গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময় কখন

Daily Inqilab মো. বশিরুল ইসলাম

৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১৬ এএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১২:১৬ এএম

কথায় বলে অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। প্রয়োজন হলেও অত্যধিক সূর্যালোক মাটির জন্য যেমন ক্ষতিকর, তেমনি চারার জন্যও ক্ষতিকর। বর্তমান পরিস্থিতিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ট্রেন্ডে গা ভাসিয়ে অনেকেই গাছের চারা রোপণ করছে। আমাদের বুঝতে হবে, এই সময়টা গাছ লাগানোর উপযুক্ত সময় কি না? কারণ, আপনি যে গাছের চারাটা রোপণ করছেন তার পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে বেড়ে ওঠার জন্য উপযুক্ত আবহাওয়া প্রয়োজন। সাধারণত জুন, জুলাই ও আগস্ট মাস হচ্ছে গাছের চারা লাগানোর উপযুক্ত সময়। এ সময় আলো-বাতাস, অনুকূল তাপমাত্রা, বৃষ্টি পর্যাপ্ত থাকে বলে চারাও সুন্দরভাবে প্রকৃতির মধ্যে বেড়ে ওঠে।

বর্তমানে বাংলাদেশে গ্রীষ্মকাল বিরাজ করছে। গ্রীষ্মে সূর্যের প্রখর তাবদাহে প্রকৃতি এক ভয়াল মূর্তি ধারণ করেছে। তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকছে প্রায় প্রতিদিনই। এটা ঠিক যে, আবাসিক ও অনাবাসিক ভবনসহ ব্যাপক নির্মাণ কাজের কারণে শহরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। শহরাঞ্চলে আবাদি জমি ও গাছপালা কমে যাওয়ায় বনায়ন ও বৃক্ষরোপণের সুযোগ নেই বললেই চলে। তবে, ছাদ-বাগান করে শহরের তাপমাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব। ছাদের বাগান বাইরের তাপমাত্রার চেয়ে ঘরের তাপমাত্রা প্রায় ১.৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস হ্রাস করতে পারে, এমনটাই পরিবেশবিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। বাগানসহ ছাদের তাপমাত্রা ও বাগানবিহীন ছাদের তাপমাত্রার পার্থক্য প্রায় ৭.৮৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হয়। অব্যবহৃত ছাদে খুব সহজেই পরিকল্পিতভাবে ফুল, ফল ও শাক-সবজির বাগান তৈরি করে পারিবারিক ফুল, ফল ও শাক-সবজির চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে।

যেসব গুণের কারণে আমাদের এ দেশকে সবুজ-শ্যামল বলা হতো তার বেশিরভাগেই ছিল চারদিকে ঘন গাছপালা আর সবুজের সমারোহ। এখন সেই সবুজ-শ্যামল রূপ খুব কমই চোখে পড়ে। গাছপালা ও ফসলি জমি ধ্বংসের কারণে পাখপাখালিও আগের মতো আর তেমন দেখা যায় না। গাছপালা কাটার ফলে পাখিদের আশ্রয়স্থলও কমে যাচ্ছে। অতিথি পাখির আগমনও কমে গেছে। প্রতিনিয়তই এভাবে গাছপালা কেটে উজাড় করতে থাকলে পাখিদের বংশ বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। এরকম পরিস্থিতিতে, পরিবেশ সুরক্ষায় সারাদেশে গাছ লাগানোর নির্দেশনা দিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। বিশেষ করে সব সিটি করপোরেশন ও পৌরসভা এলাকায় গাছ লাগাতে বলা হয়েছে।

এবারের গ্রীষ্মে আমরা যে প্রচন্ড তাপদাহে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছি, তার অন্যতম কারণ গাছের পরিমাণ কমে যাওয়া! দুঃখের বিষয় হলো, প্রতিবছর গ্রীষ্মে যখন গরমে হাঁসফাঁস করতে থাকে মানুষ, তখনই বৃক্ষ নিধন নিয়ে বিলাপ, আর বেশি বেশি গাছ লাগানোর পরামর্শ চলতে থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বৃক্ষ রোপণের আন্দোলন চলে। আমরা জানি, সূর্যের প্রখর রোদ আর শুষ্ক গরম বাতাস থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়, আমাদের চারপাশটা গাছগাছালির সবুজে ভরিয়ে দেওয়া। তবে, এর অর্থ এই নাই যে, যখন তখন গাছ লাগিয়ে ভরিয়ে দেব। এই তাপদাহ মধ্যে গাছ লাগালে সেই গাছ বাঁচানো খুবই কষ্টকর। কারণ, প্রতিটি জীবই তার জীবন ধারণ ও সুষ্ঠু বৃদ্ধির জন্য খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। উদ্ভিদের জীবন চক্র সম্পন্নের জন্য বিভিন্ন প্রকার খাদ্যের প্রয়োজন হয়। উদ্ভিদ মাটি ও বাতাস থেকে তার খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। মাটিতে অবস্থিত বিভিন্ন খাদ্য উপাদান পানির সাথে মিশে উদ্ভিদের গ্রহণ উপযোগী হয়। সাধারণত উদ্ভিদ মাটি থেকে মূল দ্বারা খাদ্য উপাদান গ্রহণ করে এবং তা পাতার ক্লোরোফিলের দ্বারা সূর্যালোকের সাহায্যে নিজের খাদ্য তৈরি করে।

মনে রাখা প্রয়োজন, চারা রোপণের পর চারা টিকিয়ে রাখাই বড় কাজ। এ জন্য প্রথমেই গরু, ছাগল বা অন্যান্য তৃণভোজী প্রাণীর হাত থেকে চারাকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে। চারা রোগাক্রান্ত হলে রোগ-বালাই নাশক প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে স্থানীয় বনকর্মী বা কৃষিকর্মীর পরামর্শ নিতে হবে। এই গরমের মধ্যে চারার গোড়ায় প্রয়োজন মাফিক পানি দিতে হবে। এই গরমে প্রথমত কী পরিমাণ পানি চারাগাছে দিতে হবে এবং মাটিতে কী পরিমাণ পানি দিতে হবে সেই বিষয়ে সচেতন হতে হবে। অপরদিকে চারাগাছে প্রয়োজনীয় সার দেওয়া জরুরি। সঠিকভাবে চারা বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত আলো-বাতাস। প্রাকৃতিকভাবে প্রাপ্ত আলো বাতাসে গাছ খুব দ্রুত বেড়ে ওঠে। যেকোনো জাতের গাছের জন্য যা খুবই দরকারি। তাই বাড়িতে এমন স্থানে গাছ রাখুন, যেখানে নিয়মিত আলো-বাতাস মেলে।

সুস্থ, সুন্দর ও বাসযোগ্য ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার জন্য যেকোনো দেশের আয়তনের শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। ৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদের অধিবেশনে প্রশ্নোত্তর পর্বে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী সাবের হোসেন চৌধুরী দেশের মোট আয়তনের ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ এলাকায় বনভূমি রয়েছে বলে জানিয়েছেন। এই তাপদাহে সহনীয় করতে চাইলে আমাদের বরং উচিত, নির্বিচারে বন নিধনের পরও এখনো যতখানি টিকে আছে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ পরিসংখ্যান ও মানচিত্র তৈরি করে সেগুলো সংরক্ষণ, পুনরুদ্ধার ও বর্ধনে জোর দেওয়া। বিভিন্ন এলাকায় এখনো পুরোনো ও বৃহৎ বৃক্ষ টিকে রয়েছে, সেগুলো সংরক্ষণে নজর দিতে হবে। বাড়াতে হবে জলাধার, উন্মুক্ত মাটি। সেই সঙ্গে পরিবেশবান্ধব ভবন নির্মাণে দায়বদ্ধতা। আরও দরকার ব্যক্তিগত পরিবহন কমিয়ে গণপরিবহন এবং হাঁটার উপযোগী ফুটপাত।

পরিবেশ রক্ষায় প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের দেশে বৃক্ষরাজি অনেক কম। তাই সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর সরকারি-বেসরকারিভাবে বিভিন্ন ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়, যেমন- পরিবেশ মেলা, বৃক্ষমেলা, সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি, বসতবাড়ি বনায়ন কর্মসূচি, বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি, ফলদ-বনজ-ভেষজ বৃক্ষরোপণ কার্যক্রম, ফলদ বৃক্ষমেলা। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠন থেকে বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ইতোমধ্যে সারাদেশে বৃক্ষ রোপণ কর্মসূচি পালন করছে ছাত্রলীগ। ২১ এপ্রিল থেকে আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত ১০ দিনে পাঁচ লাখ গাছ লাগানোর কর্মসূচি নিয়েছে সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। এছাড়া পরিবেশ দিবস-২০২৪ উপলক্ষে এক কোটি বৃক্ষরোপণ করে গিনেজ বুকস অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে অন্তর্ভুক্তির কর্মসূচি পরিকল্পনা রয়েছে সংগঠনটির। এ চারাগুলো পরিচর্যা দিকে আমাদের নজর দিতে হবে। আগেই বলেছি, চারা রোপণের পর চারা টিকিয়ে রাখাই বড় কাজ।

পরিবেশ সুরক্ষায় ২০১৯ সালে একদিনে এক কোটি ৩০ লাখ গাছ লাগিয়েছে তুরস্ক। এর মধ্যে এক ঘণ্টায় সর্বোচ্চ বৃক্ষরোপণ বিচারে ইন্দোনেশিয়াকে হারিয়ে নতুন বিশ্বরেকর্ড গড়েছে তারা। এর আগে ইন্দোনেশিয়া এক ঘণ্টায় সর্বোচ্চ ২ লাখ ৩২,৬৪৭টি চারা রোপণ করে রেকর্ড গড়েছিল। অন্যদিকে তুরস্ক এক ঘণ্টায় রোপণ করে ৩ লাখ ৩,১৫০টি চারা। জানা যায়, সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া এক পোস্টের জেরে এ কর্মসূচি পালিত হয়। ওই পোস্টে এনিস সাহিন নামের এক তুর্কি নাগরিক বলেন, দুর্দান্ত একটি আইডিয়া পেয়েছি। মুসলিম দেশ হিসেবে আমরা ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহায় সরকারি ছুটি পাই। বৃক্ষরোপণের জন্য একটি সরকারি ছুটি হলে কেমন হয়?

উপযুক্ত মৌসুমে গাছের চারা রোপণের পাশাপাশি তাদের অনবরত পরিচর্যাও জরুরি। তা না হলে গাছের চারা টিকিয়ে রাখা প্রায় অসম্ভব। অনেকে বাসার ছাদ এমনভাবে তৈরি করে নেন, যেন বাগান করতে সুবিধা হয়। নিজের বাসা হলে তো নিজের ইচ্ছামতো সাজিয়ে নেওয়া সম্ভব। তবে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই পানি দেওয়া ও ভালো নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।

লেখক: কৃষিবিদ, উপ-পরিচালক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের টাকার পাহাড়

দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের টাকার পাহাড়

মার্কিন অবস্থান নিয়ে লু’র বক্তব্যের পর বিএনপির কথার জবাবের প্রয়োজন পড়ে না -ওবায়দুল কাদের

মার্কিন অবস্থান নিয়ে লু’র বক্তব্যের পর বিএনপির কথার জবাবের প্রয়োজন পড়ে না -ওবায়দুল কাদের

বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করছে ভারত : মির্জা ফখরুল

বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সকল কার্যক্রম পরিচালনা করছে ভারত : মির্জা ফখরুল

অর্থনীতিবিদদের গৃহভৃত্য মনে করেন রাজনীতিকরা : ফরাসউদ্দিন

অর্থনীতিবিদদের গৃহভৃত্য মনে করেন রাজনীতিকরা : ফরাসউদ্দিন

৫ লোভী তরুণের কান্ড!

৫ লোভী তরুণের কান্ড!

ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়ার পর বিএনপির মাথা আরো খারাপ : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

ডোনাল্ড লু বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়ার পর বিএনপির মাথা আরো খারাপ : পররাষ্ট্রমন্ত্রী

কোরবানিতে চাহিদার চেয়ে পশু বেশি আছে প্রায় ২৩ লাখ

কোরবানিতে চাহিদার চেয়ে পশু বেশি আছে প্রায় ২৩ লাখ

গাজায় ১৫ হাজারের বেশি শিশু নিহত

গাজায় ১৫ হাজারের বেশি শিশু নিহত

রাশিয়ান অস্ত্র মার্কিন মহাকাশ ব্যবস্থা নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে

রাশিয়ান অস্ত্র মার্কিন মহাকাশ ব্যবস্থা নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে

খারকিভ ছেড়ে পালিয়েছে ইউক্রেনের সেনা

খারকিভ ছেড়ে পালিয়েছে ইউক্রেনের সেনা

দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে চীনে পৌঁছেছেন পুতিন

দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে চীনে পৌঁছেছেন পুতিন

ভাসানীর আদর্শে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে : জাগপা

ভাসানীর আদর্শে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে : জাগপা

উচ্চতাপে দুর্বিষহ জনজীবন

উচ্চতাপে দুর্বিষহ জনজীবন

তীব্র গরমে নাকাল সিলেটবাসী ব্যবসায়ীর মৃত্যু

তীব্র গরমে নাকাল সিলেটবাসী ব্যবসায়ীর মৃত্যু

কনসার্টে অবহেলায় শিশু!

কনসার্টে অবহেলায় শিশু!

হারানো জিনিস খুঁজে দেবে!

হারানো জিনিস খুঁজে দেবে!

চিপসের জন্য বিবাহ বিচ্ছেদ!

চিপসের জন্য বিবাহ বিচ্ছেদ!

বিএনপির উদ্দেশ্যে নানক :  ইট মারলে পাটকেল খাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবেন

বিএনপির উদ্দেশ্যে নানক : ইট মারলে পাটকেল খাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবেন

ইতালির প্রেসিডেন্ট সার্জিও মাতারেলার সঙ্গে ড. ইউনূসের সাক্ষাৎ

ইতালির প্রেসিডেন্ট সার্জিও মাতারেলার সঙ্গে ড. ইউনূসের সাক্ষাৎ

বৈদেশিক ঋণনির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষ নজরের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

বৈদেশিক ঋণনির্ভর প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশেষ নজরের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর