ডায়াবেটিস : প্রতিরোধের প্রদক্ষেপ নিতে হবে এখনই
১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম | আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৪ এএম
প্রতিবছরের ন্যায় এবারও ১৪ নভেম্বর উদযাপিত হচ্ছে বিশ্ব ডায়াবেটিস দিবস ২০২৪। ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন (আইডিএফ) ডায়াবেটিসকে বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে ঘোষণা করে। পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই বেপরোয়া ভাবে ডায়াবেটিস রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যদিও কিছু উন্নত দেশ এ বৃদ্ধির হারকে লাগাম পরাতে পেরেছে।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতেই আফ্রিকার দেশগুলোর পর সবচেয়ে বেশি হারে ডায়াবেটিসের রোগী বাড়ছে, কিন্তু এ সবদেশেই সবচেয়ে বেশি ডায়াবেটিসের রোগীর বসবাস। বাংলাদেশের চিত্র মোটেও সুখকর নয়; আইডিএফের ২০২১ সনের সমীক্ষা মোতাবেক, পাকিস্তানের পর বাংলাদেশেই ডায়াবেটিস রোগীর প্রাবল্য এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি।
ডায়াবেটিস হবার পিছনে যে সকল বিষয় জড়িত সেগুলোকে দু’টি ভিন্ন ভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়:
পরিবর্তন যোগ্য ঃ জীবনযাত্রা সম্পর্কিত বিষয় যেমন- স্থুলতা, অলস জীবন যাপন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, মানসিক চাপ, ঔষধ ইত্যাদি।পূর্বে চিহ্নিত প্রি-ডায়াবেটিসগর্ভকালীন অপুষ্টিঅপরিবর্তনীয় ঃ পারিবারিক ইতিহাসবয়স/লিঙ্গগবেষণালব্ধ তথ্য ও প্রমাণ সাপেক্ষে এ কথা আজ মোটামুটি নিশ্চিত যে টাইপ-২ ডায়াবেটিস এবং জটিলতাসমূহ প্রতিরোধ করা সম্ভব। ডায়াবেটিস প্রতিরোধের মাধ্যমে যেমন মানুষের দূর্ভোগ দূর করা যায় তেমনি দূর করা সম্ভব চিকিৎসা সংক্রান্ত অর্থনৈতিক ব্যয়ভার। আর এ প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন সচেতনতা ও সমন্বিত প্রচেষ্টা। প্রতিরোধ করা সম্ভব ৩ টি স্তরে।
প্রাথমিক প্রতিরোধ:
ডায়াবেটিস হতে না দেয়ায় প্রাথমিক প্রতিরোধ-এর লক্ষ্য। এ কাজে যাদের ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি বেশি তাদের চিহ্নিত করে প্রতিরোধের চেষ্টা করা হয়। আর এভাবে ডায়াবেটিস এবং ডায়াবেটিস জনিত জটিলতা সংক্রান্ত চিকিৎসা খরচ কমানো সম্ভব। যদিও টাইপ-১ ডায়াবেটিস প্রতিরোধের ব্যাপারে নিশ্চিত তথ্য ভিত্তিক কোন প্রমাণ নেই, এটা সত্যি যে টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব। স্বাভাবিক ওজন ধরে রাখা এবং প্রতিদিন কিছু শারীরিক পরিশ্রমের লক্ষ্যে জীবন যাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করা সম্ভব।
দু’টি ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে প্রাথমিক প্রতিরোধ করা সম্ভব।১। সাধারণ জনগোষ্ঠীর ডায়াবেটিস প্রতিরোধ ঃ এ ক্ষেত্রে একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীকে সামনে রেখে তাদের স্বাস্থ্য পরিচর্যায় কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয় যা ডায়াবেটিসের পাশাপাশি উচ্চরক্তচাপ, হৃদরোগ এবং অন্যান্য অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধে সমান সহায়ক। এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদ্যোগগুলো হলো:
সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা:জাতীয় এবং বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থাকে সাহায্য করা।প্রতিরোধের অর্থনৈতিক উপকারিতা সম্পর্কে জন সাধারণকে অবহিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করা।বেসরকারী উদ্যোগ:কর্মক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করা।স্বাস্থ্যকর খাদ্য ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
