ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে যেভাবে গ্রহণযোগ্যতা দিয়েছেন বাজপেয়ী
২৮ মে ২০২৩, ০৮:৩৩ পিএম | আপডেট: ২৯ মে ২০২৩, ১২:০১ এএম
ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর ব্যাঙ্গালরের এক হোস্টেলে ১৯৭৫ সালের ২৬ জানুয়ারি পুলিশ এসে গ্রেফতার করে সেসময়ের একজন নামকরা বিরোধী রাজনীতিক অটল বিহারী বাজপেয়ীকে। এর আগের দিন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং পুরো দেশকে এক অভূতপূর্ব সঙ্কটে ঠেলে দেন।
নির্বাচন স্থগিত রাখা হয়, নাগরিক অধিকার সঙ্কুচিত করা হয়, গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হয় এবং সরকারের সমালোচক আর বিরোধী রাজনীতিকদের কারাবন্দী করা হয়। ইন্দিরা গান্ধী একই সঙ্গে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে (আরএসএস) নিষিদ্ধ করেন, যেটিকে পরবর্তীকালের হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির আদর্শগত ধারার ভিত্তি বলে গণ্য করা হয়। এই বিজেপিই এখন ভারতের ক্ষমতায়।
অটল বিহারী বাজপেয়ী তখন ছিলেন জনসংঘ বলে একটি দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতা এবং আরএসএস এর সদস্য। দুই দশক পর তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন। দুবার খুব স্বল্প সময়ের জন্য- ১৯৯৬ এবং ১৯৯৮ সালে। পরের বার একটি কোয়ালিশন সরকারের প্রধান হিসেবে ১৯৯৯ হতে ২০০৪ সাল পর্যন্ত পূর্ণ-মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। তবে ১৯৭৫ সালের সেই গ্রীষ্মে যখন অটল বিহারী বাজপেয়ী গ্রেফতারের হুমকিতে আছেন, তখন এক দলীয় কর্মীকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, শহরের সবচেয়ে “ভালো কারাগার” কোনটি।
তাকে যখন থানায় আনা হয়, তখন বেশ বিরক্ত মনে হচ্ছিল। তবে তিনি বেশ নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাকে একমাস কারাগারে কাটাতে হয়। সেখানে বসে তিনি কবিতা লিখতেন- নিজেকে তিনি নাম দিয়েছিলেন কায়দি কাভিয়ারি- অর্থাৎ বন্দী কবি। সেখানে তিনি তাস খেলেও সময় কাটাতেন, আর রান্নাঘরে রান্নার তত্ত্বাবধান করতেন। ভুল চিকিৎসায় শারীরিক অবস্থা জটিল হয়ে পড়লে এরপর জুলাই মাসে একটি বিশেষ বিমানে অটল বিহারী বাজপেয়ীকে দিল্লি নিয়ে আসা হয়। রাজধানীতে তিনি তার অপারেশন থেকে সেরে উঠতে বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থাকেন, এরপর তাকে প্যারোলে বাড়িতে যেতে দেয়া হয়। তবে সেখানে তাকে থাকতে হতো পুলিশের নজরদারিতে।
মধ্য ডিসেম্বর নাগাদ বাজপেয়ীকে বেশ হতাশ বলে মনে হচ্ছিল। “আমার জীবন সায়াহ্নে সূর্য অস্ত যেতে চলেছে বলে মনে হয়.. শব্দগুলোর আর কোন অর্থ নেই.. এক সময় যা ছিল সঙ্গীত, এখন তা এলোমেলো আওয়াজ”- একটি কবিতায় তিনি লিখেছেন। আরএসএস-এর সার্বক্ষণিক কর্মী, যারা ‘প্রচারক’ বলে পরিচিত, তারা তখনো গোপনে কাগজপত্র বিলি করে এবং আইন-অমান্য কর্মসূচির মাধ্যমে জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু মনে হচ্ছিল এই আন্দোলন স্তিমিত হয়ে আসছে।
ইন্দিরা গান্ধীর উপদেষ্টারা তখন বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করছে ‘আত্মসমর্পণের দলিলে’ সই করতে যাতে সরকারের সাথে আপসরফা করা যায়। সরকারের জারি করা জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে যে কোন গণঅভ্যুত্থান হচ্ছে না- সেটা জেনে নাকি অটল বিহারী বাজপেয়ী বেশ ধাক্কা খেয়েছিলেন- বাজপেয়ীকে নিয়ে এক নতুন জীবনী-গ্রন্থে লেখক অভিষেক চৌধুরী সেটাই দাবি করেছেন।
তবে সেসময় কেউ যা অনুধাবন করতে পারেন নি, তা হলো, বাজপেয়ী এক বছরের মধ্যেই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একটি বিরোধী মোর্চা গঠনে বড় ভূমিকা পালন করবেন। ‘জনতা পার্টি’ নামে পরিচিত এই দল ছিল আসলে চারটি মধ্যপন্থী এবং দক্ষিণপন্থী দলের জোট, যার মধ্যে জনসংঘও ছিল। এরপর ১৯৭৭ সালের মার্চের নির্বাচনে জনতা দল ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেসকে নাটকীয়ভাবে হারিয়ে দেয়। স্বাধীনতার ৩০ পর সেই প্রথম কংগ্রেস ভারতের জাতীয় নির্বাচনে হারলো।
ইন্দিরা গান্ধী এই নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন জানুয়ারিতে এবং পরে জরুরি অবস্থা তুলে নিয়েছিলেন। নির্বাচনে জনতা পার্টি পার্লামেন্টের ৫৪২টি আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসনে জিতেছিল। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল, জনতা মোর্চায় জনসংঘ একাই জিতেছিল ৯০টি আসন, সবচেয়ে বেশি। অভিষেক চৌধুরী বলছেন, অটল বিহারী বাজপেয়ী জনতা সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য দাবি জানাতে পারতেন, কিন্তু তখন তার বয়স ছিল ৫২ বছর, প্রধানমন্ত্রীর পদের জন্য তাকে বেশি তরুণ বলে মনে করা হচ্ছিল।
পরে জনতা দল সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ৭৮ বছর বয়সী মোরারজী দেশাই। একজন কাঠখোট্টা এবং সংযমী রাজনীতিক। তার মন্ত্রিসভায় জনসংঘ থেকে তিনজনকে মন্ত্রী করা হয়। বাজপেয়ী পেয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব। তিনি তখন ‘ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে কোন বড় পরিবর্তন ঘটবে না’ বলে ঘোষণা দেন এবং চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করার অঙ্গীকার করেন।
অভিষেক চৌধুরীর মতে, ভারতে “হিন্দু জাতীয়তাবাদকে” মূলধারার রাজনীতিতে পরিণত করতে অনেক দিক থেকেই অটল বিহারী বাজপেয়ী এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তার এই মত ভারতে প্রচলিত ধারণার বিপরীত। এই কৃতিত্ব সাধারণত দেয়া হয় বাজপেয়ীর সহযাত্রী বিজেপি নেতা লাল কৃষ্ণ আদভানিকে। ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় শহর অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণের জন্য দশকব্যাপী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি, যার পথ ধরে বিজেপি ক্ষমতায় এসেছিল। অটল বিহারী বাজপেয়ীর জীবনীকার অভিষেক চৌধুরী বলছেন, “এই বিশ্লেষণে আসলে আত্মপ্রবঞ্চনা আছে, কারণ এতে আগের রাজনৈতিক ধারাকে উপেক্ষা করা হয়েছে।”
তিনি বলেন, "লোকে যেটা ভুলে যায়, তা হলো, বিজেপির উত্থানের অনেক আগে- তাদের পূর্বসূরি জনসংঘ একটি দক্ষিণপন্থী দল হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ১৯৮৪ সালে পার্লামেন্টে মাত্র দুটি আসন থেকে ২০১৪ এবং ২০১৯ সালে পর পর দুটি নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে বিজেপির বিজয়ের অনেক আগে এটা ঘটেছে। বাজপেয়ী সেই জনসংঘে ছিলেন"। তিনি আরও বলেন, ১৯৬৭ সালে জনসংঘ যখন তার শিখরে, তখন পার্লামেন্টে তাদের ৫০ জন এমপি ছিল, বিভিন্ন রাজ্যের বিধান সভায় ছিল আরও ৩০০ জন সদস্য। “বাজপেয়ী ছিলেন ভারতীয় রাজনীতির দুই যুগের মধ্যে সংযোগ সেতু- কংগ্রেস এবং দক্ষিণপন্থী যুগ। বাজপেয়ী না থাকলে কোন নরেন্দ্র মোদী তৈরি হতো না,” বলছেন অভিষেক চৌধুরী।
১৯৮০ সালে যখন কলহ-বিবাদে লিপ্ত জনতা পার্টি সরকারের পতন ঘটলো, তখন বাজপেয়ী প্রস্তাব করলেন যে জনসংঘকে নতুন মোড়কে একটি মূলধারার রাজনৈতিক দলে পরিণত করা উচিৎ। তারপরই বিজেপির জন্ম হলো। অনেকে বাজপেয়ীকে কট্টরপন্থীদের একটি দলের ‘মুখোশ’ বা মধ্যপন্থী বলে বর্ণনা করেন। অভিষেক চৌধুরী বলছেন, ‘কট্টরপন্থী হওয়ার সুযোগ বাজপেয়ীর ছিল না, কারণ তিনি এমন এক রাজনৈতিক জোটে ছিলেন, যেখানে অনেক ভিন্ন ধারার রাজনৈতিক দল ছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে রাজনীতিতে আপসের একটি বড় ভূমিকা আছে। “তবে এমপি হওয়ার আগে পর্যন্ত বাজপেয়ী একজন কট্টরপন্থীই ছিলেন,” বলছেন তিনি।
বাজপেয়ী আরএসএসে যোগ দেন তার কলেজ জীবনে। আরএসএস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯২৫ সালে। তিনি প্রতি সপ্তাহে বক্তৃতা দিতেন, সাংবাদিক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। ভারতে ইসলামের ইতিহাস সম্পর্কে একটি বইও লিখেন। তিনি দক্ষিণপন্থীদের চারটি পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, যার মধ্যে আরএসএসের মুখপাত্র ‘পাঞ্চজন্য’ও আছে। এই পত্রিকায় তিনি গোরক্ষা, হিন্দু পারিবারিক আইন, ভারতের সঙ্গে বাকী বিশ্বের সম্পর্ক এবং হিন্দুত্ববাদ- এরকম নানা বিষয়ে লিখেছেন।
বলিউডের ছবি বারাসাতের গানগুলিকে যখন তিনি ‘নোংরা এবং অশ্লীল’ বলে বর্ণনা করেন, তখন বোঝা গিয়েছিল তিনি কতটা গোঁড়া রক্ষণশীল ছিলেন। তিনি এধরনের ছবি শিশুদের জন্য দেখা নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছিলেন। তবে কয়েক-দশক করে বাজপেয়ী একজন বাস্তববাদী রাজনীতিকে পরিণত হন বলে মনে হয়। তিনি যখন জনতা পার্টিকে নির্বাচনী মোর্চায় পরিণত করতে কাজ করছিলেন, তখন স্থানীয় গণমাধ্যমে তাকে এই বলে প্রশংসা করা হয় যে, “বিভিন্ন বিষয় বোঝা এবং মতপার্থক্য দূর করার মতো ক্ষমতা এবং নমনীয়তা" তার মধ্যে আছে।
অভিষেক চৌধুরীর মতে অটল বিহারী বাজপেয়ী তার ছয় দশকের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ভারতের সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে রহস্যময় রাজনীতিকই থেকে গেছেন। তিনি মারা যান ২০১৮ সালে, ৯৩ বছর বয়সে। সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
দোয়ারাবাজারে স্ত্রীর যৌতুক মামলায় যুবক গ্রেপ্তার
সচিবালয়ে আগুন পরিকল্পিত: প্রকৌশলী ইকরামুল খান
সেন্ট মার্টিন থেকে ফেরার পথে আটকা পড়েছেন ৭১ পর্যটক
জকিগঞ্জে মোটরসাইকেল দূর্ঘটনায় এক যুবকের মৃত্যু
বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের চামড়া শিল্পের অগ্রগতির লক্ষে ইসিফোরজে’র প্রি-ওয়ার্কশপ
উচ্চ পর্যায়ের নতুন কমিটি গঠন, ৩ কর্মদিবসে প্রাথমিক প্রতিবেদন
ব্রাহ্মণপাড়ায় ছুরিকাঘাতে এক যুবককে হত্যা
কালীগঞ্জে পুকুর থেকে ২ শিশুর লাশ উদ্ধার
নিবন্ধন চূড়ান্ত: হজযাত্রী ৮৩ হাজার ২৪২ জন
হল্যান্ডের পেনাল্টি মিস,বিবর্ণ সিটি ফের হারাল পয়েন্ট
শরীফ থেকে শরীফার গল্প বাতিল করতে হবে: ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ
বিসিএ নির্বাচন সম্পন্ন: মিজান সভাপতি, মতিন সম্পাদক
ডেঙ্গুতে আরও ৪ জনের মৃত্যু, হাসপাতালে ভর্তি ১৫৩
বিএনপি মুক্ত সাংবাদিকতায় বিশ্বাসী: শাহজাহান চৌধুরী
সচিবালয়ে আগুন: গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ব্যর্থতাকে দায়ী করলো এবি পার্টি
পরকীয়া প্রেমের ঘটনায় গৌরনদীতে উপ-সহকারী ২ কৃষি কর্মকর্তা এলাকাবাসীর হাতে আটক
‘প্রতিবন্ধীদের সংগঠন ও সম্পদ দখল করে পতিত সরকারের শিল্পমন্ত্রীর কন্যা’
আশিয়ান সিটির স্টলে বুকিং দিলেই মিলছে ল্যাপটপ
সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি পরিকল্পিত নাশকতা: ইসলামী আইনজীবী পরিষদ
গাজীপুরে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাকে ছাড়িয়ে আনতে থানায় বিএনপি নেতাদের ভিড়