অর্থনীতি ও কর্মসংস্থানে জরুরি উদ্যোগ নিতে হবে

Daily Inqilab ইনকিলাব

২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৩ এএম | আপডেট: ২৫ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০৩ এএম

দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে অশনি সংকেত দেখা যাচ্ছে। গত ১৬ বছর ধরে একদিকে বল্গাহীন দুর্নীতি, লুটপাট, ব্যাংক জালিয়াতি ও নিয়ন্ত্রণহীন অর্থপাচারের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে ভেতর থেকে দুর্বল ও দেউলিয়া করে ফেলা হয়েছে, অন্যদিকে মিথ্যা তথ্য, ভুয়া পরিসংখ্যান ও ধাপ্পাবাজি করে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে প্রবৃদ্ধি জাহির করা হয়েছে। পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এখন সবকিছু স্পষ্ট হয়ে উঠছে। অন্তর্বর্তী সরকার যখন পাচার হওয়া বিপুল অর্থ ফিরিয়ে আনার সাথে সাথে নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা নিয়ে কাজ করছে, তখন দেশের আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বাস্তবতা, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক দ্বন্দ্ব ও সামরিক উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণে আমাদের অর্থনীতির সামনে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ দেখা দিচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় সামনের দিনগুলোতে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস ও দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার আগাম পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। গতকাল সহযোগী একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদনে চলতি অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৩.৩ শতাংশে নেমে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছরের শেষে আরো ৩০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমায় নেমে যাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দেশে অতি দরিদ্র জনসংখ্যা দুই বছর আগের ১৮.৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৫ সাল নাগাদ ২২.৯ শতাংশে উন্নীত হওয়ার কথা বলা হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বাণিজ্য নীতিসহ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক দ্বন্দে¦র কারণে বাংলাদেশের রফতানি খাতের প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার আশঙ্কার কথাও বলা হয়েছে। একদিকে বাণিজ্যিক সক্ষমতা হ্রাস পাওয়া, অন্যদিকে নিয়ন্ত্রণহীন মূল্যস্ফীতি অর্থনীতির সূচকগুলোতে নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করছে।

আমাদের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি, বেসরকারি উদ্যোগের তৈরি পোশাক খাত এবং প্রবাসীদের আয়ের উপর নির্ভরশীল রেমিটেন্স প্রবাহের উপর দাঁড়িয়ে থাকা অর্থনীতি এমনিতেই ৩-৪ শতাংশের উপর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে সক্ষম। বিশ্বব্যাংক ৩.৩ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে আভাস দিচ্ছে, তা নিয়ে সংশয় থাকলেও পরিস্থিতি যে অনুকূল নয়, তা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির এই পূর্বাভাস দক্ষিণ এশিয়ার গড় প্রবৃদ্ধির চেয়ে প্রায় আড়াই শতাংশ কম। এ কথা ঠিক যে, ১৫-১৬ বছরের অবাধ দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনায় প্রায় ভেঙ্গে পড়া অর্থনৈতিক ব্যবস্থা রাতারাতি আমূল পাল্টে ফেলা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার পাশাপাশি প্রথমেই স্বল্প মেয়াদি পদক্ষেপের মাধ্যমে বিদ্যমান বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সুরক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ নেয়া জরুরি। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো রাষ্ট্র সংস্কার ও আগামী নির্বাচন নিয়ে জাতীয় সংলাপ ও ঐকমত্য প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে, এটা খুবই ইতিবাচক বিষয়। কিন্তু নানাবিধ দাবিদাওয়া নিয়ে প্রতিদিনই রাজপথে ও শিল্পাঞ্চলে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তাহীনতা দেখা দিচ্ছে। নির্বাচনকে সামনে রাখে রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে ঐক্য, সমঝোতা ও শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিবেশ সৃষ্টি করতে না পারলে দেশের অর্থনীতিতে যে ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে তারই আভাস প্রতিফলিত হয়েছে। বিগত সময়ের অভিজ্ঞতার আলোকে দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতাকেই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের প্রধান প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখানো হচ্ছে। অর্থনীতির এমন নাজুক অবস্থা হঠাৎ করেই দেখা দেয়নি। বিগত বছরগুলোর ধারাবাহিক ব্যর্থতার কারণে সংকট এমন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এহেন বাস্তবতায় সরকারের পক্ষ থেকে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ভেঙে পড়ায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর দেশে এক প্রকার নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি দেখা গেছে। এখনো সবকিছুর উপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পতিত স্বৈরাচার বিদেশে বসে ষড়যন্ত্র করছে এবং উস্কানিমূলক বক্তব্য ও নির্দেশনা দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সহযোগী রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যকার স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও মতভিন্নতা শিক্ষাঙ্গন ও রাজপথে উত্তাপ ছড়াতে দেখা যাচ্ছে। নানাবিধ সংস্কার, পতিত স্বৈরাচারের গুম-খুন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার ও নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় সরকারের মেয়াদ নিয়ে অনিশ্চয়তা থাকায় নতুন বিনিয়োগ উদ্যোগেও অনিশ্চয়তা দেখা যাচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় সরকারকে জরুরি ভিত্তিতে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের উপযোগী উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষত গ্রামীণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, কুটির শিল্প এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিনিয়োগের স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনা এগিয়ে নেয়ার কোনো বিকল্প নেই। ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সংকট ও মূল্যস্ফীতির কারণে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা ধরনের সামাজিক অপরাধ প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। পতিত স্বৈরাচারের দোসরদের উদ্দেশ্যমূলক অপতৎপরতা এক্ষেত্রে বাড়তি প্রভাব সৃষ্টি করছে। ভারত-পাকিস্তান, চীন-মার্কিন বৈশ্বিক উত্তেজনার কারণে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা আরো প্রকট আকার ধারণ করতে পারে। এহেন বাস্তবতায় দেশীয় শিল্পোদ্যোগ ও কর্মসংস্থানের দিকে নজর দিতে হবে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির মুখে যে কোনো সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক শক্তিও চরম সংকট ও পতনের সম্মুখীন হতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিগত শতকের শেষদিকে নাইজেরিয়ার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। জ্বালানি ও শিল্প বিনিয়োগে বিপুল সম্ভাবনাময় দেশটি আভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার মুখে অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্বের সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশ এখন রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দক্ষতা ও সাফল্য যেমন দেশকে বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সোপানে পৌঁছে দিতে পারে, তেমনি তাদের কোনো কোনো ব্যর্থতা ও ভুল পদক্ষেপ দেশকে অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করতে পারে। সরকারকে দারিদ্র্য রোখার ব্যবস্থা নিতে হবে। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান ছাড়া দারিদ্র্য রোখার সহজ পথ নেই। না হলে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও অপরাধ প্রবণতা বাড়বে। কোনো কিছুতেই তা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এ ব্যাপারে সরকারের যে কোনো উদ্যোগের ক্ষেত্রে দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক পক্ষগুলোকে ঐক্যবদ্ধভাবে সরকারের পাশে দাঁড়াতে হবে।


বিভাগ : সম্পাদকীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

আওয়ামী লীগ ঘাতক ও সন্ত্রাসী দল
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা : সম্ভাবনার পথ অন্বেষণ করতে হবে
দেশনেত্রী দেশে ফিরছেন : তার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে
ক্ষতিকর গেম বন্ধ করা হোক
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও দায়বদ্ধতা
আরও
X
  

আরও পড়ুন

হাসনাত আব্দুল্লাহর গাড়িতে হামলার ঘটনায় আটক ২

হাসনাত আব্দুল্লাহর গাড়িতে হামলার ঘটনায় আটক ২

সাবেক মন্ত্রী-এমপি-মেয়র সহ যারা হলেন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সিলেটে হামলা ঘটনা মামলার আসামী

সাবেক মন্ত্রী-এমপি-মেয়র সহ যারা হলেন বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে সিলেটে হামলা ঘটনা মামলার আসামী

হাসিনার কুশপুত্তলিকার সঙ্গে হেফাজতের কোনো সম্পর্ক নেই

হাসিনার কুশপুত্তলিকার সঙ্গে হেফাজতের কোনো সম্পর্ক নেই

রাস্তায় যানজট সৃষ্টির দায়ে ব্রাহ্মণপাড়ায় ভ্রাম্যমান আদালতে জরিমানা

রাস্তায় যানজট সৃষ্টির দায়ে ব্রাহ্মণপাড়ায় ভ্রাম্যমান আদালতে জরিমানা

গুজব ও অপতথ্য মোকাবিলায় দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে তথ্য কর্মকর্তাদের

গুজব ও অপতথ্য মোকাবিলায় দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে হবে তথ্য কর্মকর্তাদের

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুতে এবি পার্টির শোক প্রকাশ

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুতে এবি পার্টির শোক প্রকাশ

২০২৫ অর্থবছরের ২য় প্রান্তিকে ভিসা’র ৯ শতাংশ রাজস্ব প্রবৃদ্ধি অর্জন

২০২৫ অর্থবছরের ২য় প্রান্তিকে ভিসা’র ৯ শতাংশ রাজস্ব প্রবৃদ্ধি অর্জন

গাজীপুরে মসজিদের খতিব হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচার দাবিতে সমাবেশ

গাজীপুরে মসজিদের খতিব হত্যাকারীদের গ্রেফতার ও বিচার দাবিতে সমাবেশ

কৃষি দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, জাতীয় উন্নয়ন অগ্রগতির প্রধানতম হাতিয়ার- ড. মোশাররফ

কৃষি দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, জাতীয় উন্নয়ন অগ্রগতির প্রধানতম হাতিয়ার- ড. মোশাররফ

মিজানুর রহমান সোহেলের ‘জিরো টাকায় বিজনেস’ বইয়ের প্রি-অর্ডার শুরু

মিজানুর রহমান সোহেলের ‘জিরো টাকায় বিজনেস’ বইয়ের প্রি-অর্ডার শুরু

মাকে নিয়ে তারকা মেহজাবীনের সাথে ফাইভ স্টারে ডিনারের সুযোগ বিকাশ-এ

মাকে নিয়ে তারকা মেহজাবীনের সাথে ফাইভ স্টারে ডিনারের সুযোগ বিকাশ-এ

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুতে প্রধান বিচারপতির শোক

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের মৃত্যুতে প্রধান বিচারপতির শোক

সড়ক দুর্ঘটনায়  চাটমোহরের মাদ্রাসা সুপারের মৃত্যু

সড়ক দুর্ঘটনায়  চাটমোহরের মাদ্রাসা সুপারের মৃত্যু

রূপালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় এখন ইউনুস ট্রেড সেন্টারে

রূপালী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয় এখন ইউনুস ট্রেড সেন্টারে

বীভৎস অবতারে ধরা দিলেন মোশাররফ করিম

বীভৎস অবতারে ধরা দিলেন মোশাররফ করিম

চট্টগ্রাম ‘ফিটনেস সাগা’ উদ্বোধন

চট্টগ্রাম ‘ফিটনেস সাগা’ উদ্বোধন

জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় স্থানীয়দের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে : সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় স্থানীয়দের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে : সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান

আওয়ামী লীগ ঘাতক ও সন্ত্রাসী দল

আওয়ামী লীগ ঘাতক ও সন্ত্রাসী দল

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা : সম্ভাবনার পথ অন্বেষণ করতে হবে

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা : সম্ভাবনার পথ অন্বেষণ করতে হবে

দেশনেত্রী দেশে ফিরছেন : তার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে

দেশনেত্রী দেশে ফিরছেন : তার সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে