স্বৈরাচারের পতনে অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে
২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ এএম | আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৬ এএম
এটা স্বীকার্য দেশের বিভিন্ন আন্দোলনে আওয়ামী লীগের অবদান রয়েছে। তবে শাসন ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ সবসময়ই স্বৈরাচারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। বিগত প্রায় ১৬ বছরের কথাই ধরা যাক। এ সময়জুড়ে আওয়ামী লীগ একটি স্বৈরতন্ত্র কায়েম করেছিল। ২০১৪ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়াই জোর করে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রেখেছিল। তার এই ক্ষমতার লোভ দেশের গণতান্ত্রিক সকল প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করেছিল। বিচার ও শাসন ব্যবস্থার কবর রচনা করেছিল। উন্নয়নের ফানুস দেখিয়ে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছিল। পাচার করা টাকা দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা বিদেশে বেগম পাড়া তৈরি করেছিল। এক কথায়, একটি দেশের যাবতীয় আর্থিক, বিচারিক, প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা ভেঙে দিয়েছিল। দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে পঙ্গু করে দিয়েছিল। শেখ হাসিনার কথাবার্তায় তাঁকে একটি গ্রাম্য মূর্খ ঝগড়াটে মহিলা বলেই মনে হতো। তাঁর বাচনভঙ্গিতে প্রতিশোধের আগুনের ফুলকি বের হতো। প্রতিশোধের এ আগুনের ফুলকি শেখ হাসিনাকে ভয়ংকর এক ফ্যাসিবাদী রাক্ষসে রূপান্তরিত করেছিল। প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসে বিরোধীদলকে নির্মূল করার প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা! শেখ হাসিনা ছিলেন রাজনৈতিক নিপীড়ক, অর্থনৈতিক শোষক এবং সাংস্কৃতিক ঘাতক। তিনি দেশবাসীকে ভারতীয় দাস বানানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। গোটা দেশবাসীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সকল যন্ত্র ব্যবহার করেছিলেন। বিরোধী যে কোনো চ্যালেঞ্জিং ব্যক্তি ও দলকে ঘায়েল করতে গুমবাহিনী তৈরি করেছিলেন। তৈরি করেছিলেন আয়না ঘরখ্যাত ভয়ংকর টর্চার সেল। এটি ছিল ভয়ংকর এক অন্ধকার ও বিভীষিকাময় দুনিয়াবি জাহান্নাম । তাঁর সাথে চ্যালেঞ্জিং যে কোনো বিরোধী ব্যক্তিকে এ জাহান্নামে ঢুকিয়ে কুরে কুরে তার জীবনটাকে ধ্বংস করে দিতেন। জনগণের কান্নারও কোনো অধিকার ছিল না দেশে। জনগণের কষ্ট প্রকাশ করার মাধ্যম ছিল শুধু বোবা কান্না।
শেখ হাসিনা দেশে ভয়ানক এক সন্ত্রাসী মিডিয়া সিন্ডিকেট তৈরি করেছিলেন। এ সিন্ডিকেটের চেইন অব কমান্ড ছিল মজবুত ও শক্তিশালী। তারা এই চেইন অব কমান্ডের অধীনে কাজ করতো। কর্মরত এসব মিডিয়াকর্মী ছিল শেখ হাসিনা সরকারের পোষা গোলাম। এ গোলামগুলোর অপপ্রচার ছিল সুপরিকল্পিত এবং অকল্পনীয়। বলা বাহুল্য যে, শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ ছিল মূলত ভারতের বিশ্বস্ত অনুচর। ভারতের এজেন্ডাই ছিল শেখ হাসিনার এজেন্ডা। আর এ এজেন্ডা বাস্তবায়নে সহায়তা করতো সাংবাদিক নামের পোষা এ গোলামেরা। এসব গোলাম অবশ্য ভারতীয় ‘র’ পক্ষেই কাজ করতো। ‹র› এর নেতৃত্বে দেশে মাঝে মাঝেই জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ হতো। ভারত ও আওয়ামী লীগের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে মাঝে মাঝেই তারা এ নাটক মঞ্চায়ন করতো। আর এ নাটকের মূল পরিচালক ও প্রযোজক ছিলেন শেখ হাসিনা। অভিনেতা হিসেবে অভিনয় করতো সাংবাদিক, পুলিশ ও র্যাবসহ বিভিন্ন বাহিনীর সদস্যরা।
দেশের পুলিশ, বিজিবি, র্যাব এবং আনসার বাহিনীকে শেখ হাসিনা দলীয় বাহিনীতে পরিণত করেছিলেন। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীকে আওয়ামী বাহিনী বানানোর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। এসব বাহিনীর পেশাদারিত্বের কবর রচনা করেছিলেন শেখ হাসিনা। সেনাদের একাংশের সক্রিয় সহযোগিতায় শেখ হাসিনা গড়ে তুলেছিলেন ভয়ংকর এক সন্ত্রাসী জগত। বাংলাদেশের গোটা প্রশাসন ছিল আওয়ামী কর্তৃত্ববাদের বিশাল এক সাম্রাজ্য। সামরিক, বেসামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য নিয়ে গড়ে উঠেছিল এ সাম্রাজ্য। গড়ে ওঠা এ সাম্রাজ্য পরিচালিত হতো ফরিদপুর এবং গোপালগঞ্জের ক্যাডার বাহিনী দ্বারা। সাম্রাজ্যের সম্রাজ্ঞী ছিলেন শেখ হাসিনা নিজে। এ সাম্রাজ্যে সৃষ্টি হয়েছিল ভয়ংকর ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন। ফ্যাসিবাদী শাসনের যাতাকলে নিষ্পেষিত হচ্ছিল বাংলার আঠারো কোটি মানুষ। দেশের যেকোনো ঘটনায় শেখ হাসিনা খুব জোরে শোরে ৭১কে সামনে নিয়ে আসতেন। ৭১কে পুঁজি করেই আওয়ামীরা প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করতো। বিরোধীদলের উপর দমন পীড়ন চালাতেন। দেশে তারা বিভক্তির বীজ বপন করেছিল। রাজাকার, যুদ্ধাপরাধী ও জঙ্গি ধুয়া তুলে গোটা দেশকে তারা দুইভাগে বিভক্ত করেছিল। দেশের সবচেয়ে বড়ো গণতান্ত্রিক দল হলো বিএনপি। বিএনপিকেও তারা স্বাধীনতা বিরোধী তকমা দিয়ে সীমাহীন অত্যাচার চালাতো। মিথ্যা অভিযোগে জামায়াতে ইসলামীর উপর তারা অমানবিক ক্রাকডাউন চালিয়েছে। এ দলের শীর্ষস্থানীয় নেতাদেরকে তারা জুডিশিয়াল কিলিং করেছে। আলেমদের তারা জেলে ঢুকিয়েছে। হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে রাতের অন্ধকারে ক্রাকডাউন চালিয়ে শতশত নিরীহ আলেমকে হত্যা করে লাশ পুড়িয়ে দিয়েছে। এতকিছুর পরও আওয়ামী নেতাদের চাপাবাজি ও গলাবাজি বন্ধ ছিল না। গলাবাজি ও চাপাবাজিতে আওয়ামী লীগের নেতারা ছিল চ্যাম্পিয়ন। এ চাপাবাজির মূল লক্ষ্য ছিল তাদের অপরাধকে আড়াল করা। তারা মিথ্যা জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ করে দেশবাসীকে সেদিকে ব্যস্ত রাখতো। আর নিজেরা লুটপাট করে দেশের অর্থ বিদেশে পাচার করতো।
এতকিছু করেও শেখ হাসিনার শেষ রক্ষা হয়নি। ৫ আগষ্ট ২০২৪ তারিখে তিনি পালিয়ে কোনো রকম জীবন বাঁচিয়েছেন। দলের শীর্ষস্থানীয় থেকে তৃণমূল পর্যায়ের নেতারা পর্যন্ত গা ঢাকা দিয়েছে। ঘটনার সূত্রপাত কোটা বিরোধী আন্দোলনকে ঘিরে। শিক্ষার্থীরা শুরুতে কোটা বিরোধী আন্দোলন শুরু করে। শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদেরকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেন। রাজাকারের বাচ্চা বলে শিক্ষার্থীদেরকে গালাগালি করেন। শিক্ষার্থীরা তখন তার এ কথা উইড্র করতে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করে। তাঁকে ক্ষমা চাওয়ার জন্য শুরু হয় নতুন আন্দোলন। এক পর্যায়ে আন্দোলন শেখ হাসিনার পদত্যাগের এক দফা দাবিতে রূপ নেয়। এ আন্দোলনে সারা দেশের মানুষ অংশগ্রহণ করে। কোটি কোটি মানুষের বাঁধভাঙ্গা জোয়ারে ভীত হয়ে ওঠে স্বৈরাচার ও তার দোসররা। অবস্থা আঁচ করতে পেরে আগেভাগেই দেশ থেকে পালিয়ে যায় স্বৈরাচারের সহযোগি নেতাকর্মীরা। হাসিনার আশ্রিত পুলিশ বাহিনী ছাত্রদের