একদিকে রোহিঙ্গার চাপ, ইয়াবাসহ মাদকে সয়লাব হওয়া সীমান্তবর্তী উপজেলা টেকনাফে। ২৭১ কিমিটার সীমান্ত এলাকা অনেকটাই অরক্ষিত। একদা টেকনাফ সীমান্ত শুধুই মাদক ও চোরাচালানের রুট হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে এই জনপদ আরো অনেক বেশি বিপদজনক হয়ে উঠেছে। এই সীমান্ত দিয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করছে স্বর্ণ, আইস, ইয়াবা, গরু, ছাগল, মহিষ আর বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী, ভোগ্যপণ্য, ভর্তুকী দেওয়া পন্য সার, ডিজেল, জ্বালানী। এখন এই জনপদ আরেকটি ভয়ঙ্কর চক্রের দখলে-পাহাড়কে আশ্রয় করে গড়ে উঠেছে এক ‘অপহরণ সাম্রাজ্য’।
অপহরণ আতঙ্কে তটস্থ এলাকাবাসী। ইতিপুর্বে এখানকার বাসিন্দারা মিয়ানমারে যুদ্ধের কারণে গোলাবারুদের বিস্ফোরণজনিত আতঙ্কে দিন কাটাত। বর্তমানে এর চেয়ে বড় আতঙ্কের নাম এই অপহরণ-মুক্তিপণ বাণিজ্য। এখন কে, কখন অপহরণের শিকার হয়, সেই চিন্তায় আতঙ্কগ্রস্ত থাকে সবাই। দিন দিন এ ধরনের ঘটনা বেড়ে চললেও কোনো স্থায়ী সমাধান মিলছে না। একের পর এক অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় আতঙ্ক এবং ক্ষোভ বাড়ছে স্থানীয়দের মাঝে।
পাহাড় ঘেরা হ্নীলা, হোয়াইক্যং ও বাহারছড়া ইউনিয়নের বাসিন্দা, ব্যবসায়ী এমনকি কৃষকরাও আজ এই চক্রের ভয়ংকর টার্গেট। অপহরণের পর দাবি করা হচ্ছে লাখ লাখ টাকার মুক্তিপণ। কেউ না পেলে শারীরিক নির্যাতন বা জীবননাশের হুমকি- এটাই যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত সপ্তাহে টেকনাফের হোয়াইক্যং ইউনিয়নের পশ্চিম মহেশখালীপাড়ায় এমনই একটি চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় সেনাবাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির সমন্বয়ে গঠিত যৌথবাহিনী। অভিযানে অপহরণকারী দলের সদস্য মোহাম্মদ রফিক (২৭) গুলিবিদ্ধ হন।
অন্যদিকে অপহরণের ছয় দিন পর মঙ্গলবার (২২-এপ্রিল) রাত ৯টার দিকে কক্সবাজারের টেকনাফের বাহারছড়ার শিলখালীর পাহাড়ের আস্তানায় অভিযান চালিয়ে সিলেটের জাকিগঞ্জ এলাকার ছয় বাসিন্দাকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। ধারণা করা হচ্ছে, মানব পাচারকারীরা তাঁদের বিদেশে পাচারের উদ্দেশ্যে অপহরণ করে গোপন আস্তানায় আটকে রেখেছিল। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, গত ১৫ এপ্রিল কাজের সন্ধানে সিলেটের জকিগঞ্জ থেকে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা দেন ছয় বাসিন্দা। ১৬ এপ্রিল কক্সবাজারে পৌঁছে সবাই পরিবারের সঙ্গে মুঠোফোনে কথাও বলেন। এরপর সবার মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
স্থানীয়দের মতে, অপহরণ চক্রের সদস্যরা সাধারণত সন্ধ্যার পর পাহাড়ি গোপন পথ ধরে জনবসতিতে নামে। তারা টার্গেট করে অর্থবান পরিবার, একাকী চলাফেরা করা ব্যক্তি বা ব্যবসায়ীকে। অপহরণের পর ভুক্তভোগীকে নিয়ে যাওয়া হয় পাহাড়ি গুহায় বা খামারে-যেখান থেকে শুরু হয় মোবাইল ফোনে অপহৃতদের আত্মীয় স্বজনদের কাছ থেকে মুক্তিপণ দাবির নাটক।
এই অপহরণ চক্রে রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি স্থানীয় প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক মদদপুষ্ট ব্যক্তিদের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। তারা অত্যাধুনিক মোবাইল প্রযুক্তি ব্যবহার করে, বারবার অবস্থান পরিবর্তন করে এবং পাহাড়ি দুর্গম পথ ব্যবহার করায় অভিযান চালানো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
এক সিনিয়র পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, “চক্রটি আধা-সামরিক কৌশলে চলে। তাদের আচরণ পরিকল্পিত ও গোছানো। যেকোনো সময় হানা দেয় এবং মুহূর্তেই গা ঢাকা দেয়।”
কেন বাড়ছে অপহরণ? অপহরণের ঘটনার ধরন, অপহৃত ব্যক্তি এবং আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর দেওয়া তথ্য মিলিয়ে টেকনাফে অপহরণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে তিনটি কারণ চিহ্নিত করা যায়।
