স্মৃতিতে ৯১-এর সেই কালোরাত্রি
২৮ এপ্রিল ২০২৩, ০৭:৪১ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:২৬ পিএম
১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল দিনটি ছিল কালোমেঘাচ্ছন্ন, ভ্যাপসা গরম, পশ্চিমের আকাশ লাল আভা। বিকাল থেকে মিডিয়াতে প্রচার হচ্ছে সাইক্লোনের সতর্ক সংকেত। সন্ধ্যা থেকে মানুষের মাঝে আতঙ্ক। বহু সাইক্লোন, টর্নেডো জলোচ্ছ্বাসে অভ্যস্ত গ্রামীণ জনপদের মানুষ অবহেলায় ঘুমিয়ে পড়ে। রাত ১১টায় হঠাৎ বাতাসের তীব্রতা ১০০ মাইল গতি অতিক্রম করে। শুরু হয় ২০০ বছরের ইতিহাসের ভয়ঙ্কর সাইক্লোনের তা-ব, ১৪০ মাইল বাতাসের গতির সঙ্গে বাড়তে থাকে সমুদ্রের জলোচ্ছ্বাস। উপকূলীয় অঞ্চলে ১০ থেকে ১৮ ফুট উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাস ১৫০ মাইল গতিতে আঘাত হানে। ভোর ৪টা পর্যন্ত চলে সাইক্লোনের তা-ব। অরক্ষিত উপকূলের ভাঙ্গা বেড়িবাঁধ দিয়ে পানির তোড়ে মাটি ও ছনের ঘর নিমিষে ধ্বংস হয়ে যায়। পানির তীব্র ¯্রােতে ভেসে যেতে থাকে মানুষ, পশু, ঘর-বাড়ি ও গাছপালা। ভোর ৪টার পর যখন বাতাসের গতি কমে আসে তখন দেখা যায়, সমস্ত চট্টগ্রাম এক ধ্বংসপ্রাপ্ত নগরী। সমস্ত উপকূল মিরসরাই, সীতাকুন্ড, সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, আনোয়ারা, বাঁশখালী, চকরিয়াতে মানুষ ও পশুর লাশ, সর্বত্র লোনাপানি, রাস্তাঘাট বিধ্বস্ত, কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা নেই। ১,২৬,০০০ হাজার মানুষ ১০ লক্ষাধিক গবাদি পশু এককোটি ঘরবাড়ি বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সব শেষ। সংকট আরো জটিল হয়, আহত মানুষের চিকিৎসা, লাশ দাফন, অসহায় মানুষের অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়দান, এই বিশাল বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে দেশ-বিদেশ থেকে এগিয়ে আসে জনগণ, প্রতিষ্ঠান ও এনজিও সংস্থা। বিশ্ব মিডিয়ায় হেড লাইন হয়ে বাংলাদেশের দুর্যোগ সচিত্র প্রচার হতে থাকে।
সাইক্লোনের তিন দিন পর আমি আমাদের বাড়ি বাঁশখালী সাধনপুর পৌঁছি। আমাদের মাটির দোতলা বাড়ি, দোতলা কাচারি ঘর, নিশ্চিহ্ন হয়ে খেলার মাঠ হয়ে গেছে। পুরো গ্রাম লন্ডভন্ড। পশ্চিম সমুদ্র উপকূল এলাকার বেঁচে থাকা মানুষ আমাদের এলাকায় আশ্রয় নেয়। সমস্ত বাঁশখালী মৃত মানুষ, পশু ও বিধ্বস্থ ঘর-বাড়ি। শুধু বাঁশখালীতে ২২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। আমাদের বাঁশখালীবাসীর সৌভাগ্য তৎকালীন পাবনার ডিসি আমাদের গ্রামের সন্তান আবু সোলায়মান গ্রামে আসেন, খবর পেয়ে আমি লোকজন নিয়ে রাত ১০টায় তার সাথে দেখা করি। এলাকার সমস্যা নিয়ে আলোচনা করি এবং সমাধান ও সহযোগিতার জন্য তাকে পরদিন উপজেলায় যাওয়ার জন্য অনুরোধ করি। পরদিন ২টি মোটর সাইকেল জোগাড় করে আমরা উপজেলায় পৌঁছি। একজন ডিসিকে সম্মান জানাতে প্রশাসনিক কর্মকর্তা সবাই উপস্থিত। টিএনও বলেন, স্যার, আপনার কিছু বলার আছে? ডিসি সাহেব বলেন, আমার ছোট ভাই সেলিম বলবে, টিএনও আমাকে কিছু বলতে বললে, আমি বললাম, আপনি কাগজ-কলম ও কার্বন পেপার নেন। তখন বিদ্যুৎ নাই, ফটোকপি হবে না। আমি বললাম, তিনি লিখলেন, উপজেলার জন্য ১০ জন ডাক্তার, ত্রাণ সমন্বয়ক ১০ জন ম্যাজিস্ট্রেট, ১০টি স্পিড বোড, শৃংখলার জন্য সেনাবাহিনী এবং প্রয়োজনীয় তাবু, ঔষধপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী প্রয়োজন এবং আমাদের ২নং সাধনপুর ইউপি’কে ‘বি’ থেকে ‘এ’ ক্যাটাগরিতে উন্নতি করা হোক। (উল্লেখ্য এ গ্রুপে বি থেকে দ্বিগুণ রিলিফ সুবিধা পাওয়া যায়)। সোলায়মান ভাইকে বললাম, সার্কেট হাউজে চট্টগ্রাম ত্রাণ ও পুনর্বাসন সমন্বয়ক কর্নেল অলি আহম্মদের হাতে কপিটা দেবেন। আগে জেলা প্রশাসক থেকে স্বাক্ষরটা নেবেন। তারপর আপনার কাজ শেষে করে আপনি পাবনা চলে যাবেন। আপনাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখিত। তিনি রুম থেকে বেরিয়ে আমাদের জড়িয়ে ধরে বললেন, তুমি একঘণ্টায় অসাধারণ কাজ করেছ। তোমার সব দাবি আজকের মধ্যেই পূরণ হয়ে যাবে। পরদিন তাই হলো। একে একে সেনাবাহিনী, ডাক্তার, প্রয়োজনীয় রিলিফ সামগ্রী আসতে শুরু হলো।
চারিদিকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার জন্য মানুষের হাহাকার অবস্থা। একটি ত্রাণের গাড়ি আসলে সবাই দৌড়ায়। চারিদিকে তখনো মানুষ ও গরু-ছাগলের লাশ। পরদিন বাড়িতে ইউপি থেকে চৌকদার এসে বললো, উপর থেকে লোক এসেছে আপনাকে এখন ইউপিতে যেতে হবে। গিয়ে দেখলাম, একজন অফিসার তিনি লক্ষ্মীপুরের ডিসি আবদুর রব, ডেপুটেশনে ১০ জন ম্যাজিস্টের একজন হয়ে এসেছেন। টিএনও সাহেব বলেছেন, আমার ইউপি ‘এ’ ক্যাটাগরি কিনা? তদন্ত রিপোর্ট দিতে। তাকে নিয়ে রিকশাযোগে সোজা বেড়িবাঁধ দিয়ে চৌধুরী ঘাট পর্যন্ত গেলাম, দু’পার্শ্বে বিধ্বস্থ ঘর-বাড়ি। বেড়িবাঁধে একদিন আগে সামরিক বাহিনী আবর্জনা জ্বালিয়ে দেওয়ায় ভেসে উঠেছে মানুষ ও পশুর লাশ। উল্লেখ্য, লবণ পানি হওয়াতে এসব লাশের তেমন দুর্গন্ধ ছিল না। উনি এসব দেখে বললেন, আর দেখতে হবে না, চলেন। উল্লেখ্য, ২২শ ঘর বিধ্বস্থ হলে ‘এ’ ক্যাটাগরি হয়। আমাদের ইউপি চেয়ারম্যানের ভুল রিপোর্টে ১৭০০ বিধ্বস্থ ঘর দেওয়াতে ‘বি’ গ্রুপ হয়েছিল। ইউপি অফিসে গিয়ে ডিসি রব সাহেব বলেন, আপনি প্রতিবেদন লিখে দেন, আমি স্বাক্ষর করে দেব। আমি প্রতিবেদন লিখে তাকে দিলাম। তিনি স্বাক্ষর করে খামে ভরে নিলেন। যাওয়ার আগে আমাকে ইউপি রিলিফ সমন্বয়ের দায়িত্বে দিয়ে গেলেন। পরদিন থেকে আমার ইউপি’তে ‘এ’ গ্রুপে দ্বিগুণ রিলিফ আসতে শুরু করলো। সাথে সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে একমাস রিলিফ বণ্টন করলাম। মাঝখানে একদিন শহরে এসে আমার অফিস আলিকোতে আসি। আমার কলিগ মিথুন বলেন, কেয়ার মহাসচিব, অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছে। তুমি চলো, তঁঁাঁর কাছে কিছু সহযোগিতা পাওয়া যায় কিনা? আমরা সার্সন রোড কেয়ার অফিসের স্টাফদের বললাম, আমি বাঁশখালী থেকে এসেছি, মহাসচিব ডি হসডন সাহেবের সাথে দেখা করার জন্য। তারা না করে দিল। আমি সরাসরি তার রুমে ঢুকে গেলাম। বললাম, আমার এলাকায় দশ হাজার মানুষ অভুক্ত। এখনো এলাকা পানির নিচে। তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেন, হোয়াট? তিনি উত্তেজিত হয়ে বললেন, কী বলছো তুমি? আমি এখনি হেলিকপ্টার নিয়ে ওখানে যাবো। তুমি সিউর? আমি বললাম, ইয়েস। তিনি আমার ঠিকানা ও কার্ড নিলেন। বললেন, এলাকায় যাও রিলিফ পৌঁছে যাবে। আমি ওইদিন আমার বাড়িতে ফিরে আসি। পরদিন কেয়ার অফিস থেকে আমার নামে ৪৩০টি প্যাকেট (যেখানে কম্বল, চিড়া, চাউল ছিল) এক ট্রাক মাল পাঠায়। আমি সাধনপুর হাই স্কুলে রিলিফসমূহ গ্রহণ করে তাৎক্ষণিক উপস্থিত মানুষের মাঝে বিতরণ করি। সোলেমান ভাই পাবনা থেকে পরে এক ট্রাক রিলিফ পাঠায়। তাও আমি দ্রুত বিলি করে দেই। দেশি ও বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে চেম্বার অব কমার্স, কেয়ার, কারিতাশ ও ব্যক্তি উদ্যোগে মানুষকে সহযোগিতার আপ্রাণ চেষ্টা চালাই। চট্টগ্রাম মহানগরীতে বিশেষ করে হালিশহর, পতেঙ্গা উপকূলে ক্ষতির পরিমাণ বেশি ছিল। বিমান বাহিনীর সমস্ত বিমান, বিমান বন্দর এবং চট্টগ্রাম বন্দরের সকল উপকরণ বিধ্বস্ত। কর্ণফূলীতে ঘটেছে বিপুল সংখ্যক জাহাজডুবী। নদীতে আর উপকূলে শুধুই লাশ। এসব দুর্যোগ মোকাবেলায় সাহসী ভূমিকা রাখেন চট্টল গৌরব মহিউদ্দিন চৌধুরী। তিনি সমস্ত উপকূলের লাশ নিজ হাতে দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করা, রান্না করা খাদ্য বিতরণ, বাসস্থান ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। ৯১-এর দুঃসহ স্মৃতি জাগানিয়া মানুষগুলো এখনো চরম অবহেলা নিয়ে বেঁচে আছে। প্রয়োজন একটি স্মৃতিস্তম্ভ, মৃতদের তালিকা ও সরকারি সহযোগিতা।
লেখক: প্রাবন্ধিক
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মাইলফলকের টেস্ট স্মরণীয় করে রাখতে চান মিরাজ
আজারবাইজানে কপ-২৯ সম্মেলনে ঠাকুরগাঁওয়ের ইএসডিওর সাইড ইভেন্ট অনুষ্ঠিত
বেতন পেয়ে অবরোধ প্রত্যাহার করল বেক্সিমকোর শ্রমিকেরা
লেবাননে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত ৪৭
ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য মনোনীত দুই সদস্যের বিরুদ্ধে যৌন কেলেঙ্কারির অভিযোগ
ট্রাম্প ব্যবসায়ী, আমরাও একজন ব্যবসায়ী পার্টনার চাই : টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস
আদানির দুর্নীতি : এবার ভারতেই বির্তকের মুখে মোদি সরকার
প্রেসিডেন্টর সঙ্গে তিন বাহিনী প্রধানের সৌজন্য সাক্ষাৎ
নিজ্জর হত্যায় মোদীর সংশ্লিষ্টতার দাবি কানাডার সংবাদমাধ্যমের ,‘হাস্যকর’ দাবি ভারতের
পাকিস্তানে যাত্রীবাহী গাড়িতে গুলি, নিহত ৪২
এক সপ্তাহে রিজার্ভ বাড়ল ৬ কোটি ১০ লাখ ডলার
ইউক্রেন যুদ্ধ বৈশ্বিক সংঘাতে পরিণত হচ্ছে : পুতিন
মুরগি-সবজিতে কিছুটা স্বস্তি, আলু এখনো চড়া
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা, যা বলল যুক্তরাষ্ট্র
মার্কিন শ্রম প্রতিনিধি দল ঢাকা আসছে আজ
পার্থে শুরুতেই চাপে ভারত
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ১৮ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা
সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়ার সঙ্গে জামায়াত আমীরের কুশল বিনিময়
সিঙ্গেল সিটের দাবিতে গভীর রাতেও হলের বাইরে ছাত্রীরা
ইসরাইলি হামলায় গাজায় নিহতের সংখ্যা ৪৪ হাজার অতিক্রম করলো