হাসিনার পতনের পর বিএনপির আট মাস

Daily Inqilab কামরুল হাসান দর্পণ

১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৮ এএম | আপডেট: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৮ এএম

গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তী সরকারের আট মাসের সাফল্য-ব্যর্থতার হিসাব জনগণ করছে এবং আগামী নির্বাচনের আগ পর্যন্ত করে যাবে। তবে হাসিনার পতনের পর ক্ষমতায় যাওয়ার সম্ভাব্য দল হিসেবে বিএনপি এই আট মাসে কী করেছে, তার হিসাবও জনগণ করবে এবং করছে। আগামী নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় যেতে পারে, এ বিবেচনা করে তারা দলটির ওপর তীক্ষè দৃষ্টি রাখছে। ক্ষমতায় গিয়ে দলটি কী করতে পারবে, এ হিসাব করা শুরু করেছে। বিএনপি ক্ষমতায় এলে তাদের কতটুকু লাভ হবে, দেশের অর্থনীতি, রাজনীতি, পররাষ্ট্রনীতিসহ শাসন ব্যবস্থা কীভাবে পরিচালনা করবে, এ হিসাব জনগণ করবে এটাই স্বাভাবিক। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে তার লাভ-ক্ষতির হিসাব নয়, তারা নিজেদের এবং দেশের স্বার্থ ও লাভ-ক্ষতির হিসাবকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সচেতন, শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী মহলে এখন এ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। তারা এখন অন্তর্বর্তী সরকার ও বিএনপিকে পাশাপাশি রেখে ভাল-মন্দ বিচার করছে। মূলত অন্তর্বর্তী সরকার বলতে তারা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকেই বোঝেন। তারা তাঁকে একের মধ্যে একশ’ হিসেবে নিয়েছেন এবং তার কর্মকা-কেই আমলে নিচ্ছেন। ক্ষমতাকামী বিএনপি ও ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মধ্যেই রাষ্ট্র পরিচালনার ভালো-মন্দের বর্তমান ও ভবিষ্যতের পার্থক্য নিয়ে তারা বিচার-বিশ্লেষণ করছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এখন যে কাজ করছেন এবং বিএনপি ক্ষমতায় এলে এ কাজ করতে পারবে কিনা, তা এখন সাধারণ মানুষের আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বিএনপি ক্ষমতায় এলে কি করবে বা কি করতে পারবে, তা জনগণের কাছে স্পষ্ট নয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, বর্তমান কর্মকা-ের ওপর আগামীর পথ তৈরি হয়। এ বিবেচনায়, হাসিনার পতনের পর বিগত ৮ মাসে বিএনপির বর্তমান কর্মকা-ের ওপরই আগামী নির্বাচনে জনগণ রায় দেবে। এর ওপরই নির্ভর করছে, তার ক্ষমতায় যাওয়ার বিষয়টি। বিগত ৮ মাসের মধ্যে বিএনপির কর্মকা-ের ইতি এবং নেতি দুটো দিকই রয়েছে। এক্ষেত্রে, নেতিবাচক দিকটিই সাধারণ মানুষের আলোচনায় বেশি উঠে আসছে। অবশ্য ইতোমধ্যে বিএনপি অভিযোগ করেছে, মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে তাকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপির যেসব বিষয় মিডিয়া ট্রায়ালের শিকার বা ভার্চুয়াল জগতে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে, সেসব বিষয়ে ব্যাখ্যা বা সেগুলো যে অসত্য, তা প্রমাণে বিএনপি কি পদক্ষেপ নিয়েছে বা নিচ্ছে? কেবল মিডিয়া ট্রায়ালের অভিযোগ করলেই তো হবে না। এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন প্রমাণের জন্য জনগণের সামনে কি দলটি সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা দিচ্ছে? দিচ্ছে না।

দুই.
অস্বীকার করার উপায় নেই, হাসিনার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকারের ভালনারেবল পরিস্থিতিতে বিএনপি পাশে না থাকলে হাসিনা ও মোদি প্রযোজিত অব্যাহত ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করা সম্ভব হতো না। সরকার ও রাষ্ট্রের ক্রাইসিস মুহূর্তে ছাত্রদের পাশাপাশি বিএনপি রক্ষাবুহ্য হয়েছিল। সরকারকে আগলে রেখেছিল। দলটির শীর্ষ নেতারা সাহস দিয়ে বলেছেন, এ সরকারের সাথে আমরা আছি। কারণ, একটি অরাজনৈতিক ও অনভিজ্ঞ সরকারের পক্ষে ভঙ্গুর রাষ্ট্র কাঠামো নিয়ে সে সময় ফ্যাসিস্ট হাসিনা ও তার সুসংগঠিত এবং শক্তিশালী সন্ত্রাসী দল আওয়ামী লীগ, পুলিশ-প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বত্র ছড়িয়ে থাকা তার দোসরদের ষড়যন্ত্রের সামনে টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন ছিল। বিএনপি ও তার নেতাকর্মীরা মাঠে থেকে সেসব ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় ব্যাপক সহযোগিতা করেছে। বিএনপি যদি সে সময় চুপ করে বসে থাকত, তাহলে পরিস্থিতি কী হতো, তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না। এটাও ঠিক, বিএনপির নেতাকর্মীরা দীর্ঘ দেড় দশকের বেশি সময় ধরে ফ্যাসিস্ট হাসিনার যে নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তার পতনের পর দলটির চুপ করে বসে থাকারও কোনো কারণ ছিল না। বরং অন্তর্বর্তী সরকারকে রক্ষায় প্রতিরোধ গড়ে তোলাই তার মূল দায়িত্ব ছিল। সে তা করেছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদমুক্ত করে তার চলার পথ মসৃণ করে দিতে সহায়তা করেছে। এ সরকারকে ওন করে বলেছে, যেকোনো মূল্যে এ সরকারকে রক্ষা করতে হবে। তা নাহলে, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব বলে কিছু থাকবে না। বিএনপি অভিজ্ঞ ও পোড় খাওয়া দল। সে সময় তার এই ভূমিকাই প্রত্যাশিত ছিল। সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে, হাসিনার পতনের পর ক্ষমতাকামী দল হিসেবে বিএনপি দেশের মানুষের সামনে কী বার্তা দিয়েছে? ক্ষমতায় গেলে তাদের কল্যাণে কী করবে, কীভাবে দেশ পরিচালনা করবে, এ নিয়ে কি স্পেসিফিক কোনো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে? বিএনপির একজন নেতা বা কর্মীকে যদি এ প্রশ্ন করা হয়, তাহলে তিনি কি এসব প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন? পারবেন না। বরং দেশের মানুষ দেখেছে এবং যা নিয়ে এখন দলটি সমালোচনার মুখোমুখি, তা হচ্ছে, তার একশ্রেণীর নেতাকর্মীর চাঁদাবাজি, দখলবাজি ইত্যাদি। দলের শীর্ষ নেতার কড়া নির্দেশ এবং অনেক জায়গায় নেতাকর্মীদের বহিষ্কার করা সত্ত্বেও তারা নিবৃত্ত হচ্ছে না। ফলে জনমনে এ ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছে, এখনই এ অবস্থা, ক্ষমতায় গেলে না জানি কী করে! হাসিনার পতনের পর মূলত বিএনপির এ শ্রেণীর নেতাকর্মীর কারণেই সমালোচনা শুরু হয়েছে। এ সমালোচনা থেকে দলটি এখনও বের হতে পারছে না। অনেকে বলছেন, বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর নীরব চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্ব চলছে। তারা এটাও বলছেন, নেতাকর্মীদের ওপর দলের শীর্ষ নেতাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। তারা লগামহীন হয়ে পড়েছে। এ নিয়ে ভার্চুয়াল জগতে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা সমালোচনা করছে। মিডিয়ায়ও কিছু কিছু সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। এখন এটা যদি বিএনপির কাছে মিডিয়া ট্রায়াল মনে হয়, তাহলে যা নিয়ে ট্রায়াল হচ্ছে, তার প্রতিকার বা প্রতিরোধ কেন করা হচ্ছে না? নেতাকর্মীদের কেন নিয়ন্ত্রণ ও লাগাম টেনে ধরা হচ্ছে না? বিএনপির তো মনে রাখা উচিৎ, সে যাতে ক্ষমতায় আসতে না পারে, এজন্য তার বিরোধীপক্ষ এসব অপকর্ম জনগণের সামনে ম্যাগনিফাই করে তুলে ধরবে। প্রতিপক্ষ এ পলিটিক্স করবে, এটাই স্বাভাবিক। এ পলিটিক্স কি বিএনপি জানে না? নিশ্চয়ই জানে। প্রতিপক্ষের এই প্রপাগান্ডার জবাব দেয়ার জন্য দলটি কি পাল্টা ব্যবস্থা নিয়েছে? ব্যবস্থা না নিয়ে মিডিয়া ট্রায়াল বা প্রতিপক্ষের দোষ দিয়ে তো লাভ নেই। দেশের মানুষ দেখছে, ফ্রান্স প্রবাসী এক ইউটিউবারের ধাক্কাই বিএনপি সামাল দিতে পারছে না। তাকে নিয়ে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে এখন বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বক্তব্য দিতে হচ্ছে। এক ব্যক্তিকে নিয়ে যখন দলের মহাসচিব ও শীর্ষস্থানীয় নেতাকে বক্তব্য দিতে হয়, তখন তা খুবই দৃষ্টিকটু ঠেকে। দলটির কি উচিৎ নয়, তার বিরোধিতা না করে তার যুক্তি ও তথ্য, যদি তা তার কাছে সত্য বা অসত্য মনে হয়, তা খ-ন করার মতো জবাব বা বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া?

তিন.
এবার আসা যাক, বিএনপির পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে। একজন সাধারণ মানুষও জানে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ভারত এবং আগামীর পররাষ্ট্রনীতির বড় নিয়ামক শক্তি চীন। ভারত বাংলাদেশের জনগণের কাছে চিরশত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। সে বাংলাদেশকে তার অঙ্গরাজ্যের মতো ব্যবহার ও করতলে রাখতে চায়। দেড় দশকের বেশি সময় ধরে হাসিনাকে দিয়ে সে এ কাজ করেছে। ৫ আগস্টকে যে নতুন স্বাধীনতা বলা হয়, তা মূলত হাসিনার পতনের সাথে সাথে ভারতের আধিপত্যবাদের পতনের জন্যই বলা হয়। দেশের মানুষ এই দ্বিতীয় স্বাধীনতাকে অকুণ্ঠচিত্তে গ্রহণ করেছে। তাদের শতকরা নব্বই ভাগই এখন ভারতবিরোধী। বিএনপি কি দেশের মানুষের এই সেন্টিমেন্ট ধারন করতে পেরেছে? তার আচার-আচরণে তা প্রতীয়মান হচ্ছে না। বিএনপির মধ্যম সারির কিছু নেতা মুখে মুখে ভারতবিরোধী কথা বলছেন ঠিকই, তবে তা জোরালো কোনো বিরোধিতা নয়। ভারতও তা জানে। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেন ভারতকে অবহিত করেই তার বিরোধিতার রাজনীতি করছে, যাতে ভারত অসন্তুষ্ট না হয়। হ্যাঁ, বিএনপি বেশ কয়েক মাস আগে তিস্তার পানি নিয়ে ভারতবিরোধী লংমার্চ ও সভা-সমাবেশ করেছে। কলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশের হাইকমিশনে হামলা ও অগ্নিসংযোগের প্রতিবাদে লংমার্চ করেছে। তার আগে ভারতীয় পণ্য বর্জন কর্মসূচিতে ইন্ডিয়ান চাদর ও শাড়ি পুড়িয়ে প্রতিবাদ করেছে। সম্প্রতি ভারতের পার্লামেন্টে বিতর্কিত মুসলিম ওয়াকফ (সংশোধন) বিল ২০২৫ নামে যে আইনটি পাস করা হয়েছে তা নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, এই আইনে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের অধিকার খর্ব এবং বৈষম্যমূলক আচরণের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে বিএনপির কাছে দেশের মানুষের প্রত্যাশা সে বাংলাদেশবিরোধী ভারতের যেকোনো আচরণ ও সেখানের মুসলমানদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতনের প্রতিবাদে জোরালো ভূমিকা। সভা-সমাবেশ ও মিছিল করে প্রতিবাদ করা, যেমনটি ভারতের হিন্দুরা করে থাকে। এ ব্যাপারে বিএনপির রিজিড থাকার কোনো কারণ নেই। কারণ, এটাই দেশের মানুষের প্রত্যাশা। ফলে ভারত প্রশ্নে বিএনপির অবস্থান জনগণের কাছে পরিস্কার করতে হবে। ‘ধরি মাছ, না ছুঁই পানি’ মতো ‘কাকচালাকি’ নীতি নিলে চলবে না। ভারতের চোখে চোখ রেখে কথা বলার হিম্মত দেখাতে হবে, যেটা দেখাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। দুঃখের বিষয়, নির্বাচনকে সামনে রেখে, বিএনপির ভারতবিরোধী মনোভাবে যেন ভাটা পড়েছে। এই যে মোদি সরকার ও তার গোদি মিডিয়া বাংলাদেশে হিন্দুদের নির্যাতন করা হচ্ছে বলে অনবরত মিথ্যা কথা ও সংবাদ প্রকাশ করে যাচ্ছে, তা নিয়ে কি বিএনপি জোরালো কোনো প্রতিবাদ বা কর্মসূচি পালন করেছে? করেনি। এমনকি, বিমসটেক সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সাইডলাইন বৈঠকে মোদি যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা বলেছেন, তার বিরোধিতা কি দলটি করেছে? করেনি। কেন করেনি? নির্বাচন সামনে বলে? নির্বাচনে ভারতের সহায়তার প্রত্যাশায়? সচেতন মহল তো এখন তাই মনে করছে। তাহলে, ভারতবিরোধী সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বিএনপির প্রতি কেন অনুরক্ত হবে? সঙ্গতকারণেই তাদের মনে এই সন্দেহ কিংবা ভয় কাজ করবে, বিএনপি যদি ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগের মতো সেই ভারত তোষণ নীতি শুরু করে, ভারতের আধিপত্যবাদকে আবার জায়গা করে দেয়, তাহলে? যে ভারতের আধিপত্যবাদকে জনগণ রক্ত দিয়ে বিদায় করেছে, সেই ভারতই যদি আবার বিএনপির কাঁধে ভর করে, তাহলে এই রক্তের কি মূল্য থাকবে? ভারত সরকার, মিডিয়া এমনকি বিরোধীদলগুলো ক্রমাগতভাবে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনের কথা বলে বেড়াচ্ছে, অথচ সেখানে যে প্রতিনিয়ত মুসলমানদের নিপীড়ন, নির্যাতন, খুন, উচ্ছেদ, একের পর এক ইসলাম ও মুসলমানবিরোধী আইন করছে, তা নিয়ে তো বিএনপি টুঁ শব্দ করছে না। কেন করছে না? ভারত তো সরাসরি আমাদের আভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে প্রতিনিয়ত কথা বলে যাচ্ছে। বিএনপিসহ বিরোধীদলগুলোরও তো একইভাবে ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের নির্যাতন ও অধিকার হরণের বিরুদ্ধে কথা বলা দায়িত্ব। এখানে চুপ করে বসে থাকার কোনো কারণ নেই। বিএনপি কি বোঝে না, দেশের সিংহভাগ মানুষ ভারতের আগ্রাসন ও আধিপত্যবাদের ঘোরবিরোধী? দলটির প্রতিষ্ঠাতা, স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমান জনগণের এই সেন্টিমেন্ট ধারন করেছেন বলেই তো বিএনপি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তিনি জনগণের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হয়ে আছেন। আমাদের অস্তিত্ব ও স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার এই নীতির ওপরই তিনি বিএনপিকে দাঁড় করিয়েছেন। এই ভারতবিরোধী অবস্থানের কারণেই তো তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত সেই দল যদি এখন ভারতের সমর্থনের আশা কিংবা ভারতের অন্যায্য আচরণের প্রতিবাদ করলে সে অসন্তুষ্ট হবে, এমন মনোভাব ধারন করে, ভারতের চোখে চোখ রেখে কথা না বলে, তাহলে তা জিয়াউর রহমানের নীতিকেই অবজ্ঞা করা হলো। আঘাত এলে, পাল্টা আঘাত করতে না পারলে ক্ষমতাকামী রাজনৈতিক দলের ওপর জনগণ কেন ভরসা করবে? অথচ দেশের নব্বই ভাগ মানুষেরই প্রত্যাশা ভারতের যেকোনো অন্যায় ও অন্যায্য আচরণের বিরুদ্ধে সবার আগে বিএনপি প্রতিবাদ করবে। বিএনপি কি এটা বোঝে না? বিএনপি কি মনে করে, আগামী নির্বাচনে ক্ষমতায় যেতে দেশের মানুষের সমর্থনের চেয়ে ভারতের সমর্থন বেশি প্রয়োজন? যদি তা মনে করে থাকে, তাহলে বলতে হবে, দলটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ জিয়াউর রহমানের নীতি ও দেশের মানুষের সেন্টিমেন্ট এখনো ধারন করতে পারেনি। এখন একটি কথা বেশ উচ্চারিত হচ্ছে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতের অন্যায্য আচরণের প্রতি যে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন এবং বিভিন্ন কর্মকা- ও বিবৃতি দিয়ে ভারতকে ব্যতিব্যস্ত ও চাপে রেখেছেন, তা তিনি জিয়াউর রহমানের নীতি অনুসরণ করেই করছেন। এ কারণে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের মানুষের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছেনড. মুহাম্মদ ইউনূস বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের নীতি অনুসরণ করে এগিয়ে যাচ্ছেন এবং দেশের মানুষের সমর্থন পাচ্ছেন, অথচ বিএনপি তার প্রতিষ্ঠাতা সেই জিয়াউর রহমানের নীতি থেকেই দূরে সরে রয়েছে।

চার.
আমাদের দেশে এখন ভারতের আধিপত্যবাদ ও খবরদারির বিরোধিতার রাজনীতির বিকল্প নেই। হাসিনা ও আওয়ামী লীগের মতো ভারতের দাস হয়ে ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকার দিন শেষ। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে তার কবর রচিত হয়েছে। এখন যদি বিএনপি ও অন্য কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় যাওয়ার লোভে ভারত তোয়াজনীতি অবলম্বন করে, তাহলে তাদের সে আশা পূর্ণ হবে না। বিএনপির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ, এটা বোঝে কিনা জানি না। তবে সাধারণ মানুষ এটা বুঝে গেছে, বিএনপি ক্রমাগতভাবে ভারতের দিকে ঝুঁকছে। বিএনপির এই আচরণ তারা পছন্দ করছে না। ফলে ভেতরে ভেতরে মানুষের মনোভাব পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে। তারা এখন ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে বিকল্প হিসেবে বেছে নিচ্ছে। এর মূল কারণ, দায়িত্ব গ্রহণের আগে এবং শুরু থেকেই তিনি ভারতের চোখে চোখ রেখে কথা বলে যাচ্ছেন। ভারতের যেকোনো অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিবাদ করছেন। এতে তাঁর প্রতি দেশের মানুষের ব্যাপক সমর্থন বাড়ছে। মানুষের এই সমর্থন তাঁর অবস্থান শক্ত করে তুলছে। ভারত কি তাঁকে কিছু করতে পারছে? পারছে না। কারণ, তার ভারতের আগ্রাসনবিরোধী নীতি তাঁকে শক্তিশালী করে তুলেছে। বলা বাহুল্য, ভারত বড় প্রতিবেশী, তাকে তোয়াজ করে চলতে হবে, এ পরিস্থিতি এখন আর নেই। বিশ্বের কোথাও নেই। পাশাপাশি থেকেও ছোট-বড় প্রত্যেক দেশ তাদের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও আত্মমর্যাদা নিয়ে চলছে। দূরদেশের সাথে যে নীতি, প্রতিবেশী দেশের সাথেও একই নীতি অবলম্বন করছে। প্রতিবেশী বদলানো না গেলেও, তার সাথে সম্পর্কের নীতি বদলানো যায়। ইউরোপের প্রায় সবদেশ একে অপরের প্রতিবেশী। তাই বলে ছোট দেশ, বড় দেশকে তোয়াজ করে চলে না। প্রত্যেকে পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সমমর্যাদা ও সমতাভিত্তিক সম্পর্ক নিয়েই চলছে। সবার আগে নিজের স্বার্থ প্রাধান্য দিচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোও ক্ষমতায় যাওয়া বা টিকে থাকার জন্য প্রতিবেশী বা প্রভাবশালী দেশের সমর্থন প্রত্যাশা ও তোয়াজনীতি অবলম্বন করে না। বিএনপি যদি সেই আওয়ামী লীগের মতো ভারত ছাড়া ক্ষমতায় যাওয়া ও থাকা যাবে না, এমন নীতি অনুসরণ করে, তবে এটা নিশ্চিত তার ক্ষমতায় যাওয়ার পথ দীর্ঘ হয়ে যাবে। যদি ভারতের চোখে চোখ রেখে কথা বলার নীতি অবলম্বন করে, তাহলে ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে তার আর কিছুই প্রয়োজন হবে না। তাকে এটা মনে রাখতে হবে, এই ভারতের জন্যই ফ্যাসিস্ট হাসিনা দেড় দশকের বেশি সময় টিকে ছিল এবং বিএনপি সীমাহীন নিপীড়ন-নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। তার নেতাকর্মীরা যদি তা ভুলে যায়, তাহলে কিছুই বলার নেই।

darpan.journalist@gmail.com


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

বালাকোট যুদ্ধ : মুসলিম নবচেতনার মাইলফলক
বেগম জিয়ার বীরোচিত প্রত্যাবর্তন : মাইনাস টু নিয়ে ভারতীয় প্রোপাগান্ডার বেলুন ফুটো
অর্থনীতিতে বহুমাত্রিক সংকট বাড়ছে
আওয়ামী লীগ ঘাতক ও সন্ত্রাসী দল
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা : সম্ভাবনার পথ অন্বেষণ করতে হবে
আরও
X
  

আরও পড়ুন

মনোহরগঞ্জে অবৈধভাবে মাটি কাটা ও বিক্রির অপরাধে ২জনকে কারাদন্ড, গাড়ি জব্দ

মনোহরগঞ্জে অবৈধভাবে মাটি কাটা ও বিক্রির অপরাধে ২জনকে কারাদন্ড, গাড়ি জব্দ

ঝড়ের কারণে ডুবোচরে আটকা পড়েছে ফেরি বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান

ঝড়ের কারণে ডুবোচরে আটকা পড়েছে ফেরি বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমান

মহড়ার আগেই ডুবে গেল ঐতিহাসিক যুদ্ধজাহাজ

মহড়ার আগেই ডুবে গেল ঐতিহাসিক যুদ্ধজাহাজ

কালিয়াকৈরে ডাকাত সন্দেহে তিন যুবক আটক

কালিয়াকৈরে ডাকাত সন্দেহে তিন যুবক আটক

গাজীপুরে ট্রাক চাপায় নারী শ্রমিক নিহত ঢাকা -ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ

গাজীপুরে ট্রাক চাপায় নারী শ্রমিক নিহত ঢাকা -ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ

স্বেচ্ছায়  ফেরত যেতে চাওয়া অভিবাসীদের সহায়তা দেবে ট্রাম্প প্রশাসন

স্বেচ্ছায় ফেরত যেতে চাওয়া অভিবাসীদের সহায়তা দেবে ট্রাম্প প্রশাসন

খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশে স্বাগতম : সারজিস আলম

খালেদা জিয়াকে বাংলাদেশে স্বাগতম : সারজিস আলম

হাসনাত আব্দুল্লাহর উপর হামলার ঘটনায় মামলাঃ হুকুমের আসামি সাবেক মন্ত্রী ও মেয়র

হাসনাত আব্দুল্লাহর উপর হামলার ঘটনায় মামলাঃ হুকুমের আসামি সাবেক মন্ত্রী ও মেয়র

মেট গালায় রাজকীয় ভঙ্গিমায় ইতিহাস গড়লেন শাহরুখ, তলোয়ার হাতে ভিন্ন অবতারে দিলজিৎ

মেট গালায় রাজকীয় ভঙ্গিমায় ইতিহাস গড়লেন শাহরুখ, তলোয়ার হাতে ভিন্ন অবতারে দিলজিৎ

ইসরাইলি আগ্রাসনে গাজায় প্রতি ৪০ মিনিটে মারা যাচ্ছে একটি শিশু

ইসরাইলি আগ্রাসনে গাজায় প্রতি ৪০ মিনিটে মারা যাচ্ছে একটি শিশু

অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ সুন্দরবনের দুর্ধর্ষ ডাকাত করিম শরীফ বাহিনীর ২ সহযোগী আটক

অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ সুন্দরবনের দুর্ধর্ষ ডাকাত করিম শরীফ বাহিনীর ২ সহযোগী আটক

লক্ষ্মীপুরে হত্যার ১১ বছর পর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তার

লক্ষ্মীপুরে হত্যার ১১ বছর পর যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তার

চিন্ময় দাসকে আরও ৪ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আদেশ

চিন্ময় দাসকে আরও ৪ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর আদেশ

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে ‘মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা’ দিল এনসিপি

জাতীয় ঐকমত্য কমিশনকে ‘মৌলিক সংস্কারের রূপরেখা’ দিল এনসিপি

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় অগ্রগতি হচ্ছে: আলী রীয়াজ

রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় অগ্রগতি হচ্ছে: আলী রীয়াজ

৯ দিন ধরে বন্ধ ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, অগ্রগতি নেই তদন্ত কমিটির

৯ দিন ধরে বন্ধ ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, অগ্রগতি নেই তদন্ত কমিটির

ভূরুঙ্গামারীতে অটো রিক্সার ধাক্কায় বাকপ্রতিবন্ধী নারীর মৃত্যু

ভূরুঙ্গামারীতে অটো রিক্সার ধাক্কায় বাকপ্রতিবন্ধী নারীর মৃত্যু

"রাবি শিক্ষার্থীদের পেটানোর হুমকি: ভাইরাল স্ক্রিনশটে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতার নাম!"

"রাবি শিক্ষার্থীদের পেটানোর হুমকি: ভাইরাল স্ক্রিনশটে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতার নাম!"

পাকিস্তান ইস্যুতে ভারতের অভিযোগে উদ্বিগ্ন ওআইসি

পাকিস্তান ইস্যুতে ভারতের অভিযোগে উদ্বিগ্ন ওআইসি

সোনারগাঁওয়ে মাদক ব্যবসায়ী জীবনের অত্যাচারে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ

সোনারগাঁওয়ে মাদক ব্যবসায়ী জীবনের অত্যাচারে এলাকাবাসী অতিষ্ঠ