বিশ্বাসঘাতক রাজনৈতিক দল ও গণহত্যাকারীদের সাথে আপসের সুযোগ নেই

Daily Inqilab জামালউদ্দিন বারী

০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম | আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

সাড়ে ১৫ বছর পর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনাসহ তার সাঙ্গপাঙ্গদের হাত অসংখ্য নিরপরাধ মানুষের রক্তে রঞ্জিত। তাদের বাড়িঘর, জমিজিরাত ও ব্যাংক-ব্যালেন্স কোটি মানুষের ঘাম ঝরানো পরিশ্রমের ফসল চুরি করে গড়ে উঠেছে। গুম হওয়া শত শত মানুষের পরিবার এখনো অজ্ঞাত-অনাবিস্কৃত আয়নাঘরের সন্ধানে মরিয়া হয়ে ঘুরছে। পিতা-মাতা ও সন্তানের চোখের অশ্রু শুকিয়ে গেলেও খুনি চক্রের এতটুকু অনুতাপ ও অনুশোচনা নেই। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের হাতে গুম হওয়া লোকগুলোর কারো কারো শিশু-কিশোর সন্তানেরা মায়ের সাথে, আত্মীয় পরিজনের সঙ্গী হয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে তাদের করুণ আর্তি প্রকাশ করেছিল, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্টি আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিন’। ইলিয়াস আলীর স্ত্রী-সন্তানদের আশ্বাসও দেয়া হয়েছিল। গণভবনে শেখ হাসিনার চোখে নাটুকে কুম্বিরাশ্রু দেখে অনেকে আশা করেছিল, হয়তো তার হৃদয় কিছুটা নরম হয়েছে। গুম হওয়া মানুষটি হয়তো ফিরে আসতে পারে। কিন্তু না, ৫ আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ব্রিগেডিয়ার আমান আযমি, ব্যারিস্টার আরমানসহ খুব ভাগ্যবান দু’চারজন ফিরে আসলেও বেশিরভাগই ফিরে আসেনি। এর আগে ভারতে চালান হয়ে যাওয়া কয়েকজন ভাগ্যক্রমে ফিরে আসতে পেরেছিল। বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মামলার সাক্ষী সুখরঞ্জন বালিও ভারত থেকে ফিরে এসেছেন। এমন আরো কত সংখ্যক মানুষকে ভারতে নিয়ে হত্যা কিংবা বায়োলজিক্যাল ল্যাবের কাঁচামালে পরিনত করা হয়েছে, তার কোনো সঠিক তথ্য আমাদের হাতে নেই। সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান যদি অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা না হতেন, সিনহা হত্যার আগে ১৬৭ জনকে ক্রসফায়ারে হত্যাকারী ওসি প্রদীপ কুমারের সিরিজ কিলিং মিশন ও নারী ধর্ষণের হিসাব কোথায় গিয়ে থামতো, তা ভাবলে যে কারো পিলে চমকে যেতে পারে। কোটি কোটি টাকা চাঁদা আদায়ের শর্ত পূরণ না হলেই ক্রসফায়ার ও স্ত্রী-কন্যাদের বাড়ি থেকে ধরে এনে ধর্ষণের বিভীষিকাময় কাহিনী তাদের কাছে স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠেছিল। পিলখানায় ৫৭ জন সেনা অফিসার হত্যার মধ্য দিয়ে ভারতীয় প্রেসক্রিপশন ও সক্রিয় অংশগ্রহণে বাংলাদেশে দেশপ্রেমিক মানুষের উপর যে টার্গেট কিলিং শুরু হয়েছিল, জুলাই বিপ্লবের সময় হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে, যাত্রাবাড়িতে, নতুন বাজারে, উত্তরায়, মিরপুরে, চানখার পুলে আর চট্টগ্রাম, দিনাজপুর, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, কুমিল্লা, মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জের রাজপথে হাজার হাজার ছাত্র-জনতার উপর ফ্যাসিস্ট পুলিশের শত শত মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে যদি ছাত্র-জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়া যেত, তাহলে আজকের বাংলাদেশের সিনারিও কী হতো তথাকথিত রাজনৈতিক সুশীলরা কি তা ভেবে দেখেছেন, যারা এখনই আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পুর্নবাসনের বুলি কপচাচ্ছেন? যারা শেখ মুজিবের মূর্তির জন্য মায়াকান্না দেখিয়েছেন, আর যারা রাজপথে শত শত শিক্ষার্থীর লাশ ডিঙ্গিয়ে মেট্রোরেল কিংবা বিটিভি ভবনের ভাঙ্গা গেট-জানালার কাঁচ, ভাঙ্গা মনিটর দেখে কুম্বিরাশ্রু ফেলার ফটোসেশন করেছেন, তাদের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? অর্ধশত বছরের মিথ্যা ইতিহাসের ন্যারেটিভ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন বাংলাদেশের পথচলা ইতিহাসের নতুন গতিপথ নির্দেশ করছে।

