কবিতার বাঁক বদল এবং নতুন ধারা
২৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৯ এএম | আপডেট: ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০৯ এএম
(পূর্ব প্রকাশের পর)
কিন্তু কালের বিবর্তনে নতুন বাঁকে রবীন্দ্রনাথ এলেন আকাশছোঁয়া প্রতিভার দীপ্তি নিয়ে। তাঁর মানসিকতা মার্কসীয়- ফ্রয়েডীয় ভাবনার অনুসৃতি যা শিনতা ও দেহগত কামনা সম্পৃক্ত প্রেমের এক গভীর সমুদ্র। রবীন্দ্রনাথের শব্দ গঠন, ভাষাশৈলী, বৈচিত্র চিত্রকল্পের অনুভূতি প্রকাশের বিষয় ছিল অতুলনীয়। তাঁর কবিতা বৈশিষ্ট্য পরিশীলন এবং পরিমিতিবোধ যা বাংলা সাহিত্য তেমন করে কারোর মাঝে দেখতে পায়নি। আধ্যাতিকতা, পার্থিব-অপার্থিব জীবনের অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন কলমের খোঁচায়। বলা হয় বাংলা ভাষা যে এত মিষ্ট এবং স্নিগ্ধ তা তিনিই আমাদের দেখিয়েছেন।
‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই... ছোটো সে তরী
আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি।’
(সোনার তরী/রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
মাইকেল, বঙ্কিমদের মধ্যে আধুনিকতা ছিল না কেননা আধুনিকতা তখনো বাংলা কবিতা স্পর্শ করেনি। মূলত রবীন্দ্রযুগ হচ্ছে আধুনিকতার প্রস্তুতি যুগ যা আগেও বলেছি। এবার এলো নবযুগ যা নজরুলযুগ। নজরুল তার স্বকীয়তায় এতটাই উচ্ছল ছিল যে মানসিক ব্যক্তি সংকট উষ্ণতাকে অতিক্রম করে নতুন কাব্য দর্শন সৃষ্টি করেছেন। দিগন্ত কাঁপানো অবসাদ ও জড়তা ঘুচিয়ে উল্কার মতো আবির্ভূত হন কাব্য, প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাসে। বাঁধভাঙা জোয়ার বইয়ে দেন সাহিত্যের ডেরায়। নারী-পুরুষের বৈষম্য বিরোধী কবিতা রচনা করেন...
‘বিশ্বে যা কিছু মহান চির সৃষ্টি কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর ’
(নারী/কাজী নজরুল ইসলাম)
হিন্দু-মুসলিম মিথ-ইতিহাসকে তুলে ধরলেন তার কবিতায়। পাশাপাশি আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দের ব্যবহার ঘটান। তাই তার কবিতা হয়ে ওঠে বলিষ্ঠ এবং সমৃদ্ধ যাকে বলে সাবলাইম। এ যেন গণতান্ত্রিক ও গণমুখী ভাবনার নির্যাস। আধুনিকতার পূর্ণ সোপান নজরুল যুগে ঘটে। নজরুলের প্রয়ানের পর, কল্লোল যুগের শুরু বা তিরিশের কবিরা স্বতন্ত্র ধ্যান-ধারণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কবিতা লিখেছেন। আধুনিকতার জোয়ারে স্রষ্টার প্রতি অবিশ্বাস, অস্থিরতা, হতাশা, নৈরাশ্য, নৈঃসঙ্গ প্রভৃতি বিষয় উঠে আসে। জীবনানন্দ দাশ হয়ে ওঠেন বাংলা কবিতার সম্রাট। তিনি ঈশ্বর ভাবনায় নিরব থেকে সম্পূর্ণরূপে ইহলৌকিক ও ভিন্ন মাত্রায় চিত্রকল্প ও উপমায় কবিতা লিখেন।
‘লক্ষ্মীপেঁচা হিজলের ফাঁক দিয়ে
বাবলার আঁধার গলিতে নেমে আসে; ’
(অঘ্রাণের প্রান্তরে/জীবনানন্দ দাশ)।
সাহিত্যে মোড় ঘুরানো কবিরা হলেন মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান, আল-মাহমুদ প্রভৃতি। বাঁক সৃষ্টির পেছনে কাজ করে কবির শক্তি ও কল্পনা প্রতিভার দূরদৃষ্টি। সৃজনক্ষমতা, মৌলিকত্ব ও বাস্তব নিয়োগ প্রক্রিয়া এভাবেই নতুন দিগন্তের কবিতা পাঠকদের গ্রহণযোগ্য করে তোলে।
সম্প্রতি বাংলা কবিতায় ‘নতুন ধারার কবিতা’ চর্চা চলছে বেশ জোরেশোরে। নব্বই দশকের স্বতন্ত্র স্বরের কবি ফাহিম ফিরোজ এ ধারার প্রবক্তা বলা যায়। তাঁর হাত ধরেই শুরু হওয়া এ ধারা যদিও এখনো সেভাবে যথেষ্ট পুষ্ট হয়ে ওঠেনি, তথাপিও বলা যায় একদল নতুন প্রজন্মের কবি এবং প্রবীণ অনেক কবিও তাঁদের কবিতায় নতুনত্ব আনার জন্য ফাহমীয় ঢঙ্গের আংশিক চেষ্টা করলেও কবি ফাহিম ফিরোজই প্রথম এ কাব্যধারার একটি আঙ্গিক এবং গঠনতান্ত্রিক ইস্তেহার সূধী সমাজের সামনে এনেছেন। ইতিমধ্যে নতুনধারার কবিতার ইশতেহারও ঘোষিত হয়েছে, যদিও মুদ্রিত আকারে নয়। সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত সেসব ইশতেহার রয়েছে নতুনধারার ফেসবুক পেজে। বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হওয়ায় মূলত এ প্রসঙ্গে আমার আজকের অবতারণা।
কবি ও সাহিত্য সম্পাদক ফাহিম ফিরোজের ঘোষিত ইশতেহার অনুযায়ী, তিনি বলেন, হাজার বছরের বাংলা কবিতায় কয়েকটি গ্যাপ রয়েছে। আত্মীয় ও সম্পর্ক বাচক শব্দ এতে নেই। অথচ নাটক, গল্প, উপন্যাসে রয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, কবিতায় নেই কেন? নতুনধারা এসব যোগ করতে চায়। সম্পর্ক ও আত্মীয় কিন্তু পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রেখেছে। অথচ এ শব্দগুলোই আধুনিক কবিতায় অনুপস্থিত। তিনি তাঁর ইস্তেহারে বলেন, নতুনধারার কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হবে প্রমিত ও আঞ্চলিক ভাষার শৈল্পিক মিলন এবং সম্পর্ক ও আত্মীয়বাচক শব্দের প্রয়োগ। এছাড়া নতুন শব্দ সৃষ্টিতে নতুনধারা বেশ জোর দেয়। কারণ, যত বেশি নতুন শব্দ সৃষ্টি হবে, তত বেশি আমাদের ভাষা সমৃদ্ধ হবে। হাতে গোনা কিছু কবি নতুন শব্দ তৈরি করেছেন অতীতে। যা হিসাবের বাইরে, বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র বলা যায়। নতুনধারা এজন্য এর ওপর বেশি জোর দিচ্ছে।
প্রমিতের সাথে লোক ভাষা যুক্ত হলেই তা আধুনিকতা থেকে পৃথক হয়ে যাবে। তিনি বলেন দুয়েকটা মাত্র লোকশব্দ এক্ষেত্রে যথেষ্ট নয়। তাঁর ইস্তেহার মতে এটি হলো পঁচাত্তর ভাগ প্রমিতের সাথে পঁচিশ ভাগ লোকশব্দ অথবা সমহারে প্রয়োগ করতে হবে নতুনধারার কবিতায়। পুঁজি ও অপুঁজির মধ্যে যে বিরোধ রয়েছে নতুনধারা সেটা ভেঙে সহাবস্থান নিশ্চিত করতে চায় বলে ইস্তেহারে উচ্চারিত হয়েছে। সংঘাত, সংঘর্ষ কোনো শান্তি বয়ে আনে না, সেসব বিপ্লবীদের কাজ, নতুনধারা বিপ্লবী নয়, তবে নীরব বিপ্লবের একটা ব্যাপার রয়েছে এর মধ্যে বলে তিনি তাঁর ইস্তেহারে তুলে ধরেন। নতুনধারার অস্ত্রটা হবে ভাষার। ভাষা থেকেই আঘাত আসবে পুঁজির অহমের ওপর। তথাকথিত শিক্ষিত ভদ্রজনদের ভাষার সঙ্গে কথিত অশিক্ষিত শ্রেণি তথা মাটির ভাষার মিলন ঘটিয়ে একটি কার্যকর ‘মানুষ সমাজ’ তৈরি করতে চায় নতুনধারা। (চলবে)
বিভাগ : সাহিত্য
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
শাহজাহান ওমরকে জুতা ও ডিম নিক্ষেপ
জীবনে উত্তম কর্ম, জ্ঞান ও উন্নত চরিত্র অর্জন করতে হলে সফল ব্যক্তিদের সান্নিধ্য অবলম্বন আবশ্যক
নড়াইলে ছাত্র-জনতার ওপর হামলার মামলায় জেলা আ.লীগ সভাপতি কারাগারে
নোবিপ্রবির সঙ্গে তুরস্কের আনাদোলু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউশনাল এগ্রিমেন্ট স্বাক্ষর
শিক্ষার্থীদের মতের ভিত্তিতেই ছাত্রদলের রাজনীতি চলবে : নাছির
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় লাইনচ্যুত ট্রেন উদ্ধার, চলাচল স্বাভাবিক
না.গঞ্জে ২৪ ঘন্টায় ৪৪ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত
খরচ চালাতে লকার রুম, দরজা বিক্রি করছে রিয়াল মাদ্রিদ
যুক্তরাষ্ট্রে গৌতম আদানির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি
ক্ষেতের মধ্যে রেললাইন, জীবিকা হারানোর মুখে কাশ্মীরের আপেল চাষিরা
সাতক্ষীরায় সাফজয়ী তিন ফুটবলারের গণসংবর্ধনা
মার্কিনের পর এবার ব্রিটিশ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে রাশিয়ায় হামলা ইউক্রেনের
আহমেদাবাদ শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে ৩৫ ইরানি ছবি
কিউই সিরিজের কথা ভুলে অস্ট্রেলিয়ায় হ্যাটট্রিকের অভিযানে ভারত
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপের অনুমোদন দিয়েছে পাকিস্তান
সেনাকুঞ্জে হাস্যোজ্জ্বল খালেদা জিয়া, ড. ইউনূসের সঙ্গে কুশল বিনিময়
সউদী আরবের ফ্যাশন শো নিয়ে যেসব কারণে ক্ষুব্ধ ইসলামী পণ্ডিতরা
সশস্ত্র বাহিনী দিবসে খালেদা জিয়াকে আনতে পেরে আমরা গর্বিত: প্রধান উপদেষ্টা
ফ্যাসিস্ট হাসিনা সাংবাদিকদের কণ্ঠরোধ করেছিল: আ ন ম বজলুর রশীদ
বাংলাদেশে সরাসরি ফ্লাইট চালু করতে চায় পাকিস্তান