রংপুরে ডিসি ‘স্যার’ বগুড়ায় বিচারকের ‘পা’
২৫ মার্চ ২০২৩, ১০:২৮ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৩৩ পিএম
দেশের উত্তরাঞ্চলের দু’টি ঘটনা সমাজকে ঝাঁকুনি দিয়েছে। দুই ঘটনায় পরিস্কার এ দেশের মানুষ এখনো উপনিবেশিক শাসনামলের কব্জায় রয়ে গেছে। প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দেশের জনগণকে তাদের প্রজাই মনে করেন। অন্যদিকে এ দেশের লড়াকু মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছে তারা কাউকে ছেড়ে দেয়ার পাত্র নন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই দুই ঘটনা নিয়ে কার্যত তোলপাড় চলছে। দুই ঘটনার একটি হলো বগুড়া জেলা ও দায়রা জজ আদালত-৩-এর বিচারক রুবাইয়া ইয়াসমিনের ক্ষমতা প্রয়োগ; অন্যটি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুকের রংপুরের জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীনকে ‘স্যার’ বলতে বাধ্য করার ঘটনা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকেই পরামর্শ দিয়েছেন ডিসিদের এখন থেকে ‘জাহাপনা’ এবং সরকারি আমলাদের ‘হুজুরে আলা’ সম্বোধন করার আইন সংসদে পাস করা হোক। অবশ্য জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গতকাল বলেছেন, ডিসিদের ‘স্যার’ বা ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন করতে হবে এমন কথা নেই।
জানা যায়, ২২ মার্চ রংপুরের জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীনের কাছে একটি সামাজিক কাজে যান অধ্যাপক উমর ফারুক। আলোচনা শেষে বলেছেন, আপা চলে যাচ্ছি। স্যার না বলে আপা বলার অপরাধে (!) তাকে হেনস্তা করা হয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে তাৎক্ষণিকভাবে মেয়েকে নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন অধ্যাপক উমর ফারুক। হাতে লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সামনে অবস্থান গ্রহণ করেন অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুক। ওই সময় তার মেয়েও সঙ্গে ছিল। প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘রংপুরের জেলা প্রশাসককে স্যার ডাকতে বাধ্য করায় অবস্থান কর্মসূচি।’ এই ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়লে আলোচনা-সমালোচনার শুরু হয়। অতপর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক এবং রংপুরের গণ্যমান্য ব্যাক্তিরা ডিসি অফিসের সামনে এসে উমর ফারুকের কর্মসূচিতে একাত্মতা ঘোষণা করেন। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীন কার্যালয় থেকে নেমে এসে দুঃখপ্রকাশ করলে বিষয়টির সেখানে ইতি ঘটে। এ ঘটনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যপক সমালোচনার ঝড় উঠে। বিশিষ্টজনেরা বলছেন, একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষককে সামান্য ডিসিকে ‘স্যার’ সম্বোধন করতে হবে এটা উপনিবেশিক শাসনের নামান্তর। এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি শরিফুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান মন্ডল আসাদ স্বাক্ষরিত বিবৃতি রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক উমর ফারুককে জনসম্মুখে রংপুরের জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীন ‘স্যার’ সম্বোধন করাতে বাধ্য করার ঘটনায় রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি অত্যন্ত ব্যথিত, বিব্রত ওক্ষুব্ধ। বিষয়টি গোটা শিক্ষক সমাজকে মর্মাহত করেছে। অধ্যাপক উমর ফারুকের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক চিত্রলেখা নাজনীন বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে ওই দিনই আমি দুঃখপ্রকাশ করেছি। সেদিনই ঘটনাটি মীমাংসা হয়ে গেছে। এখন আবার নতুন করে বিষয়টি কেন সামনে আনা হচ্ছে বুঝতেছি না। আমি তো ওই শিক্ষককে স্যার ডাকতে বাধ্য করিনি।
বগুড়ায় এক বিচারকের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীর অভিভাবককে পা ধরতে বাধ্য করার অভিযোগে দফায় দফায় সড়ক অবরোধ করেন বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। পরে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস পেয়ে ঘরে ফেরে আন্দোলনকারীরা। ইতোমধ্যেই অভিযুক্ত বগুড়া জেলা ও দায়রা জজ আদালত-৩-এর বিচারক রুবাইয়া ইয়াসমিনের বিচারিক ক্ষমতা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে।
বগুড়া সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেন বিদ্যালয়ের নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেক শিক্ষার্থী পর্যায়ক্রমে শ্রেণিকক্ষ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে থাকে। গত সোমবার এক শিক্ষার্থীর শ্রেণিকক্ষ ঝাড়ু দেয়ার কথা থাকলেও নিজেকে বিচারকের মেয়ে পরিচয় দিয়ে সে শ্রেণিকক্ষ ঝাড়ু দিতে অস্বীকৃতি জানায়। এ নিয়ে তার অপর সহপাঠীদের সঙ্গে বাগ্বিত-া হয়। বিচারকের ওই মেয়ে অন্যান্য ছাত্রীদের নিয়ে ফেসবুকে কটূক্তি করেছে। তারা জানান, নিজে বিচারকের মেয়ে বলে সে ঝাড়ু দিতে পারবে না, আর আমরা নাকি বস্তির মেয়ে। এই ধরনের কথা সহপাঠীদের কী করে বলতে পারে। আর স্কুল পরিষ্কার করাটা তো আমাদের এখানে নিয়ম। শুধু আমাদের ক্লাসে নয় সব ক্লাসের ছাত্রীরাই এ কাজ করে।
এ নিয়ে বিচারক রুবাইয়া ইয়াসমিন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক রাবেয়া খাতুনকে গত মঙ্গলবার অভিভাবকদের ডাকতে বলেন। পরে প্রধান শিক্ষকের ডাকে অভিভাবকসহ ওই ৪ শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে আসে। ওই সময় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে জেলে পাঠানোর হুমকি দেন বিচারক রুবাইয়া ইয়াসমিন। এ সময় দুই অভিভাবককে ওই বিচারকের পা ধরে ক্ষমা চাইয়ে নেয়া হয়। এর প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে বগুড়া জেলা প্রশাসক ও বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সাইফুল ইসলাম ঘটনাস্থলে হাজির হয়ে শিক্ষার্থীদের সড়ক থেকে স্কুলের অডিটোরিয়ামে নিয়ে আসেন। প্রায় দেড় ঘণ্টা আলোচনার পর শিক্ষার্থীরা তার আশ্বাসে বাড়ি ফেরে। তিনি বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং বগুড়া জেলা ও দায়রা জজ স্যারকে বিষয়টি জানানো হয়েছে। তারা বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছেন। এছাড়া স্কুলে কোনো শিক্ষক বা প্রধান শিক্ষক দায়িত্বে অবহেলা করেছেন কি-না তা তদন্ত করতে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসককে (শিক্ষা ও আইসিটি) প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হবে। অতপর ওই বিচারকের বিচারিক ক্ষমতা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
ছোট্ট এই দু’টি ঘটনা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল এ দেশের মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করে শুধু দেশ স্বাধীন করেনি; প্রতিবাদ করতেও জানে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, ব্লগ, টুইটার এবং ইউটিউবে এই দুই ঘটনা নিয়ে এখনো বিতর্ক চলছে। কেউ কেউ পরামর্শ দিয়েছেন ডিসিদের এখন থেকে ‘জাঁহাপনা’ সম্বোধন করা হোক। কেউ লিখেছেন ‘সরকারি কর্মকর্তাদের জুজুরে আজম’ সম্বোধনের আইন পাস করা হোক। তবে দু’টি ঘটনা জানানা দিয়েছে গত কয়েক বছরে দেশে সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মানসিকতা কোন পর্যায়ে চলে গেছে।
ঘটনা এতোদূর গড়িয়েছে যে, গতকাল শনিবার কথা হয় জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন গণমাধ্যমকে বলেছেন, সরকারি কর্মচারীরা জনগণের সেবক। তাঁদের স্যার বা ম্যাডাম ডাকার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। ভদ্রতার খাতিরে অনেকে স্যার বা ম্যাডাম ডাকেন। কিন্তু এটি ডাকা বাধ্যতামূলক কিছু নয়। কেউ যদি আপা বা ভাই ডাকেন, তাতে দোষের কিছু নেই। এতে মাইন্ড করারও কিছুই নেই। সরকারি চাকরিজীবীরা জনগণের সেবক এই চিন্তা থেকেই কাজ করতে হবে। এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের কথা মনে করিয়ে দেন। যেখানে বলা হয়েছে ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে।’ ##
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী নদীতে নিখোঁজ দুই কিশোরের মরদেহ উদ্বার
সরকারকে ব্যর্থ করার ষড়যন্ত্রে জড়িতদের বিন্দু পরিমাণ ছাড় নয়: আসিফ মাহমুদ
ভারতে শঙ্করাচার্যের সাথে সাক্ষাৎ করে হস্তক্ষেপ চাইলেন একদল বাংলাদেশি হিন্দু
অবশেষে সচিবালয়ে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে
হাসিনাকে ভারত কি ফেরত পাঠাবে, আলজাজিরার প্রতিবেদন কি বলছে
সচিবালয়ে সেনাবাহিনী-বিজিবি মোতায়েন
কানু দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করছে, দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবি
বাংলাদেশ থেকে নথি না আসাতেই জামিন পিকে হালদারের?
সময় টিভির সাংবাদিক বরখাস্ত: এএফপির প্রতিবেদন নিয়ে যা বললেন হাসনাত
আগুনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আট ও নয়তলা
লক্ষ্মীপুরে পুলিশের কাছ থেকে আসামি ছিনিয়ে নিলো স্থানীয়রা
গাজীপুরে ছাত্রলীগ নেতা মাসুদ গ্রেফতার
সচিবালয়ের আগুন এখনও নিয়ন্ত্রণে আসেনি, কাজ করছে ফায়ার সার্ভিস
ফ্যাসিবাদের সময় উত্তরবঙ্গে বৈষম্য করা হয়েছে: নীলফামারীতে উপদেষ্টা আসিফ
সচিবালয়ে আগুন নেভাতে গিয়ে ট্রাকচাপায় নিহত ফায়ার ফাইটার সোহানুর
সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনে আগুন, নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের ২০ ইউনিট
গণমাধ্যমে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রচারের ওপর গুরুত্বারোপ করলেন উপদেষ্টা
বগুড়ার ধুনট পল্লীতে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে ব্যবসায়ীর ৩৫ হাজার টাকা ছিনতাই
দীর্ঘ ১৩ বছর পর দেশে ফিরছেন কায়কোবাদ
সিদ্দিরগঞ্জে নির্মাণাধীন ভবনের ছাদ থেকে পড়ে বিদ্যুতায়িত, দুই শ্রমিকের মৃত্যু