আওয়ামী ফ্যাসিবাদ এদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা ভারতীয় প্রেসক্রিপশনে এ দেশে সামাজিক-রাজনৈতিক চিরস্থায়ী বিরোধের ইসলামোফোবিক রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করেছে। তারা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে সেই বিভক্তি ও ইসলাম বিদ্বেষের রসদ ও ন্যারেটিভ হিসেবে গ্রহণ করলেও মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য বাস্তবায়নে কখনো কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। মূলত ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিজয়ের চেতনা কৃতিত্ব ও ইতিহাসের মেরুদ- হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি গণযুদ্ধ। স্বাধীনতার ঘোষক মেজর জিয়া, জেনারেল ওসমানী, মেজর জলিল, খালেদ মোশাররফ, কর্নেল তাহের, কর্ণেল ফারুক, রশীদ, মেজর ডালিম, বজলুল হুদাদের মত অকুতোভয় সৈনিকদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই যুদ্ধে কয়েক লাখ মুক্তিযোদ্ধার সাথে দেশের কোটি কোটি মানুষের পরিবার একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। যেখানে নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী হয়েও ক্ষমতায় বসতে না পারা আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে অপারগতা প্রকাশ করে আপসে ধরা দিয়ে পাকিস্তানের জেলে গিয়ে এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক ভাগ্য পাকিস্তানি জান্তা সরকারের সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দিয়েছিলেন। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের ৫৪ বছরের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ইতিহাস, ভারতীয় আধিপত্যবাদী আগ্রাসনে আষ্ঠে-পৃষ্ঠে বাঁধা পরা স্বৈরতন্ত্র, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে ৫৪টি অভিন্ন নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ ও পানি প্রত্যাহারের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইকোলজিক্যাল অস্তিত্বকে টুঁটি চেপে ধরার ধারাবাহিক কার্যক্রম কিংবা বাংলাদেশের মানুষের চিরন্তণ গণতান্ত্রিক আকাক্সক্ষাকে দাবিয়ে রাখতে গুম-খুন, গণহত্যার মধ্য দিয়ে বাকশালি-আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসন চিরস্থায়ী করার বাস্তব চিত্র প্রত্যক্ষ করার মধ্য দিয়ে কেউ যদি মনে করে, একাত্তরে যে যুক্তি ও আশঙ্কার কথা বলে কতিপয় ইসলামি রাজনৈতিক দল স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছিল, তাকে স্বাধীনতা বিরোধিতার তকমা দেয়া গেলেও এই প্রয়াসকে নতুন প্রজন্ম প্রকৃত সত্যকে আড়াল করার অপপ্রয়াস হিসেবে অভিযুক্ত করলে তাদেরকে দোষারোপ করা যাবে কি? একজন সিরিয়াল কিলার, খুনি ও সামাজিক-রাজনৈতিক বিভেদ-বৈষম্য সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক নেতা যখন বিদেশি সহায়তায় ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে অগণতান্ত্রিক পন্থায় রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে তা চিরস্থায়ী করতে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরও একাত্তরের রাজনৈতিক বিভাজনকেই ফ্যাসিবাদের ন্যারেটিভ নির্মাণে ব্যবহার করেন, নতুন প্রজন্ম তা প্রত্যাখ্যান করবেই। জুলাই অভ্যুত্থানে তারা তাই করেছে। গণহত্যাকারী প্রধানমন্ত্রী যখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কর্মীদের রাজাকারের নাতিপুতি বলে ট্যাগ লাগিয়েছেন, তারা সাথে সাথেই তার জবাবে, ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার-রাজাকার’ শ্লোগান নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে রাজপথে নেমে এসেছিল। একাত্তুরের রাজাকারদের চেয়ে ১৬ বছরের গুম-খুন, পিলখানা ম্যাসাকার, শাপলাচত্বর ম্যাসাকার, ২৪-এর গণহত্যার কুশীলবরা অনেক বেশি ঘৃণিত-ধিকৃত হয়ে থাকবে। এতবড় গণহত্যা ও গণঅভ্যুত্থানের পরও আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে কোনো আত্মসমালোচনা কিংবা অনুশোচনা নেই। গণহত্যা, লুটপাটের মত অপরাধের বিচার ও রাজনৈতিক রি-কনসিলিয়েশন না হওয়া পর্যন্ত তাদের প্রতি জনগণের ধিক্কার ও সংক্ষোভ কমবে না। থামবে না।

