বিশ্বমানের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নিতে হবে
০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম | আপডেট: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০১ এএম

চিকিৎসা মানুষের মৌলিক এবং অতীব প্রয়োজনীয় একটি বিষয়। মাানুষের জীবনে রোগবালাই যেমন সময়ের সঙ্গী, ঠিক তেমনি এই রোগবালাইয়ের সঠিক চিকিৎসা পাওয়া তার মৌলিক অধিকার। অসুস্থ হলেই মানুষের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে কাল ক্ষেপণের কোনো সুযোগ নাই। অসুখবিসুখ ছাড়াও বিভিন্ন দুর্ঘটনায় মানুষ আহত হয়। তখন তাদের সঠিক চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। ক্ষুধা পেলে যেমন খাবার খেতে হয়, তেমনি অসুস্থ হলে সুস্থ হবার জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। কিন্তু ক্ষুধা নিবারণের জন্য ঘরেবাইরে যেখানে-সেখানে খাবার পাওয়া গেলেও সুস্থ হবার জন্য যেখানে-সেখানে চিকিৎসা পাওয়া না এবং চিকিৎসা করাও যায় না। চিকিৎসার জন্য ডাক্তার, ঔষধ এবং হাসপাতালের প্রয়োজন হয়। আমাদের দেশে ডাক্তার এবং হাসপাতাল দুটোই প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। তাছাড়া জটিল রোগের চিকিৎসার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, উন্নত মানের চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত হাসপাতালের অভাব রয়েছে। এ অবস্থানে দেশে বিশ্বমানের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা জরুরি হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশ। এত বিশাল সংখ্যক মানুষের চিকিৎসা সেবার জন্য বিরাট সংখ্যক বিশ্বমানের হাসপাতাল দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে উপজেলা-জেলা এবং বিভাগীয় শহরগুলোতে যেসব হাসপাতাল রয়েছে, সেগুলোর মান বিশ্বমানের নয়। বিশেষ করে, উপজেলা সদরের যেসব সরকারি হাসপাতাল রয়েছে, সেগুলোতে চিকিৎসা সেবার মান কাক্সিক্ষত মানের নয়। এসব হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নাই, উন্নত মানের চিকিৎসা সরঞ্জাম নাই এবং দক্ষ জনবল নাই। অধিকাংশ ডাক্তারই উপজেলা পর্যায়ে চাকরি এবং পরিবার নিয়ে সেখানে বসবাস করতে চায় না। উপজেলায় পোস্টিং হলেই শহরে চলে আসার জন্য তদবিরে ব্যস্ত থাকে। তাছাড়া যতদিন উপজেলায় পোস্টিং থাকে, ততদিনই তারা চাকুরির সময়টুকু কাটিয়ে সন্ধ্যায় শহরে চলে আসতে চায়। এ অবস্থায় জটিল রোগে আক্রান্ত মানুষ উপজেলা পর্যায়ে যথাযথ চিকিৎসা পায় না। ফলে তারা শহরে চলে আসে। সব শহরেও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং ভালো মানের হাসপাতাল নাই। ফলে তারা বিভাগীয় শহরে চলে আসে। বিভাগীয় শহরগুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকলেও এখানকার হাসপাতালগুলোতে সকল রোগের চিকিৎসা করার মতো সুযোগ-সুবিধা নাই। এ অবস্থায় সামর্থ্যবান মানুষেরা উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশ চলে যায়। যাদের সামর্থ্য নাই তারা বাধ্য হয়ে দেশেই চিকিৎসা করে। সুস্থ হলে হয়, না হলে নিয়তিকেই মেনে নেয়।
প্রতি বছর এদেশ থেকে বিরাট সংখ্যক মানুষ চিকিৎসা করতে বিদেশে যায়। ভারত, থাইল্যান্ড এবং সিঙ্গাপুর- এই তিনটি দেশেই সাধারণত এদেশের মানুষ চিকিৎসা নিতে যায়। মোট রোগীর প্রায় ৯০ ভাগই ভারতে এবং বাকিরা সিঙ্গাপুর অথবা থাইল্যান্ডে যায়। তবে কিছু মানুষ ইউরোপ এবং আমেরিকাতেও যায়। চিকিৎসা নিতে সাধারণত মধ্যবিত্ত পরিবারের লোকজন ভারত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের লোকজন সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড এবং ইউরোপ-আমেরিকায় যায়। এ খাতে এদেশ থেকে প্রতি বছর বিরাট অংকের টাকা বিদেশে চলে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, বিদেশে চিকিৎসায় প্রতি বছর বাংলাদেশ থেকে পাঁচ বিলিয়ন মার্কিন ডলার চলে যায়। গত ১৫ ডিসেম্বর পলিসি রিসার্চ ইনিস্টিটিউট কর্তৃক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এ তথ্য প্রকাশ করেন। আমরা যদি এদেশে বিশ্বমানের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করি তাহলে চিকিৎসার জন্য এত বিরাট সংখ্যক মানুষকে আর বিদেশ যেতে হবে না। এভাবে এই খরচটা সাশ্রয় করতে পারি, যা আমাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখবে। তাছাড়া বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা করতে হলে রোগী এবং তার পরিবারকে অনেক ঝক্কি-ঝামেলা সামলাতে হয়। প্রথমত রোগীকে বিদেশে যেতে হয়। তাকে দেখাশোনা করার জন্য একজন লোককে রোগীর সাথে বিদেশ যেতে হয় এবং তাকে রোগীর সাথে সার্বক্ষণিক অবস্থান করতে হয়। চিকিৎসা খরচের পাশাপাশি তাদের পরিবহন এবং আবাসনেও অনেক অর্থ খরচ করতে হয়। রোগীর সাথে বিদেশে যাওয়া এবং সেখানে থাকার মতো উপযুক্ত মানুষও সব সময় পাওয়া যায় না। ইচ্ছা করলেই যখন তখন বিদেশে যাওয়া সম্ভব হয় না। সঠিক সময়ে পাসপোর্ট, ভিসা এবং বিমানের টিকিট পাওয়ার বিষয়সমূহ তো রয়েছেই। বিদেশ মানে সব কিছুই অপরিচিত এবং অজানা। ফলে এখানেও অনেক সমস্যা।
আমরা যদি এদেশে বিশ্বমানের কিছু হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করি, তাহলে সহজেই বিরাট একটি সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। এতে সার্বিকভাবেই দেশের জনগণ উপকৃত হবে এবং দেশ অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশে অনেক শিল্পপতি কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা পরিচালনা করছে এবং হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা করছে। বড় আকারের বিনিয়োগ এবং বৃহৎ আকারের শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার যোগ্যতা এবং সক্ষমতা এদেশের অনেক মানুষের রয়েছে। এখন এসব ব্যক্তিকে বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি বড় আকারের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসতে হবে। বাংলাদেশে ৮টি বিভাগ রয়েছে। প্রাথমিকভাবে এসব বিভাগীয় শহরে অন্তত পক্ষে একটি করে মোট আটটি বিশ্বমানের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাহলে দেশের প্রতিটি এলাকার মানুষ তাদের নিকটবর্তী হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে পারবে। এগুলো হবে বিশেষায়িত হাসপাতাল অর্থাৎ এখানে কেবল জটিল রোগের চিকিৎসা হবে। সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ চিকিৎসা সরঞ্জাম এখানে থাকতে হবে। হাসপাতালের পাশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, নার্স, কর্মকর্তা এবং রোগীর আত্মীয়-স্বজনের থাকার জন্য আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। এটি হবে একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল কমপ্লেক্স, যেখানে একজন রোগী তার প্রয়োজনীয় সকল চিকিৎসাসেবা এক জায়গায় পাবে। এসব হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে ডাক্তারদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের এগিয়ে আসতে হবে। শহরের বাইরেই এসব হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিভিন্ন দেশে অবস্থিত বিশ্বমানের হাসপাতালসমূহের সাথে যৌথ উদ্যোগেও আমরা এসব হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা এবং পরিচালনা করতে পারি। এসব প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আমরা নিয়মিত কারিগরি সহযোগিতাও নিতে পারি।
আমরা যদি এদেশে বিশ্বমানের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করি, তাহলে এদেশের মানুষ দেশেই চিকিৎসা করতে পারবে। এতে বিরাট পরিমাণে অর্থ সাশ্রয় হবে এবং মানুষের ভোগান্তিও কমবে। পাশাপাশি বিদেশিদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে পারব। বাংলাদেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা উন্নত হলে নেপাল, ভুটান, ভারতের সেভেন সিস্টার্স, পশ্চিমবঙ্গ এবং মিয়ানমারের জনগণ চিকিৎসা নিতে এদেশে আসবে। তখন এদেশের পর্যটন খাতও উন্নত হবে এবং এখাত থেকেও প্রচুর আয় হবে। আমরা বাংলাদেশকে উন্নত চিকিৎসার কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে পারি। বর্তমানে দেশে ৩৭টি সরকারি এবং ৭৪টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। প্রতিবছর দেশের সেরা মেধাবী ছাত্রছাত্রীরা মেডিকেলে পড়ার জন্য ভর্তি হয় এবং প্রতি বছরই এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ১২ হাজার ডাক্তার পাশ করে। এদের অনেকেই পরবর্তীতে দেশ-বিদেশ হতে আরো উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারে পরিণত হন। এসব বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের অনেকেই দেশে-বিদেশে অত্যন্ত সুনামের সাথে চিকিৎসা পেশায় নিয়োজিত আছেন এবং তারা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মানুষের জটিল রোগের চিকিৎসা করছেন। বিদেশে কর্মরত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের দেশের হাসপাতালসমূহে আমরা কাজে লাগাতে পারি। হাসপাতালের অন্যান্য প্রয়োজনীয় জনবল যেমন নার্স, ওয়ার্ডবয় এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের প্রয়োজনীয় জনবলের কোনো অভাব এদেশে নাই। চিকিৎসা সেবার প্রধান প্রয়োজনীয় উপাদান ঔষধ শিল্পে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই বেশ সুদৃঢ় অবস্থান তৈরি করেছে। প্রয়োজনীয় ঔষধের প্রায় নব্বই ভাগই দেশে উৎপাদিত হয়। বাংলাদেশের ঔষধ এখন পৃথিবীর অনেক দেশ এমনকি ইউরোপ-আমেরিকায়ও রপ্তানি হচ্ছে। সুতরাং চিকিৎসা সেবার গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আমাদের হাতের কাছেই আছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের প্রতিটি বিভাগীয় শহরে অন্তত একটি করে বিশ্বমানের হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগ নেয়া অত্যাবশ্যক। সরকারি-বেসরকারি উভয় উদ্যোগই নেয়া যেতে পারে। ব্যাংকগুলো এসব হাসপাতাল প্রতিষ্ঠায় সহজ শর্তে বিনিয়োগ প্রদান করতে হবে। প্রয়োজনে শেয়ারবাজারের মাধ্যমে জনগণের কাছ থেকে অর্থ যোগাড় করা যেতে পারে।
লেখক: প্রকৌশলী ও উন্নয়ন গবেষক।
omar_ctg123@yahoo.com
বিভাগ : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

কুয়াকাটায় পর্যটককে মারধর করে ৪০ হাজার টাকা ছিনতাইয়ের অভিযোগে যুবদল সভাপতিসহ গ্রেফতার -৩

সাভারে মেট্রো রেলের ডিপোতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান
পঞ্চগড়ে হাফেজা ছাত্রীদের সংবর্ধনা ও দোয়া অনুষ্ঠান

ওরসে অনৈতিক-অসামাজিকতা বন্ধে সিলেট পুলিশ প্রশাসনে স্মারকলিপি

ফরিদপুরে পদ্মার বিশ কেজি ওজনের কাতলা মাছ বিশ হাজার টাকায় বিক্রি

অনলাইন জুয়া নিষিদ্ধ করা হয়েছে: আসিফ নজরুল

ঈদুল আজহায় যে শর্তে ১০ দিনের ছুটি, জানালেন প্রেসসচিব

দেশবাসীকে ধন্যবাদ জানালেন খালেদা জিয়া

টাঙ্গাইলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় একজন নিহত

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে তালা একাডেমিক শাটডাউনের হুঁশিয়ারি

সাকিব-তামিমকে চেনেন নেইমার!

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ভুট্টা চাষে চাষীদের সাফল্য ১৪০ কোটি টাকার ভুট্টা উৎপাদন

একইদিনে চারদেশে হামলা ইহুদীদের

কিশোরগঞ্জে বজ্রপাতে দুই ছাত্রীসহ তিনজনের মৃত্যু

বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধানের সম্পদ জব্দের নির্দেশ, ৬ ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ

সুন্দরগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক ও জনবল ৩৭% পদ শূন্য থাকায় চিকিৎসা সেবা ব্যাহত

লক্ষ্মীপুর শহরে ওভারব্রিজ না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় নষ্ট হচ্ছে ১৫৩কোটি টাকার মেশিনারি

খালেদা জিয়া কখনো স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপোস করেননি: কাদের গনি

পাকুন্দিয়ায় বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে বজ্রপাতে ২ ছাত্রী নিহত, ১জন আহত