বিএনপি বনাম নতুন রাজনৈতিক দল

Daily Inqilab কামরুল হাসান দর্পণ

৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৭ এএম | আপডেট: ৩১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০৭ এএম

ছাত্র সমন্বয়কদের নতুন রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে বিএনপি এবং সমন্বয়ক-উপদেষ্টাদের মধ্যে বেশ কয়েকদিন ধরে বিতর্ক চলছে। বিতর্কের সূত্রপাত হয়, বিএনপি মহাসচিব যখন বিবিসি বাংলার সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘সরকার নিরপেক্ষ থাকতে না পারলে নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে।’ তার এ কথায় সরকারে থাকা দুই উপদেষ্টাসহ সরকারের বাইরে থাকা আলোচিত দুই উপদেষ্টা ও নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক সোচ্চার হন। তারা একসঙ্গে মির্জা ফখরুলের কথার জবাব দিয়েছেন। তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ফেসবুকে স্ট্যাটাসের মাধ্যমে যে জবাব দিয়েছেন, অন্যরা তা শেয়ার করে সবাইকে পড়তে বলেছেন। নাহিদ ইসলাম স্ট্যাটাসের মূল কথা হচ্ছে, বিএনপির মহাসচিবের দাবি, আরেকটি ১/১১ সরকার গঠনের ইঙ্গিত। তাঁর এ স্ট্যাটাস শেয়ার করে পাল্টা জবাব দিয়েছেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, সমন্বয়ক সারজিস আলম এবং হাসনাত আব্দুল্লাহ। নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারি একটু আগ বাড়িয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে ‘মুজিববাদ ও জিয়াবাদ’ চলবে না। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজনীয়তার কথা বলে কী এমন ভুল করেছেন, যাতে উপদেষ্টা ও সমন্বয়কদের তার বক্তব্যের জবাব দিতে হবে? মির্জা ফখরুল যে কথাটি বলতে চেয়েছেন, তা কি যুক্তির বাইরে? তাঁর এ বক্তব্য অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সমর্থন করেছেন। কারণ, ক্ষমতায় থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতা নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হতে পারে না। অন্তর্বর্তী সরকার কোনো রাজনৈতিক সরকার নয়। তার দায়িত্ব রুটিন কাজ ও প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন করা। এর বাইরে গেলে, তা প্রশ্নবিদ্ধ হবেই। গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে ছাত্রদের দাবি-দাওয়া থাকতেই পারে। তার মানে এই নয়, রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন করতে হবে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, গণঅভ্যুত্থানে সমন্বয়করা সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তবে তাদের সাথে ছিল, সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মী। একারণেই একে গণঅভ্যুত্থান বলা হয়। এই অভ্যত্থানের মূল লক্ষ্য ছিল, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতন। তাতে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কোনো এজেন্ডা ছিল না। হাসিনার পতনের পর গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের মূল কাজ হয়ে দাঁড়ায়, তার ভেঙে দেয়া রাষ্ট্রকাঠামো ও সংবিধান সংস্কার করা, যাতে আর কোনো ফ্যাসিজমের জন্ম না হয়। পট পরিবর্তনের পর সমন্বয়ক বা ছাত্ররা রাজনৈতিক দল গঠন করতেই পারে, তার মানে এই নয়, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় করতে হবে। তা করলে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া স্বাভাবিক। দেখা যাচ্ছে, এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারে থাকা এবং বাইরে থাকা সমন্বয়করা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন। তারা মাঠ গুছিয়ে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সঙ্গতকারণেই রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে সচেতন মহল প্রশ্ন তুলবে। ইতোমধ্যে এ প্রশ্ন উঠেছে, ওয়ান ইলেভেনের সময় যেভাবে ‘কিংস পার্টি’ তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল, সেভাবে একটি দল গঠিত হতে যাচ্ছে। ওয়ান ইলেভেনের কথাই যখন এলো, তখন বলতে হয়, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় যখন রাজনৈতিক দল গঠনের কার্যক্রম স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, তখন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, বিএনপির মহাসচিব আরেকটি ওয়ান ইলেভেন সরকার গঠনের ইঙ্গিত দিচ্ছেন, তা কি ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করা কি ওয়ান ইলেভেন সরকারের সাথে মিলে না? বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করেই আরেকটি নিরপেক্ষ সরকার প্রয়োজন হতে পারে বলে বলেছেন। তার কথার মর্মার্থ হচ্ছে, রাজনৈতিক দল যে কেউ গঠন করতে পারে, তবে সরকারে থেকে তা করলে সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণœ হয়। ॥
দুই.
সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় জাতীয় নাগরিক কমিটি নামে সমন্বয়কদের নেতৃত্বে যে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা হচ্ছে, তার আলামত ইতোমধ্যে পরিলক্ষিত হয়েছে। ইতোমধ্যে ২১০টি উপজেলায় দলটির কমিটি গঠন করা হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে তার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসতে পারে। তাদের এই রাজনৈতিক দল গঠন এবং বিভিন্ন কার্যক্রম চালানোর খরচ নিয়ে ইতোমধ্যে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। যারা এ দল গঠন করছেন, তাদের পেশা এবং আয়ের উৎস কি, কীভাবে অর্থের জোগান হচ্ছে, এ নিয়েও অনেকে প্রশ্ন করছেন। কারণ, গাড়ির বহর নিয়ে জেলায় জেলায় যাওয়া, কমিটি গঠন ইত্যাদি কার্যক্রম চালাতে অনেক অর্থকড়ির প্রয়োজন। যদিও অনেকেই বলছেন, সমন্বয়করা এখন আর ছাত্র নেই। নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের মতো বিশাল কর্মযজ্ঞ চালাতে যে বিপুল অর্থের প্রয়োজন, তা কীভাবে যোগাড় হচ্ছে, এ প্রশ্ন আসে। অবশ্য, ইতোমধ্যে দেশের মানুষ দেখেছে, সমন্বয়করা যখন বিশাল লটবহর নিয়ে বিভিন্ন জেলায় সফরে গিয়েছেন, সেখানে তাদেরকে সরকারি প্রোটোকল কিংবা সুযোগ-সুবিধা নিতে দেখা গেছে। এখনো তারা এ সুবিধা পাচ্ছেন। এর মাধ্যমে রাজনৈতিক দল গঠনে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টি পষ্ট হয়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকারে থেকে রাজনৈতিক দল গঠনের এই প্রক্রিয়ারই সমালোচনা করেছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও এ নিয়ে গত ২৫ জানুয়ারি রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত শিক্ষক সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে নতুন রাজনৈতিক দল নিয়ে খোলাখুলিভাবে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক অধিকারবঞ্চিত তরুণরা যদি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন কোনো রাজনৈতিক দল গঠন করে, অবশ্যই বিএনপি তাকে স্বাগত জানাবে। তবে রাজনৈতিক দল গঠন করতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় কিংবা প্রশাসনিক সহায়তা নেয়া হলে, তা জনগণকে হতাশ করবে। বিএনপির মতো বৃহৎ দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান যখন এ কথা বলেন, তখন বুঝতে বাকি থাকে না, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি নামে যে রাজনৈতিক দল গঠন করতে যাচ্ছে, তা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরও উপদেষ্টা মাহফুজুল আলমকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, কোনো কোনো উপদেষ্টা নিজের এলাকায় গিয়ে রাজনৈতিক দলের নেতার মতো সংবর্ধনা নিচ্ছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টারা কোনোভাবেই এ ধরনের সংবর্ধনা নিতে পারেন না। তার কথা থেকেই স্পষ্ট, সমন্বয়কদের মধ্যে যারা উপদেষ্টা হয়েছেন, তারা রাজনৈতিক নেতাদের মতো কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। অথচ অন্তর্বর্তী সরকার অরাজনৈতিক। তার কোনো কোনো উপদেষ্টার কার্যক্রমে যদি রাজনৈতিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রতিফলিত হয়, তবে তা সরকারের নিরপেক্ষতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। সেই কাজটিই এখন কোনো কোনো সমন্বয়ক উপদেষ্টা করছেন। ফলে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে, তা উড়িয়ে দেয়া যায় না। যদিও দুই সমন্বয়ক উপদেষ্টা বলেছেন, তারা রাজনৈতিক দল গঠন করলে সরকার থেকে বের হয়েই করবেন। এটা করলে কারও কোনো আপত্তি থাকবে না। নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের আগেই যদি তা সরকার থেকে বের হয়ে যান, তাহলে তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবে না। এদিকে, দেখা যাচ্ছে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের কৃতিত্ব ও মালিকানা নিয়ে একধরনের ভাগাভাগি চলছে। ইসলামপন্থী কিছু রাজনৈতিক দল ও নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের সাথে সম্পৃক্ত সমন্বয়করা তাদের আচার-আচরণে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, গণঅভ্যুত্থান কেবল তারাই ঘটিয়েছেন। অথচ কে না জানে, এ অভ্যুত্থানে ফুটপাতের হকার থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষ ও হাসিনাবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীরা অংশগ্রহণ করেছে। শত শত ছাত্র-জনতা জীবন দিয়েছে, চিরতরে অন্ধ ও পঙ্গু হয়েছে। এ কৃতিত্ব সকলের, এতে কারো একক কোনো কৃতিত্ব নেই। যেসব শিক্ষার্থী ও সমন্বয়ক সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, অবশ্যই তাদের অবদান অনস্বীকার্য। তাদের কেউ কেউ উপদেষ্টা হয়েছেন। কেউ কেউ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছেন। আবার তাদের কারো কারো বিরুদ্ধে তদবির থেকে শুরু করে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নেয়ার অভিযোগও উঠেছে। এখন তারা রাজনৈতিক দল গঠন করছেন। তবে এই রাজনৈতিক দলের গঠন প্রক্রিয়া এবং অন্য রাজনৈতিক দলকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলাকে সচেতন মহল ভালোভাবে নিচ্ছে না। বিশেষ করে সমন্বয়ক উপদেষ্টা ও বাইরের সমন্বয়করা যেভাবে বিএনপিকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে আক্রমণাত্বক কথা বলেছেন, তা গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরার ইঙ্গিত দেয়।

তিন.
জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসির উদ্দিন পাটওয়ারি দেশে মুজিববাদের সাথে জিয়াবাদ যুক্ত করে যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সমীচীন হয়নি বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। বিএনপির নেতৃবৃন্দ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছেন, আমরা কখনো ‘জিয়াবাদ’ বলে কিছু বলিনি। বিএনপির প্রতিষ্ঠার পর এমন কথা কেউ উচ্চারণও করেনি। তাহলে নাসির উদ্দিন পাটওয়ারি এ কথা কেন বললেন? বিএনপির নেতৃবৃন্দের এ কথা যুক্তিযুক্ত। কারণ, দেশের মানুষও কখনো বিএনপির পক্ষ থেকে এ ধরনের কথা বলতে শোনেনি। কিংবা জিয়াকে শেখ মুজিবের মতো দেবতাতুল্য করার প্রক্রিয়া দেখেনি। দলটি জিয়ার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী দর্শন এবং তাঁর দেয়া ১৯ দফা কর্মসূচি নিয়েই এগিয়ে চলেছে। এখানে মুজিববাদের মতো চাপিয়ে দেয়া বা আরোপিত কিছু নেই। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিব, যিনি মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি, জেল থেকে বের হয়ে জেনেছেন দেশ স্বাধীন হয়েছে, তাঁকে যেভাবে জাতির পিতাসহ বাংলাদেশের আজীবন প্রেসিডেন্ট বানানোর প্রক্রিয়া চালানো হয়েছে, তাঁর কথাই শেষ কথাÑএমন নীতি অবলম্বন করা হয়েছে, স্বাধীনতার ঘোষক এবং মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানকে কি কখনো এভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে? কিংবা তাঁকে দেবতুল্য করে শেখ মুজিবের মতো দেশের অনাচে-কানাচে মূর্তি বানিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল? রাখেনি। বরং জিয়াউর রহমান যে, স্বাধীন বাংলাদেশ নামক ভূখ-ে আমাদেরকে ‘বাংলাদেশী’ হিসেবে আলাদা জাতি হিসেবে পরিচিতি দেয়া ও জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং ইসলামী মূল্যবোধকে ধারন করেছেন, তা সকলেই মেনে নিয়েছেন। তাঁর মাধ্যমেই শেখ মুজিবের একদলীয় শাসন ব্যবস্থা থেকে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু হয়েছিল। আওয়ামী লীগসহ শেখ মুজিবের নিষিদ্ধ করা সব দল রাজনীতিতে ফিরে এসেছিল। এ কারণেই দেশের মানুষ তাকে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা বলে ডাকে। দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনে তিনি দেশকে স্বনির্ভর করতে যে ১৯ দফা দিয়েছেন, তা দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। ভারতের অন্যায্য ও আধিপত্যবাদী আচরণের বিরুদ্ধে তাঁর অনমনীয়তা দেশের মানুষ বিপুলভাবে গ্রহণ করেছে। এখন তাঁর এই দর্শন ও নীতিকে যদি কেউ শুধু বিরোধিতার জন্য নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে, তবে তাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক। এই প্রজ্ঞা নিয়ে কীভাবে রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠিত করবেন, তাই এখন বড় প্রশ্ন হয়ে উঠেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অন্তর্গত যে ভাব, তাতে তো জিয়াউর রহমানের দর্শনের প্রতিফলন রয়েছে। ফলে হুট করে যদি কেউ না বুঝে ‘জিয়াবাদ’ বলে কটাক্ষ করেন, তবে তা কি গ্রহণযোগ্যতা পাবে? মানুষ বারবার ভোট দিয়ে বিএনপিকে ক্ষমতায় এনেছে। দেশের রাজনীতিতে দলটির অবস্থান অত্যন্ত দৃঢ় এবং অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল। এ বাস্তবতা তো অস্বীকার করা যাবে না। কোনো নতুন রাজনৈতিক দলের পক্ষে কি রাতারাতি এমন অবস্থানে আসা সম্ভব? রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা নিয়েও যদি দল গঠন করা হয়, তাহলেও কি বিএনপির সমতুল্য হওয়া সম্ভব? যারা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছেন, তারা কি মনে করেন, গণঅভ্যুত্থানে তাদের ঘোষিত কর্মসূচিতে যেভাবে সর্বস্তরের মানুষ সাড়া দিয়ে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাকে বিতাড়িত করতে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিল, রাজনৈতিক দল গঠনের পর তাদের ডাকে কি সেভাবে সাড়া দেবে? নিশ্চিত করেই বলা যায়, সেভাবে সাড়া দেবে না। ইতোমধ্যে তাদের কর্মসূচিতে লোকজনের যে উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তাতে সেই সাড়া পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এ বাস্তবতা তাদের মেনে নিয়েই রাজনৈতিক দল গঠন করতে হবে। তারা রাজনৈতিক দল গঠন করুন, কেউ তো মানা করছে না। তবে তা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে বিএনপিকে প্রধান প্রতিপক্ষ বানিয়ে করতে হবে কেন? রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া তারা তাদের দর্শন ও আদর্শ নিয়ে দল গঠন করবেন, তাতে তো কেউ বাধা দিচ্ছে না। আপত্তিটা তো ওখানেই যখন স্বৈরাচার এরশাদের মতো ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। সে সময় তার গড়া জাতীয় পার্টি পাতানো নির্বাচনের মাধ্যমে নয় বছর ক্ষমতায় থেকেছে। তারা বলতে পারেন, জিয়াউর রহমানও ক্ষমতায় থেকে বিএনপি গঠন করেছিলেন। হ্যাঁ করেছিলেন, তবে তা এরশাদের জাতীয় পার্টির মতো জনসমর্থন হারিয়ে শুধু ক্ষমতার অংশীদার হয়ে থাকার জন্য হাসিনার দাসে পরিণত হয়নি। এরশাদের বন্দুকের মুখে ক্ষমতা হারিয়ে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি দীর্ঘ নয় বছর আপসহীনভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। পোড় খাওয়া দলে পরিণত হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে এরশাদের পতনের পর জনগণ বিএনপিকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। জনগণ জিয়াউর রহমানের নীতি-আদর্শ ও দর্শন পছন্দ করেছে বলেই ক্ষমতায় বসিয়েছিল এবং পরবর্তীতে বারবার ক্ষমতায় এনেছে। ফ্যাসিস্ট হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে বিএনপি যে লড়াই-সংগ্রাম করেছে, দলটির শত শত নেতাকর্মী জীবন দিয়েছে, গুম-খুন, নিপীড়ন-নির্যাতন, জেল-জুলুমের শিকার হয়েছে, আর কোনো দলের কি এই ত্যাগ আছে? কাজেই, দীর্ঘ সময় ধরে লড়াই-সংগ্রাম করে জনসমর্থন অর্জন করা এমন দলকে নবিশ কোনো দলের কেউ যদি প্রতিপক্ষ ভাবেন, তবে তা পাথরের উপর ডিমের নৃত্য করার শামিল হবে।

চার.
রাজনৈতিক দল গঠন করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের রয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফুটপাতের যে হকার অংশগ্রহণ করেছে, যে রিকশাওয়ালা তার রিকশার সিটে উঠে ছাত্র-জনতার মিছিলকে স্যালুট দিয়েছে, যে ছাত্র-জনতা অন্ধ হয়েছে, পঙ্গু হয়েছে, হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে, যারা বিজয়ী হয়ে ঘরে ফিরে গেছে, তার এবং তাদেরও অধিকার আছে, রাজনৈতিক দল গঠন করার। রাজনীতিতে ভিন্ন ভিন্ন শত ফুল ফোটা, ভিন্নমতের শত ধারা প্রবাহিত হওয়াই গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। বিপরীতমুখী আদর্শের মধ্যে যুক্তিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা, মতপ্রকাশের অবারিত স্বাধীনতা থাকা এবং তা সহনশীলতা ও শ্রদ্ধার সাথে মেনে নেয়াই গণতন্ত্রের মূল চেতনা। তা করতে গিয়ে অশোভন ও অগ্রহণযোগ্য পন্থায় আক্রমণ করা উচিৎ নয়। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা গণতন্ত্রকে যেভাবে পদদলিত করেছেন এবং মানুষের মনে প্রতিহিংসার বিষবাষ্প ঢেলে দিয়েছেন, তা থেকে আমাদের সবাইকে বের হয়ে আসতে হবে। হুঁশিয়ার হতে হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে ফ্যাসিস্টবিরোধী ঐক্য হয়েছে, তা ধরে রেখে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। যদি ঐক্য না থাকে এবং তাতে ফাটল ধরে, তাহলে সেই ফাটলের মধ্য দিয়ে কেবল বিতাড়িত ফ্যাসিস্টের ফিরে আসার পথ রচিত হবে। এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।

darpan.journalist@gmail.com


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বইমেলা দেশে দেশে
ভাষা আন্দোলনে ছাত্ররাই ছিল মূল ভূমিকায়
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কাম্য নয়
মাদকমুক্ত হোক ক্যাম্পাস
মাতৃভাষা বাংলা খোদার সেরা দান
আরও
X

আরও পড়ুন

টঙ্গীতে নারী ঘটিত ঘটনায় দুই শিক্ষার্থীর মধ্যে মারামারি

টঙ্গীতে নারী ঘটিত ঘটনায় দুই শিক্ষার্থীর মধ্যে মারামারি

মালয়েশিয়ার ও আলজেরিয়া থেকে ফিরছে ৫০ বাংলাদেশি

মালয়েশিয়ার ও আলজেরিয়া থেকে ফিরছে ৫০ বাংলাদেশি

স্থানীয় নির্বাচন বিতর্কে জাতীয় নির্বাচন পেছানো যাবে না -রিজভী

স্থানীয় নির্বাচন বিতর্কে জাতীয় নির্বাচন পেছানো যাবে না -রিজভী

ধর্ম নিয়ে ব্যবসা নয়,মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনবৃত্তান্ত হলো কোরআন- কাজী শিপন

ধর্ম নিয়ে ব্যবসা নয়,মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ জীবনবৃত্তান্ত হলো কোরআন- কাজী শিপন

অস্ত্রবাজির আতঙ্কে ঢাকার মানুষ

অস্ত্রবাজির আতঙ্কে ঢাকার মানুষ

ওয়াক আউট করল বাংলাদেশ

ওয়াক আউট করল বাংলাদেশ

রাষ্ট্রে ইসলাম বিজয়ী হলে সর্বস্তরের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে -পীর ছাহেব চরমোনাই

রাষ্ট্রে ইসলাম বিজয়ী হলে সর্বস্তরের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে -পীর ছাহেব চরমোনাই

আগে কখনো আমি এত অপমানিত বোধ করিনি -মাহমুদুর রহমান মান্না

আগে কখনো আমি এত অপমানিত বোধ করিনি -মাহমুদুর রহমান মান্না

রোজার ৯ পণ্যের আমদানি বেড়েছে

রোজার ৯ পণ্যের আমদানি বেড়েছে

সাবেক ইউপি সদস্য ও যুবদল নেতাকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা

সাবেক ইউপি সদস্য ও যুবদল নেতাকে প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা

মাতৃভাষা আল্লাহর বড় নেয়ামত

মাতৃভাষা আল্লাহর বড় নেয়ামত

লামায় অপহরণ কারী চক্রের ৪ জন গ্রেপ্তার

লামায় অপহরণ কারী চক্রের ৪ জন গ্রেপ্তার

একুশ সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বীজমন্ত্র

একুশ সব ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর বীজমন্ত্র

মুক্ত বাতাসে শহীদদের স্মরণ

মুক্ত বাতাসে শহীদদের স্মরণ

দুর্নীতিবাজ সেই নির্বাহী প্রকৌশলী ছামিউলের ফিরে আসার খবরে জনমনে তীব্র অসন্তোষ

দুর্নীতিবাজ সেই নির্বাহী প্রকৌশলী ছামিউলের ফিরে আসার খবরে জনমনে তীব্র অসন্তোষ

হাব নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তুমুল বাকবিতণ্ডা

হাব নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তুমুল বাকবিতণ্ডা

কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে বিজিবির গাড়ির ধাক্কায় শিশু নিহত

কক্সবাজার টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে বিজিবির গাড়ির ধাক্কায় শিশু নিহত

ভার্চুয়ালি করা যাবে না বিমা কোম্পানির পরিষদ সভা

ভার্চুয়ালি করা যাবে না বিমা কোম্পানির পরিষদ সভা

দু’ঘণ্টার চেষ্টায় খিলগাঁওয়ের আগুন নিয়ন্ত্রণে

দু’ঘণ্টার চেষ্টায় খিলগাঁওয়ের আগুন নিয়ন্ত্রণে

নাস্তিক রাখাল রাহার সমুচিত বিচার নিশ্চিত করতে হবে

নাস্তিক রাখাল রাহার সমুচিত বিচার নিশ্চিত করতে হবে