৫০ গ্রামের লাখো মানুষের দুঃখ বালু নদী
২২ মার্চ ২০২৩, ১১:৫১ পিএম | আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৪৭ পিএম
রাজধানী ঢাকার পাশ দিয়ে যে সব নদী বয়ে গেছে বয়ে গেছে বালু তার মধ্যে একটি। ভয়াবহ দূষণে এক সময়ের খর¯্রােতা এ নদী এখন মৃত। দূষণে এ নদীর পানি দুর্গন্ধময় এবং আলকাতরার মতো কাল রঙ ধারণ করেছে। বালু নদী মানববর্জ্য ও শিল্পবর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এক সময় যে নদী মাছে ভরপুর ছিল, সেখানে এখন শুধু বিষাক্ত কালো পানির উৎকট গন্ধ। দূষণের ফলে এই নদীতীরের মানুষের দুঃখ-কষ্টের শেষ নেই। জীবিকা নির্বাহের তাগিদে খেটে খাওয়া মানুষ, শিশু, বৃদ্ধ, নারী-পুরুষ সকলেই ভোগান্তি পোহাচ্ছেন। দুর্গন্ধে নাক ভারী হয়ে এলেও করার কিছুই নেই। দুর্গন্ধ মেনে নিয়েই জীবনযুদ্ধ চালাতে হচ্ছে নদী পাড়ের বাসিন্দাদের।
পারা-পারের যাত্রীসাধারণ ও বুড়িগঙ্গা তীরের জনসাধারণের।
এক সময় বালুনদীতে ছিল স্বচ্ছ টলটলে পানি। মৃদু ঢেউয়ের তালে চলত পালতোলা নৌকা। দুই তীরের মানুষ নদীতে মাছ ধরেছে। জলজ প্রাণী বসবাস করেছে স্বাচ্ছন্দ্যে। সেই প্রাণোচ্ছ্বল নদী অত্যাচারে-অনাচারে, দূষণে-বিষণে এখন মৃত্যুর মুখে।
নদীর দূষিত পানিতে মশার বংশবিস্তার ঘটছে। বেড়েছে মশার উপদ্রব। দূষিত পানির কারণে মাটির উর্ব্বরতা কমছে। এতে কমে গেছে ফসলের উৎপাদন। বেড়েছে রোগবালাই। বিপন্ন হয়ে পড়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশ। সব মিলিয়ে বিপর্যস্ত নদী পাড়ের মানুষের জীবন। রাজধানী ঢাকার পয়োবর্জ্য ও শিল্পকারখানার বর্জ্য পড়ে এ নদীর পানি এখন বিষাক্ত। রাজধানী ঢাকার খিঁলগাও, ডেমরা, বেড়াইদ, গুলশান ও রূপগঞ্জের এসব এলাকার প্রায় ৫০ গ্রামের কয়েক লাখ মানুষের কাছে বালু নদী এখন এক দু:খের নাম।
রূপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আইভি ফেরদৌস প্রভা বলেন, নদীর কেমিক্যাল মিশ্রিত দূষিত পানি ব্যবহারে মানব দেহে চর্মরোগসহ মরণব্যাধী ক্যান্সার দেখা দিতে পারে। তাই এখনও সময় আছে নদী রক্ষায় সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। নদীকে দূষণ মুক্ত করতে সবাইকে সচেতন হতে হবে।
শীতলক্ষ্যার মোহনা ডেমরা থেকে বালু নদীর শুরু। ডেমরা এলাকা থেকে বালু নদী টঙ্গীতে গিয়ে তুরাগে মিলেছে। বালু নদী থেকে দুটো ছোট নদী নড়াই ও দেবধোলাই ঢুকেছে ঢাকার রামপুরায়। এ দুটি ছোট নদী দিয়ে ঢাকার মিরপুর, পল্লবী, উত্তরা, গুলশান, তেঁজগাও, সবুজবাগ, মতিঝিলসহ বিশাল এলাকার শিল্প ও পয়োনালার বর্জ্য এসে রামপুরা ব্রিজের নিচ দিয়ে বালু নদী পড়ছে। এ ছাড়া ডেমরা এলাকার শত শত শিল্প কারখানার বিষাক্ত কেমিক্যাল অবাধে নদীতে পড়ছে। বছরের পর বছর আবর্জনা পড়তে পড়তে নদীটি যে বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। ঢাকা ওয়াসার থথ্যমতে, বালু নদীতে ঢাকা থেকে দৈনিক ১০ লাখ ঘনলিটার পয়োবর্জ্য, ৫৬ কোটি ঘনলিটার বর্জ্য মেশানো পানি, বিভিন্ন কলকারখানার ক্যামিক্যাল মিশ্রিত ৪৫০ ঘনলিটার বিষাক্ত তরল বর্জ্য প্রতিদিন এ নদী পড়ছে। এছাড়া বালু, নড়াই ও দেবধোলাইয়ের উপড় রয়েছে সহ¯্রাধিক খোলা পায়খানা। এসব থেকে আরো ৫৬০ ঘনফুট পয়োবর্জ্য নদীর পানিতে মিশছে।
সরেজমিনে বালু নদীর তীরবর্তী বালুরপাড়, দাসেরকান্দি, কামশাইর, চানখালী, ধীৎপুর, পশ্চিমগাঁও, চনপাড়া, দক্ষিণপাড়া, নয়ামাটিসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, নদীর বিষাক্ত পঁচা পানিতে এসব গ্রামের বৌ-ঝিয়েরা থালা-বাসন পরিষ্কার করছে। পুরুষরা এ পানিতে গরু গোসল করাচ্ছে। এমনকি অনেকে এ পঁচা পানিতেই গোসল করছে।
এলাকাগুলো ঘুরে দেখা যায়, নদীর পূর্বপাড়ে রূপগঞ্জ। আর পশ্চিমপাড়ে ঢাকার খিলগাও, ডেমরা, বেরাইদ, ডুমনী ও নাসিরাবাদ ইউনিয়ন। নদীর উভয় তীরজুড়ে ফসলের ক্ষেত। এক সময় এসব জমিতে অধিক ফসল ফলতো। দূষিত পঁচা পানির কারণে এখন ফলন অর্ধেকও হয়না বলে জানালেন অনেক কৃষক। কথা হয় বর্গাচাষি আক্কাস আলীর সঙ্গে। তিনি বলেন, আগে বিঘায় ধান পাইতাম ৪০ মণ। অহন ১৭ কি ১৮ মণ। কৃষকরা জানায়, বিকল্প উৎস না থাকায় জমিতে তারা বালু নদের পঁচা পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছে। রূপগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফাতেহা নুর বলেন, নদীর দূষিত পানিতে প্রচুর কার্বন-ডাই অক্সাইড থাকার ফলে চারাগাছের গোড়া পচে যায়। ফলে ফসল উৎপাদন কম হয়। পানি দূষণ রোধ করা না গেলে একসময় এসব এলাকায় কৃষিতে বিপর্যয় নেমে আসবে। স্থানীয় অনেকে বলেছেন, পরিবেশ বিপর্যয় ও কৃষি বিপর্যয়ের পাশাপাশি মশার উপদ্রবও অনেক বেড়েছে। মশা নিধনে নেই সরকারি কোন উদ্যোগ।
নদীর তীরবর্তী দাসেরকান্দি, চরচনপাড়া ও ফকিরখালির জেলে পল্লী ঘুরে জেলেদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দূষিত পঁচা পানির কারণে নদীতে মাছ না থাকায় দেড় শতাধিক জেলে পরিবার এখন নিদারুণ কষ্টে দিনাতিপাত করছে। বছরের ছয় মাস তাদের কাটাতে হয় অর্ধহারে-অনাহারে। তাই তাদের পরবর্তী প্রজন্ম পেশা বদলাচ্ছে। পঁচা পানি তাদের জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে। কায়েতপাড়ার জেলে পল্লীর ষাটোর্ধ্ব নরেশ চন্দ্র দাস বলেন, পঁচা দুর্গন্ধময় পানি আমগো শেষ কইরা দিছে বাজান। গাঙো মাছ কইত্তে থাকবো কন? পানি তো বিষ অইয়া গেছেগা। মেছের ( ম্যাচ ) কাঠি ধরাইয়া পানিত ফালাইলে আগুন ধইরা যায়গা।
বালু নদীর দূষণ রোধ করে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে এলাকাবাসী দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে আসছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। প্রতিশ্রুতি আর আশ্বাসের বাক্সে বন্দি রয়ে আছে। ওয়াসা সূত্র জানায়, দূষণ রোধে বালু, নড়াই ও দেবধোলাই নদীর দুই তীরের ৫০ গ্রাম বাঁচাতে ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিশাল শোধনাগার নির্মাণ করা হচ্ছে।
বালু-শীতলক্ষ্যা বাঁচাও আন্দোলনের নেতা, কলামিষ্ট ও গবেষক লায়ন মীর আব্দুল আলীম বলেন, ঢাকাকে যেমন বাঁচানো জরুরি, ঠিক তেমনি ৫০ গ্রামের লাখো মানুষকে বাঁচানোটা জরুরি। দূষিত পানির কারণে শুধু মানুষই নয়, পরিবেশ, কৃষি এমনকি জীববৈচিত্রের বিপর্যয় ঘটছে। জরুরি এ নদীর দূষণ মুক্ত করা প্রয়োজন। তা না হলে প্রকৃতি ও পরিবেশে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
সার্চ কমিটি করে গ্রহণযোগ্যদের স্থানীয় সরকারে প্রশাসক নিয়োগ করার দাবি
পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের শীর্ষ নেতাদের বৈঠক
অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের অভিযোগে ভারতে ১৬ বাংলাদেশি গ্রেপ্তার
গণহত্যার পূর্ণাঙ্গ তথ্য জাতিসংঘকে দিতে নাগরিক কমিটির দাবি
ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় অন্তত ৮ ফিলিস্তিনি নিহত, পশ্চিম তীরে সংঘর্ষ অব্যাহত
এনসিটিবি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ছুটি বাতিল
বড়দিনে ভারতকে ‘দুঃসংবাদ’ শোনালো অস্ট্রেলিয়া
প্রেমিকের মৃত্যুর খবরে প্রাণ দিলেন প্রেমিকা
ব্রাজিলে সেতু ধস: নিহত ৪, নিখোঁজ ১০
যুদ্ধকালীন ইউক্রেনের ডাকটিকিট, সাহসিকতার ভাষায় দেশপ্রেম ও প্রতিবাদের প্রতীক
বিচ্ছেদ হতে না হতেই আবারও একসাথে তারকা জুটি বেন-লোপেজ
হাইতির হাসপাতালে বন্দুকধারীদের হামলায় নিহত তিনজন
ছাত্রদলের কমিটি : ঢাকা কলেজের সামনে ৭টি ককটেল বিস্ফোরণ
আফগানিস্তানে পাকিস্তানের বিমান হামলা, নারী-শিশুসহ নিহত ১৫
গুম হন কেন্দ্রীয় সহ-সমন্বয়ক খালেদ হাসান
বিদেশি ভুল তথ্য ঠেকানোর মার্কিন সংস্থার কার্যক্রম বন্ধ
চাঁদপুরে জাহাজে সেভেন মার্ডারের ঘটনায় মামলা
গাজায় বড়দিনে শান্তির জন্য প্রার্থনা, নিহতের সংখ্যা ছাড়লো ৪৫ হাজার
স্ত্রী-সন্তানসহ শাহরিয়ার আলমের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা
মোজাম্বিকে বাংলাদেশিদের ৩শ' ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান লুটপাট ও ভাঙচুর