মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু রোধে চাই দক্ষ মিডওয়াইফ
১০ মে ২০২৪, ১২:১৫ এএম | আপডেট: ১০ মে ২০২৪, ১২:১৫ এএম
৫ মে বিশ্ব ধাত্রী দিবস ২০২৪। বিশ্বের অন্যান্য স্থানের মতো বাংলাদেশেও প্রতি বছর এই দিনে পালিত হয় দিবসটি। সন্তান প্রসবে যুগ যুগ ধরে ঘরে ঘরে যারা সেবা দিয়ে আসছে, সেই ধাত্রী বা মিডওয়াইফদের অবদানের স্বীকৃতি দেয়ার জন্যই দিবসটি পালন করা হয়। ধাত্রীদের উপযুক্ত মর্যাদা দেয়ার জন্য ১৯৮০ এর দশক থেকে আন্দোলন শুরু হয় আন্তর্জাতিকভাবে। এর প্রেক্ষিতে ১৯৯২ সালে ৫ই মে তারিখটিকে আন্তর্জাতিক ধাত্রী দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। প্রতি বছরই এই দিবসটি পালনের প্রাক্কালে প্রশিক্ষিত ও দক্ষ মিডওয়াইফ তৈরীর ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। বিশেষজ্ঞ মহলের বক্তব্য হচ্ছে মাতৃ ও শিশুমৃত্যু হার বহুলাংশে হ্রাস করতে দক্ষ মিডওয়াইফ গড়ে তোলা দরকার। এই গুরুত্ব বিবেচনা করেই সরকারী প্রতিষ্ঠানে মিডওয়াইফ পদ সৃষ্টির পাশাপাশি মিডওয়াইফ শিক্ষাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া হচ্ছে। উপজেলা ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে মিডওয়াইফ। দেশে নার্সিং ও মিডওয়াইফারি কাউন্সিল থেকে নিবন্ধন করা মিডওয়াইফের সংখ্যা প্রায় ৮ হাজার। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এবং ইউনিয়ন সাব সেন্টারে প্রায় ২ হাজার ৫৫৭ জন মিডওয়াইফ কাজ করছেন। তবে সেবাগ্রহীতার তুলনায় মিডওয়াইফদের সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায় নিরবচ্ছিন্ন সেবাদান ব্যাহত হচ্ছে। টেকসই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে দ্রুত মিডওয়াইফ নিয়োগ দেওয়া জরুরি। গত বছর চারটি কলেজে মাত্র ২০টি করে মোট ৮০টি সিটে মিডওয়াইফরা বিএসসি-ইন-মিডওয়াইফারির সুযোগ পেয়েছে। তাই বলা যায়, এ সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে।
বাংলার গ্রামীণ জনপদে মিডওয়াইফ বা ধাত্রী পেশা অতি প্রাচীন। অতীতে যখন চিকিৎসা ব্যবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি, তখন কোন প্রসূতির সন্তান প্রসবে ধাত্রীই ছিলো একমাত্র ভরসা। এরা প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা ছাড়াই বেশ দক্ষতার সাথেই নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে এসেছে। দু’য়েকটা ব্যতিক্রম ছাড়া সন্তান প্রসবে সহযোগিতার কাজটি তারা সফলতার সঙ্গেই করছে। মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু রোধে তাদের ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। তাই সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে মিডওয়াইফদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আর পেশাগত দিক থেকে হোক বা নিজের দায়িত্ববোধ থেকে হোক একজন মিডওয়াইফ খুবই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে থাকেন। সাধারণ বাংলায় মিডওয়াইফদের ধাত্রী নামে ডাকা হয় বা সবাই এই নামে চিনে থাকে।
সাধারণত মিডওয়াইফ বা ধাত্রীরা মাতৃসেবা দান করে থাকেন। গর্ভাবস্থায় থেকে শুরু করে প্রসব ও নবাগত শিশুর পরিচর্যা এবং পরামর্শ প্রদান করাই হলো মিডওয়াইফের আসল কাজ।
