দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছরেও নিরসন হয়নি শেরপুর গারো পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের সঙ্গে বন্যহাতির দ্বন্দ্ব। গড়ে উঠেনি বন্যহাতির নিরাপদ চলাচলের অভয়ারণ্য! ফলে পাহাড়ি গ্রামবাসীরা বিগত ৩০ বছর ধরে জানমাল রক্ষায় রয়েছেন চরম বিপাকে এবং আতঙ্কে। মাঝে মধ্যেই হাতির পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা যাচ্ছে মানুষ। সেইসাথে মারা পড়ছে বন্যহাতিও। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সীমান্তাঞ্চলবাসীর ঘরবাড়ি ও আবাদি ফসল। পাহাড়ি মানুষ আর হাতির দ্বন্দ্ব নিরসনে প্রয়োজনীয় স্থায়ী পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন।
জানা গেছে, বিগত ৩০ বছর ধরে শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার প্রায় ৪০ কিলোমিটার পাহাড়ি অঞ্চলজুড়ে ৫০টি গ্রামে শুরু হয় বন্যহাতির তাণ্ডব। পাহাড়ি গ্রামগুলোয় মুসলিম, গারো, হাজং, কোচ, বানাই বর্মন ও হিন্দুসহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের প্রায় লক্ষাধিক লোকের বসবাস। এদের বেশির ভাগই শ্রমজীবী ও কৃষির উপর নির্ভরশীল। গত ৩০ ধরে উপুর্যুপরি হাতির তাণ্ডবে পাহাড়িদের ঘরবাড়ি, গাছপালা, সবজি বাগান, খেতের ফসল ও জানমালের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে আসছে। ভুক্তভোগীরা জানান, প্রায় দেড় শতাধিক হাতির পাল দিনে গভীর অরণ্যে থাকে। সন্ধ্যা নেমে আসলেই খাদ্যের সন্ধানে নেমে আসে লোকালয় ও ফসলি জমিতে। কৃষকরা খেতের ফসল ও জানমাল রক্ষার্থে রাত জেগে পাহারা দিচ্ছেন। ঢাকঢোল পিটিয়ে, পটকা ফুটিয়ে মশাল জ্বালিয়ে হাতি তাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু যতই হাতি তাড়ানোর চেষ্টা হচ্ছে ততই হাতির পাল পালাক্রমে তাণ্ডব চালাচ্ছে বাড়িঘরে। দমনই যাচ্ছে না। প্রতিরোধ গড়ে তুলেও রক্ষা করা যাচ্ছে না ঘরবাড়ি ও খেতের ফসল। বিগত ৩০ বছর ধরে চরম আতঙ্কে নির্ঘুম রাত কাটছে পাহাড়ি মানুষের। গ্রামবাসীরা জানান, হাতির জন্য গারো পাহাড়ে পর্যাপ্ত খাবার না থাকায়, ক্ষুধা নিবারণে মাঝে মধ্যেই লোকালয়ে হামলা করছে। হাতির তাণ্ডবে অতিষ্ঠ গ্রামবাসীর ঘরে খাবার না থাকলেও রাতে হাতি তাড়াতে মশাল জ্বালাতে কেরোসিন ঘরে রাখা যেন বাধ্যতামূলক।
পাহাড়ি অঞ্চলে আবাদকৃত ধান পাকার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামগুলোয় হাতির তাণ্ডব বৃদ্ধি পায়। তাণ্ডবে খেতের ফসল ঘরে তুলতে পারে না কৃষকরা। কৃষি বিভাগ জানায়, হাতির তাণ্ডবে পাহাড়ি গ্রামগুলোতে শতশত একর আবাদি জমি পতিত পড়ে রয়েছে। ফলে চরম বিপাকে রয়েছেন কৃষকরা। বন্যহাতির পায়ে পিষ্ট মানুষের মৃত্যু ও ফসলের ক্ষতিপূরণ দেয়া হচ্ছে বনবিভাগ থেকে। পোড়াগাঁও ইউনিয়নের বুরুঙ্গা কালাপানি গ্রামের বাসিন্দা উকিল উদ্দিন, এরশাদ আলম ও বাদশা মিয়াসহ কৃষকরা জানান, ফসলের ক্ষতিপূরণের টাকা পেতে ভীষণ ঝামেলা পোহাতে হয়। পাহাড়ি অঞ্চলের বেশির ভাগ জমি ‘খ’ তফসিলভুক্ত। যা শত্রু সম্পত্তি ছিল। ক্ষতিগ্রস্ত জমি রেকর্ডীয় না হলে ক্ষতিপূরণও দেয়া হয় না। এসব ঝামেলা পোহাতে চান না কৃষকরা। আবার কেউ কেউ আবেদন করে বছরের পর বছর ঘুরছেন। এমন অভিযোগও অনেক কৃষকের। এছাড়া এলটমেন্ট ও সরকারি খাস জমির পরিমাণই বেশি। ফলে কাগজপত্রের জটিলতায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের ভাগ্যে জুটছে না ক্ষতিপূরণ।
অপরদিকে, বনবিভাগের পক্ষ থেকে গারো পাহাড়ে মানুষ-হাতির দ্বন্দ্ব নিরসনে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২৫ টি ইআরটি (এলিফেন্ট রেসপন্স টিম) গঠন করা হয়েছে। প্রতি কমিটিতে ১০ জন করে সদস্য। তারা জনসচেতনা বৃদ্ধিতে মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনে কাজ করছেন। সরকারি সুযোগ সুবিধা না থাকায় ঝিমিয়ে পড়েছে কমিটির কার্যক্রম। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বনভূমিতে ফসল উৎপাদন ও সীমান্তে কাটা তারের বেড়া নির্মাণে বন্যহাতির পাল ভারতে প্রবেশ করতে পারছে না। ফলে শেরপুর সীমান্তে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের স্বল্প বনভূমিতে চলাচলও ক্ষুধা নিবারণে পর্যাপ্ত খাবারও পাচ্ছে না। বাধ্য হয়েই খাবারের সন্ধানে পাহাড়ি অঞ্চলের ধানখেতে হাতির পাল হানা দেয়। কৃষকরাও ফসল রক্ষার্থে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তখনই শুরু হয় হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্ব নিরসনে বনে কাঁটাযুক্ত বেত বাগান সৃজন প্রকল্প ও সোলার ফ্যান্সিং প্রকল্প হাতে নিলেও কোনো কাজেই আসেনি।
ভুক্তভোগীরা জানান, বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র ও বনবিভাগের পদস্থ কর্মকর্তাদের যৌথ সভায় বন্যহাতির দ্বন্দ্ব নিরসনে সিদ্ধান্ত নিলে তা ফলপ্রসূ হতে পারে। গারো পাহাড়ে বন বিভাগের ২০ হাজার একর বনভূমি থাকলেও বিপুল পরিমাণের বনের জমি বেদখল ও প্রাকৃতিক বন না থাকায় বন্যহাতির আবাসস্থল সংকুচিত, পাশাপাশি খাদ্য সংকটে রয়েছে বন্যহাতি। বনবিভাগ জানায়, গারো পাহাড়ের গহীন অরণ্যে ১২০-১৩০টি বন্যহাতি অবস্থান করছে। খাদ্য ভাণ্ডার না থাকায় খাদ্য সংকটে রয়েছে হাতির পাল। হাতির তাণ্ডব শুরুর পর থেকেই গ্রামবাসীরা তাদের জানমাল রক্ষার্থে হাতির খাদ্য ভাণ্ডার গড়ে তোলার পাশাপাশি গ্রামবাসীদের নিরাপত্তায় সোলার ফ্যান্সিং স্থাপনের দাবি জানান। কিন্তু ৩০ বছরেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। শেরপুর জেলা বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ জানায়, ময়মনসিংহের গারো পাহাড়ে ২০১৪ সালের পর মানুষ-হাতি দ্বন্দ্বে ৪২ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অনেকই। একই সময়ে মারা পড়েছে ৩৩টি বন্যহাতি।
মানুষ-বন্যহাতির দ্বন্দ্বে মানুষ ও হাতি হতাহতের ঘটনা ঘটে। মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনে বনবিভাগ গারো পাহাড়ে ২৫ টি ইআরটি এলিফেন্ট গঠন করেছে। ২০১৬ সালে নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলার হাতি কবলিত গ্রামগুলোতে স্থাপন করা হয় সোলার ফ্যান্সিং (বৈদ্যুতিক তারের বেড়া)। যা দিয়ে হাতি আক্রান্ত হবে, কিন্তু মারা যাবে না। ১৩ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে সোলার ফ্যান্সিং স্থাপন করা হয়। এতে সরকারের ব্যয় হয় কয়েক কোটি টাকা যা ভেস্তে গেছে। বনবিভাগের বন্যপ্রাণী অধিদপ্তরে তদারকিতে এই কাজ সম্পন্ন করার কথা। ঝিনাইগাতীর গুরুচরণ দুধনই গ্রামে ৪.৫ কিলোমিটার, ছোটগজনীতে ৩ কিলোমিটার, বড়গজনী-হালচাটিতে ৩.৫ কিলোমিটার এবং নালিতাবাড়ীর রামচন্দ্রকুড়ার মায়াঘাসিতে ২ কিলোমিটারজুড়ে স্থাপন করা হয় সোলার ফ্যান্সিং। কিন্তু ঠিকাদার নিম্নমানের কাজ করায় ও অযত্ন অবহেলায় নির্মাণ কাজ শেষ হতে না হতেই তা অকেজো হয়ে পড়ে।
ফলে এই কার্যক্রমও কোনো কাজেই আসেনি। শেরপুর জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, গারো পাহাড়ে মানুষকে যেমন থাকতে হবে, বাঁচতে হবে। বন্যহাতিরও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব কমানোর পরিকল্পনা আছে। তিনি বলেন, ইআরটি টিমগুলোকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। বনাঞ্চলের আশপাশের সরকারি খাস খতিয়ানের/বনবিভাগের জমিও রয়েছে। সে কারণে বসবাসকারীদের ক্ষতিপূরণ পেতে নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। হাতির তাণ্ডবে আবাদ ফসল, ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিপূরণের বিষয়টি কিভাবে সহজীকরণ করা যায়, তার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। ময়মনসিংহ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আ ন ম আব্দুল ওয়াদুদ ইনকিলাবকে বলেন, বন্যহাতির আক্রমণে নিহত, আহত ও আবাদ-ফসল, ঘরবাড়ির ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৯৬ লাখ ৯২ হাজার ২শ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। ক্ষতিপূরণের পরিমাণ বৃদ্ধি ও সহজীকরণের প্রস্তাব প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। শেরপুর সীমান্তে মানুষ-হাতি দ্বন্দ্ব নিরসনে অভয়ারণ্যের বিষয়ে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়েছে।
বনবিভাগের ২২ হাজার হেক্টর জমি ছাড়াও বনাঞ্চলে হাতি চলাচলের পথে প্রায় দেড় হাজার হেক্টর খাস খতিয়ানের এবং প্রায় দুই হাজার হেক্টর ব্যক্তি মালিকানাধীন জমি রয়েছে। সেইসব ভূমি অধিগ্রহণে অনেক খরচ। ফলে হাতির অভয়ারণ্য সৃজন করা সম্ভব হয়নি। তবে পরিকল্পনাটি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।