চারদেশীয় অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার তাকিদ প্রধান উপদেষ্টার

Daily Inqilab ইনকিলাব

১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:২০ পিএম | আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৫৭ এএম

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভূরাজনৈতিক অবস্থানগত কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠার বিপুল সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। গত রোববার রাতে রাজধানীর বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেছেন, এ সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে কেউ লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে রাখতে পারবে না। তিনি এও স্মরণ করেছেন, বাংলাদেশের দুই পাশে দুই মহাশক্তি ভারত আর চীন। তারা অতিদ্রুত গতিতে এগিয়ে যাবে। আমরা যেহেতু মাঝখানে আছি, আমাদের ফেলে যেতে পারবে না। তাদের বাতাসে আমরা উড়তে থাকবো। সেই থেকে আমার বদ্ধমূল ধারণা, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ অতি চমৎকার। ভূঅবস্থানগত সুযোগ সম্পর্কে তিনি আরো বলেছেন, বাংলাদেশের সামনে বিস্তীর্ণ মহাসাগর। আমাদের উপকূল এক মস্তবড় সুযোগ। পৃথিবীর দরজা আমাদের সামনে খোলা। আমরা এতদিন এ সুযোগ ব্যবহার করতে পারিনি। কুমিরা থেকে টেকনাফ পর্যন্ত আমাদের যে উপকূল ভূমি, সেখানে যদি কাতারে কাতারে নৌবন্দর স্থাপন হয়, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর পর্যন্ত দুনিয়ার সব জাহাজকে আশ্রয় দিতে পারি, তাদের কাজ করার জন্য সুযোগ-সুবিধা দিতে পারি, আমাদের আটকাবে কে? প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশ, নেপাল, ভুটান ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো নিয়ে একটি সমৃদ্ধ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার সম্ভবানার বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেছেন। এ সম্পর্কে যা বলেছেন, তার সার কথা হলো, আমাদের সামনে যেমন অবারিত সমুদ্র রয়েছে, প্রতিবেশী নেপাল, ভুটান ও উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর তা নেই। তাদের সমুদ্রে যাওয়ার পথ নেই। বাংলাদেশ তাদের এই সুযোগ দিলে এই গোটা অঞ্চলে অর্থনীতি, যোগাযোগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিপুল প্রাণাবেগ সঞ্চারিত হতে পারে। আঞ্চলিক অর্থনীতির একটি টেকসই কাঠামো দাঁড়িয়ে যেতে পারে। দেবো আর নেবো নীতিতে প্রতিটা দেশই লাভবান হতে পারে। এই অঞ্চলের দক্ষিণে যেমন উন্মুক্ত সমুদ্র, তেমনি উত্তরে নেপালে রয়েছে হিমালয় পর্বত। এই পর্বত ঘিরে অনন্ত সম্ভাবনা রয়েছে হাইড্রো-ইলেক্ট্রিসিটির। বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে দূরত্ব মাত্র ৪০ কিলোমিটার, যা ভারতের অংশ। ভারত যদি সম্মত হয় তবে নেপাল থেকে যত ইচ্ছা বিদ্যুৎ বাংলাদেশে সরাসরি আসতে পারে। অনুরূপভাবে ভারত তার ভূমি ব্যবহারের সুযোগ দিলে নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের মধ্যে সরাসরি বাণিজ্যসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। অন্যদিকে নেপাল, ভুটান ও উত্তর পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোও বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দরগুলো ব্যবহার করে তাদের অর্থনীতি ও বাণিজ্য চাঙ্গা করতে পারে। এভাবেই আদান-প্রদানের মাধ্যমে এ অঞ্চলের অর্থনৈতিক উত্থান সম্ভবপর হয়ে উঠতে পারে।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী মানুষ, আশাবাদী মানুষ, স্বপ্নবাজ মানুষ। তার সারা জীবনের কর্মকা- দেখলেই এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তার চারদেশীয় অর্থনৈতিক অঞ্চলের ধারণা গভীর পর্যবেক্ষণ, অভিনিবেশ ও গবেষণার পরিচায়ক। কীভাবে বাংলাদেশকে অবলম্বন করে একটি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়া যায় এবং তার মাধ্যমে এই অঞ্চলের সবদেশের উন্নয়ন সম্ভবপর করে তোলা যায়, এই তাড়না থেকেই তিনি এ প্রস্তাব উপস্থাপন করেছেন। এও জানিয়েছেন, এ নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। বলা বাহুল্য, এই প্রস্তাব কার্যকর করার ক্ষেত্রে নেপাল-ভুটানের আগ্রহের ঘাটতি হবে না। উত্তর-পূর্ব ভারতীয় রাজ্যগুলোও সম্মতি জানাবে। কিন্তু ভারত রাজি হবে কি না সেটাই প্রশ্ন। ভারত রাজি ও সহযোগিতা না করলে অসম্ভব প্রতিপন্ন হবে এ অর্থনৈতিক অঞ্চল। এখানে বিশেষভাবে স্মরণ করা যেতে পারে, দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্কের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। তিনি এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলোর প্রেসিডেন্ট ও সরকার প্রধানদের সম্মতি আদায় করে ছিলেন সার্ক গঠনে। ভারত প্রথমে রাজি ছিল না। পরে রাজি হয় দ্বিপাক্ষিক বিষয় সার্ক ফোরামে আলোচনার অধিকার পাবে না, এই শর্ত মেনে নেয়ার পর। যাহোক, শেষ পর্যন্ত সার্ক গঠিত হয়। কিন্তু ভারতের অনাগ্রহ ও অসহযোগিতায় অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এই আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা তেমন কোনো সুফলই দিতে পারেনি। অনেক বছর ধরে সার্কের শীর্ষ সম্মেলন হয় না। হবে, তেমন সম্ভবনাও দেখা যাচ্ছে না। ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর সার্ক পুনরুজ্জীবিত করার তাকিদ দিয়েছেন। ভারত-পাকিস্তানের সঙ্গে কথাবার্তাও বলেছেন। পাকিস্তান সাড়া দিলেও ভারতের কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। যেহেতু এই আঞ্চলিক রাষ্ট্রসংস্থা গড়ে তোলার উদ্যোক্তা বাংলাদেশ, সে কারণে শুরু থেকেই ভারত সার্ককে ভালো চোখে দেখেনি। তার কারণেই মূলত এটি একটি অকার্যকর সংগঠনে পরিণত হয়েছে। ভারত বিভিন্ন সময়ে সার্কের বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন নামে উপআঞ্চলিক রাষ্ট্রসংস্থা গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে, উদ্যোগও নিয়েছে। কিন্তু এসব সংস্থা শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। উপআঞ্চলিক সংস্থা তো দূরের কথা, নেপাল-ভুটানকে বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার এবং বাংলাদেশকে নেপাল-ভুটানে বাণিজ্য করার করিডোর পর্যন্ত দেয়নি।

ভারত সব সময় তার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে নিতে চায়, দিতে চায় না। দাদাগিরি ও খবরদারি করার উৎকট মনোবৃত্তির কারণেই ভারত আজ তার সব প্রতিবেশীর আস্থা হারিয়ে একা হয়ে গেছে। পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে তার বাধাবাধি পুরানো। নেপাল-ভুটানের সঙ্গে সম্পর্ক আছে নামকাওয়াস্তে। শ্রীলংকা-মালদ্বীপের সঙ্গে সম্পর্কও তথৈবচ। বাংলাদেশের একটি দাস সরকার প্রতিষ্ঠা করে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক গড়ে তুললেও ছয় মাস আগে গণেশ উল্টে গেছে। স্বৈরাচার হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছে। ফলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কও এখন অত্যন্ত প্রান্তিক পর্যায়ে নেমে এসেছে। প্রতিবেশী হারানোর এহেন বাস্তবতা কেন সৃষ্টি হলো, সেটা উপলব্ধি করার সময় এসেছে ভারতের। স্বার্থান্ধ নীতি-ব্যবস্থাই যে তার এ পরিণতির জন্য দায়ী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রতিবেশী আগে, নরেন্দ্র মোদির দাবি আজ প্রহসনে পরিণত হয়েছে। কথায় বলে, প্রতিবেশী পাল্টানো যায় না। প্রতিবেশী খারাপ-ভালো যাই হোক, তার সঙ্গে থাকতেই হয়। প্রতিবেশী যারাই হোক, সবাই যদি ভালো হয়, তাহলে বসবাস শান্তি ও আনন্দময় হয়। এটা ব্যক্তির ক্ষেত্রে যেমন, তেমনি রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও সমান প্রযোজ্য। ভারতের প্রতিবেশী নীতি সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এই ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠার একমাত্র উপায় নীতির পরিবর্তন। সৎপ্রতিবেশীমূলক ও সার্বভৌম সমতার নীতি অনুসরণ করলেই আঞ্চলিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠিত হবে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস চারদেশীয় আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বলয় বা অঞ্চল গড়ে তোলার যে বিপুল সম্ভাবনার কথা বলেছেন, তা বাস্তবায়িত করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর আন্তরিক সদিচ্ছা ও কার্যকর উদ্যোগের বিকল্প নেই।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বালাকোট যুদ্ধ : মুসলিম নবচেতনার মাইলফলক
বেগম জিয়ার বীরোচিত প্রত্যাবর্তন : মাইনাস টু নিয়ে ভারতীয় প্রোপাগান্ডার বেলুন ফুটো
অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক সংকট বাড়ছে
আওয়ামী লীগ ঘাতক ও সন্ত্রাসী দল
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা : সম্ভাবনার পথ অন্বেষণ করতে হবে
আরও
X
  

