যুদ্ধবিধ্বস্ত সুদানের করুণ চিত্র তুলে ধরলেন বাসিন্দারা
১৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৫০ পিএম | আপডেট: ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ০৫:৫৩ পিএম

"মা শেষ কথাগুলো বলে যেতে পারেননি। যখন তাকে নিয়ে যাওয়া হয়, ততক্ষণে তার মৃত্যু হয়েছে।" সুদানের গৃহযুদ্ধের কবলে থাকা দারফুরে শহরে কীভাবে তার মায়ের মৃত্যু হয়েছিল সেই ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন হাফিজা।
ঠিক দুই বছর আগে সুদানে শুরু হয়েছিল ওই গৃহযুদ্ধ, যার প্রভাবে সেখানকার জীবন একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে।
মাকে হারানোর পর যে তার পরিবারের সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে, সেকথাও বলছিলেন বছর ২১-এর এই তরুণী। যে ফোনে হাফিজা নিজের কথাগুলো রেকর্ড করছিলেন, সেটা বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের পক্ষ থেকে তাকে দেওয়া হয়।
আল-ফাশেরে ক্রসফায়ারের (চারপাশ থেকে গুলি) মাঝে আটকে পড়া কিছু মানুষের কাছে কোনোমতে ফোন পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছিল বিবিসি। তারই মধ্যে একটায় নিজের কথা রেকর্ড করছিলেন হাফিজা।
ক্রমাগত বোমাবর্ষণের কারণে, এক বছর ধরে বাইরের বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে আল-ফাশের। সাংবাদিকদের পক্ষে ওই শহরে প্রবেশ করাও অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
নিরাপত্তার কারণে এই প্রতিবেদনে আমরা শুধু সেসব ব্যক্তির নামই উল্লেখ করছি, যারা বিবিসির ফোনে তাদের জীবন সম্পর্কে তথ্য রেকর্ড করতে এবং নিজেদের কথা অন্যদের কাছে তুলে ধরতে রাজি হয়েছেন।
তার পাঠানো এক বার্তায় হাফিজা বর্ণনা করেছিলেন কীভাবে তার বছর পাঁচেকের ভাই এবং কিশোরী দুই বোনের দায়-দায়িত্ব এখন তার কাঁধে।
যুদ্ধ শুরুর আগেই তাদের বাবার মৃত্যু হয়েছিল। সেনাবাহিনী এবং র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ)-কে একে অপরের বিরুদ্ধে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এই যুদ্ধ যা বিশ্বের বৃহত্তম মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে।
প্রসঙ্গত, এই দুই প্রতিদ্বন্দ্বী অর্থাৎ সেনাবাহিনী এবং আরএসএফ এক সময় একে অপরের সহযোগী ছিল। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তারা একসঙ্গে ক্ষমতায়ও আসে।
বেসামরিক শাসনের দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনাকে কেন্দ্র করে তাদের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। এই পরিকল্পনা কিন্তু আন্তর্জাতিকভাবে সমর্থিত ছিল।
ফিরে আসা যাক হাফিজার কথায়। তার বাড়ি সুদানের পশ্চিমাঞ্চলীয় দারফুর অঞ্চলে। এটাই সামরিক বাহিনী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত সর্বশেষ বড় শহর যা গত এক বছর ধরে আরএসএফ-এর দখলে রয়েছে।
হাফিজার মা ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে যে বাজারে গৃহস্থালির জিনিসপত্র বিক্রি করতে গিয়েছিলেন, সেখানে একটা শেল আঘাত হানে।
"শোক ভীষণ কঠিন একটা জিনিস। মায়ের কর্মস্থলে যাওয়ার সাহস জোটাতে পারি না আমি," মায়ের মৃত্যুর পর তার (বিবিসির দেওয়া ফোন মারফত পাঠানো) প্রথম ভিডিও বার্তায় হাফিজা এই কথাগুলোই বলছিলেন।
তিনি বলেছিলেন, "বাড়িতে একলা কাঁদতে থাকি।"
এই যুদ্ধে সেনাবাহিনী এবং র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস-দুই পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ এবং ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক নাগরিকদের নিশানা করার অভিযোগ আনা হয়েছে। এই অভিযোগ কিন্তু উভয়পক্ষই অস্বীকার করে এসেছে।
দারফুর নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর ওই অঞ্চলের অন্যান্য অংশে বসবাসকারী আরব নন এমন গোষ্ঠীর ওপর আরএসএফ গণহত্যা চালিয়েছে বলে এর আগে অভিযোগ তুলেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো। সেই অভিযোগও অস্বীকার করেছে আরএসএফ।
শহরের ভেতরে ও বাইরে যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করে তারা (আরএসএফ) এবং কখনো কখনো বেসামরিক নাগরিকদের আসা-যাওয়ার অনুমতিও দেয়। তাই হাফিজা তার ভাই-বোনদের একটা নিরপেক্ষ অঞ্চলে পরিবারের সঙ্গে থাকার জন্য পাঠাতে সক্ষম হন।
কিন্তু তাদের ভরণপোষণের জন্য অর্থ উপার্জনের চেষ্টা করতে এখানেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন তিনি।
ফোনে পাঠানো বার্তায় হাফিজা জানিয়েছেন, কীভাবে আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই নেওয়া বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের মধ্যে কম্বল ও পানি বিতরণ, কমিউনিটি কিচেনে (গোষ্ঠীর জন্য যেখানে রান্না হয়) সাহায্য করা এবং স্তন ক্যান্সার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করে গোষ্ঠীকে সমর্থনের মাধ্যমে সামান্য রোজগার করেন তিনি।
এতে তার দিন কেটে গেলেও পরিবারের অনুপস্থিতিতে নিঃসঙ্গতায় কাটে রাতগুলো।
"মা ও ভাইবোনেরা কোথায় বসে থাকতেন, সেইসব কথা মনে পড়ে। একেবারে ভেঙে গিয়েছি আমি," বলেছিলেন হাফিজা।
বছর ৩২-এর মোস্তফার পাঠানো প্রতিটা বার্তার নেপথ্যে গোলাগুলি চলার বা বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।
তিনি বলেন, "দিন-রাত আরএসএফ-এর অবিরাম কামানের গোলাবর্ষণ সহ্য করে চলেছি আমরা।"
একদিন, পরিবারের সঙ্গে দেখা করে ফেরার পর, মোস্তফা দেখেন শহরের কেন্দ্রের কাছে অবস্থিত তার বাড়িতে শেল আঘাত হেনেছে। বাড়ির ছাদ এবং দেয়ালগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আর যেটুকু অবশিষ্ট ছিল, তা লুটপাট করে নিয়ে গিয়েছে লুটেরারা।
আরএসএফকে দোষারোপ করে তিনি বলছিলেন, "সবকিছু তছনছ করে দিয়েছে। আমাদের পাড়ার বেশিরভাগ বাড়িঘর লুট করা হয়েছে।"
মোস্তফা যখন বাস্তুচ্যুতদের জন্য তৈরি একটা আশ্রয়কেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছিলেন, সেই সময় ওই অঞ্চল জোরালো আক্রমণের শিকার হয়। লুকিয়ে থাকাকালীন তার থাকা ক্যামেরাটা চালু রেখেছিলেন মোস্তফা। সেই ক্যামেরায় প্রতিটা বিস্ফোরণের সময়ের ঝাঁকুনি ধরা পড়েছে।
মোস্তফার, "আল-ফাশেরে কোনো নিরাপদ জায়গা নেই। এমনকি শরণার্থী শিবিরগুলোতেও আর্টিলারি শেল ফেলা হচ্ছে।"
"কোনোরকম আগাম সতর্ক বার্তা ছাড়াই মৃত্যু যে কাউকে আঘাত করতে পারে, তা সে বুলেটের মাধ্যমে হোক, গোলাগুলির আঘাতে হোক, ক্ষুধা বা তৃষ্ণায়।"
অন্য এক বার্তায়, তিনি বিশুদ্ধ পানির অভাব সম্পর্কে কথা বলেছেন, কীভাবে নোংরা পানি, যার উৎস নর্দমার বা নোংরা জলাধারের সঙ্গে যুক্ত, সেটাই পান করার জন্য ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ।
মোস্তফার মতোই ২৬ বছরের মানাহেলের কাছেও বিবিসির দেওয়া একটা ফোন রয়েছে। তারা দু'জনেই কমিউনিটি কিচেনে স্বেচ্ছাশ্রম দেন।
প্রসঙ্গত, কমিউনিটি কিচেন চালানোর জন্য অর্থায়ন করেন বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী মানুষ যাদের শিকড় সুদানে।
এই শহরে দুর্ভিক্ষের বিষয়ে জাতিসংঘের পক্ষ থেকে সতর্ক করা হয়েছে, যেমনটা ইতিমধ্যে নিকটবর্তী জমজম শিবিরে দেখা গিয়েছে। ওই শিবির পাঁচ লাখেরও বেশি বাস্তুচ্যুত মানুষের আবাসস্থল।
মানাহেল ব্যাখ্যা করেন, "অনেক মানুষই বাজারে যেতে পারে না। আর গেলেও সেখানে জিনিসের চড়া দাম।"
"এখানে প্রত্যেকটা পরিবার এখন সমান। ধনী-দরিদ্র বলে কিছু নেই। মানুষ খাবারের মতো মৌলিক চাহিদা মেটাতে পারছে না।"
ভাত এবং স্টু জাতীয় খাবার রান্না করে, আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাসকারীদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়। অনেকের কাছেই এটাই পুরো দিনে একমাত্র আহার।
যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন মানাহেল সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষ করেছেন। শরিয়া এবং আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন তিনি।
যুদ্ধের আঁচ আল-ফাশেরে এসে পৌঁছানোর পর মানাহেল তার মা এবং ছয় ভাইবোনকে নিয়ে ফ্রন্ট লাইন (যুদ্ধক্ষেত্র) থেকে আরও দূরের একটা নিরাপদ অঞ্চলে চলে যান।
সেই পরিস্থিতির প্রসঙ্গে মানাহেল বলেছেন, "আপনাকে আপনার বাড়িঘর ছাড়তে হয়, নিজের মালিকানাধীন সবকিছু হারাতে হয় এবং এমন একটা নতুন জায়গায় আপনি নিজেকে খুঁজে পান, যেখানে কিছুই নেই।"
তবে মানাহেলের বাবা কিন্তু তাদের বাড়ি ছাড়তে রাজি হননি। কয়েকজন প্রতিবেশী তার হেফাজতে নিজেদের জিনিসপত্র দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই সমস্ত কিছু রক্ষা করতে নিজের ভিটেতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন মানাহেলের বাবা। এই সিদ্ধান্তের জন্য তাকে প্রাণ দিতে হয়েছিল।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে আরএসএফ-এর গোলায় নিহত হন তিনি।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, আল-ফাশেরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে প্রায় দুই হাজার মানুষ নিহত বা আহত হয়েছে।
সূর্যাস্তের পর মানুষ খুব কমই ঘরের বাইরে যান। বিদ্যুতের অভাব আল-ফাশেরের দশ লাখ বাসিন্দার মধ্যে অনেককের কাছেই রাতের সময়টাকে ভয়াবহ করে তুলেছে।
মানাহেল ব্যাখ্যা করেছেন, "সৌর শক্তি চালিত আলো বা ব্যাটারি থাকা সত্ত্বেও সেখানকার বাসিন্দারা আলো জ্বালাতে ভয় পান কারণ সেগুলো "ড্রোন দ্বারা শনাক্ত করা যেতে পারে।"
এমন অনেক সময় ছিল, যখন আমরা বেশ কয়েক দিন ধরে মানাহেল বা অন্যদের কাছে পৌঁছাতে পারিনি কারণ তাদের কাছে ইন্টারনেট সুবিধা ছিল না।
তবে এই সমস্ত উদ্বেগের ঊর্ধ্বে, আরএসএফের হাতে পড়লে কী হতে পারে সে নিয়ে মানাহেল ও হাফিজা দু'জনেরই একটা বড় ভয় রয়েছে।
সেই ভয়ের বিষয়ে হাফিজা তার পাঠানো একটা বার্তায় উল্লেখ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, "মেয়ে হিসেবে আমি ধর্ষণের শিকার হতে পারি।"
তিনি, মানাহেল ও মোস্তফা সবাই অনারব (আরব নন এমন সম্প্রদায়ের) সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। আরএসএফ দখল করা অন্যান্য শহরগুলোতে যা ঘটেছে, সেখান থেকেই হাফিজাদের ভয়ের উদ্রেক হয়েছে, বিশেষত আল-ফাশের থেকে ২৫০ মাইল পশ্চিমে এল-জেনিনায় যে ঘটনা ঘটেছে।
ওই অঞ্চল ২০২৩ সালে ভয়াবহ জাতিগত হত্যাকাণ্ডের সাক্ষী ছিল, যে ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যরা গণহত্যার শামিল বলে অভিহিত করে। আরএসএফ যোদ্ধারা এবং তাদের মিত্র আরব মিলিশিয়ারা মাসালিতের মতো আরব নয় এমন জাতিগোষ্ঠীকে নিশানা করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এই অভিযোগ আরএসএফ এর আগে অস্বীকার করেছে।
চাদের সীমান্তের ওপারে অবস্থিত শরণার্থী শিবিরে আমার দেখা একজন মাসালিত নারী জানিয়েছিলেন কীভাবে তাকে আরএসএফ যোদ্ধারা গণধর্ষণ করে। ঘটনার পর প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে তিনি হাঁটতে পারেননি।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ১৪ বছরের কম বয়সী মেয়েরাও ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
আরএসএফ বাহিনীর দ্বারা পরিচালিত গণহত্যার সাক্ষী এক ব্যক্তি আমাকে জানিয়ে ছিলেন মৃত ভেবে তাকে ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছিল। আহত অবস্থায় কোনোমতে পালিয়ে বাঁচেন তিনি।
জাতিসংঘের তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে শুধু এল-জেনেইনাতেই ১০ থেকে ১৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। আর এখন এই শহরের আড়াই লাখেরও বেশি মানুষ, (যা আগের জনসংখ্যার অর্ধেক) চাদের শরণার্থী শিবিরে বসবাস করছেন।
আরএসএফ-এর কাছে এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কিন্তু তাদের তরফে কোনো প্রতিক্রিয়া মেলেনি। তবে অতীতে তারা দারফুরে জাতিগত হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে জানিয়েছিল, তাদের ওপর দোষ চাপাতে আরএসএফ-এর পোশাক পরে এসেছিল হামলাকারীরা।
সেই সময় থেকে তখন থেকে খুব কম সাংবাদিকই এল-জেনিনায় কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছেন। তবে শহরের ক্ষমতায় থাকা বেসামরিক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কয়েক মাস চলা আলাপ-আলোচনার পরে, বিবিসির একটা দলকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে সেখানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল।
গভর্নরের অফিস থেকে আমাদের সঙ্গে একজন 'মাইন্ডার' (সঙ্গে যাবেন এমন ব্যক্তি) নিয়োগ করা হয়েছিল এবং কর্তৃপক্ষ যেটুকু দেখাতে চান, সেটুকুই দেখার অনুমতি ছিল আমাদের।
তাৎক্ষণিকভাবে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সমস্ত কিছু আরএসএফ-এর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আমি তাদের যোদ্ধাদের সশস্ত্র যানে রাস্তায় টহল দিতে দেখেছি এবং তাদের কয়েকজনের সঙ্গে আমার সংক্ষিপ্ত কথোপকথনও হয়েছে। সেই সময় তারা তাদের অ্যান্টি-ভেহিকল রকেট-প্রপেলার গ্রেনেড (আরপিজি) লঞ্চার দেখিয়েছিল।
এই সংঘর্ষকে ওই যোদ্ধারা কতটা অন্যভাবে দেখেন, সেটা বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। তাদের কমান্ডার জোর দিয়ে বলছিলেন হাফিজা, মোস্তফা ও মানাহেলের মতো কোনো বেসামরিক নাগরিক আল-ফাশেরে বাস করে না।
ওই যোদ্ধা বলেছিলেন, "যুদ্ধবিদ্ধস্ত এলাকায় একমাত্র তারাই রয়েছেন, যারা যুদ্ধে যোগ দিয়েছেন। ওই অঞ্চলে কোনো বেসামরিক মানুষ নেই। যারা রয়েছেন, তাদের সবাই সেনাবাহিনীর।"
পাশাপাশি তিনি দাবি করেছিলেন এল-জেনিনা এখন শান্তিপূর্ণ অঞ্চল এবং সেখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দা, তার কথায় "প্রায় ৯০ শতাংশ" ইতিমধ্যে নিজেদের এলাকায় ফিরে এসেছেন। শুধু তাই নয়, যেসব বাড়ি খালি ছিল, সেখানে আবার মানুষ বসবাস করা শুরু করেছেন।
কিন্তু বাস্তবে শহরের হাজার হাজার বাসিন্দা এখনও চাদে শরণার্থী হিসেবে বসবাস করছেন এবং আমরা যখন গাড়িতে চেপে যাচ্ছিলাম সেই সময় আমি নিজে অনেক নির্জন এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত এলাকা দেখেছি।
চারদিক ঘুরে দেখার সময় আমাদের ওপর নজর রাখছিলেন মাইন্ডাররা। সেই পরিস্থিতিতে এল-জেনিনার জীবনের সত্যিকারের চিত্র পাওয়া কঠিন ছিল।
আমাদের একটা ব্যস্ত সবজিবাজারে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানে উপস্থিত ব্যক্তিদের কাছে আমি তাদের জীবন সম্পর্কে জানতে ছেয়েছিলাম।
যখনই তাদের কাউকে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছি, তখনই লক্ষ্য করেছি তারা উত্তর দেওয়ার আগে আমার কাঁধের ওপর দিয়ে মাইন্ডারের দিকে তাকাচ্ছিলেন। আর একমাত্র উচ্চমূল্য সম্পর্কে কয়েকটা মন্তব্য বাদে সবকিছু "ঠিক আছে" বলে জবাব দিচ্ছিলেন।
এরই মাঝে, আমার মাইন্ডার প্রায়শই আমার কানে ফিসফিস করে জানিয়ে দিচ্ছিলেন যে বাসিন্দারা জিনিসের উচ্চমূল্যের বিষয়ে 'অতিরঞ্জিত' করছে।
আমরা পশ্চিম দারফুরের গভর্নর তিজানি কারশৌমের সাক্ষাৎকার দিয়ে আমাদের সফর শেষ করেছিলাম। তার আগে যিনি গভর্নর ছিলেন তিনি আরএসএফের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ এনেছিলেন। এরপর ২০২৩ সালের মে মাসে সাবেক গভর্নর নিহত হন।
২০২৩ সালের পর এটাই তিজানি কারশৌমের প্রথম সাক্ষাৎকার ছিল। তার দাবি, এল-জেনিনায় অস্থিরতার সময় তিনি একজন নিরপেক্ষ বেসামরিক বাসিন্দা ছিলেন। কারও পক্ষে ছিলেন না তিনি।
জাতিসংঘের দেওয়া হতাহতের সংখ্যা 'অতিরঞ্জিত' বলে উল্লেখ করেছিলেন তিনি। তার কথায়, "অতীতের তিক্ততা পেরিয়ে এসে শান্তি, সহাবস্থানের স্লোগান দিয়ে আমরা এক নতুন অধ্যায় শুরু করেছি।"
তার সাক্ষাৎকারের সময় ওই কক্ষে একজন ব্যক্তি উপস্থিত ছিলেন, যিনি যে আরএসএফের প্রতিনিধি, তা আমরা বুঝতে পেরেছিলাম।
এদিকে, আমার সব প্রশ্নের উত্তরেই মি. কারশৌমের জবাব প্রায় একই ছিল- তা সে জাতিগত হত্যার অভিযোগ সম্পর্কে হোক বা সাবেক গভর্নর খামিস আবকরের সঙ্গে কী ঘটেছিল সে বিষয়ে।
মি. কারশৌমের সঙ্গে আমার কথা বলার প্রায় দুই সপ্তাহ পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
মি. কারশৌমের বিরুদ্ধে সাবেক গভর্নরের ওপর "হামলার" অভিযোগের পাশাপাশি "গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন, হত্যা, ধর্ষণ, গুরুতর ধরনের যৌন ও লিঙ্গ-ভিত্তিক সহিংসতা, অপহরণসহ একাধিক ঘটনার পরিকল্পনা করা, নির্দেশ দেওয়া বা ঘটানোর অভিযোগ" তুলেছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন।
মি. কারশৌমের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের প্রসঙ্গে তার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আমি সঙ্গে যোগাযোগ করি। জবাবে তিনি বলেন, "যেহেতু আমি এই বিষয়ে সন্দেহভাজন, তাই আমি মনে করি আমার কাছ থেকে আসা কোনো বক্তব্যেরই বিশ্বাসযোগ্যতা থাকবে না।"
তবে তিনি বলেছিলেন যে তিনি "কখনোই জাতিগত সংঘাতে অংশ নেননি এবং সংঘর্ষের সময় বাড়িতেই ছিলেন।"
পাশাপাশি, তার আরও দাবি, মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন হয় এমন কাজের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন না।
মি. কারশৌম বলেছিলেন, "হত্যা, অপহরণ বা ধর্ষণের মতো অভিযোগের ক্ষেত্রে স্বাধীন তদন্তের মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।"
"খার্তুমে সংঘাতের শুরু থেকেই আমরা শান্তির জন্য চাপ দিয়েছি। আমাদের সামাজিকভাবে ভঙ্গুর রাষ্ট্রে সহিংসতা রোধ করতে সুপরিচিত উদ্যোগের প্রস্তাবও দিয়েছি।"
এল-জেনিনার নিয়ন্ত্রণে থাকা ব্যক্তিদের প্রচারিত তথ্য আর সীমান্তের ওপারের শরণার্থীদের কাছ থেকে শোনা অসংখ্য অভিজ্ঞতার মধ্যে তীব্র বৈপরীত্য রয়েছে। এই দুই চূড়ান্ত বৈপরীত্যমূলক বিবরণের ওপর ভিত্তি করে এটা কল্পনা করা কঠিন যে বাস্তুচ্যুতরা ফিরে এসেছেন।
ঠিক একই কথা প্রযোজ্য আরও ১ কোটি ২০ লাখ সুদানের নাগরিকদের ক্ষেত্রেও, যারা তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন এবং হয় বিদেশে শরণার্থী হিসাবে আছেন অথবা সুদানের ভেতরেই কোনো আশ্রয় শিবিরে বসবাস করছেন।
শেষ পর্যন্ত, হাফিজা, মোস্তফা ও মানাহেলও মনে করেন এল-ফাশারে তাদের জীবন অসহনীয় হয়ে উঠেছে এবং ২০২৪ সালের নভেম্বরে তিনজনই নিকটবর্তী অন্য শহরে চলে যান।
মার্চ মাসে সামরিক বাহিনী রাজধানী খার্তুমের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার পর দারফুরই এখন সর্বশেষ প্রধান অঞ্চল যেখানে আধাসামরিক বাহিনী এখনও মূলত নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আর এটাই এল-ফাশেরকে আরও তীব্র যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত করেছে।
জিনিসপত্র গোছাতে গোছাতে মানাহেল বলছিলেন, "আল-ফাশের ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে।"
"আমরা আমাদের ভাগ্য না জেনেই চলে যাচ্ছি। আমরা কি কখনো আল-ফাশেরে ফিরতে পারব? এই যুদ্ধ কবে থামবে? কী হবে আমরা কিছুই জানি না।" সূত্র: বিবিসি।
বিভাগ : আন্তর্জাতিক
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন

কমলগঞ্জে ব্রি-ধান ১০৮ চাষে সফল কৃষক মিঠ

মুসলমানদের চিন্তা চেতনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল সরকারই আগামী দিনে দেশ চালাবে: এ এম এম বাহাউদ্দীন

ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে এরদোগানের সাথে কাজ করতে চান ট্রাম্প

“ময়মনসিংহে নিখোঁজ বাক-প্রতিবন্ধী যুবককে ২৪ ঘন্টার মধ্যে উদ্ধার করলো পিবিআই ময়মনসিংহ জেলা”

খন্দকার রুমী এহসানুল হক স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের নতুন স্বতন্ত্র পরিচালক

বছরের শেষ নাগাদ কমতে পারে তেলের দাম

গফরগাঁওয়ে পরীক্ষায় নকল: শিক্ষার্থী বহিষ্কার, শিক্ষককে অব্যাহতি

নাসিরনগরের আকাশী বিলে ভয়াবহ টর্নেডো

জকিগঞ্জের সুলতানপুর ইউপি চেয়ারম্যানকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিতে হাইকোর্টের নির্দেশ

উন্নত আগামীর ব্যাংকিং: বাংলাদেশ জুড়ে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড বাংলাদেশের টেকসই উদ্যোগ সমূহ

মানিকগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হামলার অভিযোগে আ.লীগের ৩৫ জনকে আসামি করে মামলা

বেশি প্রাণহানি মোটরসাইকেল ইজিবাইকে, এপ্রিলে সড়কে নিহত ৫৮৩

ডা. জুবাইদা রহমানকে বরণে প্রস্তুত ‘মাহবুব ভবন’

এনআরবিসি ব্যাংকের নতুন এমডি তৌহিদুল আলম খান

রোডক্রাশরোধে আহছানিয়া মিশনের ৯ সুপারিশ

তারেক রহমান সহসাই দেশে ফিরবেন: ডা. জাহিদ

পদ্মার ২২ কেজির এক পাঙাশ ৪০ হাজার টাকায় বিক্রি

বুকটা ধড়ফড় করতাছে, আমার বুকের মানিকদের বুকে ফিরাইয়্যা দেন বাবাজি'

নতুন সাইবার নিরাপত্তা আইন : ‘কুখ্যাত’ ৯ ধারা বাতিল

হোয়াটসঅ্যাপ-মেসেঞ্জারে পাওয়া যাবে দেওয়ানী মামলার বার্তা