বাংলাদেশে বিভাজন ও এন্টাগনিজমের রাজনৈতিক ন্যারেটিভ ভারতীয় আধিপত্যবাদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসির প্রধান অংশ। গত ৫৩ বছর ধরে ভারতীয় আধিপত্যবাদের মূল অংশীজন ছিল বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিব পরিবারবর্গ। হাজার হাজার মানুষকে গুম-খুন ও গণহত্যার পরও অভ্যুত্থান ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্র ও মনস্তত্ব আমূল পাল্টে যাওয়ার পরও মাসের পর মাস ধরে পতিত শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে রাজনীতিতে পুর্নবাসিত করার অবিরাম অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা। ভারতীয় উপমহাদেশের ডেমোগ্রাফি থেকে বাংলাদেশকে কখনোই পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করা সম্ভব নয়। ভূরাজনৈতিক কৌশলগত কারণে বাংলাদেশের গুরুত্বকে ভারত কখনোই অগ্রাহ্য করতে পারবে না। এহেন গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রতিবেশীকে তারা নিজেদের কায়েমি স্বার্থের গিনিপিগ বানিয়ে রাখতে যে আগ্রাসি রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছে, এ যুগে তা অচল। ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাও বাংলাদেশের সাথে সম্পর্কের প্রশ্নে অতিমাত্রায় শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগ নির্ভরতাকে ‘এক ঝুড়িতে সব ডিম’ রাখার ঝুঁকি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। বাংলাদেশের ঘটমান বাস্তবতায় অনেকে এখন আর আওয়ামী লীগকে একটি সাধারণ রাজনৈতিক দল হিসেবে মানতেই নারাজ। তারা আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার একটি প্রজেক্ট হিসেবেই মনে করছে। দেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষের আকাক্সক্ষা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে দাবিয়ে রেখে বিনা ভোটে ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী রাখতে হাসিনার বিকল্প আর কেউ ছিল না। বাংলাদেশের জনগণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বজনমতকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশে গণতন্ত্র হত্যা, মানবাধিকার হরণ এবং রক্তাক্ত রাজনৈতিক পটভ’মি সৃষ্টির ক্ষেত্রে অসুরের প্রতি ভারতের নির্লজ্জ পক্ষপাতী ভূমিকা সেই সত্যকেই বার বার তুলে ধরেছে। হাজার হাজার মানুষের উপর নির্বিচার গুলি চালিয়ে অগ্নিগিরির মত গণরোষের মুখে পালিয়ে যাওয়ার পরও হাসিনাকে দিল্লীতে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তী সরকারের বিরুদ্ধে অবিরাম বিষোদগার এবং অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির ধারাবাহিক কার্যক্রমে দিল্লীর প্রত্যক্ষ মদত ও অংশগ্রহণ লুকোছাপা করার মত নয়। ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী গণমাধ্যমগুলো নির্জলা মিথ্যাচার চালিয়ে বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তী সরকার সম্পর্কে বিশ্বজনমত পাল্টে দেয়ার ক্যাম্পেইন ব্যর্থ হওয়ার পরও বাংলাদেশের সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, বিশাল বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক স্বার্থের চেয়েও যেন হাসিনাকে রক্ষা করাই মোদি সরকারের মূল লক্ষ্য। হাসিনা ভারতকে সবকিছু উজাড় করে দিয়ে বলেছিলেন, আমি ভারতকে যা দিয়েছি, ভারত তা চিরদিন মনে রাখবে। দেশ, জাতি, নিজের দলের লাখ লাখ নেতাকর্মীর স্বার্থ ও নিরাপত্তা কথা অগ্রাহ্য করে বাংলাদেশের মৌলিক স্বার্থসমুহ ভারতের হাতে তুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে জাতির সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতার বিনিময়ে ভারত তার বিশ্বস্ত এজেন্টকে রক্ষায় যা করণীয় তাই করছে! ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা সম্ভবত হাসিনাকে দিয়ে এখনো আরো বড় কিছু অর্জনের প্রত্যাশা করছে। তা না হলে শত শত কোটি ডলারের বাণিজ্যসহ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অনিবার্যতার কথা অগ্রাহ্য করে শেখ হাসিনাকে রক্ষার এমন হঠকারিতার কোনো কারণ থাকতে পারেনা। বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্যুত করে, জঙ্গিবাদ ও একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধের ভুল ন্যারেটিভ ব্যবহার করে, এখানকার সব রাজনৈতিক অক্ষ ও প্রতিরোধ শক্তিকে দুর্বল করে শেখ হাসিনাকে কাজী লেন্দুপ দর্জির ভূমিকায় নামিয়ে সিকিমের মত বাংলাদেশকে ভারতীয় ইউনিয়নভুক্ত করার কাজটিই শুধু বাকি ছিল।

শেখ মুজিব থেকে শেখ হাসিনার শেষ সময় পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এ দেশের মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অধিকার, লাখো শহীদের রক্ত ও দেশের সব মানুষের স্বপ্ন ও প্রত্যাশার সংগ্রামের সাথে বার বার বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকদের হাতে পিতা শেখ মুজিবসহ পরিবারের সদস্যদের নির্মম মৃত্যু শেখ হাসিনাকে কিছুই শেখাতে পারেনি। জনপ্রিয় দলের নেতা হিসেবে রাষ্ট্র প্রধান হিসেবে ব্যক্তি যত বড়ই হোন, লাখো মানুষের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন একটি জাতিরাষ্ট্রের মূল আকাক্সক্ষা ও স্বপ্নের সাথে আপস কিংবা বিশ্বাসঘাতকতার পরিনাম সব সময়ই ভয়ঙ্কর হয়। শেখ মুজিব এবং শেখ হাসিনার পতন তার জ্বলন্ত উদাহরণ। কারো জন্যই কোনো কিছুই থেমে থাকে না। লড়াইটা এখানেই শেষ হয়ে নতুন বাংলাদেশের সাথে ভারত নতুন সম্পর্কের ভাবতেই পারে। কিন্তু না। তারা যেন ডিস্ট্যাবিলাইজেশন প্রকল্পের আওতায় শেখ হাসিনাকে নিয়ে এখনো ভূ-রাজনৈতিক জুয়াখেলায় মত্ত রয়েছে। তাদের শেষ ভরসা ছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতা ক্ষমতা গ্রহণের পর ড. ইউনূসের প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি করে, মার্কিন সহযোগিতা নিয়ে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করার মাধ্যমে ভারতীয় আধিপত্যবাদী এজেন্ডার সর্বশেষ ধাপে পৌঁছাতে পারবে। বিধি বাম। ডোনাল্ড ট্রাম্প ভূরাজনৈতিক খেলার প্রথম রাউন্ডে মোদির চেয়ে ড. ইউনূসকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন বলে প্রতিয়মান হচ্ছে। এমনকি নিজের অভিষেক অনুষ্ঠানে শি জিন পিংকে আমন্ত্রণ জানালেও নরেন্দ্র মোদিকে দাওয়াত দেননি। ট্রাম্প এক সময় মোদিকে নিজের বন্ধু বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি এবার প্রমাণ করলেন, ব্যক্তিগত ও দলীয় বন্ধুত্বের চেয়ে জাতীয় স্বার্থ ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ভারতীয় মিডিয়া ও আওয়ামী লেসপেন্সাররা গত কয়েকমাস ধরে বগল বাজাচ্ছিল, ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশে অর্ন্তবর্তী সরকারের গনেশ উল্টে যাবে। কিন্তু ঘটল বিপরীত ঘটনা। ট্রাম্প দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথমেই বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রতি শুভেচ্ছা বার্তা জানিয়েছেন, অত:পর বাংলাদেশের সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানি(এলএনজি) সরবরাহ চুক্তি সই করেছেন। আর মোদির সাথে ট্রাম্পের ফোনালাপে কি বার্তা দেয়া হয়েছে, তা প্রকাশিত না হলেও ইংরেজী নববর্ষের ২৭ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর জানুয়ারির ২৭ তারিখে শ্রী নরেন্দ্র দমোদর দাস মোদি বাংলাদেশের অর্ন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূসকে ইংরেজী নববর্ষের শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন। এর মানে দাঁড়াচ্ছে, ভারত হয়তো আপাত দৃষ্টে বাংলাদেশ প্রশ্নে তার আওয়ামী পিরিতি কাটিয়ে নতুন সম্পর্কের বাতাবরণ তৈরী করতে চাইবে। কিন্তু বাংলাদেশে গত ৫৪ বছরে গড়ে ওঠা ভারতীয় সফ্ট পাওয়ারের এস্টাবলিশমেন্ট কি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দিক নির্দেশ পাবে? নাকি আওয়ামী লীগের জায়গায় অন্যকোনো দলের নেতাদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে পুরনো রাজনৈতিক বন্দোবস্ত টিকিয়ে রেখে ভারতীয় আধিপত্যবাদের সাংস্কৃতিক ও আমলাতান্ত্রিক নাগপাশকে আলিঙ্গণ করে ক্ষমতার হালুয়া-রুটি ভোগে মত্ত হবে। শহীদ মুক্তিযোদ্ধা, পিলখানার শহীদ সৈনিক, শাহবাগের তৌহিদী জনতা ও চব্বিশের বিপ্লবীদের রক্ত ঋণের কথা ভুলে গিয়ে কেউ যদি ভারসাম্যহীন ভারত প্রীতি ও পরনো রাজনৈতিক বন্দোবস্তে নিয়ে যেতে চায় তাকে শেখ হাসিনার পরিনতি ভোগ করতে হবে। এ দেশের ১৮ কোটি মানুষকে আর ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়ে ফায়দা হাসিলের ভাগবাটোয়ারা টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়।

bari_zamal@yahoo.com


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বালাকোট যুদ্ধ : মুসলিম নবচেতনার মাইলফলক
বেগম জিয়ার বীরোচিত প্রত্যাবর্তন : মাইনাস টু নিয়ে ভারতীয় প্রোপাগান্ডার বেলুন ফুটো
অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক সংকট বাড়ছে
আওয়ামী লীগ ঘাতক ও সন্ত্রাসী দল
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা : সম্ভাবনার পথ অন্বেষণ করতে হবে
আরও
X
  

আরও পড়ুন

ছেলে-মেয়েদের খুশির জন্য এসেছি,এটাই হয়তো শেষ!

ছেলে-মেয়েদের খুশির জন্য এসেছি,এটাই হয়তো শেষ!

আমিরকে নিয়ে আয়ারল্যান্ড ও ইংল্যান্ড সফরের উইন্ডিজ দল

আমিরকে নিয়ে আয়ারল্যান্ড ও ইংল্যান্ড সফরের উইন্ডিজ দল

কিশোরগঞ্জে পৃথক বজ্রপাতে দুই উপজেলায় তিন ছাত্রীসহ চার জনের মৃত্যু

কিশোরগঞ্জে পৃথক বজ্রপাতে দুই উপজেলায় তিন ছাত্রীসহ চার জনের মৃত্যু

লাকসামে রেলের জমিতে হকার্স মার্কেট, ইজারা দিচ্ছে পৌরসভা

লাকসামে রেলের জমিতে হকার্স মার্কেট, ইজারা দিচ্ছে পৌরসভা

বিস্ফোরণে প্রকম্পিত পোর্ট সুদান, নতুন করে দানা বাঁধছে মানবিক বিপর্যয়

বিস্ফোরণে প্রকম্পিত পোর্ট সুদান, নতুন করে দানা বাঁধছে মানবিক বিপর্যয়

খালেদা জিয়ার আগমনী অভ্যর্থনায় অংশগ্রহণকারীগণকে ধন্যবাদ: বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন

খালেদা জিয়ার আগমনী অভ্যর্থনায় অংশগ্রহণকারীগণকে ধন্যবাদ: বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন

বছর জুড়ে শিশুর টিকার সংকট, অভিভাবদের দুশ্চিন্তা

বছর জুড়ে শিশুর টিকার সংকট, অভিভাবদের দুশ্চিন্তা

গাজায় ইসরাইলি হামলা চলছেই, যুদ্ধবিরতি ‘অর্থহীন’ জানালো হামাস

গাজায় ইসরাইলি হামলা চলছেই, যুদ্ধবিরতি ‘অর্থহীন’ জানালো হামাস

নরসিংদীতে দাফনের ৬ মাস পর সাবেক পৌর কমিশনারের মরদেহ উত্তোলন

নরসিংদীতে দাফনের ৬ মাস পর সাবেক পৌর কমিশনারের মরদেহ উত্তোলন

চিকিৎসাধীন মাকে দেখতে আজই হাসপাতালে যাচ্ছেন ডা. জোবাইদা

চিকিৎসাধীন মাকে দেখতে আজই হাসপাতালে যাচ্ছেন ডা. জোবাইদা

হেঁটে ফিরোজায় ঢুকলেন খালেদা জিয়া

হেঁটে ফিরোজায় ঢুকলেন খালেদা জিয়া

বহুল আলোচিত তালার ইউএনওকে রংপুরে বদলি

বহুল আলোচিত তালার ইউএনওকে রংপুরে বদলি

সালথায় আমগাছে ঝুলছিল যুবকের ঝুলন্ত লাশ

সালথায় আমগাছে ঝুলছিল যুবকের ঝুলন্ত লাশ

পঞ্চগড়ে সাবেক ডিসি-এসপি ও এমপি-মন্ত্রীর নামে হত্যা মামলা

পঞ্চগড়ে সাবেক ডিসি-এসপি ও এমপি-মন্ত্রীর নামে হত্যা মামলা

চার খাতে এডিবির কাছে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা

চার খাতে এডিবির কাছে সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা

ঝিনাইদহে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু

ঝিনাইদহে বজ্রপাতে দুই কৃষকের মৃত্যু

নরসিংদীর রায়পুরায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ১ জন নিহত, আহত-১

নরসিংদীর রায়পুরায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ১ জন নিহত, আহত-১

ঈদুল আজহায় ছুটি ১০ দিন : প্রেস সচিব

ঈদুল আজহায় ছুটি ১০ দিন : প্রেস সচিব

ইরান-ভারত-পাকিস্তান কূটনীতি, উত্তেজনা প্রশমনে মধ্যস্থতার পথে আব্বাস আরাগচি

ইরান-ভারত-পাকিস্তান কূটনীতি, উত্তেজনা প্রশমনে মধ্যস্থতার পথে আব্বাস আরাগচি

এটিএম আজহারের আপিল শুনানি বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি

এটিএম আজহারের আপিল শুনানি বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি