ন্যাটো কি এশিয়ায় পা রাখছে?
১১ জুলাই ২০২৩, ০৩:৪৭ পিএম | আপডেট: ১১ জুলাই ২০২৩, ০৩:৪৭ পিএম
সমগ্র পশ্চিমা বিশ্বের নেতারা এখন রাশিয়ার প্রতিবেশী লিথুয়ানিয়ায় জড় হয়েছেন। বাল্টিক সগরের পাশে ছোট্ট এ সাবেক সোভিয়েত দেশের রাজধানী ভিলনিয়াসে আগামী দুদিন ধরে ন্যাটো সামরিক জোটের শীর্ষ বৈঠক হবে। ধারনা করা হচ্ছে, ইউক্রেনকে দ্রুত এই জোটের সদস্য করা বা না করা বিষয়টিই বৈঠকের মুখ্য বিষয় হবে।
সেইসাথে, জোটের কোনো দেশ রুশ হামলার শিকার হলে, কিভাবে তা মোকাবেলা করা হবে তা নিয়ে নতুন প্রস্তাবিত একটি কৌশল নিয়ে কথা হবে বলে জানা গেছে। এছাড়াও বৈঠকের এজেন্ডায় রয়েছে, এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের চারটি দেশের সাথে এ জোটের সহযোগিতার আনুষ্ঠানিক এক কাঠামো তৈরি। ভিলনিয়াসে তাই হাজির থাকবেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক ইয়ল, অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী এ্যান্থনি আলবানিজ এবং নিউজিল্যান্ডের ক্রিস হিপকিন্স।
জোটের সদস্য না হয়েও এই চারটি এশীয় দেশ পরপর দ্বিতীয়বারের মত ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠকে যোগ দিচ্ছে। গত বছর মাদ্রিদের শীর্ষ বৈঠকে প্রথমবারের মত তাদের অংশগ্রহণের পর থেকেই সন্দেহ দানা বাঁধতে থাকে যে, শীতল যুদ্ধকালে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষার জন্য তৈরি এই পশ্চিমা সামরিক জোট কি এখন এশিয়ায় তাদের সম্প্রসারণ চাইছে?
জানুয়ারিতে জাপানে গিয়ে ন্যাটো সেক্রেটারি জেনারেল জেনস স্টলটেনবার্গ টোকিওতে ন্যাটো জোটের একটি লিয়াজো অফিস খোলার বিষয়ে কথাবার্তা বলেছেন – এমন খবর ফাঁস হওয়ার পর সেই সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়। আর এখন পরপর দ্বিতীয়বারের জোটের শীর্ষ বৈঠকে এশিয়ায় আমেরিকার ঘনিষ্ঠ এই মিত্রদের অংশগ্রহণ সেই সন্দেহকে শতগুণে বাড়িয়ে দেবে। এশীয় ও প্রশান্ত মাহসাগরীয় দেশগুলোর সাথে ন্যাটোর সহযোগিতার একটি প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ভিলনিয়াসের শীর্ষ বৈঠকে গৃহীত হতে পারে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
জানা গেছে, এই চারটি দেশ আলাদা আলাদাভাবে তাদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে ন্যাটোর সাথে সহযোগিতা চুক্তি করতে চলেছে, যে চুক্তির নাম দেয়া হয়েছে আইটিপিপি (ইনডিভিজুয়ালি টেইলরড পার্টনারশিপ প্রোগ্রাম)। নিকেই সহ জাপানের একাধিক নির্ভরযোগ্য মিডিয়া গত সপ্তাহে খবর দিয়েছে টোকিও ও ক্যানবেরা ন্যাটোর সাথে আইটিপিপি চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করেছে। সরকারি সূত্র উদ্ধৃত করে নিকেই বলেছে, জাপান ও ন্যাটোর মধ্যে সহযোগিতার ১৬টি ক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে।
দক্ষিণ কোরিয়া এবং নিউজিল্যান্ডও ন্যাটোর সাথে বেশ কিছুদিন ধরেই আলোচনা মীমাংসা চালিয়েছে। তবে তাদের চুক্তিগুলো ভিলনিয়াসের শীর্ষ বৈঠকের আগে চূড়ান্ত করা সম্ভব হয়েছে কিনা তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি। আইটিপিপি চুক্তিগুলোকে ভিলনিয়াসের শীর্ষ বৈঠকে সদস্যদের সামনে রাখার পর সেগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হতে পারে।
জাপান এবং অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়ার খবর অনুযায়ী এই চারটি দেশের সাথে ন্যাটো জোটের সহযোগিতার প্রধান যে ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করা হয়েছে তা হলো: সমুদ্রে জাহাজ চলাচলে নিরাপত্তা, সাইবার নিরাপত্তা, জলবায়ু পরিবর্তন, মহাকাশে নিরাপত্তা এবং যেসব ডিজিটাল প্রযুক্তি সাইবার জগতে হুমকি তৈরি করতে পারে, যেমন এআই। প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে মীমাংসা হয়েছে যে ন্যাটো বাহিনী এবং এই চারটি দেশের সামরিক বাহিনী নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা এবং যোগাযোগ বাড়াবে যাতে প্রয়োজনে তারা নিজেদের মধ্যে সমন্বয় করে যৌথভাবে কাজ করতে পারে।
কেন এখন এশিয়ার দিকে নজর ন্যাটোর
লন্ডনে গবেষণা সংস্থা চ্যাটাম হাউজের এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় কর্মসূচির গবেষক বিল হেইটন সম্প্রতি সংস্থার সাইটে এক নিবন্ধে লিখেছেন, এশিয়াতে ন্যাটো জোটের নজর নতুন নয়। এবং এই চারটি দেশ ও ন্যাটোর মধ্যে দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে বিচ্ছিন্নভাবে সহযোগিতা চলছে। দুই হাজার এক সালে আমেরিকায় আল কায়দার সন্ত্রাসী হামলার পর আফগানিস্তানে ন্যাটোর নেতৃত্বে ইসাফ বাহিনীতে সৈন্য পাঠিয়েছিল অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড এবং দক্ষিণ কোরিয়া। জাপানের সেলফ ডিফেন্স ফোর্সের নৌবাহিনী ইসাফকে নানারকম লজিস্টিক সাহায্য জুগিয়েছে।
আরও পরে ২০০৯ সাল থেকে পূর্ব আফ্রিকার উপকূলের কাছে জলদস্যুতা ঠেকাতে ন্যাটোর নৌ তৎপরতায় অংশ নিয়েছে এশিয়া অঞ্চলের এই চারটি দেশ।
এরপর ২০১৬ সালে এই সহযোগিতা কিছুটা আনুষ্ঠানিক রূপ পায় যখন ব্রাসেলসে ন্যাটো সদর দপ্তরে এই চারটি দেশের সাথে জোটের সিনিয়র কর্মকর্তাদের এক বৈঠক হয়। ন্যাটো তখন বলেছিল ঐ দেশগুলো চেয়েছে বলেই বৈঠকটি হয়েছে। অনেক পর্যবেক্ষকও মনে করেন, উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক এবং ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচিতে আতঙ্কিত দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপান ন্যাটোর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আগ্রহী। তবে অধিকাংশ পর্যবেক্ষক মনে করেন এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলে আমেরিকা এবং ন্যাটোর নজরের প্রধান কারণ এখন চীন।
মাদ্রিদে গত বছরের ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠকে নতুন যে কৌশলপত্র গৃহীত হয়, তাতে প্রথমবারের মত সরাসরি চীনের প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়। ঐ কৌশলপত্র ঘোষণা করার সময় ন্যাটো মহাসচিব জেনস স্টলটেনবার্গ খোলাখুলি বলেন পারমাণবিক অস্ত্রসহ সামরিক ক্ষমতা বাড়াতে প্রচুর বিনিয়োগ করছে চীন এবং ন্যাটো জোট এখন চীনা পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায়। ‘তারা (চীন) প্রতিবেশীদের হামেশা হুমকি-ধামকি দিচ্ছে, তাইওয়ানকে হুমকি দিচ্ছে। তারা এখন আর্কটিকে, তারা আফ্রিকায়...ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে রাশিয়ার পক্ষে মিথ্যা প্রচারণা ছড়াচ্ছে তারা...চীন এখনও অমাদের শত্রু দেশ নয় কিন্তু সেসব মারাত্মক চ্যালেজ্ঞ তারা খাড়া করেছে তা আমাদের পরিষ্কারভাবে বুঝতে হবে,’ বলেন নেটা মহাসচিব।
বিল হেইটন মনে করেন, রাশিয়ার সাথে চীনের কৌশলগত ঘনিষ্ঠতা যেভাবে বাড়ছে তাতে ন্যাটো জোটের অনেকেই এখন মনে করছে চীন এখন ইউরোপীয় নিরাপত্তায় প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। সুইডেনের গবেষণা সংস্থা ইন্সটিটিউট ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পলিসির একটি প্রকাশনায় এক বিশ্লেষণে গবেষক হাসিম টুরকের লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান মনোযোগ এখন ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলের দিকে, ফলে ন্যাটোর অগ্রাধিকারে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য।র মতে, গত বছর পাঁচেক ধরেই চীনের ব্যাপারে ন্যাটো জোটের মনোযোগ বাড়ছে।