এক. মিয়ানমার থেকে চোরাই পথে আসা মাদকের লেনদেন। দুই. সাগরপথে মানবপাচারকারী চক্রের প্রলোভন। আর তিন. সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে অর্থ আদায়।
টেকনাফের পূর্ব পাশে মাত্র ৪ কিলোমিটার প্রশস্ত নাফ নদী; ওপারে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য। এই নদী পেরিয়ে সহজেই ইয়াবা ও আইসের চালান প্রবেশ করে বাংলাদেশে। অন্যদিকে হ্নীলা, হোয়াইক্যং ও বাহারছড়ায় গড়ে তোলা হয়েছে ৩ লাখ রোহিঙ্গার ১১টি রোহিঙ্গা ক্যাম্প। এসব ক্যাম্প ঘিরে গড়ে উঠেছে অন্তত ১০-১২টি সশস্ত্র ডাকাত ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর ঘাঁটি, যারা চাঁদা আদায়, মাদক কারবার এবং অপহরণে জড়িত। চাঁদা না দিলে অপহরণ করে নির্যাতন চালিয়ে মুক্তিপণ আদায় করে তারা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের একটি গোপন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ২৭১ কিলোমিটার সীমান্তের এলাকায় রয়েছে ৩৭টির বেশি ইয়াবা কারখানা। শুধু বাংলাদেশে পাচারের জন্য এসব কারখানায় ইয়াবা তৈরি করা হয়। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের প্রতিবেদন, ইয়াবা কারবারে জড়িত ব্যক্তি এবং অপহৃতদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে আসা এসব ইয়াবা মূলত বাকিতেই পাঠানো হয়। শর্ত দেওয়া হয় ইয়াবা বিক্রি করে টাকা পরিশোধের। কখনও কখনও বন্ধক রাখা হয় মানুষ।
তাছাড়া, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কিছু পরিবারের সদস্য মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে রয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থানরত পরিবারের অংশের দেশের বাইরে যাবার প্রবণতা ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একঘেয়েমী বন্দীদশা থেকে মুক্তি পেতেও রোহিঙ্গাদের দেশের বাইরে যাবার একটা প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রবণতার সাথে স্থানীয় কিছু বেকার জনগোষ্টি কলম্বাস পথে ( সাগর পথে) দেশের বাইরে অর্থাৎ মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া সহ মধ্যপ্রাচ্যে ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে চলে যাবার প্রবণতা সৃষ্টি হচ্ছে। এর ফলে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে ও ভিতরে মানবপাচার চক্র সক্রিয় অবস্থান জোরদার হচ্ছে। এ চক্রের সাথে যুক্ত হচ্ছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে্র কিছু প্রভাবশালী সদস্য। স্থানীয় ও রোহিঙ্গাদের অপহরণ করে টেকনাফের বিভিন্ন পাহাড়ে অবস্থান করে পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে মুক্তিপণ দাবি করে। মুক্তিপণ না পেলে তাদের উপর চলে বর্বরোচিত নির্যাতন, এমনকি হত্যাকান্ডের ঘটনাও ঘটে।
টেকনাফের গহীন পাহাড়ের ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে অসংখ্য গুহা (সুড়ঙ্গ)। আর এসব গুহাকে অপরাধী চক্র নিরাপদ আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করে। এসব গুহাগুলো টেকনাফের মুল লোকালয় থেকে অনুমানিক ১০ কিলোমিটার ভেতরে । গহীন পাহাড় হলেও সেখানে অপরাধী চক্রের প্রধানসহ কয়েকজন ব্যবহার করে ল্যাপটপসহ আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর নানা ডিভাইস। যে প্রযুক্তির মাধ্যমে অপহরণের পর বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের আগাম তথ্য জানতে পারে চক্রটি।
গহীন পাহাড়ে আস্তানা তৈরি করে অবস্থান নেওয়া অপরাধি চক্রের হাতে রয়েছে অসংখ্য ভারী অস্ত্র। তাদের সংখ্যা অনধিক ৫০ হলেও অস্ত্রের সংখ্যা ঢের বেশি। অপহরণ করে তাদেরকে পাহাড়ের বিভিন্ন গুহায় নিরাপদে রাখা হয়।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, মানবপাচারকারি ও সংঘবদ্ধ অপহরণকারি চক্র দলে দলে বিভক্ত হয়ে পুরো টেকনাফ সীমান্ত ও সাগর উপকুলীয় এলাকাজুড়ে লুকিয়ে রয়েছে। দেশ-বিদেশের নানা প্রান্তে রয়েছে তাদের দালাল ও সোর্স। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে তারা কৌশলে লোকজনকে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে পাঠানোর লোভ দেখিয়ে টেকনাফ নিয়ে আসে। টেকনাফের পাহাড়ে রয়েছে এসব পাচারকারি দলের পৃথক পৃথক আস্তানা। বিশেষ করে টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের কচ্ছপিয়া, বড়ডেইল, নোয়াখালী পাড়া, হ্নীলা ইউনিয়নের পাহাড়ের লেদা, টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হাবিরছড়া, রাজুরছড়া, মিঠাপানিরছড়াসহ আরো অনেকগুলো পয়েন্টে রযেছে পাচারকারিদের আস্তানা।
টেকনাফের গহীন পাহাড়ে রয়েছে সংঘবদ্ধ পাচারকারিদের খামারবাড়িও। এসব খামারবাড়ি দেখতে মুরগির খামারের মতই। অনেকগুলোতে মুরগির লালন পালনও করা হয়। বাস্তবে এসব পাচারকারিদের ধরে আনা লোকজনদের আত্মীয়-স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। আবার এসব খামার বাড়ি মায়নামার থেকে আনা ইয়াবার চালান রাখার ডিপোসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকান্ডের ডেরা হিসাবেও ব্যবহৃত হয়।
টেকনাফের লেদার গহীন পাহাড়ে এরকমই একটি খামার বাড়ির ছবি সংবাদকর্মীদের হস্তগত হয়েছে। টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা এলাকার ইয়াবা ডন হিসাবে পরিচিত নুরুল হুদার পুত্র শাহ আজমের খামারটিতে সার্বক্ষনিক পাহারায় থাকে সশস্ত্র রোহিঙ্গারা। পাহাড়ে ইয়াবা কারবারি, মানব পাচারকারি, অপহরণকারি এবং সশস্ত্র ডাকাতদলের এরকম খামারবাড়িসহ মাটির তৈরি গুদাম ঘরও রয়েছে।
কক্সবাজার জেলা পুলিশের গোয়েন্দা তথ্য বলছে, পাহাড়ে রান্না করলে আগুনের ধোঁয়া দেখে তাদের শনাক্ত করা যাবে বলে এসব অপহরণকারীদের খাবার সরবরাহ করছে স্থানীয় বাসিন্দাদের কেউ কেউ। টানা চার/পাঁচ দিন পাহাড়ে থাকলে মোবাইল ফোনে চার্জ থাকার কথা না। তাই তারা ব্যবহার করে পাওয়ার ব্যাংক। এমনকি পাহাড়ের আশেপাশে কে আসছে কে যাচ্ছে, এমন খবরও স্থানীয়রা অপহরণকারীদের মোবাইলে জানিয়ে দিচ্ছে।
এ বিষয়ে টেকনাফ মডেল থানার ওসি মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন বলেন, প্রযুক্তির সহায়তায় অপহৃতদের অবস্থান জানার চেষ্টা করে পুলিশ। আমরা গত জানুয়ারি থেকে মার্চ-২০২৫ পর্যন্ত প্রাইয় দেড়শ জন অপহৃতকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। ২৫টি মামলায় বেশ কয়েকজন অপরাধীকে আটক করা হয়েছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসিম উদ্দিন বলেন, “অপহরণের একাধিক ঘটনার তদন্তে মানব পাচার ও অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার যোগসূত্র মিলেছে। স্থানীয় কিছু ব্যক্তি এই চক্রের সঙ্গে সরাসরি জড়িত।”
এই ভয়ঙ্কর ‘অপহরণ সাম্রাজ্য’ এখন অস্ত্রের গুলির চেয়ে বেশি ভয় সৃষ্টি করছে ভেতরে-ভেতরে। টেকনাফের জনপদে ফিরিয়ে আনতে হলে নিরাপত্তা ও সচেতনতা দুই-ই জরুরি। প্রয়োজন স্থানীয়দের সঙ্গে সমন্বিত নিরাপত্তা কৌশল, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং পাহাড়ভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি গোয়েন্দা তৎপরতা।এমন অভিমত স্থানীয়দের।
পর্যটন, সীমান্ত ব্যবসা-বাণিজ্যসহ নানা কারণে এ উপজেলা গুরুত্বপূর্ণ। তবে ২০১৭ সালে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে পালিয়ে এসে উখিয়া টেকনাফে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে এখানকার স্থানীয়রা এমনিতেই নানা সংকটে পড়েছেন, তার ওপর এখন যুক্ত হয়েছে অপহরণ আতঙ্ক।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র বলছে, গত এক বছরে টেকনাফে অন্তত ২০২ জন অপহরণের শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ স্থানীয় ও বাকিরা রোহিঙ্গা। এর মধ্যে অন্তত ১৫০ জনকে মুক্তিপণ দিয়ে ছাড়া পেতে হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন অভিযানে অনেকে উদ্ধার হলেও, আবার অনেকে ফিরেছেন মুক্তিপণ দিয়ে। মাঝেমধ্যে অপহৃত ব্যক্তির মৃতদেহ মিলেছে পাহাড়, বন-জঙ্গল, ডোবা-নালায়। এমন প্রেক্ষাপটে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে সেনা অভিযান চালানোর দাবি করছেন স্থানীয় বাসিন্দাসহ সচেতন নাগরিক।