শেষ ঠিকানার সুদক্ষ সুনিপুণ কারিগর মনু মিয়া
০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:০৭ পিএম | আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৩:০৭ পিএম
যে কারও মৃত্যুর খবর শোনা মাত্রই তড়িঘড়ি করে খুন্তি-কোদাল, দা, চাকু, স্কেল আর করাতসহ কবর খোঁড়ার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে ঐ মৃত ব্যক্তির বাড়িতে ছুটে যান ৭৩ বছর বয়সী কিশোরগঞ্জ জেলা ইটনা উপজেলার জয়সিদ্দি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের আলোচিত গোর খোদক মো. মনু মিয়া। অতিদ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে ঘোড়ার পিঠে চেপে চলেন তিনি।
মৃত ব্যক্তির বাড়িতে গিয়ে বাঁশ কাটা থেকে শুরু করে কবর খোঁড়া শেষ করে দাফন পর্যন্ত সেখানে থাকেন তিনি। দাফন শেষ হওয়ার পর আবার সব যন্ত্রপাতি ব্যাগে নিয়ে ঘোড়ার পিঠে উঠে বাড়ির পথে রওনা হন।
কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার জয়সিদ্দি ইউনিয়নের আলগাপাড়া গ্রামের এই ৭৩ বছর বয়সী বৃদ্ধ মনু মিয়া যখন ঘোড়ায় চড়ে উদ্দাম গতিতে ছুটে চলে তখন আর বুঝতে কারো অসুবিধা হয় না যে কারও মৃত্যু হয়েছে। কবর খোঁড়ার পর মৃত ব্যক্তির পরিবারের কারও কাছ থেকে কোন পারিশ্রমিক বা যাতায়াত খরচ নেন না। এলাকার সবার কাছে শ্রদ্ধা ও সম্মানের পাত্র তিনি। নিজ এলাকায় পরিচিতি পেয়েছেন তিনি শেষ ঠিকানার কারিগর হিসেবে।
পাড়া-পড়শিরা জানান, মনু মিয়া খুব সহজ-সরল একজন ভালো মানুষ। এ যুগে স্বার্থ ছাড়া কাউকে কোনো কাজে পাওয়া যায় না, কিন্তু সেখানে মো. মনু মিয়া বিনাপারিশ্রমিকে মানুষের বাড়িতে গিয়ে কবর খুঁড়ে দিয়ে আসেন- এটা খুবই বিরল ঘটনা।
চাহিদাহীন এই মানুষটির নেই অঢেল টাকা-পয়সা, সম্পত্তি। কিন্তু তার নীতি-নৈতিকতা মুগ্ধ করে এলাকার সবাইকে। এই বুড়ো বয়সেও কোনো কিছুর বিনিময় ছাড়া সারাটা দিন তিনি যে পরিশ্রম করেন সেটা যে কোনো যুবক করলেও হাঁপিয়ে উঠবে- এমন আলোচনা সবার মুখে। স্ত্রী রহিমা আক্তারকে (৫৬) নিয়ে নিজের সৎ উপার্জনে উপার্জিত অর্থ দিয়েই ছোট সংসার চলছে- এতেই খুশি মনু মিয়া।
ইটনা উপজেলার স্থানীয় বাসিন্দাদের কথা হলে তারা ইনকিলাবকে বলেন, মনু মিয়া খুব ভালো মানুষ। তিনি বিনাপারিশ্রমিকে মানুষের কবর খোঁড়েন। মনু মিয়ারমত এমন একজন ভালো মানুষ এ এলাকায় জন্মগ্রহণ করায় তারা নিজেদের গর্ববোধ করেন।
মনু মিয়া কবর খোঁড়ার কাজ শুরু করেন ১৯৭২ সাল থেকে। নিজে পড়াশোনা না জানলেও কবর খুঁড়তে এসে তিনি মানুষকে দিয়ে ডায়রিতে সুন্দর করে লাশের নাম, ঠিকানা, দিন তারিখ লিখে রাখেন। ডায়েরির তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত তিন হাজার চল্লিশ জনের কবর খুঁড়েছেন মনু মিয়া। এর মধ্যে রয়েছে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, সাহাব উদ্দিন ঠাকুরসহ বিশিষ্টজনদের কবর। জীবনের বাকি সময়টুকু এভাবেই কাটিয়ে দিতে চান মনু মিয়া।
নিম্নমধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তান মনু মিয়ার মা সারবানুর মৃত্যু হয় ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ। মায়ের কবর তৈরিতে অংশ নেন কিশোর মনু মিয়া। সেই থেকে শুরু কবর খোঁড়ার কাজ। ৫৩ বছরেরও বেশি সময় ধরে মনু মিয়া বিনাপারিশ্রমিকে নিজের টাকা খরচ করে কবর খোঁড়ার কাজ করেন। বাবার জমি বিক্রি করে ঘোড়া কিনেছেন। যন্ত্রপাতি তৈরি করতে খরচ হয়েছে লাখ টাকা। সংসার চলে টেনেটুনে। এতে কোনো কষ্ট নেই তার। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে মনু মিয়া তৃতীয়। কবর খোঁড়ার কাজে বাহন হিসেবে এ পর্যন্ত তিনি চৌদ্দটি ঘোড়া কিনেছেন। আর এ জন্য বিক্রি করতে হয়েছে পৈত্রিক জমি।
পৈত্রিকসূত্রে পাওয়া একটি জমি বন্ধক দিয়ে বর্তমানে চলে তার সংসারসহ কবর খোঁড়ার ব্যয়। মনু মিয়া এবং স্ত্রী দুজনের সোনার সংসার থাকলেও তাদের নেই কোনো ছেলে-মেয়ে । স্বামী আর স্ত্রী এ মনু মিয়ার পরিবার।
গোরখোদক মনু মিয়ার সাথে একান্ত আলাপ চারিতায় ইনকিলাবকে বলেন, “মানুষের দেখাদেখি শখের বশেই মূলত কবর খুড়তে খুড়তে কখন যে এটা নেশা হয়ে গেছে! বুঝতেই পারিনি। কোথাও মানুষ মারা যাওয়ার খবর পেলেই আমার মনটা ছটফট করে। দ্রæত খুন্তি-কোদাল, দা, চাকু, স্কেল আর করাতসহ কবর খোঁড়ার প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে মৃত ব্যক্তির বাড়িতে ছুটে চলে যাই। সুন্দর করে কবর খুঁডতে, দাফন সম্পন্ন করে তারপর বাড়িতে আসি। আমি কবর খুঁডতে কারো কাছ থেকে কোন দিন কোনো টাকা-পয়সা নেই না। আমি স্বেচ্ছায় এই কাজটি করতে ভালোবাসি, ভালো লাগে। আমার কোনো ছেলেমেযয়ে নেই, আমি জীবনের বাকি সময়টুকু মানুষের কবর খুঁড়ে কাটিয়ে দিতে চাই। এই জন্য আমার স্ত্রীর কোন অভিযোগও নেই । আমাদের দুজনের সংসার অত্যন্ত সুন্দর ও আনন্দের। আমি ও আমার স্ত্রীর জন্য সকলের কাছে দোয়া চাই”
কিশোরগঞ্জ জেলা ছাড়িয়ে পাশর্^বর্তী জেলা উপজেলাসহ সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলাতেও বহু কবর খনন করেছেন মনু মিয়া। কবর খোঁড়ার একজন নিখুঁত, সুদক্ষ এবং সুনিপুণ কারিগর হিসেবে নিজের জেলা কিশোরগঞ্জ ছাড়িয়ে পাশের জেলা হবিগঞ্জেও সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে মো. মনু মিয়ার।
ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি ইউপি চেয়ারম্যান মো. মনির উদ্দিন ইনকিলাবকে বলেন, “ মনু চাচা অত্যন্ত সহজ সরল পরোপকারি মানুষ, সবসময় স্বার্থবিহীন মানুষের উপকার করেন। তার জীবনে তেমন কোন চাহিদা নেই। অত্যন্ত সহজ সরল জীবন যাবনে নিজেকে অভ্যস্থ করে নিয়েছেন। খুবই সৎ ও ভালো মানুষ। আমি তাঁর দীর্ঘায়ু কামনা করি।”
বিভাগ : বাংলাদেশ
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
শহীদ আবু সাঈদের কবরে তিন উপাচার্যের শ্রদ্ধা নিবেদন
রামগড়ে হত-দরিদ্রদের জন্য বিনামূল্যে চক্ষু চিকিৎসা ক্যাম্প উদ্বোধন
লন্ডনে খালেদা জিয়াকে স্বাগত জানালেন তারেক রহমান
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিন নবজাতক জন্ম দিলেন এক গৃহবধূ
একনেকে অনুমোদন পেল ৪ হাজার কোটি টাকার ১০ প্রকল্প
নরসিংদীতে জুলাই ঘোষণাপত্র বিতরণ করছেন সারজিস আলম
বিডিআর জওয়ানদের মুক্তির দাবিতে যমুনা অভিমুখে পদযাত্রা, পুলিশের বাধা
ব্রাহ্মণপাড়ায় ডায়রিয়ার প্রকোপ শীত বাড়ছে মৌসুমি রোগবালাই
এ বছর থেকেই এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বদলি শুরু : শিক্ষা উপদেষ্টা
স্কুলে না থেকেও বেতন নিচ্ছেন নিয়মিত
সুপ্রিম কোর্ট বার সভাপতি মাহবুব উদ্দিন খোকনের সঙ্গে ফজল আনসারীর সাক্ষাৎ
কম্বলডা পায়া শান্তিতে ঘুমামু
ঈশ্বরগঞ্জে পুলিশের বিশেষ অভিযানে গ্রেফতার ১১
সিরাজদিখানে মাদক নিয়ে দ্বন্দ্ব ছুরিকাঘাতে ২ জন আহত
নিয়োগ দুর্নীতির অভিযোগে ওয়াসার তাকসিমসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে মামলা
রাশিয়ার সাইবার ইউনিট পোল্যান্ডে হামলার লক্ষ্যে সক্রিয়: মন্ত্রী গাওকোভস্কি
সিংগাইরে সিসিডিবি'র উদ্যোগে কম্বল বিতরণ
মতলবে গাছ কাটতে গিয়ে গাছ ব্যবসায়ীর মৃত্যু
ট্রাম্পের গ্রিনল্যান্ড-পানামা খালের প্রতি আগ্রহে উত্তেজনা বৃদ্ধি
লক্ষ্মীপুরে জমি দখলের অভিযোগে যুবদল নেতাকে বহিষ্কার