শ্রম : প্রত্যেককেই অপরের প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে

Daily Inqilab ওয়ারিস রব্বানী

৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১১:০১ পিএম | আপডেট: ০১ মে ২০২৩, ১২:১৮ এএম

অন্যের অধীনে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করে যে সে-ই শ্রমিক। এ কাজের ধরন অনেক রকম হতে পারে, কিন্তু তার কাজের জন্য নির্ধারিত বা বাজার চলতি একটি পারিশ্রমিক ধার্য থাকে। ধার্য থাকে একটি সময় ও কিছু সুবিধা-সীমাবদ্ধতা। শ্রমিক যেহেতু তার শ্রমের বিনিময়ে অপর পক্ষ থেকে পেয়ে থাকে পারিশ্রমিক বা মূল্য, তাই স্বাভাবিক হিসেবে ও দৃষ্টিতে তার অবস্থান থাকে একটু নীচে। সুবিধার দিক থেকে এই নীচের শ্রেণি বা দুর্বল শ্রেণির প্রতি যেন কোনো রকম অন্যায়-অবহেলা না হয় ইসলামী জীবনদর্শনে সে নির্দেশনা এসেছে বহু ভাবে।

শ্রমিকের ঘাম শুকানোর আগে তার পারিশ্রমিক পরিশোধ করার নির্দেশ এসেছে। একইভাবে ধনী-সচ্ছল মালিক কর্তৃক শ্রমিকের পাওনা পরিশোধে টালবাহানা বা বিলম্ব করাকে বলা হয়েছে জুলুম। নিজে যা খাবে-পরবে শ্রমিককে তাই খেতে-পরতে দেয়ার প্রেরণা উচ্চারিত হয়েছে। শ্রম ও শ্রমিক সম্পর্কিত ইসলামের এসব নির্দেশনা দেখলে বুঝা যায়, শ্রমিককে ঠকানো বা কষ্ট দেয়ার কোনো চোরাপথ যেন খোলা না থাকে। শ্রমিককে যেন মালিকের মতোই একজন মানুষ মনে করা হয় এবং মালিক-শ্রমিকের মধ্যে যেন মানুষ হিসেবে কোনো ব্যবধানের প্রাচীর না থাকে।

ইসলামের আবির্ভাবের পর থেকেই শ্রম ও শ্রমিক সম্পর্কে ইসলামের এ দর্শন। ইসলামী আদর্শ থেকে দূরে সরে থাকার কারণে এ আদর্শের নীতিমালা থেকে আধুনিক পৃথিবী বঞ্চিত ছিল। ফলে অব্যাহত শ্রমিক নির্যাতনের এক পর্যায়ে আমেরিকার শিকাগো শহরে ১৮৮৬ সালের ১ মে শ্রমিক ধর্মঘট শুরু হয়। পরবর্তীতে রক্ত পিচ্ছিল পথ বেয়ে ১৮৮৯ সাল থেকে ১ মে দিনটিকে ‘শ্রম দিবস’ বা ‘মে দিবস’ নাম দিয়ে ছুটি কাটানো হয়, কিছু দাবি আদায় করা হয় এবং শ্রমিকের মুক্তির জন্য এ তারিখটির সঙ্গে জড়িত ইতিহাসের বন্দনা গাওয়া হয়। আসলে শ্রমিকের আওয়াজ ইসলামই সবার আগে তুলে ধরেছে। সবচেয়ে সুন্দর ও ভারসাম্যময় করে পেশ করেছে।

শ্রমিকের প্রাপ্য যথাযথভাবে পরিশোধ না করা ভয়াবহ গুনাহ। আর গুনাহের পরিণাম কখনো ভালো হয় না। কাজেই সতর্ক হওয়া কাম্য। হাদিস শরীফে শ্রমিকের মজুরি নিয়ে টালবাহানা না করে তা দ্রুত পরিশোধের তাকিদ করা হয়েছে। আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত হাদিসটি সবারই জানা আছে : মজদুরকে তার মজুরি দিয়ে দাও তার ঘাম শুকোবার আগেই। (সুনানে ইবনে মাজাহ : ২৪৪৩ )।

মজদুরকে মজুরি থেকে বঞ্চিত করার ব্যাপারে হাদিস শরীফে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারিত হয়েছে। সহিহ বুখারিতে হযরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর সূত্রে এই হাদিসে কুদসীতে বর্ণিত হয়েছে যে, আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেন : আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, কিয়ামতের দিন আমি নিজে তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াব : এক. ওই ব্যক্তি যে আমার নামে অঙ্গিকার করে তা ভঙ্গ করেছে।

দুই. যে কোনো স্বাধীন ব্যক্তিকে বিক্রি করে সেই মূল্য ভক্ষণ করেছে। আর তিন. যে কোনো মজদুরের শ্রম পুরোপুরি গ্রহণ করে তাকে তার মজুরি থেকে বঞ্চিত করেছে। (সহিহ বুখারি : ২২২৭)। ইবনে খুযাইমা, ইবনে হিব্বান ও ইসমাঈলীর বর্ণনায় একথাটুকুও আছে : ‘আর আমি যার বিরুদ্ধে দাঁড়াব তাকে পরাস্ত করেই ছাড়ব’।

এ হাদিসের আলোচনায় ইবনুত তীন (রাহ.) বলেছেন, আল্লাহ তায়ালা সকল জালিমের বিরুদ্ধেই দাঁড়াবেন, কাজেই এই হাদিসে বিশেষভাবে এদের উল্লেখের তাৎপর্য হচ্ছে এই জুলুমগুলোর গুরুতরতা ও ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে হুঁশিয়ার করা। (ফাতহুল বারী ৫/৩২২-৩২৩)। এ থেকে বোঝা যায়, শ্রমিককে তার চুক্তিকৃত মজুরি থেকে বঞ্চিত করা বা মজুরি নিয়ে টালবাহানা করা কত বড় অন্যায়। এই অন্যায় থেকে অবশ্যই আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।

ইসলাম যেহেতু সব মানুষকে স্রষ্টার সৃষ্টি হিসেবে এক নজরে দেখে তাই মালিক-শ্রমিকের দ্বন্দ্ব বা শ্রেণি বিভাজন ইসলামে কাম্য নয়। শ্রমিকের পাওনা পরিশোধে মালিকের প্রতি যেমন সতর্কবাণী উচ্চারণ করা হযেছে তেমনি মালিকের কাজে গাফিলতি ও দায়িত্বহীনতাকেও শ্রমিকের জন্য অপরাধ সাব্যস্ত করেছে। বিষয়টি এমন যে, এক ভাইয়ের সঙ্গে আরেক ভাইয়ের মুআমালায় প্রত্যেককে অপরের প্রতি দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে। এখানে এক শ্রেণির সঙ্গে আরেক শ্রেণির বিরোধ ও দ্বন্দ্বের বিষয়টি মুখ্য হতে পারে না।

এরপরও যেহেতু মালিক নামক শ্রেণিটির হাতে আল্লাহ কর্তৃক প্রদত্ত সুবিধা ও কর্তত্বের ভাগটা বেশি থাকে তাই চড়া মূল্যের এই সংকটকালে শ্রমিকের পাওনা যথাযথ পরিমাণেও যথাসময়ে আদায় করে দেওয়াই সব বিবেচনায় কাম্য। পাওনা ১০০ টাকা হ্রাস আর দু’দিনের বিলম্বও নিম্নবিত্ত একজন শ্রমিকের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে।

বরং বলা তো যায়, ইসলাম যে রহম ও করমের সর্বজনীন সবক আমাদেরকে দেয় তাতে সক্ষম ও সচ্ছল মালিকেরা এ ধরনের অভাবী মুহূর্তে শ্রমিকের পাশে আরেকটি কোমল স্পর্শ দিলে সে’টি দ্বীনি ভ্রাতৃত্বের নিদর্শন স্থাপন করবে, যা থেকে বহু সওয়াবও পাওয়া যাবে।


বিভাগ : শান্তি ও সমৃদ্ধির পথ ইসলাম


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

জীবিতদের নিকট মৃতব্যক্তির হক-২
জীবিতদের নিকট মৃত ব্যক্তির হক-১
মুমিন হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত রাসূলের প্রতি ঈমান-২
মুমিন হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত রাসূলের প্রতি ঈমান-১
সন্তানদের নেক আমলের উৎসাহ প্রদান
আরও
X
  

আরও পড়ুন

সামরিক হামলার নিন্দা জানিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান তারেক রহমানের

সামরিক হামলার নিন্দা জানিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের আহ্বান তারেক রহমানের

বিজেজিইএ’র নতুন চেয়ারম্যান বাবুল সি. ভাইস চেয়ারম্যান রেজাউল

বিজেজিইএ’র নতুন চেয়ারম্যান বাবুল সি. ভাইস চেয়ারম্যান রেজাউল

তারুণ্য ধরে রাখতে খাবার তালিকা পরিবর্তন

তারুণ্য ধরে রাখতে খাবার তালিকা পরিবর্তন

পার্বত্য অঞ্চলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে : জেলা প্রশাসক

পার্বত্য অঞ্চলের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে : জেলা প্রশাসক

নরসিংদীতে ছাগলের ঘাস খাওয়াকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ৩, গ্রেফতার ২

নরসিংদীতে ছাগলের ঘাস খাওয়াকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে নিহত ১, আহত ৩, গ্রেফতার ২

ছাগলনাইয়ায় গণ-অধিকার পরিষদের বর্ধিত সভা পন্ড!

ছাগলনাইয়ায় গণ-অধিকার পরিষদের বর্ধিত সভা পন্ড!

দিনাজপুরে পড়াশুনার ফাঁকে নারীদের উপার্জন বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মশালা

দিনাজপুরে পড়াশুনার ফাঁকে নারীদের উপার্জন বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মশালা

লাল বেনারসি এল শীতলজোড়ায় কিন্তু এল না বর :  বিয়ের আগেই না ফেরার দেশে বাবলু

লাল বেনারসি এল শীতলজোড়ায় কিন্তু এল না বর : বিয়ের আগেই না ফেরার দেশে বাবলু

রাজস্থলীর বাঙ্গালহালিয়া বাজারে অজ্ঞাত একটি লাশ উদ্ধার

রাজস্থলীর বাঙ্গালহালিয়া বাজারে অজ্ঞাত একটি লাশ উদ্ধার

কালীগঞ্জ জুলাই ‘গণঅভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেল’ এর চেক ও সঞ্চয়পত্র বিতরণ

কালীগঞ্জ জুলাই ‘গণঅভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিশেষ সেল’ এর চেক ও সঞ্চয়পত্র বিতরণ

জামায়াত নেতা আজহারুলের মুক্তি দাবিতে নোয়াখালীতে ছাত্রশিবিরের বিক্ষোভ

জামায়াত নেতা আজহারুলের মুক্তি দাবিতে নোয়াখালীতে ছাত্রশিবিরের বিক্ষোভ

অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা ১৬ লাখ ছাড়িয়ে

অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের সংখ্যা ১৬ লাখ ছাড়িয়ে

কিশোরগঞ্জে জাতীয় বিজ্ঞানমেলা ও অলিম্পিয়াড ‌‌আয়োজ‌নে প্রস্তু‌তিমূলক সভা অনু‌ষ্ঠিত

কিশোরগঞ্জে জাতীয় বিজ্ঞানমেলা ও অলিম্পিয়াড ‌‌আয়োজ‌নে প্রস্তু‌তিমূলক সভা অনু‌ষ্ঠিত

পটুয়াখালীতে তালাকপ্রাপ্তা এক মহিলা গণধর্ষণের শিকার

পটুয়াখালীতে তালাকপ্রাপ্তা এক মহিলা গণধর্ষণের শিকার

নোয়াখালীতে কারাগারের ১৮ ফুট দেয়াল টপকে আসামির পালানোর চেষ্টা, ভিডিও ভাইরাল

নোয়াখালীতে কারাগারের ১৮ ফুট দেয়াল টপকে আসামির পালানোর চেষ্টা, ভিডিও ভাইরাল

‘বিতর্কিত কমিশনের রিপোর্ট বাতিল করে কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে’

‘বিতর্কিত কমিশনের রিপোর্ট বাতিল করে কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে’

কুষ্টিয়ায় নারী চিকিৎসককে মারধরের ঘটনায় মামলা

কুষ্টিয়ায় নারী চিকিৎসককে মারধরের ঘটনায় মামলা

ইরানের কাসেম ক্ষেপণাস্ত্র যেকারণে একটি সামরিক সম্পদ

ইরানের কাসেম ক্ষেপণাস্ত্র যেকারণে একটি সামরিক সম্পদ

বিশ্ব যুব ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায় ইয়াজদানির স্বর্ণ জয়

বিশ্ব যুব ভারোত্তোলন প্রতিযোগিতায় ইয়াজদানির স্বর্ণ জয়

কীসের অপারেশন সিঁদুর, মুখ দিয়ে খারাপ কথা বের হবে : কবীর সুমন

কীসের অপারেশন সিঁদুর, মুখ দিয়ে খারাপ কথা বের হবে : কবীর সুমন