আফ্রিকায় চীন ও রাশিয়ার প্রভাব দ্রুত বাড়ছে
২৯ আগস্ট ২০২৩, ০৫:৫৬ পিএম | আপডেট: ২৯ আগস্ট ২০২৩, ০৫:৫৬ পিএম
ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার সমন্বয়ে বিশ্বে পশ্চিমা আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার একক ইচ্ছা থেকে গঠিত ব্রিকস জোটটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী হলেও এখনো খুব একটা সুসংগঠিত নয়। এই জোটটিতে এখন অন্তত আরো কয়েক ডজন দেশ যোগ দেয়ার জন্য অপেক্ষায় আছে।
ব্রিকস সম্মেলন ঘিরে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্তমানে স্বস্তির যে বাতাস বইছে তা মূলত রাশিয়র প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের এ সম্মেলন থেকে দূরে থাকার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তের কারণেই। তিনি যদি সম্মেলনে আসার বিষয়ে জোর দিতেন তাহলে, ইউক্রেনে সংগঠিত যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা থেকে তাকে গ্রেফতার করা হবে কিনা সে বিষয়ে দক্ষিণ আফ্রিকাকে তার নিজের অবস্থান স্পষ্ট করতে হতো। সেই বিব্রতকর চ্যালেঞ্জকে পাশ কাটিয়ে আসতে পেরে দক্ষিণ আফ্রিকা স্বাগতিক দেশ হিসেবে তাদের ভূমিকা পালন করেছে- বেশ গর্ব নিয়েই তারা ব্রিকসের সকালের মিটিং, বাণিজ্য মেলা, পৌর সংলাপের মতো কার্যক্রম বিষয়ক মেইল দিয়ে সাংবাদিকদের ইনবক্স ভরিয়ে দিয়েছে।
অনেক পর্যবেক্ষক মনে করেন, সেই অস্বাভাবিক দাপ্তরিক উদ্দীপনা আসলে একটা ইঙ্গিত ছিল যে, কত দ্রুত এই দেশটি পশ্চিমাদের কাছ থেকে দূরে আরো বহুমাত্রিক বিশ্বের দিকে, বিশেষ করে চীনের দিকে এবং এর থেকে কিছুটা কম করে হলেও রাশিয়ার কক্ষপথের দিকে সরে যাচ্ছে। কেপটাউনে অনুষ্ঠিত ব্রিকসের মূল সম্মেলনের আগে জোটটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকের সংবাদ সম্মেলনে একজন রুশ সাংবাদিক আমার দিকে ঝুঁকে এসে বলেছিলো: “তোমরা তোমাদের মানবাধিকারের স্বর্গরাজ্যকে নিজেদের (পশ্চিমে) কাছে রাখ, আমরা নতুন করে পৃথিবী গড়ছি।”
ব্রিকস হয়তো এখনো তার প্রাথমিক অবস্থাতেই রয়েছে, কিন্তু তারপরও এটি বাড়ছে- অন্তত কিছুটা ধীরে হলেও এর একটি মৌলিক এবং উদ্বেগজনক শক্তি ও উত্তেজনা অনুভব করা যায়। দক্ষিণ আফ্রিকা সরকারের আয়োজিত একটি বৈদেশিক নীতি বিষয়ক কর্মশালায় আমার এক সহকর্মী যোগ দিয়েছিলেন, যিনি আমাকে বলেছিলেন যে, সেখানে চীন যে ভবিষ্যৎ শক্তি এবং পশ্চিমা প্রভাব যে কমে আসছে সে বিষয়ে একটি ব্যাপক ঐক্যমত্য ছিল। আর এখানেই দক্ষিণ আফ্রিকার অস্বস্তির দিকটি সমীকরণে আসে।
দেশটির প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা একজন ধনী ব্যবসায়ী যিনি ভাল করেই জানেন যে, কোভিডের কারণে স্থানীয় অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ বেকারত্ব ও বৈষম্যের মোকাবেলা করে চলেছে। আর সে কারণেই এই ঘনীভূত সংকট কাটাতে হলে তার দেশের আরো ব্যাপকহারে বৈদেশিক বিনিয়োগ দরকার। এর সমাধান অবশ্যই রাশিয়া নয়। দেশটির সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার বাণিজ্য সম্পর্ক নেই বললেই চলে। নিঃসন্দেহে চীন এখানে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি পক্ষ। কিন্তু দেশটি ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তার দীর্ঘদিনের বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের মাঝেই আচ্ছাদিত হয়ে আছে।
তাহলে এই গভীর অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা তার সেই গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিমা সম্পর্ককে কেন ত্যাগ করবে? যদিও এই সম্পর্কে এরইমধ্যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। এই প্রশ্নের অন্তত আংশিক হলেও জবাব রয়েছে দেশটির ক্রমবর্ধমান 'উদ্বিগ্ন এবং লক্ষ্যভ্রষ্ট' ক্ষমতাসীন দলের কাছে। তিন দশক ক্ষমতায় থাকার পরও আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস তার নিজস্ব অন্তর্কোন্দল, দুর্নীতি এবং প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা থেকে বেরিয়ে আসতে হিমশিম খাচ্ছে।
ইউক্রেনের যুদ্ধের বিষয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা নানা ধরণের প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, শুরুতে তারা আগ্রাসনের নিন্দা জানিয়েছে, পরে আবার নিন্দা জানাতে অসম্মতি জানিয়েছে, নেটোকে দোষারোপ করেছে, মি. পুতিনের প্রশংসা করেছে, শান্তির মধ্যস্থতাকারী হওয়ার প্রস্তাবনা দিয়েছে, রাশিয়ার নৌ মহড়া আয়োজন করেছে, ওয়াশিংটনের কাছে সাফাই দিতে দৌড়ে গেছে, এবং ক্রেমলিনের বিষয়ে বার বার আলোচনা সামনে এনেছে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের তোলা অভিযোগ অনুযায়ী, গত বছর দক্ষিণ আফ্রিকা রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিলো কিনা সেটি নিয়ে এখনো রহস্য রয়েছে। অবশ্য প্রেসিডেন্ট রামাফোসা রাশিয়ার আগ্রাসন নিয়ে যে গভীর অস্বস্তিতে রয়েছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। একই সাথে তিনি নিজেকে আরো বেশি বহু-মেরুর বিশ্ব গঠনের বিষয়ে একজন জ্ঞানী ও নিরপেক্ষ প্রবক্তা হিসেবে তুলে ধরতে ব্যাকুল।
কিন্তু তার সরকার ও দলের অনেকেই তার এই অবস্থানকে ভাল চোখে দেখে না। বর্ণবাদ বিরোধী সংগ্রামের সময় মস্কোর সমর্থন দেয়ার বিষয়টি ছাড়াও তাদের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি নিয়েও সন্দেহ কাজ করে। এই ধরণের এলোমেলো বার্তা দ্বন্দ্বে জড়িত সব পক্ষের মধ্যেই বিরক্তির উদ্রেক করেছে এবং এতে দক্ষিণ আফ্রিকার দুর্বলতা ও সিদ্ধান্তহীনতা আরো বেশি করে সামনে এসেছে। নেলসন ম্যান্ডেলার ‘রেইনবো নেশন’ বা বহু বর্ণের দেশ এখন যে ধুকছে- সেটা নিশ্চিত। অনেকে মনে করেন যে খুব শিগগিরই এই দেশটি “ব্যর্থ রাষ্ট্রে” পরিণত হবে।
কিন্তু এর বিপরীতে ব্রিকস সম্মেলন ক্রেমলিনকে তাদের নিজস্ব, আরো কৌশলগত এবং কার্যকর কূটনীতি দেখানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম দিয়েছে। এই উপমহাদেশের সাম্প্রতিক সংবাদ শিরোনামগুলোতে প্রাধান্য পেয়েছে নিজেরের সেনা অভ্যুত্থান এবং রাশিয়ার সুবিধাবাদী ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে যোদ্ধাদের তাদের নিজস্ব স্বার্থে বিশৃঙ্খলাকে ব্যবহারের ঘটনাগুলো। এমন ঘটনা তারা এর আগে মালি ও সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকের মতো দেশগুলোতেও ঘটিয়েছে।
তবে 'ঔপনিবেশিক' আফ্রিকায় পশ্চিমা প্রভাবের বিশ্বাসযোগ্য বিকল্প হিসেবে রাশিয়া নিজেকে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সফর এবং চাতুর্যের সাথে মিডিয়াকে ব্যবহার করে বার্তা প্রদানের মাধ্যমে সাফল্যের সাথে মস্কো সেটি করেছে। দারিদ্র্য-পীড়িত দেশগুলোতে যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব, ক্রমবর্ধমান তরুণ জনসংখ্যা, বর্ধিত বেকারত্ব, স্থিতিশীলতা নিয়ে হতাশা রয়েছে, সেখানকার মানুষেরা নতুন বিকল্পের বিষয়ে বেশ উদার।
এখানে প্রশ্ন আসে যে- রাশিয়াকে রুখতে পশ্চিমা দেশগুলো কী করছে? তবে অবশ্যই এই মহাদেশ নিয়ে সাধারণ কোনো উপসংহার টানাটা বিপদজনক এবং নতুন করে শুরু হওয়া স্নায়ুযুদ্ধে আফ্রিকার সরকারগুলোকে তুরুপের তাস ভাবাটা ভুল এবং আপত্তিকর হতে পারে। কিন্তু ব্রিকসের পশ্চিমা সংস্করণ কোথায়? যুক্তরাজ্যের একজন 'আফ্রিকা বিষয়ক মন্ত্রী' রয়েছেন।
উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে ব্যস্ততা, কঠোর শর্ত এবং পছন্দের আফ্রিকান নেতাদের জন্য সুবিধাজনক বিদেশি আমন্ত্রণের মতো পদক্ষেপ এই ধারণাকে প্রতিষ্ঠা করেছে যে ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য এবং অন্যান্য সাবেক ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো এখনো এই মহাদেশকে সমর্থনযোগ্য কোনো অংশীদার নয়, বরং একটি সংকট হিসেবেই গণ্য করে। এটা হয়তো ন্যায়সঙ্গত নয়। সবকিছুর পরও, পশ্চিমা দেশগুলো দশকের পর দশক ধরে এই মহাদেশের স্বাস্থ্যসেবা, ব্যবসা এবং সরকারগুলোকে সহায়তা করতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শক্তি এবং অর্থ খরচ করেছে।
কিন্তু পশ্চিমা সামরিক বাহিনীর ভূমিকা, বিশেষ করে নিজের এবং সোমালিয়ায় ফরাসি সেনা এবং আমেরিকার ড্রোন ব্যবহার করার কঠোর সমালোচনা উস্কে দিয়েছে। এ থেকে একটা ব্যাখ্যা পাওয়া যায় যে, ব্রিকসের এই বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি কেন এই মহাদেশে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে এবং স্যান্ডটনের সমাবেশে এই জোটটি কেন সরব আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছে। সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
কম মূল্যে জমি বিক্রি না করায় দাউদকান্দিতে ছাত্রদলের নেতার বিরুদ্ধে অপপ্রচারের প্রতিবাদ
ঈশ্বরগঞ্জে ব্রেস্ট ক্যান্সার প্রতিরোধ বিষয়ক কর্মশালা
বনানীতে সড়কে সিএনজি চালকদের বিক্ষোভ, রাস্তা বন্ধ
বগুড়া সেনানিবাসে সাঁজোয়া কোরের ৪৪তম বাৎসরিক অধিনায়ক সম্মেলনে যোগ দিলেন সেনা প্রধান
গাজীপুরে এ্যাপারেলস্ কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে আহত ১২
ব্যবহারকারীদের আশ্বাস ট্রাম্পের, যুক্তরাষ্ট্রে ফের চালু টিকটক
পদ্মায় ধরা পড়লো ৪২ কেজির মহা বিপন্ন বাঘাইড় মাছ
আরও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রিয়ালের প্রেসিডেন্ট পেরেজ
সিলেটে প্রখ্যাত আলেম ইসহাক আল মাদানির ইন্তেকাল!
গাজার ধ্বংসস্তূপে নতুন স্বপ্ন বুনছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত মানুষ
গাজা চুক্তিকে যেকারণে ‘হামাসের জয়’ বলছে ইসরায়েলি গণমাধ্যম
সত্যিকারের সুখী হওয়া অনেক কঠিনঃ মিশা
গাজায় ব্যাংক সেবা পুনরায় চালুর প্রস্তুতি শুরু ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের
বদলে যাচ্ছে পুলিশ, র্যাব ও আনসার সদস্যদের পোশাক
লক্ষ্মীপুরে ড্রামট্রাকের চাপায় প্রাণ গেল দুই অটোরিকশা যাত্রীর
মানিকগঞ্জে পদ্মায় বড়শিতে ধরা পরল ৯ কেজি ওজনের বোয়াল
রাজশাহী নার্সিং কলেজের ১৪ শিক্ষার্থী ফেল করে অধ্যক্ষের কক্ষে তালা দিলেন
মেলানিয়া ট্রাম্প বাজারে আনলেন নিজস্ব ক্রিপ্টোকারেন্সি
সাবেক এমপি মোস্তফা জালাল গ্রেপ্তার
শরীয়তপুর পৌরসভার বিএনপি কার্যালয়ে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা