মাঘ মাসের শেষের দিকে হঠাৎ করে কুয়াশার চাদরে ঢাকা উত্তরের জেলা দিনাজপুর সহ আশপাশের উপজেলা। খাদ্যশস্যের ভাণ্ডার হিসেবে পরিচিত উত্তরের জেলা দিনাজপুরের হাকিমপুর উপজেলায় চলতি মৌসুমে বোরো ধানের চারা রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছে শ্রমিকরা। অতিরিক্ত খরচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছে কৃষকরা।
বর্তমান সময়ে বিদ্যুৎ, সার, কীটনাশক, ডিজেল শ্রমিকসহ সবকিছুর দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এবার বোরো চাষে অতিরিক্ত খরচের দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়েছে তাদের কপালে। মাঘের হিমেল বাতাস, কনকনে ঠান্ডা বাতাস আর ঘনকুয়াশাকে উপক্ষো করে জমি তৈরি ও বোরো ধানের চারা রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছে কৃষক ও শ্রমিকরা। বোরো চারা রোপণে পুরুষ শ্রমিকদের পাশাপাশি ব্যস্ত সময় পার করছে নারী শ্রমিকরাও। আবহাওয়া ভালো থাকলে বাম্পার ফলন ও ভালো দাম পেলে অতিরিক্ত খরচ পুষিয়ে নিতে পারবে বলে আশা করছেন কৃষকরা।
অন্যদিকে উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে, চলতি মৌসুমে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭ হাজার ৬শত ২৩ হেক্টর জমি। শুরু থেকে কৃষি অফিস থেকে সরকারি প্রণোদনাসহ সবধরনের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে উপজেলা কৃষি অফিসের লোকজন।
রবিবার (২ফেব্রুয়ারী) হাকিমপুর উপজেলার বিভিন্ন মাঠ ঘুরে দেখা যায়, বোরো ধানের চারা রোপণে ব্যস্ত সময় পার করছেন কৃষকরা। জমিতে বাড়তি সার হিসেবে বিঘা প্রতি ৬-৭ ভ্যান গোবর সার ছিটিয়ে দিচ্ছে। এরপর গভীর নলকূপ থেকে পানি দিয়ে জমি ভিজিয়ে নিয়ে পাওয়ার টিলার দিয়ে কেউবা মেসি (ট্রাক্টর) দিয়ে জমি চাষ করছে। এতে বিঘা প্রতি ১০-১৫ কেজি ডেপ,১০কেজি পটাস, ১০ টিএসপি ৫ কেজি জিপসাম ও ৫-৭ কেজি ইউরিয়া সার মিশিয়ে ৩-৪ চাষের মাধ্যমে জমি তৈরি করে জমিতে চারা রোপণ করছে শ্রমিকরা। ইতোমধ্যে এ উপজেলায় ২৫ হেক্টর জমিতে চারা রোপণ শেষ হয়েছে জানায় উপজেলা কৃষি অফিস।
উপজেলার আলিহাট ইউনিয়নের কোকতাড়া গ্রামের গভীর নলকূপের মালিক মোঃ আলম হোসেন জানান, প্রতি বছর আমার এই গভীর নলকূপ দিয়ে এই মাটে প্রায় ২০০-২৫০ বিঘা জমিতে পানি সেচ দিয়ে থাকি। এবারে ও ইতিমধ্যে বিদ্যুৎ সংযোগ পেয়েছি এবং জমিতে পানি সেচ দিতে শুরু করেছি। এখন পর্যন্ত এই গভীর নলকূপের আওতায় প্রায় ৬০-৭০ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চারা রোপণ করেছে কৃষকরা। প্রতি ১০০ শতক (এক একর) জমির জন্য নেয়া হচ্ছে ৪ হাজার ২০০ টাকা। গত বছর নেয়া হয়েছে ৩৬০০- ৩৮০০ টাকা। বিদুৎ খরচ বেশি তাছাড়া সবকিছুর দাম বেশি কি আর করা।
উপজেলার জাংগই গ্রামের বোরো চাষি আজিনুর রহমান বলেন, আমি ৮-১০ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করি। কিছু জমিতে চারা রোপণ হয়ে গেছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সম্পূর্ণ জমিতে চারা রোপণ শেষ হবে আশা করছি। তবে গত বছরের তুলনায় এবার খরচের হিসেব বেশি গুনতে হবে। পানি সেচের খরচ, জমি চাষ করা, সার, কীটনাশক ও শ্রমিকসহ সবকিছুর দাম বেশি। তাই দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি। উপজেলা কৃষি অফিস থেকে প্রণোদনা হিসেবে হাইব্রিড জাতের ধানের বীজ ও সার পেয়ে খুব উপকার হয়েছে। তবে এবার আবহাওয়া ভালো থাকলে গতবার মতো এবারও বোরো ধানের ফলন ভালো হবে বলে আশা করছি। গত বছর ধানের দাম ভালো পেয়েছি। আশা করছি এবারও ভালো দাম পাবো তাহলে খরচ পুষিয়ে নিতে পারবো বলে আশা করছি।
উপজেলার কোকতাড়া গ্রামের বর্গাচাষি শ্রী গোপাল রবিদাস বলেন, হারা (আমরা) গরীব মানুষ নিজের আবাদি জমি নাই বললেই চলে। অন্যর জমি চানা (বর্গা) নেই ইরি আবাদের জন্য, এক বিঘা জমি (৩৩ শতক) ১০-১১ হাজার টাকা দিয়ে নিতে হয়েছে। বাজারে ইউরিয়া সার আগে ১০০০-১১০০, পটাশ ৮০০, ডেপ ১০০০, টিএসপি ১৩৫০ টাকা ছিল। বর্তমানে ইউরিয়া ১৩০০-১৩৫০, পটাশ ১০০০, ডেপ ১০৫০-১২০০ টিএসপি ১৬৫০-১৭০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। জমি সেচের বাড়তি খরচ, সারের দাম, শ্রমিকদের মজুরি বেশি, সবকিছু মিলে কি হবে আল্লাহ ভালো জানে! তবে আশা করছি আবহাওয়া ভালো থাকলে এবং ধানের দাম ভালো পেলে খরচ পুষিয়ে নিতে পারবো।
বোরো ধানের চারা রোপন কাজের শ্রমিকর সরদার আব্দুল হান্নান বলেন, আমরা কয়েকজন মিলে একটা দল তৈরি করেছি। দীর্ঘদিন থেকে বোরো ও আমন ধানের চারা রোপণ করে থাকি। এবার বোরো ধানের চারা রোপণ প্রতি বিঘা (৩৩ শতক) ১ হাজার ৩০০ টাকা করে নিচ্ছি। প্রতিদিন ৫ থকে ৭ বিঘা জমিতে বোরো ধানের চারা রোপণ করতেছি। তবে এখন জমি গাড়ার অত চাপ নাই। উপজেলার আরেক নারী শ্রমিক বলেন, আমরা প্রতিদিন হাজিরা হিসেবে বোরো ধানের রোপণ করতেছি। প্রতিদিন হাজিরা হিসেবে ৫০০-৬০০ টাকা পাচ্ছি।
হাকিমপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আরজেনা বেগম বলেন, চলতি মৌসুমে এ উপজেলায় বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭ হাজার ৬'শ ২৩ হেক্টর জমি। ইতোমধ্যে চারা রোপণ শুরু হয়েছে। আশা করছি লক্ষ্য মাত্রার বেশি জমিতে বোরো চাষ হবে। ইতিমধ্যে উপজেলায় আজ ২ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ৩৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চারা রোপণ করা শেষ হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক উপজেলার ১০০০ জন প্রান্তিক কৃষকের মাঝে বিনামূল্যে বোরো হাইব্রিড ধানের বীজ বিতরণ করা হয়েছে। আর উফশি জাতের প্রণোদনা হিসেবে ২০০০ জনের মাঝে সার ও বীজ বিতরণ করা হয়েছে।