উপর বেপরোয়া গুলি বর্ষণ করে। হাজার হাজার ছাত্র পঙ্গুত্ব বরন করে। দুই হাজার কিশোর শাহাদাত বরণ করে। এ সময়ের মধ্যে ক্যান্টনমেন্ট, গণভবন এবং বঙ্গভবনে অনেক অজানা ঘটনা ঘটে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতা গণভবন ঘেরাও করে। শেখ হাসিনা অবশেষে প্রাণ বাঁচাতে হেলিকপ্টার যোগে ভারতে পলায়ন করেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগের সাঙ্গোপাঙ্গরা আত্মগোপনে রয়েছে। অনেককে গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারের পর একে একে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে তাদের লুটপাটের ফিরিস্তি।
নিবন্ধের শেষের দিকে বলতে চাই, ৫ তারিখ সকালেও কেউ অনুমান করতে পারেনি যে, হাসিনার মতো বেপরোয়া স্বৈরাচার এভাবে পালিয়ে যাবে। কিন্তু যা হবার তাই হলো। কোনো অপপ্রচার কাজে এলো না। অপপ্রচার, অপবাদ এবং পেশি শক্তি কাঁচের ঘরের মতো ভেঙে গেল। সুতরাং আগামী দিনের শাসকদের শেখ হাসিনা থেকে শিক্ষা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, অপপ্রচার, অপবাদ ও সন্ত্রাস ধান্দাবাজদের হাতিয়ার। এটা বেশিদিন টেকসই হয় না। শেখ হাসিনা সারাজীবন ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিলেন। বিরোধীদের দমনে হাতিয়ার হিসেবে অপপ্রচার এবং সন্ত্রাস বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু তার শেষ রক্ষা হয়নি। নিরস্ত্র কিশোর-কিশোরীদের হাতেই তার লজ্জাজনকভাবে ধরাশায়ী হতে হয়েছে। সময়ের অভাবে দুপুরের জন্য রান্না করা খাবারটিও খওয়া সম্ভব হয়নি। পরিশেষে বলা যায়, যাদের কাছে কোনো আদর্শ নেই তাদের একমাত্র অবলম্বন হলো সন্ত্রাস এবং অপপ্রচার, যা গুণগত ও মানগতভাবে দুর্বল। তা টেকসই হয় না।
লেখক: অধ্যাপক, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
Email: [email protected]
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
বাগেরহাট জেলা হাসপাতালে দুদকের অভিযান, মিলেছে নানা অনিয়মের প্রমাণ
ফাঁকা বাসায় ডেকে নিয়ে চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রীকে ধর্ষণ চেষ্টা, অতঃপর
মাদক ব্যবসায়ের অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হলেন শিক্ষক
সোনারগাঁওয়ে স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রধান কার্যালয় উদ্বোধন
চাটখিলে থানার পুকুরে পড়ে ছিল লুট হওয়া চায়না রাইফেল
২৬ জানুয়ারি গুলশান-২ এলাকা এড়িয়ে চলার অনুরোধ
লাকসামে সমবায়ের বার্ষিক সাধারণ সভায় -এড.সুজন
সৈয়দপুরে ঘন কুয়াশার কারনে বিমান ওঠা-নামা বন্ধ
ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যে রাজনৈতিক দল ঘোষণা: আখতার হোসেন
সৈয়দপুরে ঘন কুয়াশার কারনে বিমান ওঠা-নামা বন্ধ
কুয়াশার চাদরে ঢাকা সিলেটে, শীতের দাপটে কাহিল জনজীবন
মুজিবনগর উপজেলা বিএনপির কর্মী সমাবেশ
দিরাই সরমঙ্গল ইউপি চেয়ারম্যান জুয়েল সাময়িক বরখাস্ত
আপিল আবেদনের অনুমতি পেল চ্যানেল ওয়ান
নির্মম নির্যাতনে লিবিয়ায় মারা গেলো মাদারীপুরের রাকিব
শ্রীপুরে বাল্যবিয়ের অপরাধে বরসহ দুজনের কারাদণ্ড
সব প্রার্থীর এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দিতে চায় ইউএনডিপি
জিয়াউর রহমানের ১৯ দফার উপর ভিত্তি করে তারেক রহমান দিয়েছেন ৩১দফা: শামা ওবায়েদ
লক্ষ্মীপুরের মান্দারীতে দুই হোটেল মালিকের জরিমানা
নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আরেকটা ১/১১ এর ইঙ্গিত বহন করে : উপদেষ্টা নাহিদ