমলে আওয়ামী লীগের নেতাদের হস্তক্ষেপ ও প্রশাসনের নীরব ভূমিকায় চলতো এসব অবৈধ ইটভাটা। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে এখন তো কোনো রাজনৈতিক সরকার নেই, তবে ভাটাগুলো কাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে?
এ ব্যাপারে মেহেরপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করলে, তিনি অফিসে না আসার কারণে যোগাযোগ করতে ব্যর্থ হয় এই প্রতিবেদক। এ ব্যাপারে মুজিবনগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার খাইরুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে আমাদেরকে জানান আমরা ইট ভাটা থেকে কোন সুবিধা নিই না, এমনকি এ বছর বিজয় দিবসেও কারো কাছ থেকে উপজেলা প্রশাসন এক পয়সাও নেয় নাই। মেহেরপুর জেলা প্রশাসকের কাছে অবৈধভাবে ইটভাটা পরিচালনা ও এলআর ফান্ডে টাকা নেওয়ার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি জানান, পরিবেশ অধিদপ্তরের লাইসেন্স ছাড়া ইটভাটা গুলো পরিবেশ সম্মত ও বৈধ নয়। তিনি আরও বলেন, আপনারা জানেন আমি এখানে নতুন যোগদান করেছি এবং স্পষ্ট ভাবে বলে দিয়েছি এলআর ফান্ডে কোন টাকা নেয়া যাবেনা।