কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলসহ পুরো জেলায় শুরু হয়েছে বোরো ধানকাটা মহাউৎসব। হাওরের পাড়ে পাড়ে কৃষক যুথবদ্ধ কর্মচাঞ্চল্যে সরব ও মুখরিত হয়ে উঠেছে প্রতিটি জনপদ। এ যেন এক অন্যরকম উৎসব। নতুন ধানের গন্ধে মাতোয়ারা চারপাশ। দল বেঁধে ধান কাটছেন দাওয়ালো হিসেবে পরিচিত হাজার হাজার কৃষি শ্রমিক।
প্রখর রোদে কপাল বেয়ে পড়ছে ঘাম। তবুও যেন খুশির শেষ নেই। অন্যদিকে হাওরের পাড়ে বা
বাড়ির সামনে বিশাল চত্বরে ধান মাড়াই, ধান শুকানো ও শুকনো ধান ঝেড়ে গোলায় তোলার
নান্দনিক আয়োজন পুরো কিশোরগঞ্জের হাওর জনপদে তৈরি করেছে উৎসবের সমারোহ। এ
আয়োজন অন্য যে কোনো বছরের তুলনায় এবার একটু বেশিই মনে হচ্ছে। আবহাওয়া
ভালো থাকায় এবার ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।
এসব অঞ্চলে এমন কৃষকও আছেন যাদের উৎপাদিত ফসলের পরিমাণ তিন থেকে চার হাজার
মণও ছাড়িয়ে যায়। সব ধান সংরক্ষণ করার মতো ব্যবস্থা না থাকায় অনেকে পরিবারের বাৎসরিক খোরাকি রেখে বাকি ধান মাড়াইস্থলেই বিক্রি করে দেন। এ সময় দূর-দূরান্তের মহাজন ও চাতাল মালিকেরা ধান কেনার জন্য হাওরাঞ্চলে ভিড় জমান। বোরো ফসলকে কেন্দ্র করে প্রতি বছরই কৃষকদের মধ্যে আনন্দ-উদ্দীপনার অদ্ভুত শিহরণ জেগে ওঠে। বোরো মৌসুমে জিরাতির সমাগমও বেড়ে যায়। যারা কৃষকের জমি টাকার বিনিময়ে পত্তন নিয়ে চাষ করেন তাদেরকে বলা হয় জিরাতি। এই জিরাতিরা আসেন দূর-দূরান্ত থেকে।
তারা ফসল কাটার মৌসুমে জমির পাশে ছোট ছোট অস্থায়ী ঘর তুলে সেখানে রাত্রিযাপন করেন। সঙ্গে নিয়ে আসেন প্রয়োজনীয় সংখ্যক কৃষি শ্রমিক। এই সকল জিরাতি ও কৃষি শ্রমিকেরাও এ মৌসুমে প্রচুর ধান পেয়ে থাকেন। এছাড়া এই মৌসুমী ধানের বিনিময়ে কৃষকের জমিতে ধান কাটার জন্য সুদূর ময়মনসিংহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, গাইবান্ধা, রংপুরসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে দরিদ্র কৃষি শ্রমিকেরা কিশোরগঞ্জের হাওরের বিভিন্ন উপজেলায় এসে অস্থায়ী ডেরা তুলে বসবাস করেন। মৌসুমের শেষে ধান কাটার পারিশ্রমিক হিসেবে এরাও পেয়ে থাকেন প্রচুর পরিমাণ ধান। প্রতি বছর বৈশাখ এলেই কৃষকদের মধ্যে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের আশঙ্কা কাজ করে। ঘরে ফসল না তোলা অবধি তারা আশঙ্কামুক্ত হতে পারেন না। এবারও কৃষকেরা সে আশঙ্কার বাইরে ছিলেন না। তবে এ বছর প্রকৃতি কৃষকদের প্রতি বিরূপ ছিল না।
আশঙ্কা থাকলেও এখন পর্যন্ত কিশোরগঞ্জের কোথাও বড় ধরনের ঝড়-ঝাপটা, অকাল বন্যা
কিংবা শিলাবৃষ্টি হয়নি। ফলে বিশাল-বিস্তীর্ণ হাওরের বোরো জমিতে এবার যেন প্রকৃতিমাতা দু’হাত উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন কৃষকের বহু প্রত্যাশিত সোনালী ফসল। যেদিকেই চোখ যায় সোনা রঙ ধানের উজ্জ্বল ঝিলিক দৃষ্টির সীমানায় ঝলমলে আলো ছড়িয়ে দেয়। সকল প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে ফসল রক্ষা পাওয়ায় কৃষকের মুখে ফুটে উঠেছে তৃপ্তির হাসি।
অনেক জমিতে দেখা যায় দিনমজুরেরা কাস্তে হাতে ধান কাটছেন, অনেকে আবার ধান কাটার কাজ সারছেন হারভেস্টার মেশিনের সাহায্যে। এবারের মৌসুমে সারা দেশের ন্যায় কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকাতেও তীব্র তাপপ্রবাহ। এই তাপপ্রবাহ জনজীবনে অস্বস্তি তৈরি করলেও বোরো চাষীদের ভাগ্যে নিয়ে আসে প্রকৃতির আশীর্বাদ। রৌদ্র আর গরমের প্রখরতায় এ বছর মাঠের ধান পরিপুষ্ট হওয়ার যেমন সুযোগ পেয়েছে তেমনি মৌসুমের শুরুতেই জমির ফসল পেকে গিয়েছে। ফলে এ বছর কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ, ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, বাজিতপুর, নিকলী, তাড়াইলের হাওরে বোরোর বাম্পার ফলন
