শবে মিরাজ

Daily Inqilab আফতাব চৌধুরী

২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১২ এএম | আপডেট: ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:১২ এএম

শেষ নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.)-এর জাগ্রত অবস্থায় সশরীরে রাত্রিকালীন ঊর্ধ্বলোকে ভ্রমণের ঐতিহাসিক ঘটনার নাম মিরাজ। এটি ইসলামের উল্লেখযোগ্য চমকপ্রদ ঘটনা। নির্ভরযোগ্য মতানুযায়ী, তায়েফ থেকে ফেরা এবং মদিনা শরিফে হিজরত করার মধ্যবর্তী সময়ে রজব মাসের ২৭ তারিখ এই মিরাজ সম্পন্ন হয়। এই ভ্রমণকে দু’ভাগে ভাগ করা হয়। মক্কা শরিফের মসজিদে হারাম থেকে ফিলিস্তিনের বায়তুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত প্রথম ভাগ এবং সেখান থেকে সোজা উপরদিকে লা-মাকানের ভ্রমণ হলো দ্বিতীয় ভাগ। প্রথম ভাগকে আসরা এবং দ্বিতীয় ভাগকে মিরাজ বলা হয়। পরিভাষাগত অর্থে পুরো যাত্রাটিই হলো মিরাজ।

হযরত মোহাম্মদ (সা.) রাতে ঘুমিয়েছিলেন। জিবরিল আমিন এসে তাঁকে জাগ্রত করেন। তাঁর বক্ষ বিদীর্ণ করে জমজমের পানি দ্বারা অন্তরকে ধুয়ে দেন। এরপর বোরাক নামের বাহনযোগে বায়তুল মোকাদ্দাস পর্যন্ত নিয়ে যান। সেখানে পূর্ববর্তী নবীগণ অভ্যর্থনা জানানোর জন্য অপেক্ষারত ছিলেন। ফিরিশতা জিবরিল (আ.)-এর ইশারায় মহানবী (সা.) এই জামাতের ইমামতি করেন। আর এতে কার্যত অন্যান্য নবীরা এখানে শেষ নবীকে তাঁদের নেতা হিসাবে বরণ করে নেন। কুরআন শরিফের ‘লাতুয় মিনুন্না বিহি ওয়ালা তানসুরুন্নাহু’ বলে নবীদের জন্মের আগে তাঁদের কাছ থেকে মহানবী (সা.)-কে বিশ্বাস ও সাহায্য করার যে শপথ গ্রহণ করা হয়েছিল, মহানবীর নেতৃত্বে সকল নবীর নামাজ আদায় করার মধ্য দিয়ে তা-ই বাস্তবায়িত হলো। এরপর মিরাজ বা ঊর্ধ্ব আরোহণের সূচনা। আকাশে তখন বিশিষ্ট নবীগণ তাকে অভিনন্দন জানান। প্রথম আকাশে আদি পিতা হযরত আদম (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। তারপর পর্যায়ক্রমে অন্যান্য আকাশে অন্যান্য নবীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। যেমন, দ্বিতীয় আকাশে হযরত ঈসা, তৃতীয় আকাশে হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়। হযরত ইব্রাহিম (আ.) মর্যাদাসম্পন্ন ‘খলিলুল্লাহ’ উপাধি অর্জন করার ফলে সপ্তম আকাশে অবস্থান করেন। কিন্তু খলিলুল্লাহ’র চেয়েও বড় উপাধি হলো হবিবুল্লাহ। তাই শেষনবী সপ্তম আকাশের আরও ঊর্ধ্বে ওঠার সৌভাগ্য লাভ করেন।

মহানবী (সা.) বলেন, আমি ঊর্ধ্বলোকে যাওয়ার পথে ইব্রাহিম (আ.)-কে সপ্তম আকাশে অবস্থিত বায়তুল মা’মুরের সঙ্গে হেলান দিয়ে বসা অবস্থায় দেখেছি। তিনি আরও বলেন, বায়তুল মা’মুর সম্বন্ধে আমি জিবরিলকে জিজ্ঞেস করলাম যে, এটা কী? তিনি বললেন, এটা ফিরিশতাদের কিবলা। এখানে প্রতিদিন সত্তর হাজার ফিরিশতা সালাত আদায় করেন। যাঁরা একবার এই ইবাদত করে চলে যান, কেয়ামতের আগে তাঁরা আর সুযোগ পাবেন না। মহানবী (সা.) বলেন, অতঃপর আমাকে সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয়। আরবি ভাষায় কুল বা বরই গাছকে সিদরাতুন বলা হয়। আর মুনতাহা মানে শেষ। শাব্দিক অর্থে সিদরাতুল মুনতাহা অর্থাৎ শেষ প্রান্তের বরই গাছ। প্রশ্ন হলো, শেষ প্রান্ত বলতে কী বোঝায়? বিভিন্ন বর্ণনা মতে, ফিরিশতাদের জ্ঞানের পরিধি এ বৃক্ষ পর্যন্ত এবং শেষনবী ছাড়া অন্যান্য নবীদের শেষ পরিসীমা হলো এ বৃক্ষ। এছাড়া নি¤œভূমি থেকে যা কিছু ঊর্ধ্বগামী হয়, সব এ বৃক্ষ পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকে। এসব কারণেই একে সিদরাতুল মুনতাহা বা শেষপ্রান্তের বরই গাছ বলা হয়। এরপর প্রিয়নবী (সা.) আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেন। জান্নাত, জাহান্নাম, আরশ, কুরসি, লৌহ, কলম ইত্যাদি অদৃশ্য জগতের অচিন্তনীয় বহু কিছু পরিদর্শন করেন। সবশেষে তিনি ফিরে আসেন মক্কা শরিফের সেই পবিত্র ভূমিতে। যেখানে থেকে ভ্রমণের সূচনা করেছিলেন।

মহানবী (সা.)-এর আসরা ও মিরাজ কোনও অবস্থাতেই আত্মিক বা স্বপ্নযোগে ছিল না। ছিল সজাগ, সজ্ঞানে ও সশরীরে, যা কোরআন-হাদিস ও ঐতিহাসিকদের বর্ণনা দ্বারা প্রমাণিত। এতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। কোরআন শরিফে ওই মিরাজ সম্পর্কিত আয়াতে ‘আবদ’ শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে। আত্মা ও দেহÑ এ দু’টির সমষ্টিকে আবদ বা ব্যক্তি বলা হয়। এতেই প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ তাঁর বান্দাহকে সশরীরে নিজের কাছাকাছি নিয়ে গেছেন। প্রিয়নবী (সা.)-কে প্রথমেই পরমার্শ দেওয়া হয়েছিল, মিরাজের ঘটনাটি প্রকাশ না করার জন্য। কারণ, এত আশ্চার্জনক ঘটনা হয়তো কেউ বিশ্বাস করবে না। পরে যখন জানাজানি হয়ে যায়, তখন বিরোধীরা ঠাট্টাবিদ্রুপ শুরু করে। কিছু মুসলমান মিরাজের ঘটনা অস্বীকার করে ধর্মত্যাগী হয়ে যায়। ব্যাপারটা যদি স্বপ্নের হতো, তবে এতসব বাকবিত-ার মোটেই প্রয়োজন ছিল না।

আজকের বিজ্ঞানের যুগে মানুষ গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে চষে বেড়াচ্ছে। দেড় হাজার বছর আগে মহানবী (সা.) যেসব বাণী প্রদান করে গেছেন, তাই এখন বিজ্ঞানের হাত ধরে বাস্তবায়িত হচ্ছে। সহজ কথায়, বিজ্ঞানের গবেষণা সবেমাত্র শুরু হয়েছে। এ যুগের বিজ্ঞানীরা যদি রকেটের সাহায্যে আকাশে ভ্রমণ করতে পারেন, মাসের পর মাস সেখানে আত্মা ও দেহ নিয়ে অবস্থান করতে পারেন, তা হলে শ্রেষ্ঠ নবীর আকাশ ভ্রমণ অস্বীকার করবেন কোন যুক্তিতে? এ যুগের চন্দ্র অভিযানকে যদি বিজ্ঞানের চমকপ্রদ ঘটনা মনে করা হয়, তবে শেষ নবীর চন্দ্র দ্বিখ-িত করার ঘটনা মিথ্যা মনে করবেন কোন বিবেচনায়? মিরাজ বিষয়ে সময়ের প্রশ্নটা অত্যন্ত জটিল।

মক্কা শরিফ থেকে বায়তুল মোকাদ্দাস এবং সেখান থেকে সোজা উপরদিকে সেই উঁচু মাকাম ‘ছারিফল আকলাম’ (ফিরিশতাদের লেখালেখির আওয়াজ)-এর স্তর পর্যন্ত বা আরও উপরে পৌঁছে সব কাজ সেরে ফিরে আসতে কত সময় লেগেছিল? এ এক বিরাট প্রশ্ন। এই দীর্ঘ পথের দূরত্বে কত হাজার না কত লক্ষ মাইল, কে জানে। অথচ, একই রাতের কিছু সময় ব্যয় হয়েছে মাত্র, তা কী করে? এখানে সহজ উত্তর এই যে, সূর্য ও পৃথিবীর দূরত্ব কয়েক লক্ষ মাইলের কম নয়। তবু সূর্য উদিত হলে তার আলো পৃথিবীতে পৌছে যায় এক নিমিষে। মিরাজের ব্যাপারটা এরকমই। অতিদ্রুত গতিসম্পন্ন বোরাক নামের বাহনযোগে ‘নুর’ বা আলোর তৈরি নবী (সা.) এর সফর বলে কথা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যুগে এ বিষয়টি অস্বীকার করার জো নেই। এ কথাটিও স্মরণ করা যেতে পারে যে, সাধারণ বিলকিসের সিংহাসন চোখের পলকে যদি বহু দূর নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়, তা হলে আদমসন্তানদের সর্দার নবী (সা.) এর ঊর্ধ্ব আরোহণ কেন এক পলকে সম্ভব হবে না? অন্যদিকে, সময় ও দূরত্বের সৃষ্টিকর্তা ও মিরাজের আহ্বায়ক তো আল্লাহ। যিনি তাঁর প্রিয় মাহবুবের জন্য সবকিছু সংকুচিত করাও অসম্ভব নয়।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

অর্থনীতি যেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে
অপারেশন ডেভিল হান্টের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার্য
পতিত স্বৈরাচার ও ভারতের পাতা ফাঁদে পা দেয়া যাবে না
সড়ক মেরামত প্রসঙ্গে
সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে জাতি ঐক্যবদ্ধ
আরও

আরও পড়ুন

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ! পাল্টা হুঁশিয়ারি চীনের

তাইওয়ান প্রণালীতে মার্কিন যুদ্ধজাহাজ! পাল্টা হুঁশিয়ারি চীনের

চার লাল কার্ডের ম্যাচে লিভারপুলকে রুখে দিল এভারটন

চার লাল কার্ডের ম্যাচে লিভারপুলকে রুখে দিল এভারটন

রিজওয়ান-সালমানের অনবদ্য সেঞ্চুরিতে পাকিস্তানের রান তাড়ার রেকর্ড

রিজওয়ান-সালমানের অনবদ্য সেঞ্চুরিতে পাকিস্তানের রান তাড়ার রেকর্ড

কফিন কাঁধে মিছিল, আ.লীগ নিষিদ্ধ চাইল ছাত্র-জনতা

কফিন কাঁধে মিছিল, আ.লীগ নিষিদ্ধ চাইল ছাত্র-জনতা

শিরোপার স্বপ্ন নিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশ

শিরোপার স্বপ্ন নিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাংলাদেশ

মেয়েদের ক্রিকেট

মেয়েদের ক্রিকেট

এতীমের মা খ্যাত ফুলতলীর বড় ছাহেবের সহধর্মিণীর জানাযায় মানুষের ঢল : বিভিন্ন মহলের শোক

এতীমের মা খ্যাত ফুলতলীর বড় ছাহেবের সহধর্মিণীর জানাযায় মানুষের ঢল : বিভিন্ন মহলের শোক

নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া কেউ সংবিধান সংশোধন করতে পারে না

নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ছাড়া কেউ সংবিধান সংশোধন করতে পারে না

মুন্সীগঞ্জে থেমে থাকা বাসে আগুনে ঘুমন্ত হেলপারের মৃত্যু

মুন্সীগঞ্জে থেমে থাকা বাসে আগুনে ঘুমন্ত হেলপারের মৃত্যু

ডেভিল হান্টে ধরা আরো ৫৯১ জন

ডেভিল হান্টে ধরা আরো ৫৯১ জন

ডেভিল হান্ট অপারেশনে আশানুরূপ অস্ত্র উদ্ধার হয়নি :গাজীপুরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

ডেভিল হান্ট অপারেশনে আশানুরূপ অস্ত্র উদ্ধার হয়নি :গাজীপুরে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

পুলিশে আস্থা ফেরাতে ডিসিদের প্রস্তাব

পুলিশে আস্থা ফেরাতে ডিসিদের প্রস্তাব

বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য মৃৎশিল্প

বিলুপ্তির পথে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য মৃৎশিল্প

নাফিজের নিথর দেহের সেই ছবির স্কেচ জাতিসংঘের প্রতিবেদনের প্রচ্ছদে

নাফিজের নিথর দেহের সেই ছবির স্কেচ জাতিসংঘের প্রতিবেদনের প্রচ্ছদে

তিন ফুট বাই এক ফুটের সেল, টয়লেট ও বিছানা

তিন ফুট বাই এক ফুটের সেল, টয়লেট ও বিছানা

আয়নাঘরেও উল্টো ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয় মাজেদকে

আয়নাঘরেও উল্টো ঝুলিয়ে নির্যাতন করা হয় মাজেদকে

৭০০ থেকে ৮০০ আয়নাঘর থাকতে পারে সারা দেশে :প্রেস সচিব

৭০০ থেকে ৮০০ আয়নাঘর থাকতে পারে সারা দেশে :প্রেস সচিব

‘আয়নাঘর’ বীভৎস দৃশ্য দেখলেন ড. ইউনূস

‘আয়নাঘর’ বীভৎস দৃশ্য দেখলেন ড. ইউনূস

মানবাধিকারের চরম লংঘনকারী হাসিনা

মানবাধিকারের চরম লংঘনকারী হাসিনা

রক্তের দাগ মুছার আগেই আওয়ামী লীগ নেতা মৌলভীবাজার আইনজীবী সমিতির সভাপতি প্রার্থী

রক্তের দাগ মুছার আগেই আওয়ামী লীগ নেতা মৌলভীবাজার আইনজীবী সমিতির সভাপতি প্রার্থী