সেনাবাহিনী দায় এড়াতে পারে না
০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে গুম, খুন, অপহরণ, বিচারবর্হিভূত হত্যাকা-, ক্রসফায়ার, বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ছিল নিত্যকার বিষয়। বিরোধীদলের রাজনৈতিক নেতাকর্মী তো বটেই, সাধারণ মানুষেরও নিরাপত্তা বলতে কিছু ছিল না। হাসিনার দেড় দশকের বিভীষিকাময় শাসনামলের অবসানের পর মানুষ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে। তারা নিরাপদে থাকবে, অন্তত সরকারের কোনো বাহিনী হাসিনার শাসনামলের মতো তুলে নিয়ে নির্যাতন ও হত্যার মতো ঘটনা ঘটাবে না, এমনটাই আশা করেছে। দুঃখের বিষয়, এ ধরনের ঘটনা এখনও ঘটছে। গতকাল বেশ কয়েকটি দৈনিকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কুমিল্লা আদর্শ সদর উপজেলার পাঁচথুবী ইউনিয়নের যুবদলের আহ্বায়ক তৌহিদুল ইসলামকে গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে সেনাবাহিনীর সদস্যরা তাকে আটক করে নিয়ে যায়। গত শুক্রবার সকাল ১১টার দিকে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তৌহিদুলকে থানা-পুলিশের কাছে হস্তান্তর করে হাসপাতালে নেয়ার কথা বলা হয়। তখন তিনি অচেতন অবস্থায় ছিলেন। হাসপাতালে নেয়ার পর কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, হাসপাতালে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে। চিকিৎসক জানিয়েছেন, তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। এক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তৌহিদুলের বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। এ ঘটনার পর যৌথবাহিনীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্যও দেয়া হয়নি। উল্লেখ্য, গত সোমবার তৌহিদুলের বাবা মারা যাওয়ায় তিনি চট্টগ্রাম থেকে বাড়ি এসেছিলেন। তৌহিদুল চট্টগ্রাম বন্দরে একটি শিপিং এজেন্ট কোম্পানিতে চাকরি করতেন।
যৌথবাহিনী তৌহিদুলকে নিয়ে যাওয়ার পর তার মৃত্যুর ঘটনা শুধু দুঃখজনকই নয়, অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। তার স্ত্রী এবং শিশু ও কিশোরীসহ চার কন্যা রয়েছে। তার মৃত্যু আমাদেরকে ফ্যাসিস্ট হাসিনার সময় কক্সবাজারে পুলিশের ক্রসফায়ারে একরামুল হত্যাকা-ের কথা মনে করিয়ে দেয়। পুলিশ তার কন্যাকে ফোনে রেখেই গুলি করে হত্যা করেছিল। সেই মর্মান্তিক ও অমানুষিক ঘটনায় দেশের মানুষ মর্মাহত হয়েছিল। তৌহিদুলের মৃত্যুর ঘটনা যেন সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি। অনুমান করতে কষ্ট হয় না, যারা তৌহিদুলকে আটক করে নিয়ে গিয়েছিল, তাদের নির্যাতনেই তার মৃত্যু হয়েছে। তাকে সুস্থ অবস্থায় ধরে নেয়ার পর মৃত অবস্থায় ফেরত দেয়ার অর্থই হচ্ছে, অমানুষিক নির্যাতনে তার মৃত্যু হয়েছে। তার সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্নই তার প্রমাণ। পর্যবেক্ষকদের অভিমত, হাসিনার পতনের পর যেখানে যৌথবাহিনীর মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কথা, সেখানে তাদের হাতেই নির্যাতন ও মৃত্যুর মতো ঘটনা ঘটেছে। হাসিনার শাসনামলে র্যাবে থাকা সেনা, নৌ ও পুলিশের কর্মকর্তারা নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের সাথে জড়িয়েছিল। কুমিল্লায় তনু হত্যাকা-ের ঘটনায় সেনাবাহিনীর দিকে আঙ্গুল উঠেছিল। হত্যার তদন্ত প্রতিবেদন আর আলোর মুখ দেখেনি। যেহেতু, সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ সদস্যদের নিয়ে র্যাব গঠিত, তাই তার দায় সেনাবাহিনীর উপরও এসে পড়ে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন মহল থেকে র্যাব বিলুপ্তির দাবি উঠেছে। যৌথবাহিনীতে থাকা সেনা সদস্যদের অপরাধের দায়ও সেনাবাহিনী এড়াতে পারে না। হাসিনার অনুগত সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই কিংবা সেনা নিয়ন্ত্রিত র্যাবের কর্মকর্তারা কী ভয়ংকর ও নিষ্ঠুর কর্মকা- করেছেন, তা সারাবিশ্ব জেনেছে। বিরোধীমতের লোকজন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, এমনকি মহিলাদের তুলে নিয়ে বছরের পর বছর ‘আয়নাঘর’ নামক কুঠোরিতে কীভাবে বন্দি করে রেখেছে, নির্যাতন ও হত্যা করেছে, তার বিবরণ ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। হাসিনার অনুগত সেনাসদস্যরা কতটা অমানবিক ও নিষ্ঠুর হতে পারে, তা শুনে সাধারণ মানুষ শিউরে উঠেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনার পতন না হলে এ ধরনের বীভৎস ঘটনা প্রকাশ হতো না এবং তা চলতেই থাকত। তবে তার পতনের পরও সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, এটা দুঃখজনক, লজ্জাজনক। হাসিনা সরকার ও তার দলের প্রায় ৬২৬ জনকে ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় দিয়ে পরবর্তীতে ছেড়ে দেয়ার ঘটনা সেনাবাহিনীকে ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি করেছে। এ ঘটনা ফ্যাসিস্ট হাসিনার পক্ষেই গেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শুরুতেও সেনাবাহিনী গুলি চালিয়েছিল। হেলিকপ্টার থেকে কোন কর্মকর্তার নেতৃত্বে কিভাবে এবং কি ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, সে তথ্যও এখন প্রকাশিত হচ্ছে। সে সময় ছাত্র-জনতার উপর সেনাসদস্যরা গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানালে, সেনাবাহিনী তা থেকে সরে আসে। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর জনগণের নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সেনাবাহিনী, বিজিবি, পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী নিয়ে গঠিত যৌথবাহিনী প্রায় ছয় মাস ধরে নিয়োজিত রয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বিভিন্ন অপরাধমূলক ঘটনায় কতিপয় সেনাসদস্যর জড়িত থাকার ঘটনা ঘটেছে। গত ২২ জানুয়ারি রাজধানীতে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে দুই সেনাসদস্য পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। তার আগে এক সেনাকর্মকর্তার চুরির মতো ঘটনায় জড়িত থাকার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়েছিল। এ ধরনের ঘটনা আরও ঘটেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এবার যুবদল নেতাকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনাকে ‘বিচ্ছিন্ন’ বলার সুযোগ নেই।
মাঠপর্যায়ের সেনা সদস্যদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সেনাবাহিনীকে আর মাঠে রাখার প্রয়োজন রয়েছে কিনা, এ নিয়ে এখন প্রশ্ন উঠেছে। এ বাহিনীকে মাঠ থেকে তুলে নেয়ার কথাও এখন কেউ কেউ বলছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ ও অন্যান্য বেসামরিক বাহিনীকে সক্রিয় করার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতার কথা তারা বলছেন। প্রয়োজনে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পরিবর্তন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গতিশীল করার উদ্যোগ নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। বলার অপেক্ষা রাখে না, মাঠ পর্যায়ে কতিপয় সেনাসদস্যর অপরাধমূলক ঘটনায় জড়িয়ে পড়ায় সেনাবাহিনীর বদনাম হচ্ছে। এ বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থায় ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সেনাবাহিনীকে বলা হয়, দেশের নিরাপত্তার সর্বশেষ ভরসা। এ বাহিনীর শৃঙ্খলা ও আস্থায় ঘাটতি দেখা দিলে এবং বিশেষত্ব খর্ব হলে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে। যৌথবাহিনীর নামে সেনাবাহিনী মাঠে যে কাজ করছে, এ কাজ পুলিশের। গণঅভ্যুত্থানের পর পুলিশ দায়িত্ব পালনে অক্ষম হওয়ায় সেনাবাহিনীকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ম্যাজেস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে দায়িত্ব দেয়া হয়। অনেকের মতে, পুলিশের কাজ সেনাসদস্যরা করতে গিয়েই অপরাধমূলক ঘটনা ঘটছে। যে কাজে যে অভিজ্ঞ ও অভ্যস্ত, তাকে সেই কাজ করতে দিতে হয়। তা নাহলে, বিশৃঙ্খলা ঠেকানো কঠিন। সরকারের উচিৎ, পুলিশ বাহিনীকে দক্ষ উপদেষ্টার মাধ্যমে দ্রুত কার্যকর ও গতিশীল করা। বলার অপেক্ষা রাখে না, ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর দেশের মানুষ সেনাবাহিনীর উপর আস্থা রেখেছে। মুষ্টিমেয় সেনাসদস্যের অপরাধ প্রবণতায় সে আস্থায় চিড় ধরা মোটেই কাক্সিক্ষত হতে পারে না। হাসিনার দোসর সেনাচক্রের মতো এখনো যদি তুলে নেয়া ও হেফাজতে হত্যার মতো ঘটনা ঘটে, তবে এর চেয়ে উদ্বেগ ও দুঃখের ঘটনা আর কিছু হতে পারে না। সেনাবাহিনীর যেসব সদস্য অপরাধে জড়িয়েছে, তাদেরকে জবাবদিহিতা ও আইনের আওতায় এনে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ। সেনাবাহিনীর মধ্যে যারা ফ্যাসিস্ট হাসিনার অনুগত এবং দোসর হিসেবে কাজ করেছে এবং এখনও বহাল রয়েছে, তাদের দ্রুত অপসারণ করতে হবে।
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

টেকসই উন্নয়নে বৈশ্বিক অগ্রগতির অপরিহার্য শর্ত হলো নারীর অধিকার : তারেক রহমান

বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা কেন্দ্র ঢাকায় ‘সামাজিক উন্নয়নে রমজানের অবদান’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত

ছয় সংস্কার কমিশনের সুপারিশে মতামত দিতে আরো সময় চায় ১২ দলীয় জোট

মুসলিম লীগ নেতা কুদরতউল্লাহর দাফন

রোহিঙ্গাদের জন্য রেশন হ্রাস রোধে জরুরি তহবিলের আবেদন ডব্লিউএফপি’র

ঋণ পুনঃতফসিল সুবিধা পাচ্ছে বসুন্ধরা গ্রুপ

ইসলামের ছদ্মাবরণে উগ্রপন্থা ও উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে কঠোর হতে হবে

ধর্ষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে নারীদের সমাবেশ

রাষ্ট্রকাঠামোর পরতে পরতে ফ্যাসিবাদের ছায়া বিদ্যমান : ১১৯ নাগরিক

নাহিদের এনসিপি থেকে তিন নেতার পদত্যাগ

রোজায় সবজির দাম সহনীয় নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল

ঈদযাত্রার বাসের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু ১৪ মার্চ

৫ বছর মেয়াদি ট্রেজারি বন্ড রি-ইস্যুর তারিখ নির্ধারণ

দেশি-বিদেশি সফল উদ্যোক্তাদের পুরস্কার দেবে বিডা

শেরপুরে সুবাস ছড়াচ্ছে লিচুর মুকুল

অয়েল ট্যাংকার বিক্রি করবে এমজেএলবিডি

গণহত্যার দায়ে আওয়ামী লীগকে রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে

কুষ্টিয়ায় নারী উদ্যোক্তাকে অনৈতিক প্রস্তাব যুব উন্নয়ন কর্মকর্তার

গফরগাঁওয়ে নতুন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের যোগদান

কুলাউড়ায় পুত্রসহ ইউপি চেয়ারম্যান আটক