যে ‘উলঙ্গ’ যোদ্ধারা ব্রিটিশদের ভারত দখলে সহায়তা করেছিলেন
২৬ জুন ২০২৩, ০৭:১৯ পিএম | আপডেট: ২৭ জুন ২০২৩, ১২:০১ এএম
তিনি ছিলেন শত্রুপক্ষের মনে ভয়-ধরানো এক যোদ্ধা-নেতা। তার নিজস্ব সেনাবাহিনীতে ছিল উলঙ্গ ও জটাধারী ঘোড়সওয়ার ও পদাতিক যোদ্ধাদের দল - যুদ্ধক্ষেত্রে তারা কামানের মত অস্ত্রও ব্যবহার করতো। কিন্তু অনুপগিরি গোঁসাই শুধু সৈনিক ছিলেন না - ছিলেন একজন সন্ন্যাসীও। তিনি ছিলেন হিন্দু দেবতা শিবের ভক্ত একজন নাগা বা নগ্ন সাধু, যাদের ভারতে খুবই সম্মানের চোখে দেখা হতো।
তারা একটি প্রধান হিন্দু ধর্মীয় গোষ্ঠীর সদস্য যারা উলঙ্গ থাকেন, গায়ে মাখানো থাকে ছাই, আর মাথায় জটা। ভারতের কুম্ভ মেলা - যা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব - তাতে এদের প্রায়ই দেখা যায়। গোঁসাই ছিলেন এমনই একজন যোদ্ধা সাধু, বলছেন উইলিয়াম আর পিঞ্চ তার লেখা বই 'ওয়ারিয়র অ্যাসেটিক অ্যান্ড ইন্ডিয়ান এমপায়ার্স'। নাগারা 'ভয়ংকর এবং উচ্ছৃঙ্খল' এরকম একটা ধারণা থাকলেও অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই নাগারা "ভালো ভালো অস্ত্রে সজ্জিত এবং সুশৃঙ্খল" ছিলেন। তা ছাড়া অশ্বারোহী এবং পদাতিক -দু ধরনেরই সেনা হিসেবেও তারা ছিলেন অত্যন্ত উন্নত মানের - বলছেন পিঞ্চ, যিনি যুক্তরাষ্ট্রের কানেক্টিকাটের ওয়েসলিয়ান ইউনিভার্সিটির একজন ইতিহাসবিদ।
উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে একজন নাগা সৈনিকের একটি পোর্ট্রেট আঁকিয়েছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একজন কর্মকর্তা জেমস স্কিনার। সেই ছবিতে দেখা যায়, খালি পায়ে একজন নগ্ন সাধু, তার গায়ে ঝোলানো একটি চামড়ার বেল্ট, সাথে লাগানো বাঁকা তলোয়ার, আর কিছু কয়েকটি থলিতে ভরা বারুদ, গুলি, এবং চকমকি পাথর। তার ঘন এবং জটপাকানো চুল মাথায় এমনভাবে প্যাঁচানো যে মনে হয় যেন তিনি একটা শিরস্ত্রাণ পরে আছেন। তার বাম হাতে লম্বা নলওয়ালা সেযুগের বন্দুক - যার নাম ছিল মাস্কেট। কপালে কমলা রঙের তিলক আঁকা।
‘সেযুগে নাগাদের সুনাম ছিল আচমকা আক্রমণকারী সেনাদল হিসেবে, তা ছাড়া হাতাহাতি যুদ্ধেও তাদের পারঙ্গমতা ছিল’ - লিখেছেন পিঞ্চ। "অনুপগিরি গোঁসাইয়ের নেতৃত্বে তাদের একটি পূর্ণাঙ্গ পদাতিক বাহিনী গড়ে ওঠে - যারা সে সময়কার যে কোন সেরা সৈন্যদলের সাথেও পাল্লা দিতে পারতো।" অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে অনুপগিরি এবং তার ভাই উমরাওগিরি ২০,০০০ লোকের বাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন। উনবিংশ শতাব্দীতে এসে কামান এবং রকেটধারী সন্ন্যাসী সৈন্যদের সংখ্যা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায়।
লেখক ইতিহাসবিদ উইলিয়াম ডালরিম্পল অনুপগিরিকে বর্ণনা করেছেন একজন "ভীতিউদ্রেককারী নাগা সেনানায়ক" হিসেবে - যাকে হিম্মত বাহাদুর বা সাহসী বীর হিসেবে মুঘল খেতার দেয়া হয়েছিল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং কীভাবে তারা ভারতে আধিপত্য কায়েম করলো তা নিয়ে "দি অ্যানার্কি" নামে একটি বই লিখেছেন ইউলিয়াম ডালরিম্পল। এ বইতে তিনি লিখেছেন মির্জা নাজাফ খান নামে একজন মুঘল সেনানায়কের বাহিনীর কথা। এই বাহিনীতেই যোগ দিয়েছিলেন ভিন্ন ধরনের একদল সৈন্য: "অনুপগিরি গোঁসাইয়ের জটাধারী নাগা" - যাতে ছিল ৬,০০০ নগ্ন সাধু এবং ৪০টি কামান। অনুপগিরির বাহিনীর ব্যাপারে উল্লেখ করা হচ্ছে তাতে কী ছিল -১০,০০০ গোঁসাইয়ের একটি সেনাদল (অশ্বারোহী ও পদাতিক সমেত), পাঁচটি কামান, রসদপত্রে ভর্তি অসংখ্য বলদে-টানা গাড়ি, তাঁবু, এবং নগদ ১২ লাখ রুপি। ২০১৯-এর মুদ্রামানে এর পরিমাণ হবে ১৬ লক্ষ ব্রিটিশ পাউন্ডের সমান।
অনুপগিরি ছিলেন একজন রহস্যময় ব্যক্তি - যাকে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে সফলতম সামরিক উদ্যোক্তা বা 'ভাড়াটে বাহিনী' বলা যেতে পারে। কথাটা ভুল নয়। কারণ সে যুগে রাজারা যে সমস্ত ব্যক্তিগত বাহিনী নিয়োগ করতেন - তার সবই ছিল ভাড়াটে সৈন্য দিয়ে গঠিত। অনুপগিরির সম্পর্কে একজন সমসাময়িক ভারতীয় বলেছিলেন তিনি ছিলেন এমন একজন লোক যে "দুই নৌকায় পা রেখে নদী পার হচ্ছিলেন - যাতে কোন একটি ডুবে গেলে তিনি আরেকটিতে চলে যেতে পারেন, " কথাটি লিখেছিলেন টমাস ব্রুক - সে সময় বেনারস (এখনকার বারাণসী) শহরের একজন বিচারক।
এতে তাই অবাক হবার কিছুই নেই যে সর্বত্রই এই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের যোদ্ধার উল্লেখ পাওয়া যায়। "অনুপগিরিকে সর্বত্র দেখা যেতো কারণ তিনি ছিলেন এমন একজন লোক যাকে সবারই দরকার হতো। আবার তাকে যে দরকার হচ্ছে সে জন্য অনেকে আবার তাকে পছন্দও করতো না। যাদের ভাড়াটে সৈনিক দরকার তাদের কাছে তিনি ছিলেন একজন প্রয়োজনীয় লোক। আবার কোন গোপন খবর বের করা, দুপক্ষের মধ্যে আপোষরফা করা বা কোন একটা নোংরা কাজ কাউকে টের পেতে না দিয়ে করিয়ে নেয়া - এগুলোর জন্যও লোকে তার শরণাপন্ন হতো," বলেন মি. পিঞ্চ।
নানা পক্ষের হয়ে লড়েছেন অনুপগিরি
অনুপগিরি নানা পক্ষের হয়ে লড়াই করেছেন। ১৭৬১ সালের পানিপথের যুদ্ধে তিনি মুঘল সম্রাট ও আফগানদের হয়ে মারাঠাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তিন বছর পর তিনি মুঘল বাহিনীর হয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন বক্সারের লড়াইয়ে। আবার দিল্লিতে পারস্যের নাজাফ খানের উত্থানেও অনুপগিরি গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলেন। এরও পরে তিনি যোগ দেন ব্রিটিশদের পক্ষে এবং তাদের হয়ে ১৮০৩ সালে মারাঠাদের পরাজিত করার যুদ্ধে ভুমিকা রাখেন।
ব্রিটিশদের দিল্লি দখলের যুদ্ধেও তিনি সহায়তা করেছিলেন। এটা ছিল সেই ঘটনা যার ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দক্ষিণ এশিয়ায় তথা বিশ্বে সবচেয়ে বড় শক্তি হয়ে ওঠে, লিখেছেন পিঞ্চ। পিঞ্চের কথায়, অষ্টাদশ শতকে ভারতে মুঘল ও মারাঠা শক্তির পতন এবং ব্রিটিশ শক্তির উত্থানের ঘটনাগুলোকে যতই পরীক্ষা করে দেখা যায়, ততই এর পশ্চাতে অনুপগিরি গোঁসাইয়ের ভুমিকা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
অনুপগিরির জন্ম ১৭৩৪ সালে উত্তর ভারতের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ বুন্দেলখন্ডে। তার বাবা মারা যাবার পর বিধবা মা দারিদ্র্যের কারণে অনুপগিরি ও তার বড় ভাইকে একজন যোদ্ধা নেতার হাতে তুলে দেন। এমন গল্পও আছে যে তিনি মাটির তৈরি সৈন্যদের সাথে খেলে শৈশব কাটিয়েছেন - তবে এগুলো হয়তো নিতান্তই গালগল্প। লোকের মুখে মুখে ফেরা গল্পে আভাস পাওয়া যায় যে ১৬শ শতকে মুসলিমদের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য অনুপগিরির মতো লোকদের অস্ত্রধারী হবার অনুমতি দেয়া হয়।
তবে পিঞ্চ এমন তথ্য পেয়েছেন যে অনুপগিরি মুঘল সম্রাট শাহ আলম এবং অন্য মুসলিম নিয়োগদাতার বাহিনীতে কাজ করেছেন। এমনকি আফগান রাজা আহমদ শাহ আবদালির পক্ষ নিয়ে তিনি ১৭৬১ সালে যুদ্ধ করেছেন মারাঠাদের বিরুদ্ধে। তার জীবন নিয়ে যেসব কবিতা রচিত হয়েছে তাতে তার সঙ্গীদের মধ্যে মুসলিমরা ছিল বলে উল্লেখ পাওয়া যায়। "অনুপগিরির প্রতিভা ছিল এখানেই যে ক্ষমতার ক্ষেত্রে তার অপরিহার্যতা তিনি তুলে ধরতে পারতেন। তার জন্ম উচ্চ শ্রেণীতে হয়নি, এবং তিনি জানতেন যে কখন লড়াই করতে হবে আর কখন পালাতে হবে," পিঞ্চ লেখেন, "তিনি জানতেন কীভাবে শত্রু ও মিত্র উভয় পক্ষকে বোঝাতে হয় যে তার হারাবার কিছুই নেই।"
সেটা ছিল এমন এক সময় ও স্থান যখন একজন সশস্ত্র সাধুকে দেখা হতো এমন একজন লোক হিসেবে যে মৃত্যুকে জয় করেছে, বলছেন পিঞ্চ। ডালরিম্পল তার লেখায় বক্সারের যুদ্ধের নাটকীয় বর্ণনা দিয়েছেন - যে যুদ্ধের ফলে বাংলা ও বিহারে ব্রিটিশ ক্ষমতা নিশ্চিত হয়েছিল। ওই যুদ্ধে অনুপগিরি তার উরুতে গুরুতর আঘাত পেয়েছিলেন। আহত অবস্থায় তিনি মুঘল সম্রাট সুজা-উদ-দৌলাকে বোঝান যেন তিনি রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান। "অনর্থক মারা যাবার মুহূর্ত এটা নয়", তিনি বলেছিলেন, "আমরা অন্য আরেকদিন সহজেই জিততে পারবো, প্রতিশোধ নিতে পারবো।" তারা তখন নৌকা সাজিয়ে তৈরি একটি সেতু দিয়ে নদী পার হয়ে পালালেন। অনুপগিরি আদেশ দিলেন, সেতুটি যেন এর পরপরই ধ্বংস করে ফেলা হয়, যাতে আরেক দিন যুদ্ধ করার জন্য বেঁচে থাকা যায়। সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
টাইব্রেকারে রোনালদোর পর্তুগালকে হারিয়ে সেমিতে ফ্রান্স
৩৬ বছরের অপেক্ষা আরও দীর্ঘ হল জার্মানির,রুদ্ধশ্বাস জয়ে সেমিতে স্পেন
খেলতে খেলতেই মারা গেলেন গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়া
স্ত্রী গর্ভবতী হওয়ার পর তার সাথে যৌন সম্পর্ক করা প্রসঙ্গে।
লোক নাট্যদলের ৪৩তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী
১৩ বছর পর অভিনয়ে ফিরছেন মেহের আফরোজ শাওন
মাধ্যমিক পর্যায়ে কোডিং শিক্ষা প্রসঙ্গে
প্রাকৃতিক রক্ষাব্যুহ সুন্দরবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে
অসত্য তথ্য ও পরিসংখ্যান থেকে বের হয়ে আসতে হবে
চাঁদাদাবি করায় আখাউড়ায় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান গ্রেপ্তার
পশ্চিম তীরে পাঁচ সহস্রাধিক নতুন আবাসন অনুমোদন নেতানিয়াহুর
হীরার গয়নায় শাস্তির মুখে বলসোনারো
ইসরাইলকে থামাতে হবে, স্থায়ী যুদ্ধবিরতি মেনে নিতে বাধ্য করতে হবে : এরদোগান
মানুষের কামড়ে সাপের মৃত্যু
রকেট হামলায় ইসরাইলি কোম্পানি কমান্ডার নিহত
ভোট দিয়ে যে আহ্বান জানালেন খামেনি
যুক্তরাষ্ট্র বাহিনীকে জাপানের হুঁশিয়ারি
গাজা-ইসরাইল যুদ্ধে পশ্চিমের নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র-জার্মানি
এসসিও’র শীর্ষ সম্মেলনে মোদি কেন গেলেন না
জিম্মি প্রশ্নে মধ্যস্থতাকারী দল পাঠাবে ইসরাইল