আগামীর বাংলাদেশের স্বপ্ন
২০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৩ এএম
ফ্যাসিবাদের কিছু আদর্শ পুরো জাতির মতামত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হয়। যেমন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল বিগত পনেরো বছরে এদেশে। ২০২৪ এর বিপ্লবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘ফ্যাসিবাদ’ এখন একটি কমন শব্দ হয়ে উঠেছে। ‘বৈষম্যবিরোধী’ শব্দের সঙ্গে ‘ফ্যাসিবাদ’ শব্দ জড়িয়ে গেছে। এই শব্দটি এখন পতিত আওয়ামী লীগ সরকার ও এর সহযোগীদের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইতিহাসে ফ্যাসিবাদের উৎপত্তিগত ধারণাটি সরল নয় বরং বেশি জটিল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর রূপ অনুসন্ধান করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফ্যাসিবাদের চরিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে, খুব দেরি হওয়ার আগ পর্যন্ত মানুষ বুঝতে পারে না যে, তারা ফ্যাসিবাদের শিকার হচ্ছে। কেউ নির্দিষ্ট করে বলতে পারবে না যে, স্পেনে ফ্রান্সিসকো ফ্র্যাঙ্কোর শাসন এবং আর্জেন্টিনায় হুয়ান পেরোনের সরকারই ফ্যাসিবাদের প্রকৃত উদাহরণ এবং সেই শাসন পদ্ধতি চিহ্নিত করা ও ভেঙে ফেলার মাধ্যমেই ফ্যাসিবাদ নির্মূল করা সম্ভব। যদি তাই হতো, তাহলে বিশ্ব পরবর্তীতে আবারও ইতালিতে দূর-বামপন্থী সামরিক গোষ্ঠী রেড ব্রিগেডের উত্থান দেখত না।
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার ছিল লাশের মিছিলের উপর দাঁড়িয়ে হলেও ক্ষমতায় টিকে থাকার উদগ্র বাসনা। শাসকরা যখন স্বৈরশাসক হয়ে ওঠেন, শাসন যখন অপশাসনে পরিণত হয়, ন্যায়বিচার ভূলুণ্ঠিত হয়, রাষ্ট্রের প্রতিটা বিভাগকে যখন উলঙ্গ দলীয়করণ করা হয়, ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য রাষ্ট্রের সমস্ত বাহিনীকে নিজ স্বার্থে ব্যবহার করা হয়, ভিন্নমতাবলম্বীদের উপর চালানো হয় দমন-পীড়ন ও অমানবিক নির্যাতন, যখন মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব করা হয়, তখনই মানুষের হৃদয়ে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। জনমনের ক্ষোভ একপর্যায়ে বিস্ফোরিত হয়। বুলেট-বোমার তোয়াক্কা না করে গণআন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে সর্বস্তরের মানুষ। এটাই ইতিহাসের নির্মম বাস্তবতা। আমরা ইতিহাস সৃষ্টি করি ঠিকই, কিন্তু ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি না।
মহান আল্লাহর চিরন্তন ঘোষণা, ‘তুমি বল, হে আল্লাহ! তুমি রাজাধিরাজ। তুমি যাকে খুশি রাজত্ব দান কর ও যার কাছ থেকে খুশি রাজত্ব ছিনিয়ে নাও। তুমি যাকে খুশি সম্মানিত কর ও যাকে খুশি লাঞ্ছিত কর। তোমার হাতেই যাবতীয় কল্যাণ। নিশ্চয়ই তুমি সকল কিছুর উপরে সর্বশক্তিমান’ (আলে ইমরান ৩/২৬)। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো অত্যাচারী শাসকই স্থায়ী হয়নি কোনোদিন হবেও না।
দেশের মানুষ মোট তিনটি অভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করেছে। আইয়ুব খার বিরুদ্ধে ১৯৬৯ সালের ২৪ জানুয়ারির গণঅভ্যুত্থান, এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বরের গণঅভ্যুত্থান। এরপর দীর্ঘ ৩৪ বছর পর দেখল শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থান। আগের দু’টি অভ্যুত্থানের চেয়ে ২০২৪ সালের অভ্যুত্থান ছিল অনেক বেশি ভয়াবহ, লোমহর্ষক, নির্মম ও রক্তাক্ত। আইয়ুব খান ও এরশাদ দেশ ছেড়ে পালাননি, কিন্তু হাসিনাকে দেশ থেকে পালাতে হয়েছে।এর আগের অভ্যুত্থানে এতটা রক্তপাত হয়নি, যতটা হয়েছে ২০২৪ সালের অভ্যুত্থানে। বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান-এর মধ্যে দিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে। গত পনেরো বছর ধরে যারা ছিলেন মহাদাপুটে, মুহূর্তে হয়ে গেলেন গর্তে লুকানো থরহরি কম্প ইঁদুর। আর ক্ষণকাল পূর্বেও যারা ছিল ক্লান্ত, শ্রান্ত, বিধ্বস্ত, আশ্রয়হারা অসহায়, হঠাৎ তারাই হয়ে উঠল একেকজন হারকিউলিস। সকালে যারা ছিলেন মহামান্য রাজাধিরাজ, বিকালে তারা হলেন ধিকৃত পলায়নপর স্বৈরাচার।
বিগত পনেরো বছর বুকে চেপে বসেছিল দুঃশাসন, বিচারহীনতা, যুলুম-নির্যাতন আর বাকস্বাধীনতা হরণের এক মহা জগদ্দল পাথর। দানবীয় যুগের অন্যতম প্রতীক, দুর্নীতি এবং বৈষম্য। স্বাধীনতার চেতনার নামে হাসিনা এ দেশকে দুই ভাগ করে ফেলেছিল। হাসিনার লোকদের একচ্ছত্র আধিপত্যে বাকিরা ছিল ম্রিয়মাণ। সকল সেক্টর ছিল মহা দুর্নীতিগ্রস্ত। দলীয়ভাবে নিয়োগকৃত অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা একেকটা অফিসকে গড়ে তুলেছিল দুর্নীতির আখড়া। ব্যাংকিং সেক্টর ছিল লোপাটের কারখানা। একেকটা ব্যাংককে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল বড়ো বড়ো শিল্পগোষ্ঠী নামক দস্যুদের হাতে।
চব্বিশে ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন পরবর্তী সময়ে হয়ে যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এই আন্দোলন পরে রূপ নেয় অসহযোগ আন্দোলনে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার রক্তভেজা অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এটা ছিল এক বিরল দৃষ্টান্ত। সারা দেশে, বিজয় উল্লাস করতে দলে দলে নেমে আসে দেশের সব পেশার সাধারণ মানুষ। এমন উল্লাসের দিনেও সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। ঐদিন আশুলিয়া বাইপাইল এলাকায় গুলিবিদ্ধ ১০-১২ জনের মধ্যে ৭ জন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। তাদের মরদেহ একটি পিকআপে তুলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। আহতদের হাসপাতালে যেতেও বাঁধা দেয়া হয়। রাস্তায় পরে থাকা আক্রান্তদের ম্যানহোলে ফেলে দেওয়ার প্রচেষ্টা। কত নির্মম ও বীভৎস ঘটনা!
বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কোনো আন্দোলনেই এত বিপুল প্রাণহানি ঘটেনি। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের চেয়ে প্রবল ও রক্তাক্ত ছিল এই গণঅভ্যুত্থান। তাই অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, ‘আমরা আরেকবার স্বাধীন হলাম! শিক্ষার্থীরা এত সাহস পেল কীভাবে! কীভাবেই বা রিকশাওয়ালা থেকে সর্বস্তরের জনতাকে তারা নিজেদের লড়াইয়ে শামিল করতে পারল?’ পারল, কারণ তারা কথা বলেছে বাংলাদেশের হৃদয় থেকে।
১৬ জুলাই রংপুরে পুলিশের বন্দুকের সামনে দুই হাত প্রসারিত করে আত্মাহুতি দেন বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বীরসেনা আবু সাঈদ। আবু সাঈদের মৃত্যু রচিত করেছিল মহাকাব্যের। তার মৃত্যুই গণঅভ্যুত্থানের সূচনা এবং সেদিনই চূড়ান্ত হয়েছিল বিজয়ের পথ। স্থল, নৌ এমনকি আকাশ পথেও ছিল যুদ্ধাস্ত্রের আক্রমণ। রাজপথ ছাড়াও রেহাই পাইনি মায়ের কোলের শিশু, ঘরের মধ্যে থাকা বোনরা, ঘরের ছাদের ওপর খেলতে থাকা শিশু বা বারান্দা দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষার্থী। বিশ্ব দেখেছে এতো মৃত্যুর পরে কীভাবে পুরো দেশের ছাত্র জনতাসহ আপামর মানুষ নেমে গিয়েছিল রাজপথে।
ছাত্রদের সঙ্গে সঙ্গে এ গণঅভ্যুত্থানে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ও সংগ্রামী ভূমিকা পালন করেছে শ্রমজীবী, রিকশাচালক, পথশিশু, মেহনতি সাধারণ মানুষ। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের অভিভাবক, শিল্পী,অভিনয়শিল্পী আর নানা শ্রেণি-পেশার বিক্ষুব্ধ লাখ লাখ মানুষ। প্রায় দেড় হাজার মানুষ শহীদ হয়েছেন, তার মধ্যে শিক্ষার্থীদের বাইরে শিশুসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ ছিল। আহত হয়েছে ৩০-৪০ হাজার। অসীম ত্যাগ, সাহসিকতা আর দেশের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা হয় ‘স্বাধীনতা, নয় মৃত্যু’ অঙ্গীকারে বলীয়ান হয়ে ৫ আগস্ট গণভবন অভিমুখে ছাত্র-জনতার ঢল নামলে হাসিনাকে পালাতে হয়।
এ গণঅভ্যুত্থান একটি প্রজন্মকে রাতারাতি দায়িত্বশীল করে তুলেছিল। ছাত্র-জনতার বীরোচিত আত্মদান, হাজারো, লাখো তরুণকে জুলুমের বিরুদ্ধে দেশাত্মবোধের চেতনায় জাগিয়ে তুলেছে। তাদের অনেকের কাছে এটি ছিল মুক্তিযুদ্ধে শামিল হওয়ার মতো গৌরবের বিষয়। হাজার হাজার তরুণ শিক্ষার্থী, নারী-পুরুষ আবু সাঈদের মতো আত্মদানে গুলির মুখে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাজিত করেছে।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যারা প্রাণ দিয়েছে, তাদের কথা প্রতি মুহূর্তে মনে রাখতে হবে। সফল এই দেশ গঠনের আন্দোলনে শিক্ষার্থী-জনতা যারা ছিল, সবাই আমাদের অহংকার। এই যে সহস্রাধিক প্রাণের বিনিময়ে যে নতুন স্বাধীনতা পেলাম, এটা যেন আর নষ্ট না হয়। আমরা আর কোনো নৃশংসতা চাই না। আমরা স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখতে চাই। বলার স্বাধীনতা, লেখার স্বাধীনতা, পড়ার স্বাধীনতা, চিন্তার স্বাধীনতাকে কেউ যেন ভন্ডুল করতে না পারে। তাহলেই আমরা জাতি হিসেবে এগিয়ে যেতে পারব।
ফ্যাসিবাদী আর কোনো শক্তি যেন এই মাটি রক্তাক্ত করতে না পারে, সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। এ দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হবে, একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকার আসবে, যা হবে নিরপেক্ষ দুর্নীতিমুক্ত এবং একটি সুন্দর ও সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র গড়ার সহায়ক। জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী, দেশের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলা, রাজনীতিতে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং মানুষের ভাগ্যের উন্নয়নের কর্মসূচি হতে হবে কল্যাণকর। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন থাকতে হবে। এই বাংলাদেশ আমাদের সবার। দেশের প্রত্যেক নাগরিক সব ক্ষেত্রে সমান অধিকার ভোগ করবে। সংখ্যালঘু বলে কিছু নেই, আমরা সবাই বাংলাদেশি। আমাদের চোখে থাকবে দেশ সেবার অদম্য ইচ্ছা শক্তি। সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য চাই, অনুপ্রাণিত ও অনুকরণীয় নেতৃত্ব যে শুধু স্বপ্ন দেখাবে না, স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে।
লেখকঃ সিনিয়র তথ্য অফিসার, তথ্য অধিদফতর, পিআইডি ফিচার।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
দলীয় ভিত্তিতে প্রশাসন সাজিয়ে কেউ ক্ষমতায় আসতে পারবে না: এ এম এম বাহাউদ্দীন
আদানির সঙ্গে জড়িত মোদিও: রাহুল গান্ধী
আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি ২৫ নভেম্বর ঢাকায় আসছেন
সোহেল-টুকু-হেলালসহ খালাস পেলেন বিএনপির ২২ নেতাকর্মী
ইরানে উদ্ভাবনে নারীদের অবদান ২৪ শতাংশের বেশি
প্রকাশায় ৯৩ শতাংশ নকল করেও পদোন্নতি পান রাবি অধ্যাপক সাহাল উদ্দিন
বোরহানউদ্দিনে নিখোঁজের দুই ঘন্টা পর লেবু বাগানে মিললো শিশুর লাশ
নাবালক ছাত্রের সঙ্গে জবরদস্তি যৌন সঙ্গম, ৩০ বছরের জেল শিক্ষিকার
সেনাকুঞ্জে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর প্রতিনিধি দলের অংশগ্রহণ
মার্কিন সংসদের নারী শৌচাগার ব্যবহার করতে পারবেন না রূপান্তরকামী এমপি
বাগেরহাটে হত্যা মামলায় যুবকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড
অন্তবর্তীকালীন সরকারের নির্দেশনা পালনের প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন জিওসি
কুড়িগ্রামের উলিপুরে অগ্নিদগ্ধ হয়ে শিশুর মৃত্যু
ভারতে পাচারকালে সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে দুই নারী উদ্ধার
কুরআন-সুন্নাহর আইন ছাড়া দেশে শান্তি আসবে না : চাঁদপুরে হাবিবুল্লাহ মিয়াজী
শাহজাহান ওমরকে জুতা ও ডিম নিক্ষেপ
জীবনে উত্তম কর্ম, জ্ঞান ও উন্নত চরিত্র অর্জন করতে হলে সফল ব্যক্তিদের সান্নিধ্য অবলম্বন আবশ্যক
নড়াইলে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার মামলায় জেলা আ.লীগ সভাপতি কারাগারে
নোবিপ্রবির সঙ্গে তুরস্কের আনাদোলু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউশনাল এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর
শিক্ষার্থীদের মতের ভিত্তিতেই ছাত্রদলের রাজনীতি চলবে : নাছির