ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বড় অবদান চাই
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০৯ এএম
দেশের বিশাল এক জনগুষ্ঠির উপর এখন বন্যা ও বন্যা পরবর্তী প্রতিকুল স্বাস্থ্য সমস্যা বিরাজমান। এর পরও থেমে নেই ডেঙ্গুর তান্ডব। ডেঙ্গুর সংকট নিরসনে ব্যক্তির চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভাসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহকে ডেঙ্গু প্রতিরোধে আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্তরবর্তী সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ডে যেন ডেঙ্গু ঝুঁকি তৈরি করতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করা দরকার। ডেঙ্গুর এখন আর কোনো মৌসুমি রোগ নয়। এটি সারা বছরের রোগ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, অভিবাসনের কারণে সারা বছর ডেঙ্গুর ঝুঁকি থাকে। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ৯৫ পার হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গু বিষয়ক নিয়মিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবছর বর্ষাকালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয়। ২০২৩ সালের জুন মাস থেকে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। গেল বছর দেশে তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। এর মধ্যে ঢাকায় এক লাখ ১০ হাজার ৮ জন এবং ঢাকার বাইরে চিকিৎসা নিয়েছেন দুই লাখ ১১ হাজার ১৭১ জন। আক্রান্তদের মধ্যে হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন তিন লাখ ১৮ হাজার ৭৪৯ জন। গত বছর এক হাজার ৭০৫ জন মশাবাহিত এ রোগে মারা গেছেন, যা দেশের ইতিহাসে এক বছরে সর্বোচ্চ মৃত্যু। এর আগে ২০১৯ সালে দেশব্যাপী ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জন। ওই সময় চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীসহ প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু যায়।
২০২০ সালে করোনা মহামারিকালে ডেঙ্গুর সংক্রমণ তেমন একটা দেখা না গেলেও ২০২১ সালে সারাদেশে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ১০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
* উপসর্গ : জ্বরই এই জ্বরের প্রধান উপসর্গ। চামড়ায় দানা (র্যাশ), রক্তক্ষরণ হয়ে থাকে কারও কারও।
* জ্বর : অন্য ভাইরাস জ্বরের মতো ডেঙ্গুজ্বর সাতদিনের বেশি থাকে না। প্রথমদিকে একটানা উচ্চ তাপমাত্রায় থেকে ছয়দিনের পর জ্বর চলে যেতে পারে। দুদিন পর একদিন জ্বর না থেকে আবার দুদিনের জ্বর থাকল তারপর জ্বর চলে গেল তাও হতে পারে।
* অন্যান্য উপসর্গ : সব জ্বরে, বিশেষত ভাইরাস জ্বরে গা ম্যাজ ম্যাজ করে ব্যথা হয়। ডেঙ্গুতে ব্যথা বেশি হয়। অনেকের এত বেশি ব্যথা হয় যে, তারা হাড় ভাঙার সঙ্গে তুলনা করেন। এ ছাড়া রোগীর চোখের পেছনেও ব্যথা অনুভূত হয়।
* রক্তক্ষরণ : চামড়ায়, মুখে, খাদ্যনালিতে, চোখে হতে পারে। তবে বেশি যা হয় তা হলো মেয়েদের মাসিক একবার হয়ে গেলেও একই মাসে আবার মাসিক হয়।
* দানা (র্যাশ) : ডেঙ্গুর টিপিক্যাল র্যাশ বেরোয় জ্বরের ষষ্ঠ দিনে। তখন জ্বর থাকে না। দেখলেই চেনা যায়, খুঁজতে হয় না। এ ছাড়া জ্বরের প্রথমে গায়ে চাপ দিলে আঙ্গুলে ছাপ পড়ে। এটাকে তিনটা ফেইজে বলা হয়।
১. ফেব্রাইল ফেইজে জ্বর ও জ্বরের উপসর্গ থাকে।
২. এফেব্রাইল ফেইজে জ্বর চলে যায়। তবে এটাকে ক্রিটিক্যাল ফেসও বলে। ডেঙ্গু হিমোরেজিক জ্বরের স্টেজটা মারাত্মক জটিল হয়। এটা দুইদিন থাকে। জ্বর না থাকলেও এ সময় সতর্ক থাকতে হয়।
৩. কনভালেসেন্ট ফেইজে অধিকংশ সেরে উঠলেও কেউ কেউ ভীষণ দুর্বল হয়। বিষণ্নতায় ভোগেন।
> ডেঙ্গু জ্বর দুই ধরনের:
ক. ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভার : আর দশটা ভাইরাল ফিভারের মতো ভয় না পেলে কোনো সমস্যা নেই।
খ. ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার : ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুর সবকিছুই থাকে। রক্তনালি লিক হয় বলে বাড়তি কিছু সমস্যা হয়। জ্বরের সঙ্গে যদি হিমাটক্রিট ২০% বেড়ে যায় ও প্লাটিলেট কাউন্ট এক লাখের কম হয় তবে সেটা ডেঙ্গু হিমোরেজিক ফিভার। ডেঙ্গু হিমোরেজিক জ্বরের চারটি গ্রেড রয়েছে।
গ্রেড-১ : টুর্নিকেট টেস্ট পজিটিভ হওয়া ছাড়া রক্তক্ষরণের আর কোনো আলামত থাকে না।
গ্রেড-২ : দৃশ্যত, রক্তক্ষরণ থাকে।
গ্রেড-৩ : ১ বা ২ এর সঙ্গে যদি ব্লাড প্রেশার কমে, পালস বাড়ে।
গ্রেড-৪ : ১ বা ২ এর সাথে যদি ব্লাড প্রেশার, পালস রেকর্ড না করা যায় গ্রেড ৩ ও ৪-কে একসঙ্গে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম বলে।
* ল্যাবরেটরি পরীক্ষা : খুব টক্সিক না হলে কোনো জ্বরেরই ১ম দিন কোনো পরীক্ষার দরকার নেই। টিসি ডিসি হিমোগ্লোবিন, ইএসআর, এসজিপিটি, সিরাম ক্রিয়েটিনিন করা যায়।
এনএস ১ এন্টিজেন : এটাই জ্বরের প্রথম ৩/৪ দিনের পরীক্ষা। জ্বর থাকাকালীন পজিটিভ হয়।
* অ্যান্টিবডি পরীক্ষা : পাঁচ দিনের পর পজিটিভ হয়। এনএস ১ অ্যান্টিজেন আগে পাওয়া গেলে এটার দরকার নেই।
* প্লাটিলেট কাউন্ট ও হিমাটোক্রিট : হিমোরেজিক ফিভার ডায়াগনোসিস ও ফলোআপের জন্য করা লাগে। হিমাটোক্রিট কমে যেতে থাকলে এটা নিয়মিতই করে যেতে হবে। হিমোরেজিক ফিভার হলে পেটে ও ফুসফুসে পানি নিশ্চিত করার জন্য পেটের আল্ট্রাসনোগ্রাফি ও বুকের এক্স-রে করা লাগে।
* নিউট্রিশন : জ্বরের সময় ক্ষুধামন্দা হয়, বমি লাগে। এ সময় স্যালাইন পানি, ফলের রস উপকারী। স্বাভাবিক খাবার খাওয়া যাবে। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু এবং গ্রেড-১ হিমোরিজিকে এর চেয়ে বেশি কিছু লাগে না। গ্রেড-২ এ অতিরিক্ত সমস্যা হলো প্রথমে ধরতে না পারলে চিকিৎসা না দিলে গ্রেড-৩ বা গ্রেড-৪ অর্থাৎ শক সিনড্রোমে চলে যেতে পারে। পরিমিত পানি খেতে হবে জ্বর নামিয়ে রাখতে।
গ্রেড-২ তে যদি পেটের ব্যথা কমছে না, বমি হচ্ছে অথবা প্রেশার ঠিক থাকছে না তাহলে হাসপাতালে নিতে হবে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এটা বেশি হয়।
* রক্ত দেওয়া (ব্লাড ট্রান্সফিউশন) : রক্তক্ষরণ হলে নিয়ম হলো রক্তবদল করতে হয়। সিস্টলিক ব্লাড প্রেশার ১০০-এর নিচে নামলে, পালস ১০০-এর বেশি হলে। হিমোগ্লোবিন ১০-এর নিচে নামলে ও হিমাটোক্রিট কমে গেলে রক্ত দিতে হবে। আর হিমাটোক্রিট বাড়তে থাকলে নরমাল স্যালাইন শিরায় দিতে হবে।
> প্রতিরোধ : মশা মারতে ঘরে স্প্রে ব্যবহার করুন। তা ছাড়া ফুল হাতা কাপড় এবং পা মোজা ব্যবহার করুন। দিনে মশারি দিয়ে ঘুমান। মশার ডিম থেকে লারভা হয়ে থাকে। তাই এই পাত্র মশার বংশ বিস্তার রোধ করতে জলকান্দায়, নির্মাণ সামগ্রীর পানি, বৃষ্টিতে জমে থাকা রাস্তার এবং পাত্রের পানিতে স্প্রে করুন।
পরিশেষে বলতে চাই,বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাণীদের মধ্যে মশা এক নম্বরে। এটিই একমাত্র প্রাণী, যে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু ঘটিয়েছে। বিবিসি নিউজের তথ্য মতে, প্রতিবছর পৃথিবীতে সাত লাখ ৫০ হাজার মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় মশা। এ মুহূর্তে মশাবাহিত রোগের মধ্যে ডেঙ্গু সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ নিয়েছে।
ডেঙ্গু প্রতিরোধে চারটি ব্যাপার নিশ্চিত করা জরুরী। এক পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা, দুই মশার জৈবিক নিয়ন্ত্রণ, তিন নম্বর কীটনাশক প্রয়োগ এবং ডেঙ্গু ঠেকাতে নাগরিকদের যুক্ত করা। আর ডেঙ্গু বৃদ্ধি পাবার প্রেক্ষাপটে নেয়া পদক্ষেপগুলো ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে না গেলে নতুন সরকার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। কারণ বাংলাদেশের আবহাওয়া সব সময়ই ডেঙ্গু ভাইরাসের জন্য সহায়ক। ফলে অন্তবর্তী সরকারের যেমন কর্মপরিকল্পনা থাকা দরকার, তেমনি এই সময়ে নেয়া পদক্ষেপগুলোও চালিয়ে যেতে হবে। তাই অন্তবর্তীকালীন সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে প্রতিটি জেলা ও উপজেলা হাসপাতালে ডেঙ্গু চিকিৎসা সফলভাবে করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের কর্মরত চিকিৎসক ও নার্সদের ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ চালিয়ে যেতে হবে। তাই বর্ষাকালে যেমন মানুষ অতিরিক্ত গরম থেকে মুক্তি পায় তেমনি অনেক ধরনের রোগবালাইও মোকাবিলাও করতে হয়। তবে সময়মত সঠিক রোগ নির্ণয় করে চিকিৎসা নিলেই অধিকাংশ রোগই সেরে যায়। আবার, কিছু সাবধানতা অবলম্বন করলে সহজেই এসব রোগ প্রতিরোধ করা যায়। শুধুমাত্র বিশুদ্ধ পানি ও খাবারের ব্যাবস্থা করলে এবং আশপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখলেই বর্ষাকালের বেশিরভাগ রোগ থেকে মুক্ত থাকা সম্ভব।
মাহতাব হোসাইন মাজেদ
কলাম লেখক ও গবেষক
প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি
ইমেইল: [email protected]
বিভাগ : স্বাস্থ্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রেকর্ডের মালা গেঁথে বাংলাদেশের সিরিজ জয়
মমতা ব্যানার্জির জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী পাঠানোর প্রস্তাবটি বাস্তবতা বিবর্জিত গালগল্প
গত সাড়ে ১৫ বছর এ জাতি জিম্মি দশায় ছিল- জামায়াত আমির ডা.শফিকুর রহমান
বেনাপোলের বিএনপির সহ-সভাপতি দ্বীন ইসলামকে হত্যা, সাবেক তিন পুলিশ কর্মকর্তাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা
গ্যাস লাইন সংযোগ সহ ১০ দফা দাবিতে সিলেটের জৈন্তাপুরে সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের সাথে মতবিনিময়
৬ দফার ভিত্তিতে মাসব্যাপী কর্মসূচি জাতীয় নাগরিক কমিটির
সব ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধে হাইকোর্টে রিট
উইন্ডিজ শিবিরে নাহিদের জোড়া আঘাত
আন্তবিভাগ ফুটবল প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন জবির ফিন্যান্স বিভাগ
আগরতলা হাইকমিশনে ভাঙচুরের ঘটনায় ক্ষুব্ধ বাংলাদেশ
বায়তুল মোকাররমের খতিবসহ ১২ আলেমের বিরুদ্ধে সাদপন্থীদের মামলা
নেতাদের ভুল শুধরে নিয়ে জনগণের পাশে থাকার আহবান তারেক রহমানের
‘বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন করতে জাতিসংঘে সেনাবাহিনীর আহবান করেছে মমতা ব্যানার্জি’
‘উগ্রহিন্দুদের আট দাবিতে বাংলাদেশকে অখণ্ড ভারতের অংশ বানানোর পরিকল্পনা চলছে’
ফুটবল মাঠে সংঘর্ষ, ৫৬ জন নিহত
বিগ ব্যাশে খেলবেন না রিশাদ
ভারতে বাংলাদেশ দূতাবাসে হামলা, ঢাবিতে ছাত্র অধিকারের বিক্ষোভ
হিন্দুত্ববাদী ভারত কোনোদিন বাংলাদেশের স্বাধীনতা মেনে নিতে পারেনি: মাহমুদুর রহমান
খরা ও ভূমি ক্ষয়ের বিরুদ্ধে জরুরি বৈশ্বিক পদক্ষেপের আহ্বান পরিবেশ উপদেষ্টার
যেভাবে আতিথেয়তার পোশাক সরবরাহ করে বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলেছে ক্লোথ স্টুডিও