ধ্বংসপ্রাপ্ত জেনিন শিবিরে ফিরছে ফিলিস্তিনিরা

Daily Inqilab ইনকিলাব ডেস্ক

০৫ জুলাই ২০২৩, ০৬:৫০ পিএম | আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৩, ১২:০১ এএম

 

অধিকৃত পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে দুদিন ধরে সামরিক অভিযান শেষে ইসরাইল তাদের সেনা প্রত্যাহারের পর ফিলিস্তিনিরা শরণার্থী শিবিরে নিজেদের বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছে। ইসরাইলি হামলায় শরণার্থী শিবিরে ব্যাপক ধ্বংসের চিত্র দেখা যাচ্ছে। এই শিবিরে হাজার হাজার ফিলিস্তিনি থাকে। শিবিরের ভবনগুলোতে ইসরাইলি হামলায় বড় বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। গাড়িগুলো দুমড়ে-মুচড়ে গেছে এবং মাটিতে এখানে-সেখানে ভাঙা কাচ আর বুলেটের খোসা পড়ে আছে।

ইসরাইলি হামলায় যে ১২ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয় তাদের স্মরণে জানাজায় এবং এক শোক মিছিলে যোগ দেয় হাজার হাজার মানুষ। এদিকে জেনিনে সংঘাত থামলেও ইসরাইল এখন গাযায় বিমান হামলা শুরু করেছে। ইসরাইল দাবি করছে ফিলিস্তিনি জঙ্গিদের রকেট হামলার জবাবে তারা এই হামলা চালাচ্ছে। দুইদিনের এই হামলার সময় একজন ইসরাইলি সেনাও নিহত হয়। এদিকে বুধবার সকালে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা গাযা থেকে ছোঁড়া ৫টি রকেট মাঝপথে ধ্বংস করে দিয়েছে। কোন ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী এসব রকেট হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেনি। তবে ইসরাইলি সামরিক বাহিনী বলছে, হামাস ব্যবহার করতো এমন একটি ভূগর্ভস্থ অস্ত্র তৈরির কারখানা তারা জেট বিমান থেকে হামলা চালিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছে।

ইসরাইলের তেল আবিব শহরে মানুষের ওপর চলন্ত গাড়ি তুলে দিয়ে এবং ছুরি মেরে হামলার ঘটনায় মঙ্গলবার সাতজন আহত হয়। ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, হামলাকারী ছিল পশ্চিম তীরের এক ফিলিস্তিনি। একজন বেসামরিক লোক তাকে গুলি করে হত্যা করে। হামাস এই ঘটনাকে জেনিনে ইসরাইলের হামলার ‘স্বাভাবিক পাল্টা ব্যবস্থা’ বলে বর্ণনা করেছে। ফিলিস্তিনি নেতারা অভিযোগ করেছেন ইসরাইল জেনিনে আগ্রাসন চালিয়েছে। একজন ইসরাইলি সামরিক মুখপাত্র বিবিসিকে জানিয়েছেন, জেনিনের অভিযান আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয়েছে এবং সৈন্যরা ঐ এলাকা ত্যাগ করেছে।

জেনিনে ইসরাইলি বাহিনী এ অভিযান শুরু করেছিল সোমবার একটি ড্রোন হামলার মাধ্যমে। তারা বলেছিল, এ ড্রোন হামলার টার্গেট ছিলে ‘জেনিন ব্রিগেডের কমান্ড সেন্টার’। হামাসসহ বিভিন্ন কট্টরপন্থী ফিলিস্তিনি গোষ্ঠী এই জেনিন ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত বলে মনে করা হয়। এরপর যখন শত শত ইসরাইলি সেনা জেনিন শরণার্থী শিবিরে প্রবেশ করে, তখন আরও কিছু ড্রোন হামলা চালায় ইসরাইল। শিবিরের ভেতরে সশস্ত্র ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তাদের তীব্র লড়াই চলে। ইসরাইলি বাহিনী বলেছে, তাদের ‘সন্ত্রাস-বিরোধী’ অভিযানের মূল উদ্দেশ্য ছিল অস্ত্রশস্ত্র জব্দ করা এবং এই শিবির যে ‘একটি নিরাপদ ঘাঁটি’ সেই ধারণা ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া।

এর আগে জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার দফতরের একজন মুখপাত্র জেনিনে এবং পশ্চিম তীরের অন্যান্য জায়গায় যেরকম ব্যাপক বিমান এবং স্থল অভিযান চলছে তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি আরও বলেন, ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করেছে যে নিহত ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তিনজন ছিল শিশু। তিনি বলেন, ইসরাইলি হামলায় সেখানে যেরকম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তার ফলে সেখানে এখন খাবার পানি এবং বিদ্যুৎ সরবরাহ নেই।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, জেনিন শরণার্থী শিবিরের কিছু কিছু এলাকায় ফিলিস্তিনি অ্যাম্বুলেন্স কর্মীদের ঢুকতে দেয়া হয়নি। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ১৪০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি আহত হয়, এর মধ্যে ৩০ জনের আঘাত গুরুতর। একজন ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট কর্মকর্তা জানান, প্রায় তিন হাজার ফিলিস্তিনি, যাদের মধ্যে অনেক অসুস্থ এবং বয়স্ক মানুষও ছিলেন, তারা রাতের বেলায় ড্রোন হামলা থেকে রক্ষা পেতে পালিয়ে আসতে পেরেছেন।

হুইল-চেয়ার আরোহী এক ব্যক্তি এবং তার পরিবারকে সকালে শরণার্থী শিবির থেকে পাহারা দিয়ে বের করে আনা হচ্ছিল। তিনি বিবিসিকে জানান, তাদেরকে ইসরাইলি বাহিনী একটি কক্ষে আটকে রেখেছিল। ‘আমাদেরকে সামরিক ব্যারিকেড দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছিল। ইসরাইলি সৈন্যরা আসলো, তারপর আমরা বেরিয়ে আসলাম। ক্যাম্পে এখন আর কোন লোক নেই। অবশিষ্ট লোক বলতে ছিলাম আমরাই।’ তিনি বলেন, ‘সেখানে খুব কঠিন অবস্থা ছিল। ড্রোন থেকে আমাদের দিকে গুলি করা হচ্ছিল। এখন আমরা চলে এসেছি। আমরা সবাই খুব ক্লান্ত। আমাদের কোন খাবার নেই.. কোন পানীয় নেই।’

স্বেচ্ছাসেবী চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান এমএসএফ অভিযোগ করেছে যে ইসরাইলি বুলডোজার সেখানে অনেক রাস্তা ধ্বংস করেছে, রাস্তার ওপর থেকে টারমাক তুলে নিয়েছে। ফলে তাদের প্যারামেডিকদের পায়ে হেঁটে সামনে এগুতে হয়েছে। তবে একজন ইসরাইলি সামরিক মুখপাত্র জানান, তাদের বুলডোজার শিবিরের ভেতরে দুই কিলোমিটার রাস্তা খুঁড়ে ফেলেছে, কারণ, তার ভাষায় সেখানে জঙ্গিরা বিস্ফোরক লুকিয়ে রাখতো, আর তাতে করে বেসামরিক মানুষ এবং সৈন্যদের জীবন ঝুঁকিতে পড়তো।

সাম্প্রতিক সময়ে জেনিন নতুন প্রজন্মের ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামীদের জন্য এক নতুন ঘাঁটি হয়ে উঠেছিল। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রবীণ নেতৃত্বের ব্যাপারে এরা খুব হতাশ এবং ইসরাইলি দখলদারিত্ব নিয়ে এরা ক্ষুব্ধ। গত এক বছরে জেনিনে ইসরাইলি বাহিনী একের পর এক অভিযান চালিয়েছে। অন্যদিকে স্থানীয় ফিলিস্তিনিরাও ইসরাইলের বিরুদ্ধে অনেক মারাত্মক হামলা চালিয়েছে। এদিকে ফিলিস্তিনি প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শাতায়াহ কিছু বিদেশি সরকার ‘ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার আছে’ বলে যে বিবৃতি দিয়েছে, তা প্রত্যাখ্যান করেছেন।

এক টুইট বার্তায় তিনি বলেন, ‘ইসরাইল যে আমাদের ভূমি এবং আমাদের জনগণের ওপর দখলদারিত্ব কায়েমকারী শক্তি, সেটি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তারা যে শক্তি প্রয়োগ করে শরণার্থী শিবিরের অবকাঠামো, সুযোগ-সুবিধা, বাড়ি-ঘর ধ্বংস করেছে, লোকজনকে হত্যা করেছে, আটক করেছে, নিরপরাধ মানুষকে ঘর-বাড়ী ছাড়া করেছে, সেজন্যে তাদের নিন্দা করা উচিৎ।’ তিনি আরও বলেন, ‘আত্মরক্ষার অধিকার থাকা উচিৎ ফিলিস্তিনিদের। দখলদার শক্তির কোন আত্মরক্ষার অধিকার থাকে না।’ সূত্র: বিবিসি।

 


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

৭১'র পরাজিত শক্তি ২৪'র আন্দোলনকে ব্যবহার করে ৭১'র গৌরবকে মুছে ফেলতে চায়: নাছির

৭১'র পরাজিত শক্তি ২৪'র আন্দোলনকে ব্যবহার করে ৭১'র গৌরবকে মুছে ফেলতে চায়: নাছির

সীমান্তে অস্থিতিশলীতাই প্রমান করে ভারত কোন দিনই আমাদের বন্ধু ছিলো না : পীর সাহেব চরমোনাই

সীমান্তে অস্থিতিশলীতাই প্রমান করে ভারত কোন দিনই আমাদের বন্ধু ছিলো না : পীর সাহেব চরমোনাই

অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের আগেই চুয়াডাঙ্গার সীমান্তবর্তী ঠাকুরপুর থেকে এক নারীকে আটক করেছে বিজিবি

অবৈধভাবে ভারতে প্রবেশের আগেই চুয়াডাঙ্গার সীমান্তবর্তী ঠাকুরপুর থেকে এক নারীকে আটক করেছে বিজিবি

একটি দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছে : দুলু

একটি দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছে : দুলু

একটি দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছে : দুলু

একটি দল ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেছে : দুলু

রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ড পেল সোনালী ব্যাংক

রেমিট্যান্স অ্যাওয়ার্ড পেল সোনালী ব্যাংক

'আমাকে নিয়ম শেখাতে আসবেননা, আপনি সব কিছুতে নিয়ম দেখান'

'আমাকে নিয়ম শেখাতে আসবেননা, আপনি সব কিছুতে নিয়ম দেখান'

শতাধিক পণ্যে শুল্ক-কর বাড়ানোর অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের দাবি জাতীয় নাগরিক কমিটির

শতাধিক পণ্যে শুল্ক-কর বাড়ানোর অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের দাবি জাতীয় নাগরিক কমিটির

হাটহাজারীতে পুকুর ভরাট করায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা

হাটহাজারীতে পুকুর ভরাট করায় ৫০ হাজার টাকা জরিমানা

সংখ্যালঘুদের ওপর বেশির ভাগ হামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে : পুলিশ

সংখ্যালঘুদের ওপর বেশির ভাগ হামলা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে : পুলিশ

জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হবে

জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিতে হবে

আ'লীগ কখনোই গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল না : গোলাম পরওয়ার

আ'লীগ কখনোই গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিল না : গোলাম পরওয়ার

ব্রাহ্মণপাড়ায় যাত্রী ছাউনির অভাবে দুর্ভোগে যাত্রীরা

ব্রাহ্মণপাড়ায় যাত্রী ছাউনির অভাবে দুর্ভোগে যাত্রীরা

ছাগলনাইয়ায় কোরআন তিলাওয়াত ও ইসলামী আলোচনার মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হলো গায়ে হলুদ

ছাগলনাইয়ায় কোরআন তিলাওয়াত ও ইসলামী আলোচনার মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হলো গায়ে হলুদ

সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে সচেতনতামূলক সভা

সড়ক পরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে সচেতনতামূলক সভা

শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ঘটাতে হলে খেলাধুলার বিকল্প নেই: এডিসি লুৎফুন নাহার

শিক্ষার্থীদের মানসিক বিকাশ ঘটাতে হলে খেলাধুলার বিকল্প নেই: এডিসি লুৎফুন নাহার

হাইওয়ে পুলিশের সার্বিক বিষয় নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়

হাইওয়ে পুলিশের সার্বিক বিষয় নিয়ে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে বৈষম্য কতটা প্রকট: সাধারণের অবস্থান কোথায়

বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে বৈষম্য কতটা প্রকট: সাধারণের অবস্থান কোথায়

কোরআন তেলাওয়াত আমাদের হৃদয়ে প্রশান্তি দান করে: কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ

কোরআন তেলাওয়াত আমাদের হৃদয়ে প্রশান্তি দান করে: কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ

ড. ইউনূসের ৫ মামলা বাতিলের রায়ে আইনি দুর্বলতা পাননি আপিল বিভাগ

ড. ইউনূসের ৫ মামলা বাতিলের রায়ে আইনি দুর্বলতা পাননি আপিল বিভাগ