সামাজিক সহায়তা:পুষ্টি/স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস/ব্যায়াম ইত্যাদি বিষয়ে স্কুল থেকেই সময়োপযোগী শিক্ষা প্রদান করানগর পরিকল্পনার সময় স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, ব্যায়াম করার পর্যাপ্ত সুযোগ এবং স্বাস্থ্যসম্মত নগরায়ন নিশ্চিত করাসাধারণ জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজনীয় খেলাধুলার ব্যবস্থা করা
প্রচার মাধ্যম:জনসাধারণের পরিচ্ছন্ন শিক্ষা ও ধারণা প্রদানের মাধ্যমে তাদের উদ্বুদ্ধ করা। এ কাজে সংবাদপত্র, টিভি, রেডিও ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারে।ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্য দৈনন্দিন জীবনধারার যে সকল বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সেগুলো হলো:প্রতিদিন অন্তত: ৩০ মিনিট মাঝারী ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রম করতে উৎসাহিত করাপ্রত্যেক ব্যক্তিকে আদর্শ ওজন ধরে রাখতে উৎসাহিত করাযাদের ওজন স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি তাদের অন্তত: ৫-১০% ওজন কমানোর চেষ্টা করাঅপ্রাপ্ত বয়স্কদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে আদর্শ উচ্চতা ও আদর্শ ওজন লাভ নিশ্চিত করা
২. উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ডায়াবেটিস প্রতিরোধ:যাদের ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি খুব বেশি তাদের ডায়াবেটিস প্রতিরোধ মূলত: তিনটি ধাপে করা হয়ে থাকে:ক) উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী চিহ্নিত করণ - এই ধাপে সাধারণ জনগোষ্ঠী থেকে ব্যবহারিক, স্বল্প ব্যয়ে করা সম্ভব এমন সহজ কিছু বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী চিহ্নিত করা হয়। যে সকল বৈশিষ্ট্য থাকলে তাদের উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী বলা যেতে
পারে সেগুলো হলো:কোমরের মাপ ৯০ সেমি (পুরুষ) অথবা ৮০ সেমি (মহিলা) এর বেশি হলেবিএমআই ২৫ কেজি/মি২ এর বেশি হলে (এশিয়দের ক্ষেত্রে ২৩ কেজি/মি২ এর বেশি হলে)শারীরিক পরিশ্রম না করলেপরিবারে রক্ত সম্পর্ক কারো ডায়াবেটিস থাকলেবয়স ৩৫ বছর হলেগর্ভাবস্থায় ডায়াবেটিস হয়ে থাকলে
খ) ঝুঁকির মাত্রা নির্ধারণ - এই ধাপে চিহ্নিত উচ্চঝুঁকি পূর্ণ জনগোষ্ঠীর সকলের গ্লূকোজ খাইয়ে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রার পরীক্ষা করা হয়। এদের ভিতর যাদের প্রি-ডায়াবেটিস পাওয়া যায় তাদের ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি আরো বেশি থাকে; তাই এদের ব্যাপারে অধিকতর সচেতন হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া এই ধাপে আরো কিছু শারীরিক অবস্থা যা ডায়াবেটিস হবার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় সেগুলোর উপস্থিতি চিহ্নিত করা হয়। যেমন:
- অতিরিক্ত মেদ/ভুড়ি আছে কিনা- পরিবারে অন্য কারো ডায়াবেটিস আছে কিনা- ট্রাই গ্লিসারাইড বেশি আছে কিনা- আগে থেকেই কোন হৃদরোগ আছে কিনা ইত্যাদি এ ছাড়াও ধুমপান বা তামাক গ্রহণের অভ্যাস থাকলে সেগুলো বাদ দেবার ব্যাপারে যতœবান হওয়া ডায়াবেটিস প্রতিরোধে জরুরী।
গ) ডায়াবেটিস প্রতিরোধের চেষ্টা - এই ধাপে জীবন যাত্রার পরিবর্তনের মাধ্যমে ওজন স্বাভাবিক রাখা ও প্রতিদিন ব্যায়াম করার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করা হয়, যা ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সাহায্য করে। কিন্তু যারা জীবন যাত্রার যথেষ্ট পরিবর্তন করতে পারে না তাদের ক্ষেত্রে কখনও কখনও ঔষধ (মেটফরমিন, গ্লিটাজোন) ব্যবহার করা হয়।
দ্বিতীয় ধাপের প্রতিরোধ:ডায়াবেটিস দ্রুত নির্ণয় এবং এর জটিলতা প্রতিরোধ করা দ্বিতীয় ধাপের প্রতিরোধের অন্তর্ভুক্ত। দ্রুত নির্ণয় করার জন্য উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর একটি নির্দিষ্ট বিরতিতে ডায়াবেটিস আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা উচিত। তাছাড়া কম ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীকে ৩৫ বছর বয়সের পর ডায়াবেটিস নির্ণয়ের পরীক্ষা করে দেখা উচিত। দ্রুত নির্ণয়ের পাশাপাশি ডায়াবেটিসের সঠিক নিয়ন্ত্রণ ডায়াবেটিস জনিত জটিলতা প্রতিরোধে সাহায্য করে। এ ব্যাপারে রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণ ছাড়াও রক্তের চর্বি, ওজন, রক্তচাপ নির্দিষ্ট মাত্রার ভিতর রাখা জরুরী।
তৃতীয় ধাপের প্রতিরোধে
ডায়াবেটিক ব্যক্তির জটিলতা প্রতিরোধ করে অথবা কমিয়ে রেখে জীবন যাত্রার মান উন্নয়ন তৃতীয় ধাপের এর উদ্দেশ্য। একই সাথে ডায়াবেটিক ব্যক্তিদের কর্মক্ষম ও স্বাবলম্বী রাখার চেষ্টা করাও এর অংশ। আর তাই, তৃতীয় ধাপের রোগের চিকিৎসার সাথে সরাসরি জড়িত এবং এ ব্যাপারে চিকিৎসকই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। তৃতীয় ধাপের এর জন্য রক্তের গ্লুকোজের সঠিক নিয়ন্ত্রণ, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং ওজন স্বাভাবিক রাখার পাশাপাশি জটিলতা অনুসারে বিশেষ বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া জরুরী। যেমন:রোগ / জটিলতা বিশেষ পদক্ষেপহৃদরোগ অমপান/তামাক বর্জন করা রক্তের চর্বি স্বাভাবিক রাখাকিডনী রোগ আমিষ জাতীয় খাবার নিয়ন্ত্রণ করা
পায়ের রক্তনালীর সমস্যা সঠিক জুতা/স্যান্ডেল পরিধান করা পায়ের সঠিক যতœ নেয়া
ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশন ও বাংলাদেশের ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ তথ্যপূর্ণভাবে আস্থাশীল যে, যথাযথ পদক্ষেপ নিতে সমর্থ হলে, নিদেন পক্ষে ৫০% ডায়াবেটিসের ঝুঁকিপূর্ণ মানুষকে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের হাত থেকে আজীবনের জন্যে রক্ষা করা সম্ভব।তাই, এ ডায়াবেটিস সেবা দিবসে সকলকে ডায়াবেটিস প্রতিরোধে সচেষ্ট হবার আহ্বান জানাচ্ছি।
ডা. শাহজাদা সেলিমসহযোগী অধ্যাপক এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
বিভাগ : স্বাস্থ্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
পরলোকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং :ভারতে ৭ দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা
কালীগঞ্জে রাঙ্গামাটিয়া ধর্মপল্লীর সংবাদ সম্মেলন
গ্রাম আদালত সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরিতে সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত
মিসরে প্রেসিডেন্ট সিসির বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ
কুর্দি যোদ্ধাদের ভয়ঙ্কর হুঁশিয়ারি এরদোগানের
৩৫শ’ এজেন্টের অধিকাংশই গুজরাটের পাচারকারী
৫ সাংবাদিককে হত্যা করল ইসরাইল বিমান
তুষারপাতে অচল হিমাচল দুই শতাধিক রাস্তা বন্ধ
ক্রিপ্টো রিজার্ভ গড়বেন ট্রাম্প?
মোজাম্বিকে কারাদাঙ্গায় নিহত ৩৩, পলাতক ১৫০০ কয়েদি
গাজায় যুদ্ধবিরতি বিলম্বে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ হামাস-ইসরাইলের
পাকিস্তানে সড়ক অবরোধে শতাধিক শিশুর প্রাণহানি
আফগানিস্তানে ৭১ সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে পাকিস্তান
শুধু নারীদের জন্য
নিথর দেহ
আত্মহননে
জকিগঞ্জে প্রাক্সিসের ৭ দিনব্যাপী ইংলিশ স্পিকিং চ্যালেঞ্জ কম্পিটিশনের পুরস্কার বিতরণী
মাদ্রাসার ছাদ থেকে পাইপ বেয়ে নামার সময় পড়ে গিয়ে শিশুর মৃত্যু
গাজীপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় বিএনপি নেতাদের ভিড়
শুধু নামেই জিমনেসিয়াম