নেতাকর্মীদের বিতর্কিত ভূমিকার বিরুদ্ধে বিএনপিকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে
২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৪ এএম
![](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2025January/1-20250128210459.jpg)
ক্ষমতাসীন আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কার্যকর আন্দোলন গড়ে তুলতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যর্থতার কারণে পরপর তিনটি ভুয়া নির্বাচন করে পার পেয়ে গিয়েছিল। হাজার হাজার মামলায় বিএনপি-জামায়াতের লাখ লাখ নেতাকর্মী অনেকটা পালিয়ে বেড়ানোর মতো জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিল। গণতান্ত্রিক রাজনীতি করার সুযোগ দলবাজ পুলিশের অনুমতি-অনুমোদনের উপর ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। দেশের সবচেয়ে বড় জনসমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দল বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছিল পুলিশ। বছরের পর বছর ধরে তারা দেশের কোথাও কোনো সভা-সমাবেশ করার অনুমতি পায়নি। মাঝে মধ্যে হঠাৎ পুলিশের শর্তসাপেক্ষে দু’একটি সভাসমাবেশ করার অনুমতি দেয়া হলেও সেখানে অর্ক্রেস্টেড সাবোট্যাজ সৃষ্টি করে, হাজার হাজার নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা সাজিয়ে শত শত কোটি টাকার গ্রেফতার বাণিজ্যের মৌরসিপাট্টা ছিল পুলিশের রাতারাতি ধনী হওয়ার আয়োজন। গুম-খুন, জঙ্গি নাটক, ক্রসফায়ার নাটক করে ওসি প্রদীপ, তারেক সাইদ, বিপ্লব কুমাররা একেকজন হাজার কোটি টাকার সম্পদ বিদেশে পাচার করেছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ ও আত্মপরিচয়ের চেতনাকে মুছে দিতে বিরোধীমত দমন ও মানবাধিকার হরণের বিরুদ্ধে শুরুতেই সর্বশক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়াতে পারলে জাতির এতবড় ক্ষতি ও খেসারত দিতে হতো না। দেড় দশক ধরে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিরুদ্ধে নির্যাতন নিপীড়নের স্টিমরোলার চালানোর সুযোগ তারা কিভাবে পেল? বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা এই প্রশ্ন দলীয় ফোরামে তোলার সুযোগ পেলে এবং তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজলে তাদের আন্দোলনেই রাজপথে স্বৈরাচারের পতন ঘটানো যেত। হামলা-মামলার ভয় উপেক্ষা করে অল্প সময়ের নোটিশে বিএনপির নেতাকর্মীরা বিভাগীয় শহরগুলোতে লাখ লাখ মানুষের সমাবেশ ঘটিয়ে চমক সৃষ্টি করতে পারলেও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মীদের মতো কৌশলি কর্মসূচির মাধ্যমে সরকারকে কোনঠাসা করতে না পারার ব্যর্থতা মূলত দেশে অবস্থানরত দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের। দুর্জনেরা বলেন, তাদের অনেকের সাথে ডিজিএফআই’র হট কানেকশন ছিল, কোনো গোপন সভায় গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণের কয়েক মিনিটের মধ্যেই তা ফাঁস হয়ে যাওয়ার কারণেই কোনো আন্দোলন সফল হয়নি। এর ফলে গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কর্মসূচি বাস্তবায়নের দায়িত্বে থাকা গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের গ্রেফতার কিংবা গোপণ সমঝোতার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া ছাত্রদের আন্দোলন রাজপথে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে রূপ নেয়ার আগে এর সম্ভাব্য ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক ও বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়গুলো যদি আগেই ফাঁস