সকলের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে
০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:২৬ এএম | আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:২৬ এএম
ছাত্র-জনতার তীব্র গণআন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান এবং এখন তিনি সেখানেই বসবাস করছেন। এর মাধ্যমে শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগের একটানা সাড়ে ১৫ বছরের দোর্দ- প্রভাবের শাসনের অবসান হয়। গত ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। সরকার এখন দেশ সংস্কার এবং একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য কাজ করছেন। এদিকে ৫ সেপ্টেম্বর শেখ হাসিনার নিয়োগকৃত সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল এবং তার দল পদত্যাগ করেন। পরবর্তীতে ২৯ অক্টোবর সরকার কর্তৃক সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বিচারপতি জুবায়ের রহমান চৌধুরীকে প্রধান এবং হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান, মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম, পিএসসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোবাশ্বের মোনেম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক স¤পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার এবং পিএসসির সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপিকা জিন্নাতুন নিছা তাহমিদা বেগমকে সদস্য করে ইসি গঠনে ছয় সদস্য বিশিষ্ট সার্চ কমিটি গঠিত হয়। এই সার্চ কমিটি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে আলোচনা করে নতুন ইসি গঠনের জন্য বিভিন্ন ব্যক্তির নাম রাষ্ট্রপতির কাছে জমা দেন। পরবর্তীতে রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে ২১ নভেম্বর সিইসি এবং ইসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয় এবং ২৪ নভেম্বর তারা শপথ গ্রহণ করেন। এভাবে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়।
ভোটাধিকার একজন মানুষের সাংবিধানিক অধিকার হলেও, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনসমূহে মানুষ ভোট দিতে পারেনি। ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন এবং সংসদ নির্বাচনসহ কোনো নির্বাচনেই জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। এসব নির্বাচনে ভোটের নামে ¯্রফে একটি তামাশা করা হয়েছে। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় এসব ভোটের প্রতি জনগণের তেমন একটা আগ্রহ ছিল না। ফলে অধিকাংশ ভোটারই ভোট প্রদান করতে ভোটকেন্দ্রে যাননি। তাছাড়া এসব নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কর্মীবাহিনী ব্যালট বাক্স ছিনতাই করেছে, জাল ভোট মেরে ব্যালেট বাক্স ভর্তি করেছে, প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর এজেন্টকে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দিয়েছে এবং নিজেদের ইচ্ছামত ফলাফল ঘোষণা করে নিজেদের প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণা করেছে। সরকারের প্রশাসন এবং আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বরাবরই এসব কাজে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা দিয়েছে। আর নির্বাচন কমিশন এই নির্বাচনী ফলাফলকে অনুমোদন করেছে এবং এর মাধ্যমে এসব নির্বাচনকে বৈধতা দিয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থা এবং আগ্রহ এতটাই কমে যায় যে, স্বযং আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মীই তাদের দলীয় প্রার্থীকে ভোট দেয়ার জন্য ভোটকেন্দ্রে যায়নি এবং ভোট দেয়নি। এখন নবনিযুক্ত নির্বাচন কমিশনকে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে এবং নির্বাচনের প্রতি জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে হবে। নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। সুতরাং নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীনভাবে মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে কাজ করতে হবে।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে এদেশে তিনটি সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দশম সংসদ নির্বাচন। তৎকালীন সিইসি ছিলেন কাজী রকীব উদ্দিন আহমদ। বিএনপি-জামায়াত জোট সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নাই। সেবার ১৫৩টি আসনে বিনা ভোটে এমপি নির্বাচিত হয়। বাকী আসনগুলোতে নামকাওয়াস্তে নির্বাচন হয়। বিরোধীদল বিহীন এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় এবং পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তৎকালীন সিইসি ছিলেন কে এম নুরুল হুদা। সেই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট অংশগ্রহণ করে। সেবারের ভোট আগের রাত্রে স¤পন্ন হয়। সরকার দলীয় কর্মীবাহিনী প্রশাসনের সহযোগিতায় বিভিন্ন নির্বাচনী কেন্দ্রে বিপুল পরিমাণে ব্যালট পেপারে সিল মেরে ব্যলেট বাক্স ভর্তি করে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করে। এই ভোট ইতিহাসে নিশি রাতের ভোট হিসেবে পরিচয় লাভ করে। নিশি রাতের এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় এবং ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। পাঁচ বছর পর ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই সময়ে সিইসি ছিলেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। এই নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট অংশগ্রহণ করে নাই এবং নির্বাচন বয়কট করে। আওয়ামী লীগ এবার নতুন ফর্মুলা প্রণয়ন করে। আওয়ামী লীগের বিরাট সংখ্যক প্রার্থী স্বতন্ত্র হিসাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ছিলেন আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থী। ডামি-আমির নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে আওয়ামী লীগ আবারো সরকার গঠন করে। কিন্তু ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয় এবং পরবর্তীতে এই সংসদ ভেঙ্গে দেয়া হয়। এই তিনটি সংসদ নির্বাচনের প্রতিটিই জাতীয় পার্টি আওয়ামী লীগের সহযোগী হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং প্রতিবারই তারা সংসদে বিরোধী দল হয়েছে।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে অনুষ্ঠিত তিনটি সংসদ নির্বাচনই ইতিহাসে প্রহসনের নির্বাচন হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। স্থানীয় সরকার নির্বাচনসহ অন্যান্য যেসব নির্বাচন হয়েছে, তাও ছিল প্রহসনের নির্বাচন। এসব নির্বাচনের কোনটাতেই জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোট দেয়নি অর্থাৎ জনগণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। এসব নির্বাচনে ভোটের নামে ভোট কারচুপি হয়েছে। জনগণের ভোট প্রয়োগের হার ছিল একেবারেই কম। এক কথায় আওয়ামী লীগ তাদের শাসনামলে শুধু ভোট চুরিই করেনি, বরং পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাকেই ধ্বংস করেছে। এখন জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ এসেছে। তার জন্য পুরো নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করতে হবে। নতুন নির্বাচন কমিশনকে এই গুরুদায়িত্ব পালন করতে হবে। ভোটের প্রতি দেশের জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। তার জন্য স্বচ্ছ, স্বতঃস্ফূর্ত এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি মানুষের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। একজন মানুষের সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন, নির্ভয়ে এবং নিঃসংকোচে তার ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ দিতে হবে। যার ভোট সে দেবে, যাকে খুশি তাকে দেবেÑ এই মীলনীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ভোটের মাঠে সকল প্রার্থীর ভয়হীন প্রচারণা নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনে জোর করে ভোট কেন্দ্র দখল, ব্যালট পেপার ছিনতাই এবং জাল ভোট প্রদান চিরতরে বন্ধ করতে হবে। ভোট গণনায় কারচুপি বন্ধ করতে হবে। কেউ যদি কারো ভোটাধিকার হরণ করে অথবা হরণের চেষ্টা করে এবং জাল ভোট প্রদান করে অথবা প্রদানের চেষ্টা করে, তবে দোষীদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য নির্বাচন বিধিতে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনতে হবে এবং নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। তরুণ প্রজন্মসহ অনেকেই মানুষ এখনো ভোটার হয়নি। তাদের ভোটার করার উদ্যোগ নিতে হবে এবং নির্বাচনের আগে সকল প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে ভোটার করতে হবে। এছাড়া প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এদেশের প্রায় এক কোটি মানুষ প্রবাসে কাজ করে এবং বসবাস করে। এসব মানুষের অধিকাংশই প্রাপ্ত বয়স্ক এবং তারা সবাই ভোটার। এই প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সেই সচল এদেশের অর্থনীতির চাকা। কিন্তু ভোটের সময় বিদেশে অবস্থানের কারণে তারা ভোট দিতে পারেন না। আমরা সকল প্রবাসীদের ভোটাধিকার এবং ভোটের সুযোগ চাই। এজন্য নির্বাচন কমিশনকে উদ্যোগ নিতে হবে।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।
[email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
মেটলাইফ বাংলাদেশের “সেরা এজেন্সি ২০২৪” হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে নোয়াখালী জেলার “সুমন এজেন্সি”
রাজধানীতে গার্মেন্টস এক্সেসরিজ ও প্যাকেজিং পণ্যমেলা শুরু বুধবার
আয়নাঘর পরিদর্শনের সুযোগ পাবেন গণমাধ্যমকর্মীরা : প্রেস সচিব
মোচিক শ্রমিক ইউনিয়নের দ্বি-বার্ষিক নির্বাচন-২০২৫ সম্পন্ন
আওয়ামী লাল ফিতার দৌরাত্ম্যে অতীষ্ট প্রবাসীরা; কূটনীতিক মহসিনকে অপসারণ ও শাস্তির দাবি
খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেছেন স্থায়ী কমিটির সদস্যরা
প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করার আহ্বান প্রধান বিচারপতির
যাকাতের টাকা থেকে কি দরিদ্র ছাত্রদের লেখা-পড়া করার জন্য সহায়তা প্রসঙ্গে।
যে মামলায় আটক লতিফ বিশ্বাস
ভাড়াটিয়াসহ মালিককে বের করে বসত বাড়ি দখল
সাভার হাইওয়ে থানার ইনচার্জ শ্রেষ্ঠ অফিসার ইনচার্জ নির্বাচিত
দক্ষিণ এশিয়ান টেনিস বল ক্রিকেট চ্যাম্পিয়ানশীপে রানার্স-আপ সৈয়দপুর দলকে সংবর্ধনা
লক্ষ্মীপুরে ফিটনেস বিহীন গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান, ৩৯ হাজার টাকা জরিমানা
রোমানিয়ায় কূটনীতিক মহসিনকে শাস্তির দাবিতে ৭ দিনের আলটিমেটাম
আইনজীবীদের জুরিসপ্রুডেন্সের ওপর বই লেখার আহ্বান প্রধান বিচারপতির
বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস এসোসিয়েশনের সভাপতি নাসির মহাসচিব নেওয়াজ
খালেদা জিয়ার সঙ্গে কর্নেল অলির সাক্ষাৎ
বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকালে বিজিবি হেফাজতে ৩৬ মিয়ানমার নাগরিক
মির্জাপুর উপজেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক জাহাঙ্গীর মৃধার পদ স্থগিত
ড্রাম ট্রাকের সামনের চাকা ফেটে গিয়ে দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে আহত ২