ক্রোধে ফুঁসছে চীন
বৈরি প্রতিবেশী জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ন্যাটো সামরিক জোটের এই দহরম মহরমে প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত চীন। তারা মনে করছে তাদের কোণঠাসা করতে আমেরিকা ন্যাটো জোটকে এশিয়ায় সম্প্রসারিত করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। মাদ্রিদে গত বছর ন্যাটো শীর্ষ বৈঠকের পরপরই চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ব্রিকস জোটের এক ভার্চুয়াল শীর্ষ বৈঠকে দেয়া তার ভাষণে বলেন, ‘কিছু দেশ চূড়ান্ত নিরাপত্তার ধুয়ো তুলে এশিয়ায় সামরিক জোট বিস্তৃত করতে চাইছে। তারা জোটে জোটে সংঘাত তৈরিতে উসকানি দিচ্ছে, বিভিন্ন দেশকে জবরদস্তি করে দলে ঢোকানোর চেষ্টা করছে যাতে একচ্ছত্র আধিপত্য টিকিয়ে রাখা যায়।’ তিনি সাবধান করেন, ‘এ প্রবণতা চলতে দেয়া হলে বিশ্বে অস্থিরতা এবং নিরাপত্তাহীনতা বাড়বে।’
কিন্তু ন্যাটো কি সত্যিই এশিয়ায় সরাসরি পা রাখতে চাইছে? এশিয়ায় কি অদূর ভবিষ্যতে ন্যাটো সৈন্য মোতায়েন করতে দেখা যাবে? চ্যাটাম হাউজের গবেষক বিল হেইটন মনে করেন না এশিয়ার কোনো দেশ ন্যাটো জোটের সদস্য হবে বা এশিয়ার কোনো দেশকে সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি দেবে ন্যাটো। ‘কিন্তু ন্যাটো দেশগুলো এশিয়ায় সমমনা দেশগুলোর সাথে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ করে চীন এবং উত্তর কোরিয়ার কাছ থেকে আসা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আগ্রহী।’ সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
টিউলিপকে বরখাস্তের দাবি ব্রিটেনের বিরোধীদলীয় নেতার
দাবানল থেকে পালিয়ে আসার ‘নারকীয় অভিজ্ঞতা’ লস অ্যাঞ্জেলেসের বাসিন্দাদের
হামাসের পুঁতে রাখা বোমা বিস্ফোরণে গাজায় চার ইসরাইলি সেনা নিহত
শতাধিক পণ্য ও সেবায় সরকার ভ্যাট বাড়ানোর পথ বেছে নিলো কেন
আজ বায়ুদূষণের শীর্ষে ঘানার আক্রা, ঢাকার অবস্থান তৃতীয়
ডাকসু নির্বাচন : ছাত্রদলের সঙ্গে শিবির-বৈষম্যবিরোধীদের পাল্টাপাল্টি অবস্থান
লন্ডনে চিকিৎসকদের সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণে খালেদা জিয়া, অবস্থার দ্রুতই উন্নতি
এবার নির্বাচন কমিশনের ডিসপ্লে বোর্ডে ভেসে উঠল ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’
এবার মার্কিন পণ্যের ওপর ‘প্রতিশোধমূলক’ শুল্ক আরোপের ঘোষণা কানাডার
ফ্রান্সের বিরুদ্ধে আলজেরিয়ার তথ্য বিভ্রান্তির অভিযোগ, কূটনৈতিক উত্তেজনা বাড়ছে
আজ গরম চা দিবস
এলিফেন্ট রোডে ব্যবসায়ীকে প্রকাশ্যে চাপাতি দিয়ে কোপ, ভিডিও ভাইরাল
গাজায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে হাজার হাজার অবিস্ফোরিত বোমা
জ্যাক স্মিথ বিচার বিভাগ থেকে পদত্যাগ করেছেন
তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডে গ্যারেজের আগুন নিয়ন্ত্রণে
লস অ্যাঞ্জেলেসে দাবানল, আগুনের বিরুদ্ধে দমকল বাহিনীর মরিয়া লড়াই
হাসিনাকে যে কারণে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করতেই হবে ভারতকে: তুর্কি গণমাধ্যমের বিশ্লেষণ
সিরিয়ার স্থিতিশীলতা নিয়ে আলোচনায় সউদী আরবে বৈঠক
ইসরায়েলি বর্বর হামলায় গাজায় নিহত আরও ৩২, মানবিক সংকট চরমে
চাটমোহর পৌর বিএনপির কাউন্সিলে আরশেদ-তাইজুল-সিন্টু নির্বাচিত