হয়ে যেত, তাহলে এ আন্দোলনও অভ্যুত্থানে রূপ নিত না। যেকোনো প্রতিরোধের মুখে ছাত্র-জনতা বুক পেতে এগিয়ে যাওয়ার মত সাহস দেখাতে না পারলে ক্যান্টনমেন্টের বিশেষ সমাবেশে সামরিক বাহিনীর মধ্য সারির অফিসাররা আন্দোলন দমাতে বল প্রয়োগের সম্ভাব্য পরিনতি সম্পর্কে এমন উদ্বিঘœ হতেন না এবং সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদি ভূমিকা পালন করতেন না। দেশের জন্য, স্বৈরাচার হটানোর জন্য ছাত্র-জনতার রক্ত দেয়ার সংকল্পকে কেউ কখনো দাবিয়ে রাখতে পারেনি।
পতিত স্বৈরাচার পালিয়ে যাওয়ার পরও তার প্রেতাত্মারা এখনো আমাদের রাজনীতি এবং প্রশাসনে বিরূপ প্রভাব রেখে চলেছে। ঔপনিবেশিক আমল থেকেই রাষ্ট্রের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার হরণ এবং তাদের ঐক্যবদ্ধ শক্তির জাগরণকে দাবিয়ে রাখার মূল কৌশল হচ্ছে ক্ষুদ্র ও ক্ষীণ স্বার্থ সংশ্লিষ্ট মতপার্থক্যকে সামনে রেখে পরস্পরের মধ্যে বিভেদ-বৈরিতাকে সংঘাত-সহিংসতায় পরিনত করা। আন্তর্জাতিক-আঞ্চলিক পরিমন্ডল থেকে দেশের জাতীয় রাজনীতি, এমনকি ভিলেজ পলিটিক্সেও এই পলিসির প্রয়োগ চলছে। রিকনসিলিয়েশনের মাধ্যমে অনেক সমস্যার সমাধান করে রাষ্ট্র ও সমাজকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হলেও পর্দার অন্তরালে থাকা আধিপত্যবাদী ও গণশত্রুরা ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসির মাধ্যমে গ্রাম- মহল্লা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দল ও জাতীয় রাজনীতিকে অশান্ত, অনিশ্চিত ও কলুষিত করে রেখেছে। প্রকাশ্য রাজপথে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করেও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। তার আগে ১৫ বছর ধরে জুডিসিয়াল কিলিং, গুম-খুন, হামলা-মামলার পাশাপাশি বিএনপি-জামাতের শীর্ষ নেতাদের নানাবিধ প্রলোভন দেখিয়েও দুই প্রধান দলের জোটবদ্ধ রাজনীতির ঐক্য ভাঙতে পারেনি। কিন্তু ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পর বহুল প্রত্যাশিত গণতন্ত্র ও রাষ্ট্র মেরামতের গণদাবি পুরণ কল্পে সংবিধান সংশোধন ও প্রশাসনিক আইনের সংস্কারের প্রশ্নে এমন মতবিরোধ, নির্বাচনের জন্য অস্বাভাবিক চাপ সৃষ্টি এবং মতবিরোধ দেখা যাচ্ছে কেন? বিএনপি-জামায়াতের ঐক্য অটুট রাখা বেগম খালেদা জিয়া এবং তারেক রহমানের রাজনৈতিক দূরদর্শিতার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মূল সমন্বয়ক তথা ছাত্র প্রতিনিধিরা যখন ফ্যাসিবাদী সংবিধান পরিবর্তন ও রাষ্ট্র সংস্কারের ইস্যুগুলোকে বাস্তবায়ন করতে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অর্ন্তবর্ত সরকারের নির্দলীয়-নিরপেক্ষতার ভাবমর্যাদা ও কর্মক্ষমতাকে কাজে লাগাতে চাইছে, ৬টি সংস্কার কমিশনের মধ্যে ইতোমধ্যে ৪টির প্রস্তাব জমা পেড়েছে এবং বাকি দু’টির প্রস্তাবও শেষের দিকে। শিক্ষা সংস্কার কমিশনের মত অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ এখনো নেয়া হয়নি। স্বৈরাচার পতন ও পলায়নের পর প্রায় ৬ মাস পেরিয়ে গেলেও রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যথাযথ শৃঙ্খলা ও শক্তিমত্তায় ফিরিয়ে আনতে না পারা সরকারকে অনেক বড় চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছে। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পতিত আওয়ামী লীগের দোসর ও ভারতীয় এজেন্টরা যখন নানাবিধ ষড়যন্ত্রের জাল বিছিয়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে, তখন বিএনপি’র কতিপয় নেতার কিছু মন্তব্য, কথাবার্তা ও আচরণকে সাধারণ মানুষ ও নেতাকর্মীরা সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছে। তিনবার ক্ষমতায় গিয়েও যারা বাহাত্তরের সংবিধান পরিবর্তন করে দেশে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি। ধরে নেয়া যায়, সেসব ব্যর্থতার পেছনে ভারতীয় আধিপত্যবাদের রাজনৈতিক ও আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণমূলক নাগপাশ বড় শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। পরিনর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় অর্ন্তবর্তী সরকার ভারতের সাথে চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছে। ভারতীয় প্রপাগান্ডা, হুমকি, নিষেধাজ্ঞা ও ডিস্ট্যাবিলাইজেশনের ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করে সংবিধানসহ গণতান্ত্রিক সংস্কার, নির্বাচন ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের কাজগুলো এগিয়ে নিতে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো সমর্থন দিয়ে সরকারের পাশে থাকলেই কেবল সে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব।
নিজেদের জীবন বিপন্ন করে আন্দোলকে প্রবল রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানের পথে এগিয়ে নেয়ার রূপকার ছাত্র সমন্বয়ক যখন গণহত্যাকারিদের বিচার ও রাষ্ট্র সংস্কারকে তাদের মূল অগ্রাধিকার এজেন্ডা হিসেবে গ্রহণ করেছেন, তখন এতদিনের ঐক্যবদ্ধ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনৈক্য-অবিশ্বাস ও বৈরীতার সাথে সাথে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের সাথে আপস এবং তাদের রেখে যাওয়া বন্দোবস্ত টিকিয়ে রাখার পক্ষে কথা বলতে শোনা যাচ্ছে। গত নভেম্বরে ছাত্র সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেছিলেন, ‘রাজনীতিবিদরা হাত মেলাচ্ছে, বিপ্লবীদের ফাঁসির দড়ি এগিয়ে আসছে’ অর্ন্তবর্তী সরকার এবং রাজনৈতিক পক্ষগুলোর কর্মকা-ে ভীত হয়েই তিনি এ কথা বলেন। তাঁর এই বক্তব্যের পর ইতিমধ্যে আরো দুই মাস পেরিয়ে গেছে। প্রত্যাশিত সংস্কার ও পরিবর্তনের ধারা ধীর হলেও দেশের সামগ্রিক অবস্থা অবনতিশীল নয়। উন্নয়ন অংশীদারিত্ব ও অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ড. ইউনূসের উজ্জ্বল উপস্থিতি এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার মত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে অর্ন্তবর্তী সরকারের অটল অবস্থান জনমনে আস্থার জন্ম দিয়েছে। আর ভারতীয় এজেন্ট ও রাষ্ট্রবিরোধী পক্ষ রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে অনাস্থা ও বৈরিতা গ্যাঁড়াকলে ফেলে দেশকে একটি অনিশ্চয়তার মধ্যে নিক্ষেপ করতে চাচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদের পতন ও পালিয়ে যাওয়ার পর আগামী জাতীয় নির্বাচনে যে দলটির বিজয় প্রায় নিশ্চিত, সে দলটির কতিপয় নেতার কথাবার্তায় আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সাথে সমঝোতা ও ভারতীয় দালালদের অনুরূপ কন্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। তারা বুঝতেই পারছেনা, গত ১৬ বছর আওয়ামী ফ্যাসিবাদিরা যে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ন্যারেটিভ প্রচার করে দেশে জুডিসিয়াল কিলিং, গুম-খুন, গণহত্যার রাজনীতি চালু করেছিল, তা জনগণ গ্রহণ করেনি। এমনকি আওয়ামী লীগের সাধারণ সমর্থকরাও তাদের এহেন আচরণকে সমর্থন করতে পারেনি। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে দেশের শতকরা অন্তত ৩০ শতাংশ ভোটার আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে বলে প্রতীয়মান হলেও একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শতকরা ১৫ ভাগ ভোটারও ভোট দিতে যায়নি। আওয়ামী এমপিরা দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়লেও সে টাকা দিয়ে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে যেতে পারেনি। দলের নেতাকে সর্বকালের সেরা ব্যক্তিত্বের তকমা দিয়ে মুজিবীয় কাল্ট সৃষ্টি করা কিংবা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৬ বছর ধরে শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনার সীমাহীন ক্ষমতার দাপট, সবকিছুর উপর অপ্রতিরোধ্য নিয়ন্ত্রণ, উন্নয়নের আকাশচুম্বি ফানুস এবং বিকল্পহীন অবস্থানের একতরফা প্রচারণা ও মগজধোলাই প্রকল্প ছাত্র-জনতার মাত্র তিন সপ্তাহের আন্দোলনেই কর্পুরের মতো উবে যাওয়ার বাস্তবতা তাদের মধ্যে কোনো প্রতিতী সৃষ্টি করতে পারেনি। এতকিছুর পরও যারা আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদের ন্যারেটিভ তুলে ধরে জাতিকে বিভক্ত রাখতে চায়, তাদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষ সিদ্ধান্ত নিতে মোটেও ভুল করবে না। তাদের এহেন ভূমিকা বিএনপির প্রতি মানুষের আস্থা ও জনপ্রিয়তায় চির ধরানোর এজেন্ডার অংশ কিনা শীর্ষ নেতৃত্বকে তা ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। বিগত ১৬ বছরের আন্দোলন কর্মসূচিগুলোর সাফল্যÑব্যর্থতার পেছনে কার কি ভূমিকা ছিল, এবং চলমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় কে কি ভূমিকা পালন করছেন, এসব বিষয়কে সামনে রেখেই আগামী দিনের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্বাচন করতে হবে। শুধু বিএনপিই নয়, ছাত্র সমন্বয়কসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের সম্মুখ সারির অন্যান্য দলের ক্ষেত্রেও বিষয়গুলো একইভাবে প্রযোজ্য।
আগস্টের শুরু থেকে বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বিরামহীনভাবে ভার্চুয়াল বক্তৃতায় দলের নেতাকর্মীদের বলছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন অত সহজ হবে না। যেসব সিনিয়র নেতা দেশে অবস্থান করছেন, তারা তো বিষয়টা আরো বেশি উপলব্ধি করার কথা। তারা কেন জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের স্পিরিটের বিপরীত মেরুতে হাঁটছেন? হয়তো অনিবার্য বাস্তবতায়, বিপ্লবের পর বিদ্যমান সংবিধান ছুঁড়ে ফেলে বিপ্লবী সরকার গঠন করা সম্ভব হয়নি। হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে অপসারণ করার অনুকূল পরিবেশ ছিল না। হতেই পারে। তাই বলে ভয়াবহ সব অপরাধের বিচারের আগেই নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগের পুনর্বাসন, পরোক্ষভাবে ভারতের দালালির নীতি, মুজিবের ছবি কিংবা বাহাত্তরের সংবিধানের পক্ষে কথা বলতে হবে? আমাদের মনে রাখতে হবে,এ উপমহাদেশে একমাত্র আমরাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বৈষমহীন সমাজ ও ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের আকাক্সক্ষাকে ধারন করে একটি রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করেছিলাম। এরপর গত ৫৪ বছরে দেশের সিপাহী-জনতা, ছাত্র-জনতা রাজপথে বারবার রক্ত ঝরিয়েও স্বাধীনতার আকাক্সক্ষা পূরণে সফল হতে পারেনি। একাত্তরে লাখো শহীদের রক্ত, পঁচাত্তরের রক্ত, নব্বইয়ের রক্ত এবং লগি-বৈঠার তা-ব থেকে শুরু হওয়া গত দুই দশক ধরে চলা ক্রমবর্ধমান বৈষম্য, গুম-খুন, নিপীড়ন, নৃশংসতা ও গণহত্যার চরম প্রতিক্রিয়ায় চব্বিশের জুলাইয়ে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা জীবন দিয়ে ভারতীয় আধিপত্যবাদের ফ্রাঙ্কেনস্টাইন দানবকে দেশ থেকে তাড়িয়েছে। প্রকাশ্য ও গোপণে বিরাজমান এই আধিপত্যবাদের ক্রীড়নক দানবই গত ৫৪ বছর ধরে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্খার মূল প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করেছে। যে দলই ক্ষমতায় এসেছে, সিন্দাবাদের জিনের মত সর্বাত্মক উপায়ে ওরা তাদের উপর সওয়ার হয়ে ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য অটুট রাখতে সম্ভাব্য সবকিছু করেছে। এবার তাদের শিখন্ডীরা প্রকাশ্য গণবিপ্লবের মধ্য দিয়ে বিতাড়িত হওয়ার পর থেকে পতিত স্বৈরাচারকে আশ্রয় দেয়ার সাথে সাথে পুরনো এস্টাবলিশমেন্ট টিকিয়ে রাখতে সর্বাত্মক প্রয়াস চালাচ্ছে। সফ্ট পাওয়ার, হার্ড পাওয়ারসহ তাদের হাতে যত রকম অস্ত্র আছে সব উপায়ে সবকিছু বারবার ব্যবহার করেও যখন তারা সফল হতে পারছিল না, তখন তারা সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টি করে, হাইকমিশনে হামলা করে, বাণিজ্য ও ভিসা বন্ধ করার সাথে সাথে সরাসরি যুদ্ধের হুমকি দিয়ে অর্šÍবর্তী সরকার এবং ছাত্র-জনতাকে তাদের আধিপত্য মেনে আপস করাতে ব্যর্থ হয়েছে।
আপস কিংবা সমঝোতার সর্বনি¤œ স্তর হচ্ছে, পিলখানা হত্যাকা- নিয়ে নতুন করে কোনো উদ্যোগ না নেয়া বা ধামাচাপা দেয়া, শাপলা চত্বরে হেফাজতের সমাবেশে ম্যাসাকারের ঘটনা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারের নামে জুডিশিয়াল কিলিং, জঙ্গিবাদের নাটক সাজিয়ে দেশের আলেম-ওলামাদেরকে আয়নাঘরে গুম ও ক্রসফায়ারে হত্যার সাথে ভারতীয়দের সম্পৃক্ততার মোটিফ উন্মোচনের যে কোনো উদ্যোগের আগে তড়িঘড়ি জাতীয় নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ এবং নির্বাচনে জেতার গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসরদের সাথে গোপন সমঝোতায় উপনীত হওয়া। এসব ঘটনার সাথে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সম্পৃক্ততার অভিযোগ আছে। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, বিএনপি, জামায়াত কিংবা দেশের অন্য কোনো রাজনৈতিক দল ভারতীয় এজেন্ট ও পলাতক আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে ক্ষমতার মসনদ নিশ্চিত করতে চাইলে তাদেরকে জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট ও আকাক্সক্ষার সাথে বৈরীতা ও বিশ্বাসঘাতকতা করেই তা করতে হবে। এ ধরণের যে কোনো রাজনৈতিক সমঝোতার সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হবে ভয়াবহ। একাত্তরের শহীদদের রক্তের সাথে বেইমানি করে যে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কায়েম হয়েছিল, তা থেকে জাতিকে মুক্ত করতেই জুলাই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। জনগণের প্রতি আস্থা না রেখে ক্ষমতার মোহে এই রক্তের সাথে যারা বেইমানি করবে, তারা পতিত স্বৈরাচারের মতই ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে। ৫ আগস্টের পর যেসব বিএনপি নেতা, পাতিনেতা, হাইব্রিড নেতা বড় বড় ব্যানার-ফেস্টুন লাগিয়ে নিজেদের জাহির করছেন, যারা বাসস্ট্যান্ড, টেম্পো স্ট্রান্ড, কাঁচা বাজার ও ঘাটে চাঁদাবাজি করছে, যারা মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের আশ্রয়-প্রশ্রয় ও নিরাপত্তা দিচ্ছেন, যারা পুলিশ ও প্রশাসনিক দুর্বলতার সুযোগে প্রতিপক্ষের জায়গা জমি দখল করে নিচ্ছে কিংবা ভুয়া দাবিদার সাজিয়ে দখল করার হুমকি দিয়ে মোটা অংকের চাঁদাবাজি করছে, তারা সবাই ছাত্র-জনতার বিপ্লবের স্পিরিটের প্রতিপক্ষ। বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধেই এসব অভিযোগ বেশি উঠছে। তাদের এসব কর্মকা- নির্বাচনে বিএনপি’র গণভিত্তিকে নড়বড়ে করে দিতে পারে। তৃণমূল পর্যায়ে এসব অপরাধের সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে দলের হাইকমান্ডকে জিরো টলারেন্স নীতির আলোকে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার প্রথম শর্ত হচ্ছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় দলের নেতৃত্ব নির্বাচন করা। পেশি শক্তির প্রতিযোগিতা ও ব্যক্তিগত প্রভাব বলয় সৃষ্টির পেছনে লাখ লাখ টাকা খরচের প্রতিযোগিতা বন্ধ না হলে চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়ণ বন্ধ হবে না। নতুন বাংলাদেশের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি’র শীর্ষ নেতৃত্বকে এসব বিষয়ে আরো বেশি মনোযোগ দিতে হবে। বিএনপির ৩১ দফা লক্ষ্য ও সংস্কার কর্মসূচি মানুষের মধ্যে আশা জাগালেও দলের আভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ও যোগ্যতর নেতৃত্ব গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি এখানে অনুপস্থিত। দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে পুরনো ফ্যাসিবাদের মনস্তাত্ত্বিক ফ্রাঙ্কেনস্টাইনকে জিইয়ে রেখে ৩১ ধারা সংস্কার প্রস্তাবের আলোকে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
bari_zamal@yahoo.com
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
![টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের ইউপি চেয়ারম্যান ও কাউন্সিলরসহ ২১জন নেতাকর্মীদের আটক](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2025February/SM/pic-3-20250211224456.jpg)
টাঙ্গাইলে আওয়ামী লীগের ইউপি চেয়ারম্যান ও কাউন্সিলরসহ ২১জন নেতাকর্মীদের আটক
![কক্সবাজারে অপারেশন ডেভিল হান্ট' অভিযান অব্যাহত, গ্রেপ্তার ২৭](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2025February/SM/pic-3-20250211224214.jpg)
কক্সবাজারে অপারেশন ডেভিল হান্ট' অভিযান অব্যাহত, গ্রেপ্তার ২৭
![হাজীদের শত কোটি টাকা অতিরিক্ত বিমান ভাড়া আদায়: হাব ঐক্য কল্যাণ পরিষদ](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2025February/SM/pic-3-20250211223620.jpg)
হাজীদের শত কোটি টাকা অতিরিক্ত বিমান ভাড়া আদায়: হাব ঐক্য কল্যাণ পরিষদ
![সিঙ্গাপুর থেকে ২৬৫ কোটি টাকায় কেনা হবে ৫০ হাজার টন নন বাসমতি](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2025February/SM/rice-2-202501162109501-20250211215650-20250211223004.jpg)
সিঙ্গাপুর থেকে ২৬৫ কোটি টাকায় কেনা হবে ৫০ হাজার টন নন বাসমতি
![জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিকে অভিনন্দন জানিয়ে গাজীপুরে যুবদলের আনন্দ মিছিল](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2025February/SM/pic-3-20250211222654.jpg)
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটিকে অভিনন্দন জানিয়ে গাজীপুরে যুবদলের আনন্দ মিছিল
![শৃঙ্খলা রক্ষার্থে আমাদের কঠোর হতে হবে: উপদেষ্টা মাহফুজ](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2025February/SM/mahfuj-alam-20250211221326.jpg)
শৃঙ্খলা রক্ষার্থে আমাদের কঠোর হতে হবে: উপদেষ্টা মাহফুজ
![পটুয়াখালীতে হামলায় পিপি, জেলা জামায়াতের আমিরসহ আহত ৩](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2025February/SM/ak-1739284032-20250211220217.jpg)
পটুয়াখালীতে হামলায় পিপি, জেলা জামায়াতের আমিরসহ আহত ৩
![রামগতিতে আগুনে পুড়ল ২৪ দোকান](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2025February/SM/2-20250211215612.jpg)
রামগতিতে আগুনে পুড়ল ২৪ দোকান
![বিনামূল্যে ক্যানসারের ওষুধ দেওয়ার ঘোষণা](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2025February/SM/09-20250211-214339968-20250211215459.jpg)
বিনামূল্যে ক্যানসারের ওষুধ দেওয়ার ঘোষণা
![সীমান্তে আইইডি বিস্ফোরণে ২ ভারতীয় সেনা নিহত](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2025February/SM/08-20250211-205058166-20250211215028.jpg)
সীমান্তে আইইডি বিস্ফোরণে ২ ভারতীয় সেনা নিহত
![সিংগাইরে ইউনিয়ন আ.লীগের সভাপতিসহ আটক ৪](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2025February/SM/untitled-1-copy-20250211214027.jpg)
সিংগাইরে ইউনিয়ন আ.লীগের সভাপতিসহ আটক ৪
![সাভারে কুটি মোল্লাসহ ১৩ আসামী গ্রেপ্তার](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2025February/SM/1000036506-20250211213831.jpg)
সাভারে কুটি মোল্লাসহ ১৩ আসামী গ্রেপ্তার
![স্বামীকে জুতা মারলেন অঙ্কিতা](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2025February/SM/pic-3-20250211213028.jpg)
স্বামীকে জুতা মারলেন অঙ্কিতা
![আ’লীগ নেতাকে ছাড়াতে গিয়ে গ্রেপ্তার স্বেচ্ছাসেবক দল নেতাকে বহিস্কার](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2025February/SM/pic-3-20250211212727.jpg)
আ’লীগ নেতাকে ছাড়াতে গিয়ে গ্রেপ্তার স্বেচ্ছাসেবক দল নেতাকে বহিস্কার
![গ্রেটার সিলেট ডেভেলপমেন্ট এন্ড ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল ইউকে এর সাথে সিলেট চ্যাপ্টারের মতবিনিময়](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2025February/SM/greater-s-20250211212721.jpg)
গ্রেটার সিলেট ডেভেলপমেন্ট এন্ড ওয়েলফেয়ার কাউন্সিল ইউকে এর সাথে সিলেট চ্যাপ্টারের মতবিনিময়
![ময়মনসিংহ জেলা মোটরযান শ্রমিক ইউনিয়নের বিজয়ীদের শপথ](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2025February/SM/untitled-1-copy-20250211212537.jpg)
ময়মনসিংহ জেলা মোটরযান শ্রমিক ইউনিয়নের বিজয়ীদের শপথ
![সৈয়দপুরে নাশকতা মামলায় আ'লীগ নেতা ইউপি চেয়ারম্যান জুন গ্রেফতার](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2025February/SM/pic-3-20250211212503.jpg)
সৈয়দপুরে নাশকতা মামলায় আ'লীগ নেতা ইউপি চেয়ারম্যান জুন গ্রেফতার
![বিশ্বনাথ থানা ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ-ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় মামলা-ক্ষতি কোটি টাকা](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2025February/SM/pic-3-20250211212211.jpg)
বিশ্বনাথ থানা ভাংচুর-অগ্নিসংযোগ-ও অস্ত্র লুটের ঘটনায় মামলা-ক্ষতি কোটি টাকা
![‘ইসলামী শ্রমনীতি বাস্তবায়ন ছাড়া শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়’](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/common/-default.jpg)
‘ইসলামী শ্রমনীতি বাস্তবায়ন ছাড়া শ্রমিকদের অধিকার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়’
![শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্থাপন করা হবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বুক কর্নার](https://dailyinqilab.com/mediaStorage/content/images/2025February/SM/untitled-1-copy-20250211212030.jpg)
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্থাপন করা হবে ইসলামিক ফাউন্ডেশন বুক কর্নার