রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব কী?

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৬ মে ২০২৪, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ০৬ মে ২০২৪, ১২:০৭ এএম

টাঙ্গাইলে কমিউটার ট্রেন ও একটি তেলবাহী ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটে জয়দবেপুর জংশনের দক্ষিণ পাশের আউটার সিগনালে। গত শুক্রবার বেলা ১১টার দিকে ঘটা এই সংঘর্ষে দুই ট্রেনের ইঞ্জিন ও সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে চালকসহ আহত হয় ৪ জন। রেলকর্মীদের সংকেতজনি ভুলে এই দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানা গেছে। এজন্য এক স্টেশন মাস্টার ও দুই পয়েন্টম্যানকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। দুই ট্রেনের এভাবে মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা কম হলেও ট্রেনের ইঞ্জিন ও বগির লাইনচ্যুতিসহ বিভিন্ন ধরনের দুঘর্টনা প্রায়ই ঘটতে দেখা যায়। দুর্ঘটনায় প্রাণহানি যেমন ঘটে, তেমনি যাত্রীদের দুর্ভোগ-বিড়ম্বনার শেষ থাকে না। জয়দেবপুরে দুই ট্রেনের সংঘর্ষে কেউ নিহত না হলেও অনেক মানুষই হতাহত হতে পারতো। এ দুর্ঘটনার পর ট্রেনের সূচিতে বড় ধরনের বিপর্যয় সৃষ্টি হয় এবং যাত্রীরা চরম দুর্ভোগের কবলে পড়ে। ৩১ ঘণ্টা পর ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছে। এক খবরে উল্লেখ করা হয়েছে, উদ্ধারকারী ট্রেন ঘটনাস্থলে বিকেলে পৌঁছালেও বগি উদ্ধার করতে বেগ পেতে হয়। দু’ ঘণ্টার কাজ করতে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা লেগে যায়। ওই খবরেই বলা হয়েছে, পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের জন্য মাত্র ৫টি উদ্ধারকারী ট্রেন আছে। এগুলো অনেক পুরনো। যখন দুর্ঘটনা হরহামেশা ঘটছে, তখন উদ্ধার কাজ কঠিন ও বিলম্বিত হচ্ছে। নতুন নতুন রেললাইন, স্টেশন নির্মাণসহ রেলেওয়ের অবকাঠামো খাতে যেখানে কাড়ি কাড়ি টাকা ব্যয় হচ্ছে সেখানে উদ্ধারকারী ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর কোনো গরজ রেলওয়ের দেখা যাচ্ছে না। আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজনের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে চরম অবহেলা। সেই মান্ধতা আমলের পেপার লাইন ক্লিয়ার বা পিএলসি পদ্ধতি অনুসৃত হচ্ছে এখনো। অথচ পার্শ্ববর্তী ভারতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে সিগনাল সিস্টেম পরিচালিত হচ্ছে। গোটা ভারতে রেলওয়ে পরিচালনা করা হচ্ছে টেলিকম সিস্টেমে। বাংলাদেশ রেলওয়ের এহেন অবস্থার প্রেক্ষিতে রেল মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ক’বছর আগে বলেছিলেন, রেলের এনালগ সিস্টেমের সিগনালের ৯০ শতাংশ অকার্যকর। এতদিনে সিগনাল সিস্টেমের কত শতাংশ কার্যকর আছে, সেটাই ভাববার বিষয়।

রেলওয়ের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে অনেকগুলো মেগা প্রকল্প সরকার হাতে নিয়েছে, যার কিছু বাস্তবায়িত হয়েছে। বাকিগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে অথবা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অথচ, রেলওয়ের ঘাটতি রয়েছে পদে পদে। ইঞ্জিনের অভাব রয়েছে। বগির অভাব রয়েছে। রয়েছে দক্ষ লোকবলের অভাব। প্রযুক্তির অভাবের কথাতো আগেই বলেছি। দেশ ডিজিটালে রূপান্তরিত হয়েছে বলে কত গর্ব! কিন্তু রেলওয়ে পড়ে আছে সেই এনালগ যুগে। খবরে প্রকাশ, ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত নতুন রেললাইন প্রস্তুত। জুলাইতে উদ্বোধন হবে। ইংরেজি দৈনিক দি ডেইলি স্টারের এক খবরে বলা হয়েছে, ১৬৯ কিলোমিটারের এই ব্রডগেজ সিঙ্গেল লাইনটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৪২৪৭ কোটি টাকা। রেলওয়ের সবচেয়ে বড় প্রকল্প এটি। তবে পুরো সুবিধা এখনই পাওয়া যাচ্ছে না। ট্রেনের স্বল্পতা এবং লোকবলের অভাবই এর কারণ। এই লাইনে একদিনে ২৫ জোড়া ট্রেন চলাচল করতে পারবে। কিন্তু ট্রেন আছে সবমিলে ৫ জোড়া। দু’টি ট্রেন, যা এখন বঙ্গবন্ধু সেতু রুটে চলাচল করছে, যুক্ত হতে পারে নতুন লাইন পুরো চালু হলে। সব মিলে এই লাইনের সক্ষমতার ৭০ শতাংশই অব্যবহৃত থেকে যাবে। লোকবল সংকটও প্রকট। বলা হয়েছে, নতুন এবং অতিরিক্ত ফ্রেইট ট্রেন চালানোর মতো যথেষ্ট লোক নেই। তাহলে দাঁড়াচ্ছে কী? এত বিপুল অর্থ ব্যয়ে নির্মিত ট্রেনলাইনের সুফল ও সুবিধা এখনই পাওয়া যাচ্ছে না শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় সংখ্যক ট্রেন ও লোকবলের অভাবে। লাইন তৈরির আগে ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানো এবং লোকবল নিয়োগ ও তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। ঋণের টাকায় এত বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করে তা কাজে লাগাতে না পারার মতো চরম ব্যর্থতা আর কিছু হতে পারে না। তাহলে রেলওয়ে মন্ত্রণালয় আছে কী জন্য? এর মন্ত্রীরই বা কী দায়িত্ব? এই যে ব্যর্থতা ও ক্ষতি, তার দায় মন্ত্রী কি এড়াতে পারবেন?

রেলওয়েতে প্রচুর বিনিয়োগ হয়েছে। তার সুফল দেশ ও দেশের মানুষ এখনো পায় নি। নিরাপদ গণপরিবহন হিসাবে ট্রেনের খ্যাতি আগেও ছিল, এখনো আছে। বরং আগের খ্যাতি আরো বেড়েছে। সবদেশেই রেলওয়ের উন্নয়নে যথোপযুক্ত গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশেও হয়েছে। অবকাঠামো বাড়ানো হয়েছে ও হচ্ছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, সেটা জনগণের কল্যাণে ও উপকারে কমই কাজে আসছে। রেলওয়েতে যাত্রীসেবা বলতে গেলে কিছু নেই। অধিকাংশ ট্রেনের সিটের অবস্থা ভালো নয়। অনেক সময় পানি থাকে না। বিদ্যুৎ থাকে না। পাখা চলে না। টয়লেট ব্যবহার করা যায় না। ময়লা-আবর্জনা সর্বত্র। খাবার অরুচিকর। এই সেবা দিয়ে নতুন করে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। নিরাপদ ট্রেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে অনিরাপদ। প্রশ্ন উঠতে পারে, সেবার মান কি বাড়ানো সম্ভব নয়? অবশ্যই সম্ভব। প্রশ্ন উঠতে পারে, হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নতুন নতুন রেললাইন নির্মাণ করা যায়, আর ইঞ্জিন, বগি, উন্নত সিগনাল সিস্টেমসহ অন্যান্য সরঞ্জাম কেনা যায় না? অবশ্যই যায়। এজন্য প্রয়োজন যথোচিত উদ্যোগ ও পদক্ষেপ। বাংলাদেশে লোকের অভাব ঘটেছে, এমন কথা শুনিনি। তাহলে রেলওয়ের জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগে বাধা কোথায়? অতীতে রেলওয়ের নিয়োগ, কেনাকাটা নিয়ে অনেক খবর প্রকাশিত হয়েছে। নিয়োগ ও কেনাকাটায় স্বচ্ছতা থাকলে এরকম খবর সৃষ্টি হওয়ার কথা নয়। তাই সব ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিকল্প নেই। রেল মন্ত্রীকেই এ দায়িত্ব নিতে হবে। রেলওয়ের যেসব ঘাটতি রয়েছে অবিলম্বে তা পূরণ করতে হবে। যে দক্ষ লোক প্রয়োজন তা পূরণ করতে হবে এ জন্য স্বচ্ছ নিয়োগ পদ্ধতি করতে হবে। রেলওয়েতে এখনো অনেক দক্ষ কর্মী আছে। অনেকে অবসরে গেছে। তাদের সকলকে কাজে লাগিয়ে সুফল লাভ করার ব্যবস্থা নিতে হবে। রেলমন্ত্রীর দায়িত্ব কী? এ সবই তো?


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

সমীকরণ মেলানোর রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তা শেষে চেন্নাইকে বিদায় করে প্লে-অফে বেঙ্গালুরু

সমীকরণ মেলানোর রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তা শেষে চেন্নাইকে বিদায় করে প্লে-অফে বেঙ্গালুরু

ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে

ইসরাইলি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে

প্রোটিন উদ্ভাবনে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিচ্ছে ইউএসএসইসি-এর পিচ-টু-ফর্ক

প্রোটিন উদ্ভাবনে নতুন উদ্যোক্তাদের সুযোগ দিচ্ছে ইউএসএসইসি-এর পিচ-টু-ফর্ক

স্যানিটেশন কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে হারপিক ও সাজেদা ফাউন্ডেশন সমঝোতা

স্যানিটেশন কর্মীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা দিতে হারপিক ও সাজেদা ফাউন্ডেশন সমঝোতা

বড় পরিসরে আর. কে. মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন

বড় পরিসরে আর. কে. মিশন রোডে ব্র্যাক ব্যাংকের শাখা উদ্বোধন

বিএনপি ভোট বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে : শামসুজ্জামান দুদু

বিএনপি ভোট বর্জন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও গণতন্ত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে : শামসুজ্জামান দুদু

ভালুকার সেই শিশু দত্তক নিতে ৪ আবেদন, সিদ্ধান্ত রোববার

ভালুকার সেই শিশু দত্তক নিতে ৪ আবেদন, সিদ্ধান্ত রোববার

যক্ষা রোগ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারণা

যক্ষা রোগ প্রতিরোধে ওয়ার্ডভিত্তিক প্রচারণা

সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন

সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলামের দাফন সম্পন্ন

পানির সংকট

পানির সংকট

নীতি ও দুর্নীতির লড়াই

নীতি ও দুর্নীতির লড়াই

শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াল দশা

শিক্ষা ব্যবস্থার ভয়াল দশা

মামলাজট কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে

মামলাজট কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে

ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক বেলায়েত হোসেনের দাফন সম্পন্ন

ইসলামী আন্দোলনের নেতা অধ্যাপক বেলায়েত হোসেনের দাফন সম্পন্ন

দালালীকে পেশা হিসাবে নেওয়া প্রসঙ্গে।

দালালীকে পেশা হিসাবে নেওয়া প্রসঙ্গে।

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস ভয়াবহ আঘাতের মুখে ইসরাইল

দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হামাস ভয়াবহ আঘাতের মুখে ইসরাইল

পথ হারিয়েছে বিশ্ব : জাতিসংঘ

পথ হারিয়েছে বিশ্ব : জাতিসংঘ

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন জাহাজের অনুপ্রবেশ

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন জাহাজের অনুপ্রবেশ

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি না করা

যুক্তরাষ্ট্রের উচিত আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধি না করা

গাজা ইস্যুতে বন্ধু হারাচ্ছে ইসরাইল নানামুখী চাপে নেতানিয়াহু

গাজা ইস্যুতে বন্ধু হারাচ্ছে ইসরাইল নানামুখী চাপে নেতানিয়াহু