আশ্বাস ছাড়া ন্যাটোর কাছ থেকে আর কী পেলেন জেলেনস্কি?

Daily Inqilab ইনকিলাব ডেস্ক

১৩ জুলাই ২০২৩, ০৮:১০ পিএম | আপডেট: ১৩ জুলাই ২০২৩, ১১:৫৩ পিএম

 

 

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি অনেক প্রত্যাশা নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন লিথুয়ানিয়ার রাজধানী ভিলনিয়াসে ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠকে। কিন্তু অনেকটা বিফল মনোরথ হয়েই ফিরতে হয়েছে তাকে। তিনি চেয়েছিলেন ন্যাটোর কাছে আশ্বাস যে রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ শেষ হবার পর ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দিতে পারবে।

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর সামরিক জোটের সদস্যপদ পাওয়ার নিশ্চিত আশ্বাস ছিল তার দেশের জনগণের জন্য একটা আশার আলো, দেশটিতে শান্তির একটা চূড়ান্ত নিশ্চয়তা এবং রাশিয়ান সৈন্য আরও কখনও ইউক্রেনের মাটিতে পা রাখতে পারবে না এমন একটা ভবিষ্যত আশার বার্তা। কিন্তু তার বদলে জেলেনস্কিকে সোজাসুজি বলে দেয়া হয়েছে “মিত্র জোট যখন একমত হবে এবং তাদের শর্তগুলো পূরণ করা হবে” তখন ইউক্রেনকে এই জোটের সদস্য হবার আমন্ত্রণ জানানো হবে। অর্থাৎ সোজা কথায় – কোন প্রতিশ্রুতি নেই।

বৈঠক শুরুর আগেই ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট যে কড়া ভাষায় তার উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন তাতে অবাক হবার কিছু নেই। শীর্ষ বৈঠকের শুরুতেই তিনি বলেছিলেন ন্যাটোর নেতারা যে এমনকি একটা সময়সূচি দিতেও রাজি নন সেটা নেহায়েতই “অযৌক্তিক”। তিনি বলেন শর্তগুলোও “ধোঁয়াটে”। এছাড়াও জেলেনস্কি চরম ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এ কারণে যে রাশিয়ার সাথে যুদ্ধ পরবর্তী আলোচনায় ন্যাটো যে কোনভাবে ইউক্রেনের সদস্যপদ পাওয়ার বিষয়টি দাবার ঘুঁটি হিসাবে ব্যবহার করতে চাইবে।

কিন্তু প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ন্যাটোর নেতৃবৃন্দের সাথে মুখোমুখি কথা বলার পর কূটনৈতিক ক্ষোভের ঝড় কিছুটা প্রশমিত হয়েছে। বুধবার তারা একরকম জেলেনস্কিকে আশ্বস্ত করতে পেরেছেন এই বলে যে পরিস্থিতি বদলেছে এবং ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেবে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক বলেছেন ইউক্রেন ন্যাটো জোটেই আছে। ন্যাটোর মহাসচিব জেন্স স্টলটেনবার্গ বলেছেন বুধবার তারা সমকক্ষ হিসাবেই বৈঠক করেছেন, কিন্তু জোটের মিত্র সদস্য হিসাবে তারা বৈঠক করবেন ভবিষ্যতে।

এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন জেলেনস্কিকে বলেছেন সদস্যপদ ভবিষ্যতে আসবে। ইউক্রেনের সদস্য হবার সম্ভাবনা নিয়ে ন্যাটো আনুষ্ঠানিকভাবে কতটা নিশ্চয়তা দেবে তা সীমিত রাখার জন্য সর্বতোভাবে চেষ্টা করেছেন বাইডেন। তিনি জেলেনস্কিকে বলেছেন ইউক্রেন সঠিক পথেই এগোচ্ছে। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বেন ওয়ালেস বলেন যে এই শীর্ষ বৈঠকে এটা দেখা গেছে ইউক্রেনকে ন্যাটো পরিবারভুক্ত করার জন্য একটা গ্রহণযোগ্যতার মানসিকতা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, অন্তত কোন দেশ এখন এই শব্দটা উচ্চারণ করছে না যে, ইউক্রেন “যদি” ন্যাটোতে যোগ দেয়...! এখন বলা হচ্ছে ইউক্রেন “যখন” ন্যাটোতে যোগ দেবে! এসবই ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠক থেকে জেলেনস্কির প্রত্যাশার ঝুলিতে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইতিবাচক উষ্ণ কিছু কথাবার্তা।

এরপরেও তার জন্য ইতিবাচক কিছু ঘটেছে ন্যাটোর বৈঠকে: তিনি প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন যে ন্যাটোয় সদস্যপদের জন্য আবেদনের প্রক্রিয়া সহজ করা হবে, নতুন ন্যাটো-ইউক্রেন কাউন্সিল গঠন করা হবে- এই কাউন্সিলের মাধ্যমে কিয়েভ চাইলে জোটের বৈঠক ডাকতে পারবে, এবং, সম্ভবত সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি- বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর কিছু দেশের কাছ থেকে নতুন ও দীর্ঘমেয়াদী নিরাপত্তার নিশ্চয়তা।

জি-৭-এর নেতারা বলেছেন ইউক্রেন ন্যাটোতে যোগ দেবার আগে পর্যন্ত রুশ আগ্রাসন প্রতিহত করতে ইউক্রেনকে তারা নতুন এক থোক দ্বিপাক্ষিক সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে রাজি আছেন। এর মধ্যে থাকবে আরও বিমান প্রতিরক্ষা সহায়তা, দূর-পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র এবং এমনকি যুদ্ধবিমান, সেইসঙ্গে আরও প্রশিক্ষণ, গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ এবং সাইবার প্রযুক্তি খাতে সাহায্য। জেলেনস্কি একে আখ্যা দিয়েছেন “নিরাপত্তা খাতে উল্লেখযোগ্য বিজয়” বলে।

তবে, একটা নেতিবাচক বা অসঙ্গতিপূর্ণ মন্তব্য এসেছে ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেসের কাছ থেকে। সাংবাদিকদের ব্রিফ করার সময় তিনি ইউক্রেনের উদ্দেশ্যে একটি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন ইউক্রেনকে যে সমর্থন ও সহযোগিতা ইতোমধ্যেই দেয়া হয়েছে তার জন্য দেশটির আরও কৃতজ্ঞতা দেখানো উচিত।

তিনি বলতে চেয়েছেন এটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে কোনরকম উস্কানিমূলক মন্তব্য নয়, বরং সমর্থক একটা মিত্র দেশের কাছ থেকে বন্ধুসুলভ পরামর্শ। তিনি মূলত বলতে চেয়েছেন ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দেবার ব্যাপারে দেশগুলোর ওপর – বিশেষ করে আমেরিকার ওপর- যে কতটা রাজনৈতিক চাপ আছে সেটা ইউক্রেনের বোঝা উচিত। তিনি বলেন, অস্ত্রশস্ত্রের একটা ফর্দ নিয়ে ওয়াশিংটনে হাজির হওয়া – যেন আমেরিকা অ্যামাজনের মত একটা দোকান- চাইলেই সেগুলো কিনে দেয়া যাবে – সেটা অবশ্যই সেদেশে কিছুটা “অস্বস্তি” তৈরি করেছে।

তবে ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠক, যার মূল উদ্দেশ্য ছিল জোটের মধ্যে ঐক্য আছে তা দেখানো, সেখানে এধরনের মন্তব্য নিঃসন্দেহে অকূটনৈতিক। ঋষি সুনাক প্রকাশ্যে এই মন্তব্যের সাথে সহমত হননি, তিনি জোর দিয়ে বলেছেন ইউক্রেন সবসময়ই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছে। জেলেনস্কির সংবাদ সম্মেলনে যখন মি. ওয়ালেসের এই মন্তব্য নিয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়, তখন তাকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছিল। তিনি পাশে বসা তার প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বলেন –ওয়ালেসকে ফোন করে জিজ্ঞেস করতে তিনি আসলে কী বোঝাতে চেয়েছেন। এই ঘটনা নিয়ে মুখরোচক কিছু সংবাদ শিরোনাম হয়ত ন্যাটো এবং ব্রিটিশ সরকারের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে।

প্রায় আড়াই বছর ধরে ইউক্রেনের দাবি-দাওয়া পশ্চিমের দেশগুলো শুনেছে এবং মূলত দেশগুলো তাতে সাড়াও দিয়েছে। কিন্তু কিয়েভ সবসময়েই পশ্চিমের সাড়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে এসেছে। ইউক্রেন সবসময়েই আরও সাহায্য চেয়েছে এবং পশ্চিমা দেশগুলো অবশেষে ইউক্রেন যা চেয়েছে তা দিয়েছে। কাঁধ থেকে ছোঁড়া যায় এমন ক্ষেপণাস্ত্র থেকে শুরু করে সাঁজোয়া যান, লড়াইয়ের উপযোগী শক্তিশালী ট্যাংক এবং এখন এমনকি ক্লাস্টার বোমা। কিন্তু ভিলনিয়াসের শীর্ষ বৈঠকে সদস্যদের কাছ থেকে এসেছে ইউক্রেনের সদস্যপদ নিয়ে সোজাসাপ্টা ও স্পষ্ট উত্তর – না মানে না।

আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো ইউক্রেনের দাবির কাছে মাথা নোয়াতে রাজি হয়নি। জোটের সদস্য হিসাবে যোগদানের প্রক্রিয়ায় ইউক্রেনের জন্য বিশেষ ছাড় দিয়ে দ্রুত তাকে সদস্য করার ব্যাপারে ন্যাটো কৌশলগতভাবে সতর্ক থাকার পথই বেছে নিয়েছে। ফলে ন্যাটোর এই সম্মেলন ছিল প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির জন্য পশ্চিমের কূটনৈতিক মনোভাব যাচাইয়ের একটা সুযোগ মাত্র। কারণ পশ্চিমা দেশগুলোকেও এখন তাদের নিজের দেশে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চাপের মুখে পড়তে হচ্ছে এবং সেসব বিবেচনায় নিয়েই যে বিশ্ব রাজনীতির ময়দানে তাদের কাজ করতে হবে সেটা অনস্বীকার্য। মূল কথা হল – আপনি যেটা চাইছেন সেটা সবসময় যে পাওয়া যাবে না এটা মেনে নেয়া। সূত্র: বিবিসি।

 


বিভাগ : আন্তর্জাতিক


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

মাদারীপুরে ক্ষতিগ্রস্ত বিডিআর সদস্যদের ৩ দফা দাবিতে মানববন্ধন

মাদারীপুরে ক্ষতিগ্রস্ত বিডিআর সদস্যদের ৩ দফা দাবিতে মানববন্ধন

পূর্বাচলে প্লট দুর্নীতি : দুদকের মামলায় হাসিনা-পুতুলসহ ১৬ আসামি

পূর্বাচলে প্লট দুর্নীতি : দুদকের মামলায় হাসিনা-পুতুলসহ ১৬ আসামি

কোকোর দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আরাফাত রহমান বড় ভূমিকা ছিল: কাজী রিপন

কোকোর দেশের ক্রীড়াঙ্গনে আরাফাত রহমান বড় ভূমিকা ছিল: কাজী রিপন

তারেক রহমান একজন মানবিক মানুষ: কাইয়ুম চৌধুরী

তারেক রহমান একজন মানবিক মানুষ: কাইয়ুম চৌধুরী

রাবির সাত হলে কুরআন পোড়ানোর ঘটনায় উত্তাল ক্যাম্পাস, তদন্ত কমিটি গঠন

রাবির সাত হলে কুরআন পোড়ানোর ঘটনায় উত্তাল ক্যাম্পাস, তদন্ত কমিটি গঠন

ডিসেম্বরে সর্বাধিক রেমিট্যান্স এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য ও সউদী আরব থেকে

ডিসেম্বরে সর্বাধিক রেমিট্যান্স এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য ও সউদী আরব থেকে

যশোরে চাকুরিচ্যুত বিডিআর সদস্যদের চাকুরি পুনর্বহালের দাবিতে মানববন্ধন

যশোরে চাকুরিচ্যুত বিডিআর সদস্যদের চাকুরি পুনর্বহালের দাবিতে মানববন্ধন

অপরাধী যদি আমার ভাই হয়, তাকেও ছাড় দিবেন না: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

অপরাধী যদি আমার ভাই হয়, তাকেও ছাড় দিবেন না: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা

আবারও সিলেটের নায়ক জাকির, খুলনার টানা দ্বিতীয় হার

আবারও সিলেটের নায়ক জাকির, খুলনার টানা দ্বিতীয় হার

এবার হাসিনা-জয়ের বিরুদ্ধে নারী আইনজীবীর মামলা

এবার হাসিনা-জয়ের বিরুদ্ধে নারী আইনজীবীর মামলা

ব্যবসায়ীকে কোপানোয় শাস্তির হুঁশিয়ারি উপদেষ্টা আসিফের

ব্যবসায়ীকে কোপানোয় শাস্তির হুঁশিয়ারি উপদেষ্টা আসিফের

৩৮ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাল মালয়েশিয়া

৩৮ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাল মালয়েশিয়া

মাগুরায় সড়ক দুর্ঘটনায় দুই মোটর সাইকেল চালক নিহত

মাগুরায় সড়ক দুর্ঘটনায় দুই মোটর সাইকেল চালক নিহত

কুষ্টিয়ায় র‌্যাবের অভিযানে ইয়াবা সহ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার

কুষ্টিয়ায় র‌্যাবের অভিযানে ইয়াবা সহ মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার

কুষ্টিয়ার আলফা মোড়ে সিএনজি স্ট্যান্ড’ নাম দিয়ে চাঁদাবাজি

কুষ্টিয়ার আলফা মোড়ে সিএনজি স্ট্যান্ড’ নাম দিয়ে চাঁদাবাজি

জুলাই আগস্টে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে হামলা : বহিস্কার হলেন শাবির ২৯ শিক্ষার্থী

জুলাই আগস্টে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে হামলা : বহিস্কার হলেন শাবির ২৯ শিক্ষার্থী

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের মেয়াদ বাড়লো ১৬ দিন

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের মেয়াদ বাড়লো ১৬ দিন

সাতক্ষীরা সীমান্তে ধান চাষে বিএসএফের বাধা, পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত

সাতক্ষীরা সীমান্তে ধান চাষে বিএসএফের বাধা, পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের নায়কদের শাস্তি ও ৩ দফা দাবিতে পটুয়াখালীতে মানববন্ধন

পিলখানা হত্যাকাণ্ডের নায়কদের শাস্তি ও ৩ দফা দাবিতে পটুয়াখালীতে মানববন্ধন

ইরানের নতুন আত্মঘাতী ড্রোনে আতঙ্কে ইসরাইল!

ইরানের নতুন আত্মঘাতী ড্রোনে আতঙ্কে ইসরাইল!