> ক্যারিয়ারঃ মিডওয়াইফদের নির্দিষ্ট কোনো পদন্নোতি না থাকলেও অভিজ্ঞতার আলোকে তারা সুপারভাইজার পর্যন্ত হতে পারেন। তাছাড়া এই পেশায় নির্দিষ্ট বেতনের পাশাপাশি অভিজ্ঞতা সম্পন্নরা ঘরে ঘরে সেবা দিয়ে ভাল আয় করতে পারেন। এই পেশায় আয় রোজগারের পাশাপাশি মানুষকে সহয়তা করার যে তৃপ্তি অর্জন করা যায় তা আসলে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
> একজন মিডওয়াইফ
পদবীঃ মিডওয়াইফ/ধাত্রী।শিক্ষাগত যোগ্যতাঃ অনুমোদিত/স্বীকৃত কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপ্লোমা ইন মিডওয়াইফারি/বিএসসি ইন মিডওয়াইফারি ডিগ্রী নিয়ে এই পেশায় আবেদন করা যায় বা চাকরি করা যায়।
> প্রতিষ্ঠানঃ সরকারি/বেসরকারি, প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি।
> ধরনঃ পার্ট টাইম/ফুল টাইম।
অভিজ্ঞতাঃ সরকারি নিয়োগের ক্ষেত্রে সাধারণত অভিজ্ঞতা চাওয়া হয় না। তবে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে ১-২ বছরের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়ে থাকে।
স্কিলঃ নার্সিং-এ দক্ষতা, গর্ভবতী মা শিশু সেবার যাবতীয় বিষয়ে দক্ষতা, প্রসবকালীন ও শিশু বিষয়ক সাধারণ জ্ঞান, স্বাস্থ্য বিষয়ক জ্ঞান, ধৈর্য্য ইত্যাদি।
কাজঃ গর্ভবতী নারীর স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট সকলকে অভহিত করা।
গর্ভবতী নারীর স্বাস্থ্য জনিত বা অন্যান্য কোনো বিপদজনক উপসর্গ দেখা দিলে তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া। সন্তান প্রসবের পূর্বে গর্ভবতী নারীকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দেয়া ও ডাক্তারের নির্দেশনা মোতাবেক যাবতীয় কার্যাবলী সম্পন্ন করা। গর্ভবর্তী নারী সন্তান প্রসবের পর তাকে প্রয়োজনীয় সেবাদান করা ও নবাগত শিশুর পরিচর্যা করা। গর্ভবতী নারী ও তার পরিবারকে নব্য মা ও নব্য শিশুর যতেœ করণীয় সম্পর্কে বুঝিয়ে দেয়া। উল্লেখিত বিষয় গুলো ছাড়াও মিডওয়াইফ গর্ভবতী নারী, নব্য মা ও নব্য শিশুর প্রয়োজনে পেশাগত দায়িত্বের বাইরেও আরো নানা ধরণের দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
নার্সিং স্বাস্থ্যসেবার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সারা বিশ্বে নার্সদের অত্যাধিক চাহিদা থাকা সত্বেও কিছু প্রতিবন্ধকতার কারণে বাংলাদেশে দক্ষ নার্স ও মিডওয়াইফ তৈরী করা যাচ্ছে না। আর মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু রোধে দক্ষ মিডওয়াইফদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। দক্ষ ও পেশাদার মিডওয়াইফরা মা ও নবজাতকের মৃত্যু রোধের পাশাপাশি তাদের স্বাস্থ্য সেবায়ও ভূমিকা রাখতে পারে। এক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব পালনে জবাবদিহিতার জন্যও প্রস্তুত থাকা উচিত। সবচেয়ে বড় কথা একজন দক্ষ মিডওয়াইফ বা ধাত্রীর সেই জ্ঞান থাকাটা জরুরী যে, কখন একজন মাকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। যুগ যুগ ধরে যে ধাত্রীরা মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে আসছে, সেই ধাত্রী পেশাই এখন স্বীকৃতি পেয়েছে। এদেরকে দেয়া হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। এই মর্যাদা অক্ষুন্ন রাখার দায়িত্ব সরকারের যতোটুকু, তার চেয়ে বেশী এই পেশায় নিয়োজিতদের। আর এক সময় গ্রামে-গঞ্জে এক শ্রেণির নারীরা হাজার হাজার গর্ভবতীর নরমাল ডেলিভারি করাতো। কিন্তু এই আমরাই তাদের ছোট চোখে দেখেছি, অপমান করেছি, ফলে তারা আজ সমাজ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। সেই নরমাল ডেলিভারির সংখ্যা বৃদ্ধি ও অপ্রয়োজনীয় সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার বন্ধে দক্ষ মিডওয়াইফদেও গ্রামে গ্রামে ফিরিয়ে আনতে হবে। আর সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার প্রাণরক্ষাকারী পদক্ষেপ হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে অপ্রয়োজনীভাবে এর সংখ্যা বাড়ছে। দেশে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে যত গর্ভবতীর প্রসব হয় তার শতকরা ২৩ ভাগ সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে হয়। যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও ইউনিসেফ কর্তৃক বেঁধে দেয়া হারের প্রায় দ্বিগুণ। বর্তমানে সরকারি পর্যায়ে শতকরা ৩৮ ভাগ ও বেসরকারি পর্যায়ে শতকরা ৮০ ভাগ সিজারিয়ান অস্ত্রোপচার হয়, যা খুবই উদ্বেগজনক। আর বর্তমান বাস্তবতায় সরকারের বিশেষ কিছু উদ্যোগের কারণে জনসাধারণ এখন মিডওয়াইফদের সেবা সম্পর্কে জানতে পারছে, সেবা নিতে হাসপাতালে ছুটে আসছে। মিডওয়াইফদের সংখ্যা আরও বাড়ানো গেলে মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যুর হার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী কমিয়ে আনা কঠিন কিছু নয়। তাই মিডওয়াইফদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।’
মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ
কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।
ইমেইল: [email protected]
বিভাগ : স্বাস্থ্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
ট্রাম্পের জয়ের পর ইলন মাস্কের সম্পদ বাড়ছে রকেট গতিতে
ভয়াবহ তুষারঝড়ে বিপর্যস্ত যুক্তরাজ্য, বহু ফ্লাইট বাতিল
ইসরায়েলি হামলায় গাজায় নিহত আরও ১২০ ফিলিস্তিনি
ইভেন্টের সেরা লড়াইটি উপহার দিলেন আফরা-সানজিদা
ওয়েস্ট ইন্ডিজের রান পাহাড়ের পর জয়-জাকিরকে হারিয়ে চাপে বাংলাদেশ
নাটকীয় শেষ দশ মিনিটে দুই গোল শোধ করে বার্সাকে রুখে দিল সেল্তা
বিবর্ণ সিটিকে ইতিহাদেই বিধ্বস্ত করলো টটেনহ্যাম
নটিংহ্যামকে হারিয়ে চার ম্যাচের জয়খরা কাটালো আর্সেনাল
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা জাতীয়করণের দাবী অত্যন্ত যৌক্তিক
পাঠ্যবই ছাপায় অনিয়মে আনন্দ প্রিন্টার্সকে সতর্কতা
দক্ষিণ লেবাননে ৬ চিকিৎসাকর্মী নিহত
জনগণের সাথে জনসংযোগ বাড়াতে হবে
আমরা যুদ্ধে বিশ্বাসী না কেউ গায়ে পড়লে জবাবের প্রস্তুতি রাখতে হবে: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
বাফুফের নতুন সভাপতি তাবিথের কাছে ২৭ রেফারির চিঠি
ফের বাড়লো সোনার দাম, ভরি ১ লাখ ৪২ হাজার টাকা
বাংলাদেশে খেলা নিয়ে অনিশ্চিয়তায় হামজা!
বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেই হবে অনূর্ধ্ব-২০ নারী সাফের খেলা
সিলেটে মাজিদের ফিফটি
অ্যাম্বাসেডর কাপ উশুতে সেনাবাহিনী চ্যাম্পিয়ন
মাদক শুধু ব্যক্তিকে নয় পরিবারকেও ধ্বংস করে