আন্দোলনের নামে নৈরাজ্য রুখতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে দাবি-দাওয়া জানানোর প্রতিযোগিতা চলছে। সরকারি কর্মচারী থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শ্রমিক-কর্মচারী, এমন কি হকার-রিকশাওয়ালা পর্যন্ত দাবি-দাওয়ার মিছিলে শামিল হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ৫ আগস্ট অভূতপূর্ব গণআন্দোলনের মাধ্যমে স্বৈরাচার বিদায় করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। সেই শিক্ষার্থীদেরও একাংশ আন্দোলনে নেমেছে। যৌক্তিক-অযৌক্তিক দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে, রাস্তা অবরোধ হচ্ছে, গাড়ি ভাংচুর হচ্ছে। মানুষ আন্দোলকারীদের কাছে অসহায় ও জিম্মী হয়ে পড়েছে। পর্যবেক্ষক মহলের প্রশ্ন: দাবি-দাওয়াকারীরা এতদিন কোথায় ছিল? স্বৈরাচারের আমলে তো তাদের রাস্তায় নামতে দেখা যায়নি। কথা পর্যন্ত তারা বলতে পারেনি। সত্য বটে, স্বৈরাচারের আমলে অনেক ক্ষেত্রে অন্যায়-অনাচার, বৈষম্য-বঞ্চনা ও অবিচার হয়েছে। মানুষ যখন মুক্ত হয়েছে, কথা বলার সুযোগ পেয়েছে, দাবি-দাওয়া আদায়ের অধিকার পেয়েছে, তখন এসবের প্রতিকারে সোচ্চার হয়েছে। এর মধ্যে অস্বাভাবিকতার কিছু নেই। কিন্তু সব কিছুরই একটি অনুকূল সময় আছে। অন্তর্বর্তী সরকার এমনিতেই নানা সংকট-সমস্যার সম্মুখীন। তার ওপর সুনির্দিষ্ট কিছু দায়িত্বও আছে, যা দেশ ও জাতির আগামী দিনের পথচলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এমতাবস্থায়, দাবি-দাওয়ার মিছিল যদি চলতে থাকে তবে সরকারের মূল দায়িত্ব পালনে বিঘœ সৃষ্টি হতে বাধ্য এবং হচ্ছেও। এটা কারো অজানা নেই, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রায় ছয় মাস অতিবাহিত হতে চললেও পতিত স্বৈরাচার ও তার ভারতীয় সহযোগীদের ষড়যন্ত্র বন্ধ হয়নি। তারা যৌথ উদ্যোগে নানাভাবে অন্তর্বর্তী সরকারকে অহেতুক সংকটে ফেলার, ব্যস্ত রাখার এবং ব্যর্থ করে দোয়ার অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ‘আনসার লীগ’, ‘রিকশা লীগ’, গার্মেন্ট লীগ’, ‘সনাতন লীগ’, ‘ইসকন লীগ’ ইত্যাদির দাবি-দাওয়া ও তৎপরতা থেকে এটা বুঝতে মোটেই বেগ পেতে হয় না। এ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারকে শতাধিক দাবি-দাওয়ার আন্দোলন মোকাবিলা করতে হয়েছে। আন্দোলন এখনো চলছেই। সম্প্রীতি ইবতোদায়ি মাদরাসার শিক্ষকরা ঢাকার রাস্তায় আন্দোলনে নেমে পুলিশের মারপিটের শিকার হয়েছেন। পরে অবশ্য দাবি-দাওয়া আদায়ের আশ্বাস পেয়ে ঘরে ফিরে গেছেন। তাদের দাবি যৌক্তিক ও মানবিক। ওদিকে হঠাৎ করেই রেলওয়ের রানিং স্টাফরা রানিং অ্যালাউন্স, পেনশন ও অনুতোষিক সুবিধার দাবিতে কর্মবিরতি পালন করেছেন। ট্রেন চলেনি। যাত্রীদের অশেষ দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে। পরে সরকারি আশ্বাস পেয়ে তারা কাজে যোগ দিয়েছেন।

কারো অজানা নেই, ঢাকার সাত কলেজের শিক্ষার্থীরা অনেক দিন ধরে আন্দোলন করছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার কারণেই তাদের শিক্ষাজীবন ব্যাহত ও নানা রকম সংকটের মুখোমুখী হতে হচ্ছে বলে তারা দাবি করে আসছিল। অধিভুক্তি বাতিল ও অন্যান্য দাবিতে তারা বিক্ষোভ-সমাবেশ, রাস্তাদখল থেকে শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংঘর্ষে পর্যন্ত জড়িত হয়েছে। সরকার সাত কলেজের অধিভুক্তি বাতিল করেছে। এখন তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা ওই কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছে। তারা অনশন করেছে, রাস্তা অবরোধ করেছে, বিক্ষোভ সমাবেশ করেছে। গত শনিবার তারা বিকাল চারটার পর মহাখালী-আমতলী-গুলশান সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে ‘বারাসাত ব্যারিকেড টু নর্থ সিটি’ নামের কর্মসূচি পালন করেছে। এতে পুরো এলাকার যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। চরম ভোগান্তিতে পড়ে মানুষ। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে, সাত কলেজকে নিয়ে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় করার চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। কাজও চলছে। এমন কি, তিতুমীর কলেজের বিষয়টিও বিবেচানায় আছে। এ প্রেক্ষিতে শিক্ষামন্ত্রণালের তরফে বলা হয়েছে, বিদ্যমান বাস্তবতায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করার যৌক্তিকতা নেই। তারপরও তারা তাদের দাবিতে অনড়। এ ধরনের আচরণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কেউ আশা করে না। আমাদের শিক্ষার্থীদের একটা মর্যাদাপূর্ণ ইতিহাস আছে, ঐতিহ্য আছে, আত্মত্যাগের মহিমা আছে এবং বিজয়ের অনন্য গৌরব আছে। ভাষা আন্দোলন থেকে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান পর্যন্ত সব আন্দোলন-সংগ্রামে তাদের অগ্রণী ভূমিকা ও ইতিহাস স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ হয়ে আছে। সেই শিক্ষার্থীদের একাংশ যৌক্তিক-অযৌক্তিক দাবি নিয়ে হাজির হবে, কীভাবে তাদের কাছ থেকে এটা আশা করা যায়? অনেকরই মনে আছে, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর এইচএসসি পরীক্ষায় সব বিষয়ে পরীক্ষা না দিয়ে ফলাফল দেয়ার আবদার জানায় শিক্ষার্থীরা। সরকার তা মেনে নেয়। শিক্ষার্থীরা তাদের এরকম অন্যায় দাবি-দাওয়ার সূত্র ধরে সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করবে কিংবা রাস্তায় অবরোধ করে জনগণকে জিম্মি করবে, এটা মোটেই বরদাশতযোগ্য হতে পারে না। অশিক্ষিত-অর্ধশিক্ষিত শ্রমিক, হকার বা রিকশাওয়ালা যা করতে পারে, সেটাই যদি শিক্ষিত-সচেতন শিক্ষর্থীরা করে তবে উভয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকলো কোথায়?

পর্যবেক্ষকদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকার নরম সরকার। নরম মাটিতে বিড়াল যেমন পা আঁড়ায় তেমনি নরম সরকারের ওপরও ন্যায়-অন্যায়, যৌক্তিক-অযৌক্তিক অনেক চাপ আপতিত হয়। এতে সরকার বিপাকে পড়ে, জনগণ বিপদে পড়ে। সেই অবস্থাটাই এখন চলছে। পতিত স্বৈরাচার এখন দাঁত বের করছে। অন্যদিকে সরকারও আছে নানা সমস্যায়। এটা সরকারের জন্য মোটেই ভালো সময় নয়। সরকারকে প্রয়োজনে কঠোর হতে হবে। যে কোনো পক্ষের দাবি দাওয়ার প্রশ্নে আলোচনাই উৎকৃষ্টপন্থা। আলোচনার মাধ্যমেই যৌক্তিক সমাধান নিশ্চিত হতে পারে আন্দোলনের নামে অরাজকতা সৃষ্টি ও জনগণকে জিম্মি করা যাবে না। এটা আন্দোলনকারীদের মনে রাখতে হবে। সরকারকেও উদার ও উন্মুক্ত মনোভাব নিয়ে যে কোনো দাবি ও সংকট নিরসনে সচেষ্ট হতে হবে। সকল ধরনের নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া সরকারের দায়িত্বের অংশ ও সক্ষমতার পরিচায়ক। অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচিত সরকার নয় বটে, কিন্তু এ সরকার জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত সরকার। জনইচ্ছা ও জনসমর্থনই এ সরকারের শক্তির ভিত্তি। সরকারকে তাই যে কোনো অপকর্ম, অন্যায়, অবিচার ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। দ্বিধাহীনভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বালাকোট যুদ্ধ : মুসলিম নবচেতনার মাইলফলক
বেগম জিয়ার বীরোচিত প্রত্যাবর্তন : মাইনাস টু নিয়ে ভারতীয় প্রোপাগান্ডার বেলুন ফুটো
অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক সংকট বাড়ছে
আওয়ামী লীগ ঘাতক ও সন্ত্রাসী দল
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা : সম্ভাবনার পথ অন্বেষণ করতে হবে
আরও
X
  

আরও পড়ুন

এবার হত্যার হুমকি পেলেন শামি

এবার হত্যার হুমকি পেলেন শামি

ছেলে-মেয়েদের খুশির জন্য এসেছি,এটাই হয়তো শেষ!

ছেলে-মেয়েদের খুশির জন্য এসেছি,এটাই হয়তো শেষ!

আমিরকে নিয়ে আয়ারল্যান্ড ও ইংল্যান্ড সফরের উইন্ডিজ দল

আমিরকে নিয়ে আয়ারল্যান্ড ও ইংল্যান্ড সফরের উইন্ডিজ দল

টেকসই উন্নয়নে সব খাতে ন্যায্য রূপান্তরের আহ্বান পরিবেশ উপদেষ্টার

টেকসই উন্নয়নে সব খাতে ন্যায্য রূপান্তরের আহ্বান পরিবেশ উপদেষ্টার

কিশোরগঞ্জে পৃথক বজ্রপাতে দুই উপজেলায় তিন ছাত্রীসহ চার জনের মৃত্যু

কিশোরগঞ্জে পৃথক বজ্রপাতে দুই উপজেলায় তিন ছাত্রীসহ চার জনের মৃত্যু

লাকসামে রেলের জমিতে হকার্স মার্কেট, ইজারা দিচ্ছে পৌরসভা

লাকসামে রেলের জমিতে হকার্স মার্কেট, ইজারা দিচ্ছে পৌরসভা

বিস্ফোরণে প্রকম্পিত পোর্ট সুদান, নতুন করে দানা বাঁধছে মানবিক বিপর্যয়

বিস্ফোরণে প্রকম্পিত পোর্ট সুদান, নতুন করে দানা বাঁধছে মানবিক বিপর্যয়

খালেদা জিয়ার আগমনী অভ্যর্থনায় অংশগ্রহণকারীগণকে ধন্যবাদ: বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন

খালেদা জিয়ার আগমনী অভ্যর্থনায় অংশগ্রহণকারীগণকে ধন্যবাদ: বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন

বছর জুড়ে শিশুর টিকার সংকট, অভিভাবদের দুশ্চিন্তা

বছর জুড়ে শিশুর টিকার সংকট, অভিভাবদের দুশ্চিন্তা

গাজায় ইসরাইলি হামলা চলছেই, যুদ্ধবিরতি ‘অর্থহীন’ জানালো হামাস

গাজায় ইসরাইলি হামলা চলছেই, যুদ্ধবিরতি ‘অর্থহীন’ জানালো হামাস

নরসিংদীতে দাফনের ৬ মাস পর সাবেক পৌর কমিশনারের মরদেহ উত্তোলন

নরসিংদীতে দাফনের ৬ মাস পর সাবেক পৌর কমিশনারের মরদেহ উত্তোলন

চিকিৎসাধীন মাকে দেখতে আজই হাসপাতালে যাচ্ছেন ডা. জোবাইদা

চিকিৎসাধীন মাকে দেখতে আজই হাসপাতালে যাচ্ছেন ডা. জোবাইদা

হেঁটে ফিরোজায় ঢুকলেন খালেদা জিয়া

হেঁটে ফিরোজায় ঢুকলেন খালেদা জিয়া

বহুল আলোচিত তালার ইউএনওকে রংপুরে বদলি

বহুল আলোচিত তালার ইউএনওকে রংপুরে বদলি

সালথায় আমগাছে ঝুলছিল যুবকের ঝুলন্ত লাশ

সালথায় আমগাছে ঝুলছিল যুবকের ঝুলন্ত লাশ

পঞ্চগড়ে সাবেক ডিসি-এসপি ও এমপি-মন্ত্রীর নামে হত্যা মামলা

পঞ্চগড়ে সাবেক ডিসি-এসপি ও এমপি-মন্ত্রীর নামে হত্যা মামলা

চার খাতে এডিবির কাছে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা

চার খাতে এডিবির কাছে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা

ঝিনাইদহে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু

ঝিনাইদহে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু

নরসিংদীর রায়পুরায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ১ জন নিহত, আহত-১

নরসিংদীর রায়পুরায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ১ জন নিহত, আহত-১

ঈদুল আজহায় ছুটি ১০ দিন : প্রেস সচিব

ঈদুল আজহায় ছুটি ১০ দিন : প্রেস সচিব