নদী বাঁচলে দেশ বাঁচবে
১৯ মার্চ ২০২৩, ০৮:৩৪ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৯:৩৬ এএম
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। সমাজ গঠনে নদীর ভূমিকা প্রাচীনকাল থেকেই প্রাধান্য পেয়ে আসছে। নদী মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। নদ-নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছে মানবসভ্যতার ইতিহাস। দেশের কৃষিকাজ, পানি বিদ্যুৎ, পানি সেচ ব্যবস্থা পানিপথ পরিবহন, পানীয় জলের জোগান, মৎস্য উৎপাদন, শহর ও শিল্পকেন্দ্রের প্রয়োজনীয় পানি সরবারহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে দেশবাসীর জীবনে নদ-নদীর প্রভাব খুবই বেশি। নদ-নদীগুলো যেন মায়ের হাতে সন্তানস্নেহে লালন-পালন করে চলছে আমাদের। দেশের অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপে নদ-নদীর গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীর সকল নদীই বিশ্বমানবতার পথিকৃৎ। বিন্দু বিন্দু পানিরাশির অববাহিকায় উৎসস্থল পাহাড়ের অভ্যন্তর থেকে ছড়া, নদ-নদী, মহানদী, সমুদ্র, পানিপ্রবাহ ও মহাসাগরের সৃষ্টি। নদী ছড়া উপত্যকার নামেই গ্রাম-শহরের পরিচিত। নদীর সাথে মানুষের আত্মীয়তার বন্ধন চিরকাল। নদী তার জীবন উৎসর্গ করেছে মানুষের কল্যাণে। নদী ইতিহাস রচনা করে। নদীর পানি সর্বধর্ম সর্বজাতির কাছে পবিত্র। নদী নিয়ে কত কথা, রূপকথা, কত গল্প, কবিতা আর গান রচিত হয়েছে। নদীর পাদদেশে গড়ে উঠেছে শহর, বন্দর, নগর, হাটবাজার, শিল্পকারখানা প্রভৃতি।
আমাদের বুড়িগঙ্গা। একদিন এই নদী ছিল ঢাকার প্রাণ। কিন্তু আজ? আজ বুড়িগঙ্গা শীর্ণ এক নদী। বুড়িগঙ্গায় এখন স্বচ্ছ পানি পাওয়া বিরল। নদীর অধিকাংশ জুড়ে আছে কালো, নীলাভ ও দুর্গন্ধযুক্ত পানি, যা জীবাণুযুক্ত এবং স্বাস্থ্যের জন্য, পরিবেশের জন্য খুবই ক্ষতিকর। এই পানি ঢাকা নগরীর কলকারখানার বর্জ্য ও প্রতিদিনকার বিপুল পরিমাণ মল ও আবর্জনামিশ্রিত। এই পানিতে গোসল, কাপড়কাচা, বাসন মাজা আর রান্না-বান্নাসহ দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার পর্যন্ত সবকিছুই হচ্ছে। নদীর তীরে গড়ে উঠেছে জাহাজ নির্মাণ কারখানা।
খাল দিয়ে রাজধানীর যাবতীয় ময়লা পানি গিয়ে পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। খাল যে জায়গায় বুড়িগঙ্গায় মিশেছে সেখানে গেলেই চোখে পড়বে এক নরকীয় দৃশ্য। এখানে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে পানি দুর্গন্ধ। পানিতে ভাসছে পশু-পাখির নাড়ি-ভূড়ি। ভাসছে অসংখ্য পলিথিন ব্যাগ। এলাকার পানিতে সারাক্ষণ বুদবুদ উঠতে দেখা যায়। বুড়িগঙ্গার এক নৌকার মাঝি আহাদ মিয়া জানালেন, এখানে প্রায়ই মাছ মরে ভেসে ওঠে।
বুড়িগঙ্গা দিয়ে লঞ্চ ও স্টিমার আসা-যাওয়া করে। এসব নৌযান থেকে তেল অনবরত মিশছে নদীতে। এছাড়া চলছে ইঞ্জিনচালিত নৌকা। পানির উপর তেলের বিশাল আস্তরণ মাঝে মাঝে খুব স্পষ্টতই দেখা যায়। বুড়িগঙ্গার ডানদিকে অবস্থিত ডকইয়ার্ডে বিভিন্ন ধরনের যাত্রী ও মালবাহী জাহাজ নির্মাণ ও ভাঙ্গা হচ্ছে। ডকইয়ার্ডের যাবতীয় আবর্জনা ও বর্জ্য পদার্থ পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। সবকিছু মিলিয়ে বুড়িগঙ্গা দূষিত ও বিষাক্ত হয়ে পড়ছে প্রতিনিয়ত। পাগলায় অবস্থিত আবর্জনা ও বর্জ্য পদার্থ পড়ছে বুড়িগঙ্গায়। সবকিছু মিলিয়ে বুড়িগঙ্গা দূষিত ও বিষাক্ত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ইসলামবাগ, চাঁদনীঘাট, কামরাঙ্গীরচর, মান্দাইল, বড়িশুরসহ নদীর উভয়তীরের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় উন্মুক্ত পায়খানা রয়েছে নদীর উপর। ফলে এই নদীর পানি ব্যবহার মোটেই নিরাপদ নয়।
ঢাকার হাজারীবাগ এলাকায় ছোটবড় শত শত ট্যানারি রয়েছে। এর মধ্যে সামান্য সংখ্যক সরকার কর্তৃক অনুমোদিত। এসব ট্যানারির পরিত্যক্ত বর্জ্য পদার্থ ড্রেন দিয়ে বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। ট্যানারি শিল্পে ‘ক্রোসমল’ জাতীয় এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহৃত হয়। প্রতিদিন একটি কারখানা ১০/১৫ টন ক্রোমসল ব্যবহার করে। একটি ট্যানরির হাজার হাজার গ্যালন ‘ডাস্ট ওয়াটার’ প্রতিদিন পড়ছে সোজা বুড়িগঙ্গায়। ফলে নদীর পানিতে ক্রোমিয়ামের মাত্রা বেড়ে গিয়েছে। এছাড়া ট্যানারির বর্জ্যে ক্ষতিকর আর্সেনিকও রয়েছে। প্রতিদিন ট্যানারির হাজার হাজার গ্যালন বর্জ্য পানি বুড়িগঙ্গায় পড়ার ফলে নদী বিষাক্ত হচ্ছে। ভরাট হয়ে যাচ্ছে নদীর তলদেশ পলি পড়ে। ক্ষতিকর ক্রোমিয়াম ও আর্সেনিক পলির সঙ্গে জমা হচ্ছে। ফলে শুধু পানিই বিষাক্ত হচ্ছে না ইতোমধ্যে মাছও নিঃশেষ হয়ে গেছে। চিকিৎসকদের অভিমত, শরীরে ক্রোমিয়ামের মাত্রা অধিক হলে ক্যান্সার হতে পারে। অথচ, হাজারীবাগ এলাকায় গেলেই দেখা যাবে. ড্রেনগুলো দিয়ে ¯্রােতধারায় হালকা সবুজ ও নীল রঙের ট্যানারির বর্জ্য পানি বুড়িগঙ্গায় যাচ্ছে। এর সবটাই ক্রোমিয়ামযুক্ত পানি। বুড়িগঙ্গার তীরে রয়েছে মিডফোর্ড হাসপাতাল। এই হাসপাতালের জীবাণুযুক্ত যাবতীয় পানি ও বর্জ্য ড্রেন দিয়ে বুড়িগঙ্গায় পড়ছে। তাছাড়া হাসপাতালের রোগীদের ব্যবহৃত পোশাক, বিছানার চাদর ও যাবতীয় লিনেন বুড়িগঙ্গায় ধোয়া হচ্ছে। ফলে নানান জটিল রোগের জীবাণু মিশছে বুড়িগঙ্গার পানিতে। এখানে মধ্যবিত্ত, নি¤œবিত্ত, বিত্তহীনদের গোসল করতে দেখা যায়। প্রতিদিন এখানে হাজার হাজার নারী-পুরুষ গোসল করে। কাপড় কাচা থেকে হাঁড়ি-কুঁড়ি ধোয়া-মাজা পর্যন্ত। কেন ট্যাপে পানি থাকা সত্ত্বেও নদীর পানি ব্যবহার করেন এ সম্পর্কে গোসলকারীদের মতামত নেয়া হলে জানায়, প্রয়োজনীয় পানির খুব অভাব। স্থানীয় সব হোটেলে মিউনিসিপ্যালিটির পানি সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলেও হাতমুখ ধোয়ার জন্য বুড়িগঙ্গার পানি ব্যবহার করা হয়। একজন পরিবেশ বিজ্ঞানী বলেন, বুড়িগঙ্গা ক্রমাগত দূষিত হয়ে পড়ছে। অথচ, বুড়িগঙ্গার দূষণ নিয়ন্ত্রণের যেমন উদ্যোগ নেই, তেমনি দূষণ কী হারে বাড়ছে তারও পর্যবেক্ষণ নেই। শুকনো মৌসুমে বুড়িগঙ্গার পানি ব্যবহার খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে বলে বিশেষজ্ঞরা মতামত ব্যক্ত করেছেন।
নদীকে দূষণমুক্ত রাখা নাগরিক জীবনের সাংবিধানিক মৌলিক কর্তব্য। চিরকাল ধরেই নদীর তীরে মৎস্যজীবীদের বসবাস। দৈনন্দিন নদীতে মাছ শিকার তাদের প্রধান জীবিকা। ইতিহাসের পাতায় মিশরকে নীল নদের দান বলা হয়। সিন্ধু নদের তীরে গড়ে উঠেছে সিন্ধু সভ্যতা। ধরণীর বুকে নদী চিরকাল বয়ে যাবে আপন ধারায়। নদীর প্রতি মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস গড়ে উঠেছে প্রাচীনকাল থেকে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য হ্রাসের ফলে নদী দিন-দিন হারিয়ে ফেলছে তার নাব্য। নির্বিচারে বন ধ্বংসের কারণে পাহাড়ের মাটি আগের মতো বৃষ্টির পানি ধরে রাখতে না-পারায় থাকে না মাটি ছোঁয়া পানি। ফলে শুকনো মৌসুমে নদী, ছড়াতে থাকে না পানি। পার্বত্য অঞ্চলের নদীগুলো খরার প্রকোপে পানিহীনতায় ভুগছে। বন ধ্বংসের ফলে নদী ও ছড়া পানি ধারণ ক্ষমতা হারিয়েছে। নদীর পানি ভাসিয়ে আনে বাঁশ, পাহাড়ে উৎপাদিত জুমের ফসল। নদীতে মাছ ধরে মৎস্যজীবীরা তাদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। নদীপথে নৌকায় গ্রাম্য জীবনের মানুষ যাতায়াত করে। ভূগর্ভে পানির স্তর নিম্নমুখী, তাই মানুষের পানির চাহিদা পূরণ করতে প্রযুক্তি অবলম্বন করে নদীর প্রাকৃতিক পানিকে ব্যবহার করছে। উপজাতীয় অঞ্চলে ছড়ার পানি একমাত্র পানীয়। নদীর ছড়ায় বাঁধ দিয়ে সেচ প্রকল্প গড়ে উঠেছে। প্রায় নদীতে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্টের মাধ্যমে পানিশোধানাগারে নদীর পানি পরিশোধন করে লক্ষ মানুষের পানীয়জলের জোগান দিচ্ছে। বায়ু পানি বৃষ্টি ব্যতীত জীবপ্রাণ ধ্বংস। পানি মন্ডলের মহাসমুদ্রের চেয়ে নদীর গুরুত্ব মানুষের কাছে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ। নদী, ছড়ার পানি পান করে বন্যরাও বেঁচে আছে। পাহাড় হতেই নদী ছড়ার সৃষ্টি। নদী পরিবেশের বিশেষ অঙ্গ, মানুষের কাছে নদীর গুরুত্ব তাই অপরিসীম। নদী দূষণ সম্পর্কে মানুষের অবচেতনার ফলে নদী বা ছড়ার বালুচরে খোলা আকাশের নিচে মুক্ত পায়খানা, নদীতে ভাসমান মৃত গবাদি পশুর দেহ মাটিতে পুঁতে না-দিয়ে নদীর পানি ফেলে দেওয়ার রীতি রয়েছে। সম্প্রতি পরিবেশ বিষয়ক সচেতনতা বুদ্ধির সুবাদে নদীতে মুক্ত পায়খানা করার কুঅভ্যাস অনেকাংশে কমে গেছে। নদী ও ছড়া নাগরিক জীবনের সম্পদ হিসেবে প্রদান করছে মুক্ত পানি, বিদ্যুৎ, সেচ, নদীর বালু-পাথর, মৎস্যজাতীয় সুষম খাদ্য। নদীর চরে সবুজ ফসল, শাকসবজি। নদীর খরস্রোতে ভেসে আসছে জ্বালানি কাঠ, মানুষ তা সানন্দে সংগ্রহ করছে।
আগেকার শীতের মরশুমে পাহাড়িরা নদীতে মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে প্রাকৃতিক বিষ প্রয়োগ করত। এক জাতীয় বিষাক্ত লতার রস নদীর পানিতে মিশিয়ে দিত। এতে কিছু সময়ের জন্য মাছের চোখ অন্ধকার হয়ে যেত। শত শত মানুষ আনন্দে উল্লাসে নদীতে মাছ ধরার জন্য দল বেঁধে নেমে পড়ত। এখানো নদী ও ছড়ার পানিতে বিষ মিশিয়ে মাছ ধরার কান্ড ঘটতে দেখা যায়। যার ফলে নদীর কোলে প্রকৃতিতে উৎপন্ন ছোটো বড়ো মাছ, কাঁকড়া, ঝিনুক, শামুক, কচ্ছপ, ব্যাঙ প্রভৃতি জলজ প্রাণী বংশানুক্রমে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এতে মৎস্যজীবীরা সমূলে বিপন্ন হচ্ছে। ঔষধিসম্পন্ন বহু মাছ আজকাল নদীতে দু®প্রাপ্য। নদীতে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া থাকে, যা নদীকে দূষণমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। নদীতে বিষ প্রয়োগের চরম প্রবণতায় পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী জীবাণুরা বিলুপ্ত হতে চলেছে। রাসায়নিক বিষ কৃষকের জমিতে ক্ষতিকারক কীট-পতঙ্গ রোধ করার জন্য আবি®কৃত হয়েছে। নদী চিরকাল মানুষের সুখ-দুঃখের সাক্ষী। নদী মানব সভ্যতার দিশারী বলেই মানুষ নদীর কাছে ঋণী। নদীতে বিষ প্রয়োগে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞায় সরকার অনতিবিলম্বে আইন প্রণয়ন করুক।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
গণমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারের ওপর গুরুত্বারোপ করলেন উপদেষ্টা
বগুড়ার ধুনট পল্লীতে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে ব্যবসায়ীর ৩৫ হাজার টাকা ছিনতাই
দীর্ঘ ১৩ বছর পর দেশে ফিরছেন কায়কোবাদ
সিদ্দিরগঞ্জে নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ থেকে পড়ে বিদ্যুতায়িত, দুই শ্রমিকের মৃত্যু
নাচোলে পিয়ারাবাগানে এক গৃহবধূ খুন
৫ জানুয়ারি থেকে ৪৪তম বিসিএসের মৌখিক পরীক্ষা শুরু
নোয়াখালীর সুবর্ণচরে মোটর থেকে বৈদ্যুতিক তার খুলতে প্রাণ গেল যুবকের
কারখানায় আগুন, পরিদর্শনে হাতেম
নির্বাচনের তারিখ নিয়ে যা জানালেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার
কবি জসীমউদ্দিনের মেজ ছেলে ড. জামাল আনোয়ার আর নেই
ভাঙ্গায় দুই গ্রামবাসীর মধ্যে সংঘর্ষে নারী-পুরুষসহ আহত- ১০
আমাদের সংস্কৃতির অংশ হলো সব ধর্মের মাঝে সম্প্রীতি ও সহাবস্থান: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
রাতের আধারে অসহায় ব্যাক্তিদের বাড়ির দরজায় গিয়ে কম্বল দিলেন ইউএনও
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রশংসা করলেন রাহাত, জানালেন নিজ অনুভূতি
সাবেক দুদক কমিশনার জহরুল হকের পাসপোর্ট বাতিল, দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
শ্রীপুরে ভুয়া মেজর আটক
প্রশ্ন: কিসব কারণে বিয়ের বরকত নষ্ট হয়ে যায়?
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অনুপম দৃষ্টান্ত মুহাম্মদুর রাসূলুল্লাহ (সা:)
আল-কুরআন তাজকেরায়ে মীলাদ নামায়ে আম্বিয়া (আ:)
ভারত উপমহাদেশে মুসলিম সভ্যতার জাগরণে আবুল হাসান আলী নদভির শিক্ষাচিন্তা