ইবনে সিনা; চিকিৎসাবিজ্ঞানে সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তারকারী মুসলিম মনীষী
০১ জুন ২০২৪, ০৯:৪৯ এএম | আপডেট: ০১ জুন ২০২৪, ০৯:৪৯ এএম
ইবনে সিনা ছিলেন একজন পারসিক মুসলিম বহুবিদ্যাবিশারদ। তার পুরো নাম আবু আলি হুসাইন বিন আব্দুল্লাহ ইবনুল হাসান বিন আলী ইবনে সিনা। তিনি আবু আলী সিনা, পুর সিনা বা পাশ্চাত্যে ল্যাটিন ভাষায় আভিসেনা (Avicenna), হিব্রু ভাষায় তার নাম আভেন সিনা (Aven Sina) নামেও পরিচিত। তাকে ইসলামী স্বর্ণযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, চিন্তক, লেখক এবং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক গণ্য করা হয়। তর্ক-সাপেক্ষে তিনি প্রাক-আধুনিক যুগের সবচেয়ে প্রভাবশালী দার্শনিক। ইবনে সিনা ছিলেন গ্রীক অ্যারিস্টটল (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৫-৩২২) দর্শন দ্বারা প্রভাবিত একজন পেরিপেটিক দার্শনিক। ধারণা করা হয় যে, তিনি ৪৫০টি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। যার মধ্যে ১৫০টি দর্শনশাস্ত্র বিষয়ক এবং ৪০টি চিকিৎসা বিজ্ঞান বিষয়ক রচনাসহ মোট ২৪০টি গ্রন্থ বর্তমানে টিকে রয়েছে।
তার সর্বাধিক বিখ্যাত রচনাগুলোর মধ্যে "কিতাব আশ- শিফা" অন্যতম। যেটি একটি দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক বিশ্বকোষ। তার আরেকটি এমনই প্রসিদ্ধ গ্রন্থ "কানুন ফি খাল তিব্ব" একটি চিকিৎসা-বৈজ্ঞানিক বিশ্বকোষ। যা বহু মধ্যযুগীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রামাণ্য চিকিৎসা শাস্ত্রের পাঠ্যবই হিসেবে যুক্ত করা হয়েছিল। ১৬৫০ সাল পর্যন্ত গ্রন্থটি সরাসরি পাঠ্যবই হিসেবে ব্যবহার হত।
তিনি হিপোক্রেটিস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০-৩৬০), এরিস্টটল (খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২), গ্যালেন (খ্রিস্টপূর্ব ৪৬০-৩৬০), নয়াপ্লাতোবাদ (খ্রিস্টপূর্ব ২৭০-২০৪), জাফর আস-সাদিক (৭০০-৭৬৫), ওয়াসিল ইবনে আতা (৭০০-৭৪৯), আল-কিন্দী (৮০১-৮৭৪), আল-ফারাবী (৮৭২-৯৫৬), আল-রাজী (৮৬৫-৯২৫), আল-বেরুনী (৯৭৩-১০৪৮), আল-মসীহী (৯৬০-১০১০), আবুল হাসান হানকারী (১০১৮-১০৯৩) দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
পরবর্তীকালে ওমর খৈয়াম (১০৪৮-১১৩১), ইবনে রুশদ (১১২৬-১১৯৮), ইয়াহিয়া ইবনে হাবাশ সোহরাওয়ার্দী (১১৫৪-১২০৮), নাসিরুদ্দীন তুসী ১২০১-১২৭৪), ইবনুন নাফিস (১২১৩-১২৮৮), ইবনে তুফাঈল (১১০৫-১১৮৫), রেনে দেকার্ত (১৬৯৬-১৬৫০), আলবার্টাস মাগনাস (১২০০-১২৮০) মুসা বিন মৈমুন (১১৩৫-১২০৪), জন ডান্স স্কোটাস (১২৬৬-১৩০৮), টমাস আকুইনাস (১২২৫-১২৭৪), অকহামের উইলিয়াম (১২৮৫-১৩৪৯), আবু উবাইদ জুজ জানি (১০১০-১০৭০), বর্তমান সময়ের ইরানী দার্শনিক সৈয়দ হোসেইন নসর সহ (১৯৩৩-) আধুনিক যুগের দার্শনিকগণ তার দ্বারা দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছেন।
দর্শন এবং চিকিৎসাশাস্ত্র ছাড়াও ইবনে সিনা'র রচনা সংকলনে জ্যোতির্বিজ্ঞান, আলকেমি, ভূগোল এবং ভূতত্ত্ব, মনোবিজ্ঞান, ইসলামী ধর্মতত্ত্ব, যুক্তিবিদ্যা, গণিত, পদার্থবিজ্ঞান এবং কবিতা বিষয়ক লেখাও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ইবনে সিনা বুখারা'র (বর্তমান উজবেকিস্তান) অন্তর্গত খার্মাতায়েন জেলার আফসানা নামক স্থানে ৩৭০ হিজরি মোতাবেক ৯৮০ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম আবদুল্লাহ এবং মাতার নাম সিতারা। তার ছিলেন ফার্সীভাষী। ফার্সী ভাষায় তিনি বেশ কিছু কবিতা ও গ্রন্থ রচনা করেন। তবে সমকালীন অন্যান্যদের মতো তিনিও আরবি ভাষাকে জ্ঞান প্রকাশের মূল বাহন হিসেবে গ্রহণ করেন। ইবনে সিনা'র পিতা বুখারার সামানীয় সাম্রাজ্যের (৮১৯-৯৯৯) অধীনে একজন সরকারী কর্মকর্তা ছিলেন।
ইবনে সিনা'র ধর্মীয় মাযহাব নিয়ে একাধিক তত্ত্ব প্রচলিত রয়েছে। মধ্যযুগীয় ঐতিহাসিক জহির আল দ্বীন আল বায়হাক্বি (৯৯৪-১০৬৬) ইবনে সিনাকে ইখওয়ান আল সাফা'র অনুসারী বলে মনে করেন। অপরদিকে দিমিত্রি গুস্তা, আইশা খান এবং জুলস জে জেনসেন ইবনে সিনাকে সুন্নি হানাফি মাযহাবের অনুসারী হিসেবে দেখিয়েছেন। ইবনে সিনা হানাফি আইন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। তার শিক্ষকদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ আলী ইবনে মানুনের আদালতে হানাফি বিচারক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ইবনে সিনা জানিয়েছিলেন যে, অল্প বয়সে ইসমাইলিয়দের দ্বারা তিনি প্রভাবিত হননি। যদিও, ইরানী দার্শনিক সৈয়দ হোসেন নসরের মতে, ১৪ শতকে শিয়া বিজ্ঞ নুরুল্লাহ শুশতারি অনুসারে ইবনে সিনা শিয়া অনুসারী ছিলেন। শারাফ খোরসানী এ ব্যাপারে দ্বিমত প্রকাশ করেন। তিনি সুন্নি গভর্নর সুলতান মাহমুদ গজনবীর একটি আমন্ত্রণের প্রত্যাখ্যান পত্রকে নথি হিসেবে দেখিয়ে, ইবনে সিনাকে ইসমাইলি অনুসারী বলে দাবী করেছেন। একই ধরনের দ্বিমত ইবনে সিনার পারিবারিক পটভূমির ভিত্তিতে পাওয়া যায়। বেশিরভাগ লেখকেরা সুন্নি মতবাদী বলে মনে করলেও সাম্প্রতিককালে ইবনে সিনার পরিবারকে শিয়া অনুসারী বলে দাবী করা হয়।
ইবনে সিনা'র পরিবারবর্গ আফসানাতে বাস করতেন। তার দ্বিতীয় ভাইয়ের জন্মের পর আবদুল্লাহ ও সিতারা সবাইকে নিয়ে বুখারায় চলে আসেন। তাদের শিক্ষার জন্য যথোপযুক্ত গৃহশিক্ষক নিয়োগ করেন। এখান থেকেই ইবনে সিনা'র শিক্ষার হাতেখড়ি হয়। সব ভাইয়ের মধ্যে ইবনে সিনা শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই বিশেষ মেধার স্বাক্ষর রাখেন। মাত্র ১০ বছর বয়সে সমগ্র কুরআন মুখস্থ করেন। মুখস্থের পাশাপাশি তিনি সকল সূক্ষ্ম ও জটিল বিষয় নিয়ে ছোটবেলা থেকে চিন্তা করতেন। এতে তার বাবা-মা ও শিক্ষক সকলেই বিস্মিত হতেন। বাবা ইবনে সিনাকে ইসমাইলি শাস্ত্র বিষয়ে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করেন।
ইবনে সিনা'র পিতা আবদুল্লাহ সেখানকার এক মেওয়া বিক্রেতার কথা আগে থেকেই জানতেন। এই বিক্রেতা ভারতীয় গণিতশাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিল। বাবা আবদুল্লাহ ইবনে সিনাকে এই মেওয়া বিক্রেতার কাছে গণিত শেখার ব্যবস্থা করে দেন। মেওয়া বিক্রেতা এর আগে কাউকে তার জ্ঞান বিতরণের সুযোগ পান নি। এই সুযোগে সে ইবনে সিনাকে সানন্দে শিক্ষা দিতে থাকেন। ইবনে সিনা মেধাবী হওয়াতে অল্পদিনের মধ্যেই ভারতীয় গণিতের অনেক বিষয় তার আয়ত্তে আসে। এরপর তাকে অধ্যয়ন করতে হয় ইসমাইলি শাস্ত্রের আইন অধ্যায়। এতেও তিনি দক্ষতা অর্জন করেন। এর মাঝে আর একজন যোগ্য শিক্ষকের সন্ধান পান ইবনে সিনা'র পিতা। তিনি ছিলেন তৎকালীন অন্যতম জ্ঞানী ব্যক্তিত্ব আল নাতেলী। নিজ পুত্রকে শিক্ষা দেয়ার জন্য তিনি নাতেলীকে নিজের গৃহে থাকার ব্যবস্থা করে দেন। এই শিক্ষকের কাছে সিনা ফিকহ, আইনশাস্ত্র, জ্যামিতি এবং জ্যোতিষ শাস্ত্র শিক্ষা করেন। ছাত্রের মেধা দেখে পড়ানোর সময় নাতেলী বিস্মিত হয়ে যেতেন। তার অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে ভ্যাবাচেকা খেতে হত তাকে। বিস্মিত হয়ে তিনি ইবনে সিনা'র পিতা আবদুল্লাহকে বলেছিলেন, "আপনার ছেলে একদিন দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হবে। দেখবেন, ওর পড়াশোনায় কোন ব্যাঘাত যেন না ঘটে।"
পরবর্তীতে ইবনে সিনা'র শিক্ষক হিসেবে আরও দুজন নিযুক্ত হন। তারা হলেন- ইবরাহিম ও মাহমুদ মসসাহ। এসময় শিক্ষক নাতেলী বুঝতে পারেন, ইবনে সিনাকে বেশীদিন শিক্ষা দেয়ার মতো সামর্থ্য বা জ্ঞান তাঁর আর অবশিষ্ট নেই। তখন ইবনে সিনা শিক্ষার বিষয়ে অনেকটা নিজের উপর নির্ভর করেই চলতেন। এসময় সম্বন্ধে তিনি তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন:
“ যে কোনো সমস্যার সমাধান ওস্তাদ যে রূপ করতেন, আমি তার চেয়ে ভালভাবে করতে পারতাম। তাঁর কাছে "জাওয়াহির মানতিক" বা "তর্কশাস্ত্রের খনি" নামক বইটি পড়ে মুখস্থ করার পর বুঝলাম, আমাকে শেখাবার মতো কিছু নতুন আর তাঁর কাছে নেই। তখন বইগুলো আর একবার পড়তে শুরু করলাম। ফলে সকল বিষয়ে আমি বিশেষ পারদর্শী হয়ে উঠলাম। ইউক্লিডের জ্যামিতির (দ্য এলিমেন্ট্স) প্রথম কয়েকটি সম্পাদ্যের সমাধানে ওস্তাদের সাহায্য নিয়ে বাকি কটির সমাধান আমি নিজেই করলাম। টলেমি'র ১৩ খণ্ডের "আলমাজেস্ট" বইটি পড়া শুরু করে সমস্যার সম্মুখীন হলে ওস্তাদ বললেন, "তুমি নিজে সমাধান করতে চেষ্টা কর, যা ফল দাঁড়ায় এনে আমাকে দেখাও। আমি বিচার করে রায় দেবো।" একে একে সব সমস্যার সমাধান করে ওস্তাদের সম্মুখে হাজির করলাম। তিনি দেখে-শুনে বললেন, "ঠিক হয়েছে, সব কটিই নির্ভুল সমাধান হয়েছে।" আমি বেশ বুঝতে পারলাম, এ ব্যাপারে ওস্তাদ আমার কাছ থেকে কিছু নতুন তথ্য শিখে নিলেন। ”
এরপর নাতেলী বুঝতে পারলেন তার প্রয়োজন শেষ। এরপর তিনি বুখারা ছেড়ে চলে যান। এসময় চিকিৎসা শাস্ত্র এবং স্রষ্টাতত্ত্ব সম্বন্ধে ইবনে সিনা'র মৌলিক জ্ঞানের বিকাশ ঘটে। গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটল (খ্রিষ্টপূর্ব ৩৮৪-৩২২) এর দর্শন সম্পূর্ণ ধাতস্থ করেন এ সময়েই। নতুন বই না পেয়ে আগের বইগুলোই আবার পড়তে লাগলেন। তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে লাগল। বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা তার কাছে পড়তে আসত। তরুণ বয়সেই তিনি এবার শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি ইউক্লিড (খ্রিস্টপূর্ব ৩০০-২২৫) এবং ক্লডিয়াস টলেমি (খ্রিস্টপূর্ব ১৮০-১০০) এর গ্রন্থও অধ্যয়ন করেন।
এ সময় বুখারার বাদশাহ নুহ বিন মনসুর (৯৬৩-৯৯৭) এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। দেশ এবং বিদেশের সকল চিকিৎসকের চিকিৎসা ব্যর্থ হয়। ততদিনে ইবনে সিনার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ায় বাদশাহের দরবারে তার ডাক পড়ে। তিনি বাদশাহকে সম্পূর্ণ সারিয়ে তোলেন। তার খ্যাতি এ সময় দেশে-বিদেশে আরও ছড়িয়ে পড়ে। আরোগ্য লাভের পর বাদশাহ ইবনে সিনাকে পুরস্কার দেয়ার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন। এসময় ইবনে সিনা বিপুল সম্পদ ও উচ্চপদের বদলে কেবল বাদশাহ্র কাছে শাহী কুতুবখানায় (বাদশাহ্র দরবারের গ্রন্থাগার) পড়াশোনার অনুমতি প্রার্থনা করেন। বাদশাহ তার এ প্রার্থনা মঞ্জুর করেন। এভাবেই ইবনে সিনা শাহী গ্রন্থাগারে প্রবেশের সুযোগ পান। গ্রন্থাগারের ভিতরে গিয়ে অবাক হয়েছিলেন ইবনে সিনা। কারণ এমন সব বইয়ের সন্ধান তিনি সেখানে পেয়েছিলেন, যেগুলো এর আগেও কোনদিন দেখেন নি এবং এর পরেও সন্ধান পাননি। প্রাচীন থেকে শুরু করে সকল লেখকদের বইয়ের অমূল্য ভাণ্ডার ছিল এই গ্রন্থাগার। সব লেখকের নাম তাদের রচনাসমূহের বিস্তারিত বর্ণনা তৈরির পর, তিনি সেগুলো অধ্যয়ন করতে শুরু করেন। এমনই পাগল হয়ে গিয়েছিলেন যে, নাওয়া-খাওয়ার কথা তার মনেই থাকত না।
১০০১ সালে ইবনে সিনা'র পিতার মৃত্যু হয়। সুলতান নুহ বিন মনসুরও ততদিনে ইহলোকে ত্যাগ করেছেন। নুহ বিন মনসুর (৯৬৩-৯৯৭) এর উত্তরাধিকারী নতুন সুলতান ইবনে সিনাকে তার পিতার স্থলাভিষিক্ত করেন। এভাবে ইবনে সিনা বুখারা অঞ্চলের শাসনকর্তার অধীনে সরকারী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন শুরু করেন। কিন্তু রাজনীতিতে তিনি ছিলেন নতুন। অভিজ্ঞতার অভাবে কার্য সম্পাদনে তাকে হিমশিম খেতে হত। কিছুদিনের মধ্যেই রাজ্যের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ট্রান্সঅকসিনিয়া'য় বিদ্রোহ দেখা দেয়। খার্মাতায়েনের পূর্বপ্রান্ত দিয়ে ঐতিহাসিক অক্সাস নদী (উজবেকিস্তানের আমু দরিয়া)যা বুখারা এবং তুর্কিস্তানের মধ্যবর্তী সীমারেখা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে। সেখানকার দুর্ধর্ষ প্রকৃতির লোকেদের বিদ্রোহ দমন করা ছিল খুবই কষ্টসাধ্য। ইবনে সিনা এই বিদ্রোহ দমনে ব্যর্থ হন। এতে সুলতান তার ওপর বেশ বিরক্ত হন। আত্মসম্মানবোধ থেকেই ইবনে সিনা চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে পড়েন। এই যাত্রায় তার বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছিল। কখনও রাজার হালে থেকেছেন। কখনও আবার কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। তবে সকল কিছুর মধ্যেও তার মূল অবলম্বন ছিল চিকিৎসাবিজ্ঞান। এই বিজ্ঞানের বলেই তিনি সবসময় সম্মানিত হয়েছেন। এরই বদৌলতেই চরম দুর্দিনের মধ্যেও আনন্দের দেখা পেয়েছেন। ইবনে সিনা অনেক দেশ ভ্রমণ করেছেন। তার অভিজ্ঞতার ঝুলিও ছিল সমৃদ্ধ। তৎকালীন মুসলিম বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধ নগরী খোয়ারিজমে তিনি গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি পণ্ডিত আল বেরুনী (৯৭৩-১০৪৮) এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। আল বেরুনী'র মূল উৎসাহ ছিল ভারতবর্ষ। কিন্তু ইবনে সিনা (৯৮০-১০৩৭) কখনও ভারত অভিমুখে আসেননি। তিনি যাত্রা করেছিলেন পশ্চিম দিকে। তার মূল উৎসাহও ছিল পশ্চিমা বিশ্ব। এ কারণেই হয়তো তার চিকিৎসাবিজ্ঞান সংক্রান্ত বইগুলো প্রাচ্যের সীমানা ছাড়িয়ে পাশ্চাত্য জগতেও আপন অবস্থান তৈরি করে নিয়েছিল। আল বেরুনী (৯৭৩-১০৪৮) এর সাথে নিয়মিত তার চিঠি আদান-প্রদান হত।
খোয়ারিজম থেকে বিদায় নিয়ে ইবনে সিনা রাজধানী শহর গুরুগঞ্জে উপস্থিত হন। এই শহরে তার জীবনের বেশ কিছু সময় অতিবাহিত করেন। এখানে অবস্থানকালেই চিকিৎসা বিষয়ে তার অমর গ্রন্থ "কানুন ফি- খাল তিব্ব" রচনা করেন। এরপর যান পূর্ব পারস্যের অন্তর্গত "খোরাসান" শহরে। স্বাধীন জীবন যাপনে সর্বদা অভ্যস্ত ছিলেন ইবনে সিনা। কিন্তু এই সময় গজনীর সুলতান মাহমুদ (৯৭১-১০৩০) ইবনে সিনা'র গুণের কথা জানতে পেরে, তাকে দরবারে নিয়ে যাওয়ার জন্য দিকে দিকে দূত প্রেরণ করেন। সুলতান মাহমুদের ইচ্ছা ছিল তার জামাতা খোয়ারিজম অধিপতির দরবারকে তিনি জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের দ্বারা সুশোভিত করবেন। ইবনে সিনাকে তিনি চেয়েছিলেন সভাসদ হিসেবে। কিন্তু ইবনে সিনা এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জর্জন নামক স্থানে পালিয়ে যান। গজনী'র সুলতান মাহমুদ (৯৭১-১০৩০) এ খবর জানতে পেরে জর্জনের অধিপতিকে ফরমান পাঠান যেন, ইবনে সিনাকে হস্তান্তর করা হয়। যেভাবেই হোক; স্বেচ্ছায় আসতে না চাইলে বন্দী করতে হবে। কিন্তু ইবনে সিনা এবার জর্জন থেকেও পালিয়ে গিয়ে আবার নিরুদ্দেশ যাত্রা করেন। এবার তার যাত্রার দিক ছিল ইরানের দিকে।
ইরানে যাওয়ার পথে ইবনে সিনা তার সমসাময়িক মহাকবি ফেরদৌসী (৯৪০-১০২০) এর জন্মস্থান বিখ্যাত তুস নগরী পরিদর্শন করেছিলেন। এখান থেকে তিনি ইরানের সুপ্রাচীন শহর হামাদানে গমন করেন। ঐশ্বর্যশালী এবং ঐতিহাসিক এই নগরীটিকে ভালো লেগেছিল ইবনে সিনা'র। এখানে অনেকদিন ছিলেন তিনি। দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করে তিনি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন। বয়সও হয়েছিল অনেক। তাই তিনি মানসিক ও শারীরিক প্রশান্তি খুঁজছিলেন। হামাদানে তিনি এই প্রশান্তি খুঁজে পান। এখানে তিনি ধীর-স্থির মনে চিন্তা করার সময় সুযোগ লাভ করেন। হামাদানের সম্রাট তার থাকা-খাওয়া ও নিরাপদ চলাচলের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তিনি এখানে চিকিৎসা সেবার মাধ্যমে স্বাধীন জীবিকা যাপন করতেন। এর সাথে তিনি ধ্যান করতেন অধিবিদ্যা, ধর্মতত্ত্ব এবং দর্শনের মৌলিক বিষয়ে। এখানেই তিনি বিখ্যাত দার্শনিক গ্রন্থ "কিতাব আশ- শিফা" রচনা করেন। এই বইটি কবি ওমর খৈয়াম (১০৪৮-১১৩১) এর খুব প্রিয় ছিল। কথিত আছে, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এটি তিনি সাথে রেখেছিলেন। হামাদানে ইবনে সিনা অনেক কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। সারাদিন পরিশ্রমের পর রাতে তিনি অভিজাত ব্যক্তিবর্গের সাথে আমোদ-প্রমোদে লিপ্ত হতেন। সুবিশেষ দার্শনিক প্রজ্ঞার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও গম্ভীর মূর্তিতে বসে থাকা তার স্বভাবে ছিল না। তাই বলে কখনও আবার আমোদ-আহ্লাদে একেবারে মজে যেতেন না। নিজের ধীশক্তি সবসময় সক্রিয় রাখতে পারতেন। কখনোই বিস্মৃত হতেন না যে, তিনি একজন জ্ঞানপিপাসু এবং জ্ঞান চর্চাই তার মুখ্য কাজ।
ইবনে সিনা যুক্তিবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। ৫ খণ্ডের চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর "কানুন ফি- খাল তিব্ব" নামে বিশ্বকোষ রচনা করেন। এটি মুসলিম বিশ্বে ১৭ শতক এবং ইউরোপে ১৮ শতক পর্যন্ত প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসাবে ব্যবহৃত হত। এছাড়াও "আত-কিয়াত", কিতাব আল নাজাত" এবং "কিতাব আল ইশারাত" নামে তিনি চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর গ্রন্থ রচনা করেন। ইউনানী চিকিৎসা নিয়েও তিনি কাজ করেছেন। যা আজও তার থিউরি'র উপর নির্ভরশীল। ইউনানী ঔষধ চারটি মানসিক অবস্থার ধারণার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। (১) শ্লেষ্মা, (২) রক্ত, (৩) হলুদ পিত্ত, (৪) কালো পিত্ত। (১) শ্লেষ্মাঃ এক ধরনের পিচ্ছিল নিঃসরণ যা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের শ্বাসতন্ত্র, পৌষ্টিক তন্ত্র ইত্যাদি হতে নিঃসরিত হয়। যাকে ইংরেজি পরিভাষায় মিউকাস (Mucus) বলে।
হলুদ পিত্তঃ রস (ইংরেজি: Bile) এক প্রকার দেহাভ্যন্তরীণ ক্ষরণ যা তৈল বা স্নেহ জাতীয় খাদ্যের পরিপাকে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এর বর্ণ পীতাভ-সবুজ এবং স্বাদ তিক্ত।
এ চিকিৎসা পদ্ধতির উপর ভারতীয় ও চৈনিক প্রাচীন ঐতিহ্যগত চিকিৎসার প্রভাবও বিদ্যমান।
হামাদানের সুলতান অসুস্থ হলে ইবনে সিনা তার চিকিৎসা করেন। এতে সম্রাট আরোগ্য লাভ করেন। এই চিকিৎসায় খুশি হয়ে সম্রাট তাকে প্রধানমন্ত্রীর পদে নিয়োগ দেন। কিন্তু রাজনীতিতে তিনি বরাবরের মতোই ছিলেন অপরিপক্ব। তাই এই পদ-প্রাপ্তি তার জীবনে নতুন বিড়ম্বনার সৃষ্টি করে। তাছাড়া হামাদানের সেনা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা বিদেশী ইবনে সিনাকে সহ্য করতে পারছিল না। তাদের সাথে ইবনে সিনা'র বিরোধের সৃষ্টি হয়। সেনাধ্যক্ষ ইবনে সিনাকে গ্রেফতার করার জন্য সম্রাটের কাছে আবেদন জানাতে থাকে। সৈন্যবাহিনীর প্রধানের অনুরোধ উপেক্ষা করার সাধ্য সম্রাটের ছিল না। তাই তিনি ইবনে সিনাকে নির্বাসন দণ্ড দিয়ে অন্য এক স্থানে কারাবন্দী করে রাখেন। তা নাহলে শত্রুদের হাতে হয়তো তিনি মারা পড়তেন। শত্রুর পাশাপাশি ইবনে সিনার বন্ধুও ছিল অনেক। তাদের সহায়তায় ইবনে সিনা এই কারাজীবন থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষমও হয়েছিলেন। হামাদান থেকে পালিয়ে তিনি ইরানের অন্যতম নগরী ইস্পাহানের পথে পা বাড়ান।
কিছুদিন পর ইবনে সিনা ইরানের ইস্পাহান নগরীতে সাধুর ছদ্মবেশে প্রবেশ করেছিলেন। ইস্পাহানের সম্রাট সাধুর প্রকৃত পরিচয় জানতে পেরে, নিজ দরবারে নিয়ে আসেন। ইবনে সিনা'র স্থান হয় রাজসভায়। ইবনে সিনাকে আশ্রয় দিতে পেরে সম্রাট নিজেও সম্মানিত বোধ করেন। ইস্পাহানে বেশ কিছুকাল ইবনে সিনা শান্তিতে দিনাতিপাত করেন। হামাদানের কেউ তাকে এসময় বিরক্ত করত না। এখানে বসেই তিনি তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ "কিতাব আল ইশারাত" রচনা করেন। কিন্তু এখানেও বেশীদিন শান্তিতে থাকতে পারেননি ইবনে সিনা। অচিরেই হামাদান এবং ইস্পাহানের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে যায়। ইস্পাহানের সম্রাট হামাদানের বিরুদ্ধে অভিযান প্রস্তুত করেন। এ সময় সম্রাট ইবনে সিনাকে সাথে নেয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। চিকিৎসা সেবা প্রদানের কারণেই তাকে নেয়ার ব্যাপারে সম্রাট মনস্থির করেন। নিজে অসুস্থ থাকা সত্ত্বেও সম্রাটের অনুরোধ ইবনে সিনা প্রত্যাখ্যান করেতে পারেন নি। ইস্পাহানের সৈন্যবাহিনীর সাথে হামাদানের পথে রওয়ানা করেন। হামাদানের সাথে ইবনে সিনা'র অনেক স্মৃতি বিজড়িত ছিল। এখানে এসে তিনি আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। তার এই অসুখ আর সারে নি। হামাদানের যুদ্ধ শিবিরে অবস্থানকালে ইবনে সিনা ৪২৮ হিজরি মোতাবেক ১০৩৭ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
বিভাগ : ইসলামী জীবন
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
রাজপথে পরিকল্পিত নৈরাজ্য
বড়কে মান্য করুন, বৃদ্ধকে সম্মান করুন-১
সম্রাট জাহাঙ্গীর : রূপান্তরের বাদশাহী-৩
বেগম খালেদা জিয়াকে পেয়ে সেনাকুঞ্জ গর্বিত : প্রধান উপদেষ্টা
এক যুগ পর সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়া : যার হাসিতে হেসে উঠেছে বাংলাদেশ
নতুন জেনারেশনের চিন্তা-চেতনা সবাইকে বুঝতে হবে : এ এম এম বাহাউদ্দীন
নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন : প্রধান নির্বাচন কমিশনার হলেন সাবেক সচিব এ এম এম নাসির উদ্দীন
পররাষ্ট্রসচিব পর্যায়ের বৈঠক : শেখ হাসিনাকে ফেরানো নিয়ে আলোচনার সুযোগ রয়েছে
সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়াকে সম্মান জানানোয় গোটা জাতি আনন্দিত : মির্জা ফখরুল
পররাষ্ট্র দপ্তরের নিয়মিত ব্রিফিংয়ে মিলার : বাংলাদেশে মানবাধিকার বহাল থাকবে এটিই যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিশেষ পরামর্শক নিয়োগ পেলেন টবি ক্যাডম্যান
হাইকোর্টের অভিমত : কুরআন অবমাননা ও মহানবীকে কট‚ক্তির শাস্তি মৃত্যুদন্ডের বিধান করতে পারে সংসদ
জ্বালানি তেলের দাম কমানোর সুযোগ আছে : সিপিডি
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল : খুনি হাসিনার পক্ষে লড়বেন জেড আই খান পান্না
বিগত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে যারা অপরাধ করেছেন তাদের শাস্তির সুপারিশ : সম্পাদক ও সিনিয়র সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময়
ডয়চে ভেলের প্রতিবেদন : ট্রাম্প ফেরায় বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা
এডিস মশার ভয়াবহ রূপ : একদিনে ডেঙ্গুতে আরো ৯ জনের মৃত্যু
ব্যবসায়ীরা হতাশ : বাংলাদেশিদের ভিসা না দিয়ে উল্টো বিপাকে ভারত!
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬ -এ পদার্পণ : শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি
ফ্রিল্যান্সিং প্রশিক্ষণ প্রকল্প, ব্যয় ২৯৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা