বাংলাদেশ কি আঞ্চলিক ভূরাজনীতির গিনিপিগ?

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

০৩ জুলাই ২০২৪, ১২:১৭ এএম | আপডেট: ০৩ জুলাই ২০২৪, ১২:১৭ এএম

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের সমস্ত প্রচেষ্টা ও প্রতিশ্রুতি ব্যর্থ করে দিয়ে শুধুমাত্র ভারতীয় সমর্থন নিয়ে বাংলাদেশে আরো একটি একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে চতুর্থবারের মতো আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেছে। দিল্লীর মসনদে যে দলই ক্ষমতায় থাকুক, আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের জন্য বিশ্বস্ত ও আস্থাশীল বন্ধু। ওয়ান-ইলেভেন পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতায় বসাতে ভারতের তৎকালীণ কংগ্রেস সরকার অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছিল। সেটি ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন ওয়ার অন টেররিজমের আওতায় বিশ্বের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলের উপর পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি দক্ষিণ চীন সাগরের উপর চীনা আধিপত্য খর্ব করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি ও নতুন ভারত নীতির অংশ। অর্থাৎ চীনকে মোকাবেলা করতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর উপর ভারতের খবরদারি ও আধিপত্যবাদী নীতির অনুমোদন। রাশিয়া-চীন-ইরানের সমঝোতা ও সহযোগিতামূলক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে দুই দশকে বিশ্ব পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টে গেছে। বিশ্বের সবচেয়ে দুর্বল অর্থনীতির দেশ আফগানিস্তান থেকে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক-অর্থনৈতিক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ন্যাটো বাহিনীকে লজ্জাজনক পরাজয় স্বীকার করে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। এরপর মধ্যপ্রাচ্যের উপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে আইএস জুজু, বাশার আল আসাদকে হটাতে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ, মধ্যপ্রাচ্যের পশ্চিমা বশংবদ বাহিনীগুলোর জোট গঠন করে ইয়েমেনের ইরান সমর্থিত হুতিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধসহ প্রতিটি সংঘাতে পশ্চিমা বাহিনীর সমর্থনপুষ্টদের শোচনীয় পরাজয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে তার নীতির পরিবর্তন ও নতুন কৌশল গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করে। ট্রিলিয়ন ডলারের সামরিক বাজেট খরচ করেও আফগান তালেবানদের হটাতে না পেরে সেখান থেকে মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর তড়িঘড়ি পাততাড়ি গোটানোর সিদ্ধান্তকে মার্কিনীদের ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ আনুষ্ঠানিক ইতি বলে মনে করেছেন অনেক পশ্চিমা রাজনৈতিক-সামরিক বিশ্লেষক। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের শুরুতেই জায়নবাদী সামরিক বিশ্লেষকরা একে এন্ডলেস ওয়ার বা অন্তহীন যুদ্ধ বলে ঘোষণা করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বকে নিরাপদ, গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ করে তোলাই সে যুদ্ধের মূল লক্ষ্য বলে জাহির করা হয়েছিল। যুদ্ধ শুরুর ২ মাসের মাথায় ওয়াশিংটন ভিত্তিক থিঙ্কট্যাঙ্ক ব্রুকিংস ইনস্টিটিউট ওয়ার অন টেররিজমের সম্ভাব্য ভবিষ্যত নিয়ে যে গবেষণাধর্মী বিশ্লেষণ তুলে ধরেছিল, তাতে বলা হয়েছিল, এই যুদ্ধের আপাত কোনো পরিসমাপ্তি নেই। ২০০১ সালের ১ ডিসেম্বরে প্রকাশিত ব্রুকিংস ইনস্টিটিউটের সেই মন্তব্য কলামের শিরোনাম ছিল, ‘ন্যাস্টি, ব্রুটিশ অ্যান্ড লং: আমেরিকা’স ওয়ার অন টেররিজম’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দু’জন কূটনীতিক ও পররাষ্ট্র বিশেষজ্ঞ ইভু এইচ হ্যালডার এবং জেমস এম লিন্ডসে যৌথভাবে প্রায় ৫ হাজার শব্দে লেখা নিবন্ধের শেষে যে উপসংহার দিয়েছিলেন, তাতে বলা হয়েছিল, এই যুদ্ধে কোনো গতানুগতিক বিজয় কিংবা পরিসমাপ্তি না থাকলেও এগারো সেপ্টেম্বর ২০০১ এর পরবর্তী সময়ে যদি মার্কিন জনজীবনে সন্ত্রাস-নিরাপত্তাহীনতা আগের চেয়ে কমিয়ে আনা সম্ভব হয়, সেটাই হবে এ যুদ্ধের বিজয়ের স্মারক। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ২৩ বছর পেরিয়ে এসে মার্কিন জনজীবন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি বিপন্ন ও অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। একটিমাত্র পরিসংখ্যানেই তা অনেকটা স্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে। ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে স্কুল শুটিংয়ের ঘটনা ছিল ১৮টি, এবং তাতে ৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আর ২০২৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩৪৬টি স্কুল শুটিংয়ের ঘটনায় ২ শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। ২০২২ সালে স্কুল শুটিংয়ে ২৭৩ জনের মৃত্যু হয়। দুই দশক ধরে যুদ্ধের ব্যয় মেটাতে গিয়ে মার্কিন জনগণকে ট্রিলিয়ন ডলারের ঋণের জালে আবদ্ধ করে সামজিক-অর্থনৈতিক অধিকার খর্ব করে আরো অনিরাপদ করে তোলা হয়েছে।

পশ্চিমাদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ সারাবিশ্বে সন্ত্রাস ও নিরাপত্তাহীনতা আরো বাড়িয়ে তুলেছে। মুসলমানদের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় রাজাদের হাজার বছর আগের ক্রুসেড যেমন তাদের জন্য চরম ব্যর্থতা ও পরাজয় ডেকে এনেছিল, একইভাবে একবিংশ শতকের শুরুতে এসে জর্জ ডাব্লিউ বুশের নয়া ক্রুসেড ও অন্তহীন যুদ্ধ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের পতন ঘন্টা বাজিয়ে দিয়েছে। নাইন-ইলেভেন সন্ত্রাসি বিমান হামলা, ইরাক-আফগানিস্তান দখল থেকে শুরু করে, সিরিয়া-ইয়েমেন যুদ্ধ থেকে ইউক্রেন ও গাজা যুদ্ধ পর্যন্ত পশ্চিমাদের স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী প্রতিটি সামরিক আগ্রাসনের নেপথ্যে জায়নবাদী ইহুদিরা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে। জায়নবাদ ও স্বেতাঙ্গ বর্ণবাদকে সামনে রেখে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব সম্প্রদায় থেকে বিচ্ছিন্ন করে তোলার প্রেক্ষাপটে ২০২০ সালের মার্কিন নির্বাচনে জো বাইডেন বিচ্ছিন্নতা কাটাতে এবং অন্তহীন যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতি ও গণতন্ত্রের প্রতি প্রতিশ্রতিশীল দেশগুলোর সাথে অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক ও নিরাপত্তা সহযোগীতাকে দৃঢ় করতে গণতন্ত্র ,মানবাধিকার,মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সুশাসনের মানদন্ডকে প্রাধান্য দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। বুশ-ওবামা- ট্রাম্পের সময়ের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের গাঁটছড়া ভেঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি নতুন বৈশ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করলেও তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নতুন স্নায়যুদ্ধের জন্ম দিয়েছে। চীন-মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে বাংলাদেশ যেন দুই পক্ষের তুরুপের তাস হয়ে উঠেছে। জো বাইডেন প্রশাসন গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মানদণ্ডকে সামনে রেখে বাংলাদেশে একটি স্বচ্ছ গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পালাবদল এবং মানবাধিকার সমুন্নোত করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিল। বাংলাদেশে ওয়ান-ইলেভেন সেনাসমর্থিত সরকারের প্রেক্ষাপট এবং নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফলাফল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের মধ্যকার আঞ্চলিক সমঝোতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়েছিল। এ বিষয়ে সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টন, ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিসহ সাবেক কূটনীতিকদের লেখা ও ফাঁস হওয়া তথ্য থেকে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। মূলত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় নির্বাচনের পর থেকেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের নতুন চিন্তাধারা প্রকাশ পেয়েছিল। সে সময় ভারতের একচ্ছত্র পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশে একটি নজিরবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। প্রধান বিরোধীদল বিএনপিসহ দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়া সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৩ টিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। তবে ভোটারবিহীন নির্বাচনের ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে স্বল্প সময়ের মধ্যে আরেকটি নির্বাচনের কথা বলেছিল। পশ্চিমা বিশ্বের তরফ থেকেও একটি রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের চাপ সৃষ্টি করা হলেও শেষতক চীন-মার্কিন ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির আওতায় বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আকাক্সক্ষা ও পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিশ্রুতি ভারতের একগুঁয়ে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী নীতির কাছেই যেন সমর্পিত হয়। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর কূটনীতিকদের যে লম্ফঝম্ফ, হম্বিতম্বি দেখা গিয়েছিল, দিল্লীতে ডোনাল্ড লু’র এক বৈঠকের পর সবকিছু যেন কর্পূরের মতো উবে গেল। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিবৃতি, পিটার হাসের অতি তৎপরতা সবকিছু চুপসে গিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ভাগ্য ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির মধ্যে হাবুডুবু খেতে খেতে ডুবতে বসেছে।

সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া-ইয়েমেনে পশ্চিমা নীলনকশা ব্যর্থ হওয়ার পর ইউক্রেনে বশংবদ শাসক বসিয়ে রাশিয়াকে হুমকির মুখে ঠেলে দিয়ে দূরপ্রাচ্যকে টার্গেট করে ইউক্রেন যুদ্ধকে অবস্যম্ভাবী করে তোলার পর সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করেও রাশিয়াকে পরাস্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। গাজা যুদ্ধে হামাস, হিজবুল্লাহ, হুতিদের হাতে ইসরাইলের নাস্তানাবুদ অবস্থা এবং ভূমধ্যসাগর, লোহিত সাগর এবং হরমুজ প্রণালীতে ইঙ্গ-মার্কিন নৌ শক্তি ত্রাহি অবস্থায় পড়েছে। এহেন বাস্তবতায় ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজির আওতায় মার্কিনীদের জন্য সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক হুমকি চীনকে ঠেকাতে ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়াকে সাথে নিয়ে বে অফ বেঙ্গলের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার লড়াইটাই এখন বাকি আছে। এ লড়াইয়ে চীন-রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভারতকে পশ্চিমা অক্ষের পক্ষে রাখতে বাংলাদেশকে বাফার স্টেট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। ইন্দো-প্যাসিফিকের পার্টনারশিপ ঠিক রাখতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও জনপ্রত্যাশাকে ভারতীয় হেজিমনির কাছে বন্ধক রাখা হয়েছে, এমন ধারণা এখন সাধারণ মানুষের মধ্যেও বদ্ধমূল হচ্ছে। ভূরাজনৈতিক লড়াইটা এখন এমন পর্যায়ে পৌছেছে যে, পরাশক্তির মূল কুশীলবদের এখন আর বিকল্প কোনো পথ খোলা নেই। সম্প্রতি রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন উত্তর কোরিয়া সফরে গিয়ে আঞ্চলিক অংশিদারিত্বের যে স্বীকৃতি দিয়েছেন, সেখানে চীন এবং ইরানের প্রসঙ্গ আসলেও ভারতের নাম আসেনি। অথচ স্নায়ুযুদ্ধকালে ভারত ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্যতম কৌশলগত মিত্র। সে সময় পাকিস্তান একই সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে একটি পারমানবিক শক্তি হয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিল। গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা চীন, ভারত, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা করতে সক্ষমতার দাবি করলেও সত্যিকার অর্থে কারো সমর্থনই লাভ করতে পারেনি, অথবা নিজের সার্বভৌম অবস্থান পরিষ্কার করতে পারেনি। রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ ভোটাভোটিতে চীন, রাশিয়া এবং ভারতকে মিয়ানমারের পক্ষে প্রায় অভিন্ন ভূমিকায় দেখা গেছে। বাংলাদেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন, মানবাধিকার, আইনের শাসন, দুর্নীতি, অর্থ পাচার ও রাজনৈতিক মিমাংসার প্রশ্নেও চীন, ভারত বা রাশিয়ার ভূমিকা জনগণের প্রত্যাশার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে। গত ১৫ বছরে দেশের অবকাঠামো ও বিদ্যুৎ খাতের মেগা প্রকল্প ও নানামুখী উন্নয়নের নামে যে লুটপাট হয়েছে, তার মূল অংশীদার ও বেনিফেশিয়ারি এই তিন আঞ্চলিক পরাশক্তি। ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি, ব্রিক্স, সাংহাই কো-অপারেশনের মত আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থায় চীন-ভারত-রাশিয়ার সহাবস্থান থাকলেও বাংলাদেশের স্থান কোথাও হয়না কেন? এখানেও ভারতীয় আধিপত্যবাদী নীতিকেই দায়ী করা যায়। সাংহাই কোঅপারেশনের ৯টি সদস্য রাষ্ট্রের মধ্যে আছে চীন, রাশিয়া, ইরান, ইন্ডিয়া, পাকিস্তান, কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান , তাজিকিস্তান, উজবেকিস্তান। এর গেস্ট এবং ডায়ালগ পার্টনার হিসেবে ১৫টি দেশের মধ্যে সউদী আরব, কাতার, তুরস্ক, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মিয়ানমার, মালদ্বীপ, আফগানিস্তানের নাম থাকলেও বাংলাদেশের নাম না থাকা অস্বাভাবিক ব্যাপার। এর পেছনে বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা অথবা আঞ্চলিক ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশকে গুরুত্বহীন করে রাখতে মহল বিশেষের অপচেষ্টার ভূমিকা থাকতে পারে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক দিল্লী সফরে যেসব চুক্তি সমঝোতা সই হয়েছে, তার কোনোটিতেই বাংলাদেশের স্বার্থ রক্ষিত হওয়ার প্রমান পাওয়া যায়নি। গত ১৫ বছরে শেখ হাসিনা ভারতকে যা দিয়েছেন তা সারাজীবন মনে রাখতে হবে বলে তিনি বলেছিলেন। বিনিময়ে বহুল প্রত্যাশিত তিস্তার পানি বন্টন চুক্তি, কিংবা গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যা পায়নি বাংলাদেশ। অথচ ১৫ বছর আগে নবম জাতীয় নির্বাচনের পর শেখ হাসিনার প্রথম দিল্লি সফরেই তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে সমঝোতার কথা বলা হয়েছিল। সে সময় উইকিলিকসে ফাঁস হওয়া তথ্যে জানা যায়, পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা গওহর রিজভী মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির সাথে সাক্ষাতে, প্রধানমন্ত্রীর প্রথম সফরে দিল্লীর সাথে সম্পর্কের ‘রূপান্তর’, উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোতে বাণিজ্য সম্প্রসারণ এবং ভারতের বাণিজ্য প্রতিবন্ধকতা দূর করার বিষয়ে আলোচনার প্রসঙ্গ উঠে এসেছিল। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সাথে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা ও সম্ভাব্য বাণিজ্য চুক্তিতে ভারতের ভূমি ব্যবহার করে নেপাল-ভূটানের সাথে সরাসরি যোগাযোগ ও বাণিজ্য সম্প্রসারণের কথাও বলা হয়েছিল। এরপর ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তায় একে একে আরো তিনবার ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগ। সম্পর্কের রূপান্তরের হাত ধরে গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশের সাথে ভারতের বন্ধুত্বের অনন্য উচ্চতার সিঁড়ি বেয়ে দেশের লাখ লাখ উচ্চ শিক্ষিত যুবককে বেকারত্বের গ্লানিতে ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশের জব মার্কেট ও অর্থনৈতিক সেক্টরগুলোতে অবৈধভাবে লাখ লাখ ভারতীয় চাকরি নিয়ে শত শত কোটি ডলার নিয়ে গেছে। এ সময়ে ভারতের রেমিটেন্স আয়ের অন্যতম প্রধান উৎস হয়েছে বাংলাদেশ। এ সময়ে বিএসএফ’র গুলিতে বাংলাদেশিদের প্রাণের মূল্য ভারতীয় গরু-ছাগলের চেয়েও কমেছে। বিশ বছর আগে দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে ইমার্জিং টাইগার বলে বিবেচিত বাংলাদেশ এতদিনে কোরিয়া-মালয়েশিয়ার কাছাকাছি অবস্থানে থাকার কথা থাকলেও শেয়ার বাজার কারসাজি, ব্যাংক জালিয়াতি, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি, মেগা প্রকল্পের নামে সীমাহীন দুর্নীতি, ঘুষ ও কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে সরকারি আমলা ও ক্ষমতাসীন দলের অনেকে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাট, বিদেশে পাচার, দেশকে দেউলিয়াত্বের কাছাকাছি ঠেলে দিয়েছে। সবই করা হয়েছে ভারতের বশংবদ সরকার ও দুর্নীতিগ্রস্ত আমলাতন্ত্রের ছত্রছায়ায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলারের রিজার্ভ তলানিতে গিয়ে ঠেকলেও একেকজন আমলা, পুলিশ, রাজনীতিবিদের অনেকের দেশি-বিদেশি একাউন্টে রয়েছে হাজার হাজার কোটি টাকার গুপ্তধন। চীনের দিকে ঝুঁকে যাওয়া ঠেকাতেই সম্ভবত পশ্চিমারা দুর্নীতি, মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জিগির তুলে বাংলাদেশের উপর ভারতের আধিপত্য ঠিক রাখার কৌশলী ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, কিংবা এখনো করে চলেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি, মূল্যস্ফীতি এখন শ্রীলঙ্কার চেয়েও দুর্বল ও ভঙ্গুর। বসবাসের স্থান হিসেবে বাংলাদেশের রাজধানী এখন যুদ্ধবিদ্ধস্ত ইউক্রেনের রাজধানীর চেয়েও অনিরাপদ। হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা শহরের যানজট কমানো যায়নি, বায়ুদূষণ, নদীদূষণ, গণপরিবহনের বিশৃঙ্খলা ও নাগরিক নিরাপত্তাহীনতা কমিয়ে আনা যায়নি। ডিজিটাল বাংলাদেশের মানুষ সোমালিয়া, ইথিওপিয়ার চেয়েও ধীর গতির ইন্টারনেট ব্যবহার করে। উন্নয়নের ফাঁকা বুলির আড়ালে ভারতীয় আধিপত্যবাদের হেজিমনি বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা, নিরাপত্তা ও সব সম্ভাবনার টুটি চেপে ধরেছে। আর পশ্চিমাদের কাছে আমরা যেন এখন শ্রেফ ভূরাজনীতির গিনিপিগ।

[email protected]


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

কোটা আন্দোলন, গভীর রাতে উত্তাল ঢাবি

কোটা আন্দোলন, গভীর রাতে উত্তাল ঢাবি

গ্রামীণ ব্যাংকের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী

গ্রামীণ ব্যাংকের বৃক্ষরোপণ কর্মসূচী

কেরানীগঞ্জে ভুয়া দাতা সেজে দলিল করার সময় আটক ৩

কেরানীগঞ্জে ভুয়া দাতা সেজে দলিল করার সময় আটক ৩

ফ্রান্সে রোববার চূড়ান্ত দফা ভোট, নিয়োজিত থাকবে ৫০ হাজার পুলিশ

ফ্রান্সে রোববার চূড়ান্ত দফা ভোট, নিয়োজিত থাকবে ৫০ হাজার পুলিশ

পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার পর শাহবাগ ছাড়লেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা

পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণার পর শাহবাগ ছাড়লেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা

মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রাজ্যপালের মানহানির মামলা

মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রাজ্যপালের মানহানির মামলা

ইন্দোনেশিয়ার গুহায় আবিষ্কৃত ৫১ হাজার ২০০ বছরের পুরনো চিত্রকর্ম

ইন্দোনেশিয়ার গুহায় আবিষ্কৃত ৫১ হাজার ২০০ বছরের পুরনো চিত্রকর্ম

মিথ্যাচার করাই বিএনপি'র স্বভাব: একেএম এনামুল হক শামীম

মিথ্যাচার করাই বিএনপি'র স্বভাব: একেএম এনামুল হক শামীম

সরকারি টাকায় বিদেশ সফর বন্ধ, গাড়ি কেনায় নিষেধাজ্ঞা

সরকারি টাকায় বিদেশ সফর বন্ধ, গাড়ি কেনায় নিষেধাজ্ঞা

মাতারবাড়িতে স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করা হবে: বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী

মাতারবাড়িতে স্থলভিত্তিক এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করা হবে: বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী

কাস্টমস কমিশনার এনামুলের ৯ তলা বাড়ি ও দুই ফ্ল্যাট জব্দের হুকুম

কাস্টমস কমিশনার এনামুলের ৯ তলা বাড়ি ও দুই ফ্ল্যাট জব্দের হুকুম

আমিরাতে ব্রেন স্ট্রোক করে দু-মাস চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশির মৃত্যু

আমিরাতে ব্রেন স্ট্রোক করে দু-মাস চিকিৎসাধীন অবস্থায় বাংলাদেশির মৃত্যু

পশ্চিম সুদানে সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি, হতাহত ৩২

পশ্চিম সুদানে সেনাবাহিনী ও আরএসএফের মধ্যে ব্যাপক গোলাগুলি, হতাহত ৩২

ভারতের ভূখন্ড ব্যবহার করে নেপাল- ভূটানে বাণিজ্য করার সুবিধা দিতে হবে সংবাদ সম্মেলনে ববি হাজ্জাজ

ভারতের ভূখন্ড ব্যবহার করে নেপাল- ভূটানে বাণিজ্য করার সুবিধা দিতে হবে সংবাদ সম্মেলনে ববি হাজ্জাজ

প্রশ্ন : প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করা প্রসঙ্গে।

প্রশ্ন : প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করা প্রসঙ্গে।

মালয়েশিয়াগামী ১৭ হাজার কর্মীর টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ প্রবাসী প্রতিমন্ত্রীর

মালয়েশিয়াগামী ১৭ হাজার কর্মীর টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ প্রবাসী প্রতিমন্ত্রীর

‘প্রগতি’ প্রথম সংখ্যা

‘প্রগতি’ প্রথম সংখ্যা

বর্ষাকাল

বর্ষাকাল

আজ ব্রিটেন এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে : কেয়ার স্টারমার

আজ ব্রিটেন এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করতে যাচ্ছে : কেয়ার স্টারমার

অসমাপ্ত সমীকরণ

অসমাপ্ত সমীকরণ