হয়েছে।
কিশোরগঞ্জের দিগন্ত বিস্তৃত হাওরাঞ্চলে এখন যেদিকেই তাকানো যায়, সেদিকেই পাকা ধানের সোনালী রঙের ঝিলিক। বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে এবার। আবহাওয়া বৈরী না হলে চলতি মৌসুমে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাবে, আশা কৃষি বিভাগের। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, শিলাবৃষ্টি এবং আগাম বন্যার শঙ্কায় ৮০ শতাংশ পাকলেই কাটতে হবে ধান। কৃষি বিভাগের এমন পরামর্শে প্রখর রোদের তাপ উপেক্ষা করেই বোরো ধান কাটায় ব্যস্ত কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলের কৃষকেরা।
ইতিমধ্যে কিশোরগঞ্জের হাওরাঞ্চলের ৫০ শতাংশ ধান কাটা ভালোভাবে সম্পন্ন হয়েছে। যদিও মাঝে মাঝে আবহাওয়ার জরুরি বার্তায় বলা হচ্ছে, ভারী বৃষ্টিপাত দমকা হাওয়া বইতে পারে। এতে জেলার নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি এবং ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারী বৃষ্টিপাতের ফলে নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এ জন্য হাওরের জমিতে ৮০ ভাগ ধান পাকলেই দ্রুত কাটতে কৃষকদের অনুরোধ জানায় জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন, আবহাওয়া প্রশাসন ও কৃষি দপ্তর। গত কয়েক দিনের রোদের ঝিলিকে কৃষকের মুখে হাসি আর হাসি দেখা যাচ্ছে।
কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, বাজিতপুর, নিকলীর বৃহৎ হাওরগুলো সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, মাঠে মাঠে সোনার ধানের শীষ বাতাসে দুলছে। আধা পাকা বোরো ধানের ম-ম গন্ধে মাতোয়ারা কিষান-কিষানি। চৈত্রের শেষদিকে কিছু জমির আগাম জাতের ধান কাটা শুরু হলেও পহেলা বৈশাখ আনুষ্ঠানিকভাবে ধান কাটা শুরু হয়। এরই মধ্যে আবহাওয়ার পূর্বাভাসে ফসল ঘরে তোলা নিয়ে উৎকণ্ঠা দেখা দেয় হাওরবাসীর মধ্যে। তবে গত কয়েক দিনের রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ায় কৃষকরা ধান কাটা ও মাড়াইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। হাওরের অধিকাংশ এলাকা এখনও শুকনো। হাওরের নদ-নদী ও খাল-বিলে এখনও পানি আসেনি। এতে খানিকটা কৃষকদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তির হাসির ঝিলিক
লক্ষ্য করা গেছে।
মিঠামইন হাওরের নবাবপুর গ্রামের কৃষক মোয়াজ্জেম হোসেন, শাহাব উদ্দিন ও শংকর দাশ বলেন, প্রথমে ফসল ঘরে তোলা নিয়ে শঙ্কা দেখা দিলেও এখন আর সেই শঙ্কা নেই। আবহাওয়া আমাদের অনুকূলে থাকায় ভয় কেটে গেছে।ঘাগড়া গ্রামের আরেক কৃষক আব্দুল মোতালিব বলেন, হাওরজুড়ে ধান কাটার ধুম পড়েছে। বৈশাখে ঝড়-বৃষ্টি হবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে এবার উপজেলার হাওর, নদ-নদী, খাল এখনও অনেকটা শুকনো। এতে ফসল হারানোর শঙ্কা অনেকটাই কেটে গেছে। শান্তিপুর গ্রামের কৃষক জামাল, ইসলামপুর গ্রামের কৃষক এমরান, বড়হাটি গ্রামের কৃষক অমল দাশ ও বীরেন্দ্র দাশ বলেন, এবার ফলন ভালো হয়েছে। তবে ধান কাটার মৌসুমি কৃষি শ্রমিকের সংকট রয়েছে এলাকায়। তাই পরিবারে লোকজন ও এলাকার শ্রমিকদের নিয়ে ধান কাটছি। ধানের ন্যায্য মূল্য পেলে আমরা লাভবান হবো। জমি আবাদ করতে গিয়ে ঋণ করতে হয়েছে। তবে ভালোয় ভালোয় ধান তুলতে পারলে সব ঋণ শোধ করা যাবে।
কিশোরগঞ্জের হাওরে এবার বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। বিগত কয়েক বছরের তুলনায় এবার হেক্টরপ্রতি অন্তত ১০ মণ ধান বেশি হচ্ছে বলে ধারণা কৃষি বিভাগের। জেলার সব হাওরের চিত্র একই। এবার ধানে কোনো চিটা হয়নি। এখন পুরোদমে ধান কাটা চলছে। ক্ষেতের ৮০ ভাগ ধান পাকা হয়ে গেলে কেটে ফেলার পরামর্শ কৃষি বিভাগের। কৃষি দপ্তরের পরামর্শের পর ধান কাটায় গতি এসেছে। এই অবস্থায় যেদিকে চোখ যায় ক্ষেতগুলোতে কেবল সোনালি ধানের শিষ দোল খাওয়ার দৃশ্য। কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবার জেলায় বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১ লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে। এর মধ্যে হাওরে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১ লাখ ৪ হাজার ৪৩০ হেক্টর। ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১১ লাখ ৮৩ হাজার ৩৬৮ টন। যার আনুমানিক বাজারমূল্য চার হাজার কোটি টাকা। চালের লক্ষ্যমাত্রা ৭ লাখ ৮৮ হাজার ৯১২ টন।
এদিকে বৃহস্পতিবার (২৪ এপ্রিল) দুপুরে কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলার এলএসডি খাদ্য গোদাম প্রাঙ্গণে জেলা প্রশাসন ও খাদ্য বিভাগ, কিশোরগঞ্জে অভ্যন্তরীণ বোরো ধান সংগ্রহ কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করে গেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের খাদ্য সচিব মো. মাসুদুল হাসান। কিশোরগঞ্জে অভ্যন্তরীণ বোরো ধান সংগ্রহ কার্যক্রম উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় খাদ্য সচিব মো. মাসুদুল হাসান বলেছেন, কৃষক যাতে ন্যায্য মূল্য পায় সেদিক বিবেচনা করে সরকার ধান ও চালের মূল্য নির্ধারণ করে দিয়েছে। কৃষকের নিরলস শ্রমে এবার হাওরসহ সারা দেশে বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।
কৃষকরা বাংলাদেশের প্রাণ। তাই কৃষকদের অবদান আমাদের স্মরণ রাখতে হবে সবসময়। সরকারও কৃষক ভাইদের নানাভাবে সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। এই সৌহার্দ্য অব্যাহত থাকলে অচিরেই আমাদের দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হবে। অতীতে নানা কারণে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হতো না। এবার যে কোনো মূল্যে ধান চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করবে সরকার। কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) উপ-পরিচালক ড. মো. সাদিকুর রহমান ইনকিলাব বলেন, “ভালো ফলনের খুশি ধরে রাখার জন্য দরকার জমির ধান ৮০ ভাগ পাকা মাত্র কেটে ফেলা।” কৃষকদের প্রতি এ আহ্বান জানান।
কারণ, ঝড় কিংবা শিলাবৃষ্টি হাওরের পাকা নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই যায়। খাদ্যে উদ্বৃত্ত কিশোরগঞ্জ
জেলায় চলতি বছর ১ লাখ ৬৮ হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে।
উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১১ লাখ ৮৮ হাজার ২১০ টন। আবাদ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। ফলন
ভালো হওয়ায় উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করবে। শ্রমিক সংকট কাটাতে হাওরে ২২০টি
কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিন ধান কাটার কাজ করছে। এছাড়া প্রতিদিনই বাহিরের জেলা থেকে হারভেস্টার মেশিন আসছে।