আরও পড়ুন

টাঙ্গাইলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় একজন নিহত

টাঙ্গাইলে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় একজন নিহত

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে তালা একাডেমিক শাটডাউনের হুঁশিয়ারি

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনে তালা একাডেমিক শাটডাউনের হুঁশিয়ারি

সাকিব-তামিমকে চেনেন নেইমার!

সাকিব-তামিমকে চেনেন নেইমার!

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ভুট্টা চাষে চাষীদের সাফল্য ১৪০ কোটি টাকার ভুট্টা উৎপাদন

কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে ভুট্টা চাষে চাষীদের সাফল্য ১৪০ কোটি টাকার ভুট্টা উৎপাদন

একইদিনে চারদেশে হামলা ইহুদীদের

একইদিনে চারদেশে হামলা ইহুদীদের

কিশোরগঞ্জে বজ্রপাতে দুই ছাত্রীসহ তিনজনের মৃত্যু

কিশোরগঞ্জে বজ্রপাতে দুই ছাত্রীসহ তিনজনের মৃত্যু

বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধানের সম্পদ জব্দের নির্দেশ, ৬ ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ

বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধানের সম্পদ জব্দের নির্দেশ, ৬ ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ

সুন্দরগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক ও জনবল ৩৭% পদ শূন্য থাকায় চিকিৎসা সেবা ব্যাহত

সুন্দরগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসক ও জনবল ৩৭% পদ শূন্য থাকায় চিকিৎসা সেবা ব্যাহত

লক্ষ্মীপুর শহরে ওভারব্রিজ না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার

লক্ষ্মীপুর শহরে ওভারব্রিজ না থাকায় ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পারাপার

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় নষ্ট হচ্ছে ১৫৩কোটি টাকার মেশিনারি

সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানায় নষ্ট হচ্ছে ১৫৩কোটি টাকার মেশিনারি

খালেদা জিয়া কখনো স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপোস করেননি: কাদের গনি

খালেদা জিয়া কখনো স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে আপোস করেননি: কাদের গনি

পাকুন্দিয়ায় বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে বজ্রপাতে ২ ছাত্রী নিহত,  ১জন আহত

পাকুন্দিয়ায় বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে বজ্রপাতে ২ ছাত্রী নিহত, ১জন আহত

ময়লা আবর্জনার দুর্গন্ধে নাকাল নাটোর পৌরবাসি

ময়লা আবর্জনার দুর্গন্ধে নাকাল নাটোর পৌরবাসি

গোয়ালন্দে ধান কেটে ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছে কৃষকেরা

গোয়ালন্দে ধান কেটে ঘরে তুলতে ব্যস্ত সময় পার করছে কৃষকেরা

চান্দিনায় ন্যায্যমূল্যের  পণ্য বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে   কে এম জামাল হোসেন এর বিরুদ্ধে

চান্দিনায় ন্যায্যমূল্যের  পণ্য বিতরণে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে   কে এম জামাল হোসেন এর বিরুদ্ধে

পাবিপ্রবির ছাত্র হল-১ এর প্রভোস্ট হলেন ড. শাহজাহান আলী

পাবিপ্রবির ছাত্র হল-১ এর প্রভোস্ট হলেন ড. শাহজাহান আলী

আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলারের বিদায়

আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী ফুটবলারের বিদায়

ভূঞাপুরে মাদক ৩ কারবারির কারাদন্ড

ভূঞাপুরে মাদক ৩ কারবারির কারাদন্ড

আমাদের প্রয়োজন অংশীদার, উপদেশদাতা নয় : জয়শঙ্কর

আমাদের প্রয়োজন অংশীদার, উপদেশদাতা নয় : জয়শঙ্কর

নারায়ণগঞ্জে হকার হত্যা মামলায় ৪ জনের মৃত্যুদণ্ড, ২ জনের যাবজ্জীবন

নারায়ণগঞ্জে হকার হত্যা মামলায় ৪ জনের মৃত্যুদণ্ড, ২ জনের যাবজ্জীবন