তাপদাহ থেকে বাঁচার উপায়

Daily Inqilab ড. মো. কামরুজ্জামান

০৩ মে ২০২৪, ১২:২১ এএম | আপডেট: ০৩ মে ২০২৪, ১২:২১ এএম

সারাদেশে দেখা দিয়েছে নজিরবিহীন তাপমাত্রা। মানুষের জীবন হয়ে পড়েছে দুর্বিষহ। পরিবেশ ও প্রকৃতিেিত দেখা দিয়েছে বিরূপ প্রভাব। আর এ তাপমাত্রা শুধু বাংলাদেশেই সীমাবদ্ধ নেই। বিশ্বের^ সব জায়গাতেই গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণ মানুষের মতই বিজ্ঞানিরা এটি নিয়ে বেশ চিন্তিত। বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে এন্টার্কটিকায় দ্রুত বরফ গলছে। অন্যদিকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে পৃথিবীর উপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, যা মোকাবেলা করা মুনুষ ও প্রকৃতির জন্য সত্যিই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদ্ভিদ ও প্রাণিবৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে এটা রীতিমত একটি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা মহামারি থেকে বিশ^ সবেমাত্র নিস্তার পেয়েছে। করোনা ছিল অদৃশ্য এক ভাইরাস। নখ-দন্তহীন অদৃশ্য এ ভাইরাসটির আক্রমণে উল্টে গিয়েছিল গোটা বিশ্ব। ল-ভ- করে দিয়েছিল মহাশক্তিধর বিশ্বকে! অতিক্ষুদ্রাকার এ শক্তি ওলট-পালট করে দিয়েছিল শক্তিধর আমেরিকা ও ইউরোপকে। মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিল পরাশক্তিদের অহমিকা। এর মোকাবেলায় তাদের পারমাণবিক বোমা, গানবোট, বোমারু বিমান ও মিসাইল কোনো কাজে আসেনি। লক্ষ লক্ষ লাশ হতবিহবল করে তুলেছিল আমেরিকানদের। তাদের সর্বোচ্চ প্রযুক্তি ও শ্রেষ্ঠ গবেষণা চোরাবালিতে রূপান্তরিত হয়েছিল। ফলে অদৃশ্য এ শক্তির কাছে তারা অসহায় আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়েছিল। অতিক্ষুদ্র এ শক্তির কাছে ধরাশায়ী হয়েছিল শক্তিধর মহাদেশ ইউরোপ। বিশ্ব মোড়লিপনায় এগিয়ে থাকা ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি ও স্পেনের শক্ত ভীতকে দুমড়েমুচড়ে নড়বড়ে করে দিয়েছিল করোনা। সুপার পাওয়ার, নিউক্লিয়ার, সাবমেরিনসহ সর্বাধুনিক প্রযুক্তির লীলাভূমি হলো ইউরোপ মহাদেশ। কিন্তু ক্ষুদ্রাকার করোনাভাইরাস তাদেরকে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য করেছিল। আমেরিকার মতো তারাও এ ভাইরাসের কাছে বশ্যতা স্বীকার করেছিল। করোনা তাদের দাম্ভিকতার মূলোৎপাটন করে ছেড়েছিল। তাদের বিশাল সা¤্রাজ্যের ভীত তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল। আমেরিকা ও ইউরোপকে তছনছ করে এটি আঘাত হেনেছিল দক্ষিণ এশিয়ায়। এশিয়ার পরাশক্তি রাশিয়াও নিস্তার পয়নি করোনার ছোবল থেকে। আর ভয়ানক দানবীয় আকার ধারণ করে এটা আছড়ে পড়েছিল উদীয়মান পরাশক্তি ভারতে। ভারতের হাসপাতাল, রাস্তাঘাট ও নদ-নদীতে লাশের স্তূপ দেখেছিল বিশ^। ভীত-সন্ত্রস্ত ভারতবাসী বিভিন্ন ভাষায় সৃষ্টিকর্তার কাছে নিবেদন করতে বাধ্য হয়েছিল। ভুক্তভোগী ভারতবাসীর করুণ আর্তনাদে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের অবস্থাও ভালো ছিল না। বাংলাদেশে করোনায় মৃত্যু হয়েছিল প্রায় ১৫ হাজারের মতো।

শক্তিশালী দেশগুলোতে করোনা আক্রমণ করেছিল ভয়ানক শক্তিরূপে। আর দুর্বলদেশগুলোতে আঘাত হেনেছিল অপেক্ষাকৃত কম শক্তিরূপে। করোনার দাপটে ল-ভ- পৃথিবীতে দেখা দিয়েছিল ভঙ্গুর দশা। অর্থনৈতিক অবকাঠামো ভেঙে পড়েছিল। এ মন্দার গতির গভীরতা বিশ্বকে প্রবলভাবে ঝাঁকুনি দিয়েছিল। ফলে ২০২২ সালে বিশ্বে বেকারত্বের হার বেড়ে গিয়েছিল। করোনাকালীন সময়ে করোনা তার রূপ পরিবর্তন করছিল বারবার। নতুন রূপে দাপিয়ে বেড়িয়েছিল এক দেশ হতে আরেক দেশে। শক্তিধর দেশগুলো টিকা আবিষ্কার করলেও তার কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল। একদিকে করোনার প্রকোপে বিশ্ববাসী ছিল দিশেহারা। ভূমিকম্প, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টির কারণে পৃথিবী হয়ে পড়েছিল বসবাসের অযোগ্য। শীতে এশিয়া যখন জুবুথুবু, আমেরিকা-ইউরোপে তখন দাউ দাউ করে জ্বলছিল আগুনের লেলিহান শিখা। বাংলাদেশে শুরু হয়েছিল ফণি, আম্ফান, আইলা ও নার্গিসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ।

বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা বর্তমানের সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভূপৃষ্ঠের তলদেশে পানির স্তর ক্রমাগত নিচে নেমে যাচ্ছে। গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে জলবায়ুর ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পরিবেশগত সকল ব্যবস্থা ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর মোট মৃত্যুর ১৬ শতাংশের মৃত্যু হচ্ছে পরিবেশ দূষণের কারণে। আর বাংলাদেশে এ সংখ্যা ২৮ শতাংশ। পরিবেশ দূষণের কারণে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী দেখা দিচ্ছে স্বাস্থ্য ঝুঁকি। দরিদ্র নারী ও শিশুরা ক্ষতির শিকার হচ্ছে বেশি। শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। নারীদের গর্ভের শিশু মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দূষিত বায়ুর প্রভাবে চোখ, নাক ও গলার সংক্রমণ দেখা দিয়েছে। পরিবেশগত সমস্যার কারণে দেশে অটিজম শিশুর জন্মহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দেশে প্রায় এক লাখের মতো অটিজম শিশু রয়েছে। শিশুদের ফুসফুসের নানা সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। ত্রুটিপূর্ণ জন্ম ও ক্যান্সার মারাত্মক আকারে বেড়ে গিয়েছে। জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে হচ্ছে। ১০ লাখ প্রজাতি বিলুপ্তির পথে রয়েছে। মরুভূমি দীর্ঘ হচ্ছে। জলাভূমি হারিয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর এক কোটি হেক্টর বন হারাচ্ছে। সমুদ্রের মাছ নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিবছর বায়ু ও পানি দূষণে ৯০ লাখ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। (সূত্র: আন্তোনিও গুতেরেস, জাতিসংঘ মহাসচিব, ৪ ডিসেম্বর, ২০২০)

এত দুর্যোগের কবলে পড়েও বিশ্ববাসীর মধ্যে শুভ চেতনা উদয় হচ্ছে না। সদয় হওয়ার পরিবর্তে তারা আরো নির্দয় ব্যবহার প্রদর্শন করে চলেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস অবশ্য মহামারীর পিছনে মানুষের কর্মকা-কে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, মানুষ প্রকৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। মানুষ প্রাণিকূলের আবাসন ধ্বংস করছে। বন্য প্রাণির বসবাসের জায়গার উপর হস্তক্ষেপ করছে। ফলে বিক্ষিপ্ত এসব প্রাণি থেকেই উৎপত্তি হচ্ছে নানা মহামারি। প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ চলমান থাকলে করোনার চেয়েও শক্তিশালী ভাইরাস উৎপত্তি হতে পারে, যা পৃথিবী থেকে মানবজাতিকে বিলুপ্ত করে দিতে পারে মর্মে তিনি সতর্কবার্তা প্রদান করেছেন।

মানুষের অপ্রয়োজনীয় উচ্চাকঙ্খা আর আবিষ্কার থেকেই জন্ম হচ্ছে নানা দুর্যোগের। মানুষের আবিষ্কৃত রোবটই একদিন মানবতাকে ধ্বংস করে দেবে বলে মন্তব্য করেছিলেন বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং। তিনি আরো বলেছিলেন, মানুষের গবেষণার মাধ্যমে সৃষ্টি হবে কিছু জীবাণু। যা জীবজগতকে চরম বিপর্যয়ে নিয়ে যাবে। পৃথিবীতে করোনাভাইরাসের চেয়েও বহুগুণ শক্তিশালী ভাইরাস আবিষ্কৃত হবে এবং পৃথিবীকে ধ্বংস করে দেবে। পৃথিবীতে সৃষ্টি হতে পারে মহাজাগতিক বিস্ফোরণ ও সৌর ঝড়। এর ফলে পৃথিবীতে সৃষ্টি হবে প্রচন্ড তাপদাহ। যা জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিতে পারে সমগ্র সৃষ্টিজগতকে। পৃথিবী ধ্বংসের সবচেয়ে বড় উপকরণ হলো পারমাণবিক অস্ত্র। এটার অপপ্রয়োগের কারণে তৈরি হতে পারে গ্লোবাল ওয়ার্মিং। বিস্তীর্ণ এলাকা হয়ে যেতে পারে মরুভূমি। বেড়ে যেতে পারে মারাত্মক জীবাণুর প্রকোপ। আর ছোটো এই নীল গ্রহটি হয়ে যেতে পারে বসবাসের একেবারেই অযোগ্য। এক ধাক্কায় ধ্বংস হবে না এ সুন্দর পৃথিবী। মানুষের অনৈতিক উচ্চাভিলাষের কারণে পৃথিবী বারবার ধ্বংসের মুখোমুখি হবে। কৃত কর্মকা-ের জন্য খেসারত দিতে হবে মানুষকে। ফলে মানুষ হয়ে পড়বে হতবিহবল ও সন্ত্রস্ত। আর এভাবেই মানুষের কাছে বারবার ফিরে আসবে পৃথিবী ধ্বংসের আলামত।

‘সকল অশান্তির জন্য মানুষের কৃতকর্ম যেমন দায়ী, আবার তাদেরই একটিমাত্র পদক্ষেপ এই অশান্তি দূর করে দিতে পারে’ বলেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। আর সেটি হলো, প্রকৃতির সঙ্গে ন্যায্য ও শান্তিপূর্ণ আচরণ। ইসলাম ধর্মের বিশেষজ্ঞগণও জাতীয় মহামারীকে মানুষের পরিশুদ্ধ হওয়ার সুযোগ বলে মনে করেন। কারণ, আল্লাহ তা‘আলা সুন্দর এ বিশ্বকে ধ্বংস করতে চান না। (সূরা কাসাস: ৫৯)। কিন্তু যখন বিশ্বের শক্তিশালী শাসকেরা পাপাচারে লিপ্ত হয় তখন জনপদের উপর আযাব এবং ধ্বংস নেমে আসে। (সূরা বনি ইসরাইল: ১৬)। আর এ ধ্বংস একবারে আসে না। চূড়ান্ত ধ্বংসের পূর্বে লঘু আকারে থেমে থেমে শাস্তি অবতীর্ণ হতে থাকে, যাতে করে তারা পাপকর্ম থেকে ফিরে আসে। (সূরা আস সিজদা: ২১)। মানব সভ্যতার ইতিহাস চর্চায় দেখা যায়, যুগে যুগে প্রভাবশালী জাতির পাপাচারের কারণে পৃথিবীতে নানান ধরনের মহামারীর আগমন ঘটেছিল। আজ থেকে ঠিক পাঁচ হাজার বছর আগের কথা। জর্ডানে জন্ম নিয়েছিলেন লুত (আ.)। তার সম্প্রদায় ধ্বংস হয়েছিল সমকামিতা ও ব্যভিচারের অপরাধে। প্রকৃতি সেখানে রুদ্ররূপ ধারণ করেছিল। আল্লাহ তা‘আলা জনপদের উপরের অংশকে নিচের দিকে, আর নিচের অংশকে উপরের দিকে উল্টো করে দিয়েছিলেন। ফলে সেখানে সৃষ্টি হয়েছিল একটি সাগর। ইতিহাসে যাকে মৃত সাগর বলা হয়ে থাকে। পাপাচারের শাস্তির সাক্ষী হিসেবে জর্ডানে অবস্থিত এ মৃত সাগরটি আজও বিদ্যমান রয়েছে। বর্তমান যুগে সেই সমকামিতা নির্লজ্জভাবে অনেক দেশের নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার!

শক্তিমানদের অস্বাভাবিক অহংকার, ঔদ্ধত্য ও নাফারমানির কারণে মিসরে অবতীর্ণ হয়েছিল জলোচ্ছ্বাস। (সুরা আরাফ: ১৩৩)। আল্লাহর প্রেরিত নবী নূহ (আ.)কে পাপিষ্ঠরা মিথ্যাবাদী ও পাগল বলে তিরস্কার করেছিল। ফলে প্রকৃতি রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছিল। রুদ্ররূপিপ্রকৃতি মহাপ্লাবনের মাধ্যমে গোটা বিশ্বকে ভাসিয়ে দিয়েছিল। (সূরা আল-কামার: ১১)। ফেরাউন মিসরে নিজেকেই ¯্রষ্টা বলে ঘোষণা দিয়েছিল। প্রতাপশালী এ রাজা দুর্বল ও সংখ্যালঘু মুসলিমদের উপর হামলা করেছিল। ফলে প্রকৃতি তাকে নীল নদে ডুবিয়ে মারার মাধ্যমে বদলা নিয়েছিল। (সূরা ইউনুস: ৯২)। সিরিয়ায় আগমন ঘটেছিল শোয়াইব (আ.) এর। সিরিয়াবাসী তখন পার্থিব লোভ-লালসায় মত্ত ছিল। অধিক লাভের আশায় পারস্পারিক লেনদেনে তারা ওজনে কম দিত। সমাজের প্রভাবশালীগণ দুর্নীতি, রাহাজানি, ছিনতাই ধর্ষণ ও মজুতদারীতে লিপ্ত ছিল। ফলে তাদের উপর প্রচন্ড তাপদাহ সৃষ্টি হয়েছিল। অগ্নি বৃষ্টির বর্ষণ হয়েছিল। অবশেষে ভূমিকম্পের মাধ্যমে তারা সেখানে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। (সূরা আনকাবুত: ৩৬-৩৭)।

পৃথিবীতে আদ জাতি ছিল সমকালীন যুগের সেরা। নির্মাণ শিল্পে তারা ছিল জগতসেরা। তাদের নির্মিত ইরাম শহরের মতো অনিন্দ্য সুন্দর শহর আর কোথাও ছিল না। অঙ্কনশিল্পে তারা ছিল সুদক্ষ। জ্ঞান-বিজ্ঞান আর সংস্কৃতিতে তারা ছিল অনন্য। এ কারণে তারা ঔদ্ধত্য ও অহংকারী হয়ে উঠেছিল। তারা দুর্বলদের উপর বর্বর আচরণ শুরু করেছিল। সংখ্যালঘুদের উপর তারা স্বৈরশাসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিল। তারা নবী হুদ (আ.) এর আদেশ এবং নিষেধ প্রত্যাখ্যান করেছিল। ফলে আদ জাতির এলাকা খরার কবলে পতিত হলো। দীর্ঘ তিন বছরের খরাতে তারা নাকাল হয়ে পড়েছিল। প্রচন্ড দুর্ভিক্ষ তাদের গ্রাস করেছিল। তথাপিও তারা তাদের জুলুম-শোষণ থেকে ফিরে এলো না। অতঃপর তাদের উপর পতিত হলো বিরাট এক ঝঞ্ঝাবায়ু। আর এ ঝঞ্ঝাবায়ু তাদের উপর স্থায়ী হলো সাত রাত-আট দিন পর্যন্ত। ফলে আদ জাতির এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলো। নিরাপরাধ মানুষেরা রক্ষা পেল। (সূরা হাক্কা: ৬-৭)। আদ জাতির পরে প্রাচীন পৃথিবীর সমৃদ্ধশালী জাতি ছিল সামুদ জাতি। এ জাতির নেতৃত্বে থাকা শক্তিমান লোকগুলো অন্যায়-অত্যাচার এবং অনৈতিকতার চরম সীমালঙ্ঘন করেছিল। তারা তাদের প্রেরিত নবী সালেহ (আ.) এর উপদেশ প্রত্যাখ্যান করল। অতঃপর একরাতে বজ্রপাত এবং প্রচ- ভূমিকম্প তাদের নাস্তানাবুদ করে দিল। অবশেষে নিজ গৃহেই উপুড় হওয়া অবস্থায় তাদের মৃত্যু হলো।

উল্লেখিত ইতিহাস এটাই প্রমাণ করে যে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা গ্রহণ করে না। আধুনিক শক্তিমান জালিমদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় প্রাচীন ইতিহাসের পাপ ও শোষণের নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়ে চলেছে। দুর্বলদের অক্টোপাশের ন্যায় পিষে মেরে চলেছে। সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত রেখেছে। ইউরোপ অ্যামেরিকা থেকে তারা সংখ্যালঘু মুসলিমদের বিতাড়ণের ঘোষণা দিয়েছে। এ উদ্দেশ্যে তারা বসনিয়াতেই ৩ লক্ষ মুসলমানকে হত্যা করেছে। ৬০ হাজার মুসলিম নারীকে গণধর্ষণ করেছে। ইউরোপ এবং আমেরিকার প্রত্যক্ষ ষড়যন্ত্রে ফিলিস্তিনের ৫১ লাখ মুসলিম উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। আজও এসব ফিলিস্তিনিরা ভিনদেশি শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছে। তারা ফিলিস্তিনকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দিয়েছে। কসোভাতে তারা চালিয়েছে মুসলিম নিধন। চেচনিয়া থেকে প্রায় পাঁচ লাখ মুসলিমকে সাইবেরিয়ায় নির্বাসন দিয়েছে। তালাবদ্ধ করে আগুনে পুড়িয়ে অসংখ্য মুসলিমকে হত্যা করেছে। মিথ্যা ও ঠুনকো অভিযোগে তারা ৫ হাজার বছরের পুরোনো ইরাকি সভ্যতা ধ্বংস করেছে। আফগানিস্তানকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। লিবিয়া চূর্ণ-বিচূর্ণ করেছে। আর মায়ানমার থেকে ইতিমধ্যেই ১০ লক্ষ মুসলিমদের বিতাড়িত করা হয়েছে। ভারতের গুজরাট ও কাশ্মীরসহ বিভিন্ন প্রদেশে মুসলিম নিধন অব্যাহত রয়েছে।

দীর্ঘ এ আলোচনা দ্বারা প্রাচীন এবং আধুনিক মোড়লদের চরিত্রে অনেক মিল খুঁজে পাওয়া যায়। প্রাচীনকালে রাজা-বাদশাদের শাসন-শোষণ, আচরণ ও পাপাচার ছিল সেকালের আধুনিকতায় সেরা। আর এ কালের রাজা-বাদশাদের পাপাচারগুলো একালের আধুনিকতায় সেরা। পরিবর্তন এসেছে শুধু পরিভাষা এবং সময়গত ভিন্নতায়। সেকালের ব্যভিচার একালে লিভ টুগেদারের মোড়কে নান্দনিক রূপ পেয়েছে। সেকালের মুসলিম নির্যাতন একালে ইসলামী সন্ত্রাস দমনের রূপ নিয়েছে। তাই সুদূর আমেরিকা থেকে বাংলাদেশের শক্তিমান শাসকদেরকে দুর্বলেরা যুদ্ধবাজ নেতা হিসেবেই চেনে। দুর্বলরা তাদেরকে দখলদার, দাঙ্গাবাজ ও চরিত্রহীন হিসেবেই পায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তারা ১৫ থেকে ১৯ কোটি মানুষকে হত্যা করেছে। আর ২৩ কোটি মানুষকে বানিয়েছে পঙ্গু। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তারা হত্যা করেছে ৫ থেকে ৮ কোটি মানুষ। লোভের আগুন দিয়ে তারা বর্তমানে গোটা ভূপৃষ্ঠকে জা¡লিয়ে দিয়েছে।

পৃথিবীকে বাঁচাতে তাই এসব মাতলামি বাদ দিতে হবে। পাপাচার বন্ধ করতে হবে। সকল সৃষ্টির সাথে শান্তিপূর্ণ আচরণ করতে হবে। হিংসাত্মক মনোভাব পরিহার করতে হবে। এটি একটি নৈতিকতার পরীক্ষা। আর এ পরীক্ষায় পাস করা এখন সময়ের দাবি। পরীক্ষায় ফেল গেলে প্রকৃতি আরো কঠিনরূপে আবির্ভূত হবে। অত্যাচারিত, নিষ্পেষিত আর শোষিত জনগোষ্ঠী আল্লাহর কাছে সব বলে দেবে। ফলে নতুন করে আবার সৃষ্টি হবে মহাপ্রলয়। মানুষের মুক্তির পথ সংকীর্ণ হয়ে যাবে। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাবে। ¯্রষ্টার কাছে দোয়ার দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। মানুষ আর ফিরে আসার সুযোগ পাবে না।

লেখক: অধ্যাপক, দা‘ওয়াহ এন্ড ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
Email: [email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

কাঁচামরিচের দাম ১৮০ টাকা ছুঁয়েছে

কাঁচামরিচের দাম ১৮০ টাকা ছুঁয়েছে

তাইওয়ানে চীনের আধিপত্য নিয়ে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র

তাইওয়ানে চীনের আধিপত্য নিয়ে উদ্বিগ্ন যুক্তরাষ্ট্র

'এশিয়ান অনূর্ধ্ব-১৪ টেনিস প্রতিযোগিতা’র বিজয়ীদের মাঝে নৌপ্রতিমন্ত্রীর পুরস্কার বিতরণ

'এশিয়ান অনূর্ধ্ব-১৪ টেনিস প্রতিযোগিতা’র বিজয়ীদের মাঝে নৌপ্রতিমন্ত্রীর পুরস্কার বিতরণ

বিশ্বকাপে বোল্টের ফেভারিট ওয়েস্ট ইন্ডিজ

বিশ্বকাপে বোল্টের ফেভারিট ওয়েস্ট ইন্ডিজ

জাপানিদের কালচার খুবই আধুনিক- নসরুল হামিদ

জাপানিদের কালচার খুবই আধুনিক- নসরুল হামিদ

টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবায় কর কমানোর দাবিতে র‌্যালি

টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবায় কর কমানোর দাবিতে র‌্যালি

শেরপুরে সড়ক দূর্ঘটনায় দুই মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু

শেরপুরে সড়ক দূর্ঘটনায় দুই মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যু

যুক্তরাজ্যে দুটি ব্র্যান্ডে পাওয়া গেলো ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ইথিলিন অক্সাইড

যুক্তরাজ্যে দুটি ব্র্যান্ডে পাওয়া গেলো ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ইথিলিন অক্সাইড

দুমকীতে কাপ পিরিচ মার্কার প্রার্থী ও সমর্থকদের ওপর হামলা, আহত-৫

দুমকীতে কাপ পিরিচ মার্কার প্রার্থী ও সমর্থকদের ওপর হামলা, আহত-৫

ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক সৈয়দ বেলায়েত হোসেনের ইন্তেকাল

ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক সৈয়দ বেলায়েত হোসেনের ইন্তেকাল

রাজবাড়ীতে ভোট চেয়ে বাড়ী ফেরার পথে একজনকে কুপিয়ে জখম

রাজবাড়ীতে ভোট চেয়ে বাড়ী ফেরার পথে একজনকে কুপিয়ে জখম

৫ দিনের ছুটির কবলে বেনাপোল স্থলবন্দর

৫ দিনের ছুটির কবলে বেনাপোল স্থলবন্দর

গোদাগাড়ীতে কৃষি মন্ত্রীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান সোহেল

গোদাগাড়ীতে কৃষি মন্ত্রীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানালেন নবনির্বাচিত চেয়ারম্যান সোহেল

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী তৎপরতার তথ্য পেলেই অভিযান : র‌্যাব পরিচালক

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী তৎপরতার তথ্য পেলেই অভিযান : র‌্যাব পরিচালক

যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল

যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল

প্রস্তুতি ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত

প্রস্তুতি ম্যাচে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত

ফ্রান্সে ইহুদি উপাসনালয়ে আগুন, অভিযুক্তকে গুলি করে হত্যা

ফ্রান্সে ইহুদি উপাসনালয়ে আগুন, অভিযুক্তকে গুলি করে হত্যা

নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে

নৌযান চলাচল বন্ধ থাকবে দ্বিতীয় ধাপের উপজেলা নির্বাচনে

বেলজিয়াম-নেদারল্যান্ডস-জার্মানিকে হারিয়ে বিশ্বকাপের আয়োজক ব্রাজিল

বেলজিয়াম-নেদারল্যান্ডস-জার্মানিকে হারিয়ে বিশ্বকাপের আয়োজক ব্রাজিল

নদী ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘূম রাত কাটে উপকূলবাসীর

নদী ভাঙন আতঙ্কে নির্ঘূম রাত কাটে উপকূলবাসীর