আল্লাহর তরফে জেয়াফত সাহরি

Daily Inqilab ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

০৫ এপ্রিল ২০২৩, ১১:৩৭ পিএম | আপডেট: ০১ মে ২০২৩, ১২:০৭ এএম

ধরুন, কোনো কারণে রাতে উপোষ ঘুমোতে হয়েছে। তখন পেটে ক্ষিধা মোচড় দিলেও শেষ রাতে উঠে খেতে চাইবেন না। বলবেন, সকাল হোক, নাশতায় রাতেরটা পুষিয়ে নেব। কারণ, শেষ রাতে ঘুুমের মজাটা খাবারের মজার চেয়ে বেশি।

সাধারণত আমরা তিন বেলা খাবার খাই। দুপুর ও রাতের খাবার ভারী হয়। সকালের নাশতা হয় হালকা। সারারাত খাওয়া-দাওয়া বন্ধ থাকে, এরপরও সকালের নাশতা ভারী করার কথা কেউ বলে না। এই নিয়ম পৃথিবীর সব দেশে।

শেষ রাতে খাবার গ্রহণের রেওয়াজ মানব সভ্যতার কোনো অধ্যায়ে ছিল না। মুসলিম সমাজেও রমযান বাদে কখনো শেষ রাতে উঠে কেউ খাওয়া-দাওয়া করে না। এই যে রমযানে নিয়ম ভঙ্গ করে শেষ রাতের সেহরি খাওয়া, এই ব্যতিক্রম নিয়ে কী কখনো চিন্তা করেছি।

সারাদিন রোযা রেখে সন্ধ্যায় ইফতার ও খাওয়ার পর দীর্ঘ তারাবিহ নামায। তারপর ক্লান্ত শরীরে রোযাদার ঘুমিয়ে পড়ে। এরপর শেষ রাতে আবার কীভাবে জাগতে পারে। একজন-দু’জন নয় পাড়াগাঁ, শহর-নগর পুরো জনপদ এক প্রশান্ত অনন্দে জেগে উঠে। ঘরের নিদ্রালুদের ঘুম ভাঙানোর সাথে প্রতিবেশীদের ডাকাডাকির গ্রামীণ অভিজ্ঞতা কমবেশি আমাদের সবার আছে। মাইক, মোবাইলের প্রচলনে অবশ্য এখন এই ডাকাডাকি, পাড়া জাগানোর সংস্কৃতি ম্লান হয়ে পড়েছে।

আমরা কী চিন্তা করেছি, শেষ রাতে ঘুম থেকে জেগে রোযাদার কেন বলে না, এখন ক্ষিধা নেই, খাব না। সবাই সেহরিতে দুপুর বা সন্ধ্যার খাবারের মতোই পুরো মাত্রায় আহার করে তৃপ্তি সহকারে। স্বভাব ও সভ্যতার নিয়মের বাইরে শেষ রাতের এই জাগরণ, খাবার গ্রহণ টানা একমাস চলে। কার আহ্বানে রোযাদারের ঘুম ভেঙে যায়। কিসের শক্তি বলে ঘুমের জড়তা ঝেড়ে জাগ্রত হয়। কোন আধ্যাত্মিক আকর্ষণ তার হৃদয়মনকে উন্মাতাল করে। এর একটিমাত্র জবাব হতে পারে। তা হলো ঊর্ধ্বাকাশে আল্লাহ পাক বান্দাকে যে ডাক দেন, তার অনুরণন রোযাদারের হৃদয়ের কানে বেজে উঠে রমযানে।

আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তাআলা প্রতি রাতেÑযখন রাতের শেষ তৃতীয়াংশ অবশিষ্ট থাকে, দুনিয়ার নিকটবর্তী আসমানের দিকে নেমে আসেন আর বলতে থাকেন আমাকে আহ্বান করার কেউ আছ কি আমি তার আহ্বানে সাড়া দিতাম। আমার কাছে কিছু চাওয়ার কেউ কি আছে, আমি তাকে দান করতাম। আমার কাছে কে গোনাহ মার্জনা চাইবে আমি তার গোনাহ মাফ করে দিতাম। (বুখারি ও মুসলিম)

আসমানী এই আহ্বান সারা বছর প্রতি রাতে আব্যাহত আছে। কিন্তু অনেকে মনের কানে শুনি না, সাড়া দেই না। দূরের মসজিদের মাইকের আওয়াজ দিনের বেলা শোনা যায় না। অথচ একই আওয়াজ রাতের নিস্তব্ধতায় স্পষ্ট ভেসে আসে। কারণ, আজানের শব্দতরঙ্গ দিবসের শোরগোলে হারিয়ে যায়। আসমানী আহ্বানও বছরের অন্য সময়ে ঠিকভাবে না পৌঁছলেও রমযানের আধ্যাত্মিক পরিবেশে রহমতের ¯িœগ্ধতায় ঈমানদারের কর্ণকুহরে আজান দেয়। শেষ রাতের এই রূহানী আজান, এই দাওয়াত, এই নিমন্ত্রণ, এই যেয়াফত চট্টগ্রামের ভাষায় এই মেজবান স্বয়ং আল্লাহর তরফে। এ কারণে স্বভাব সভ্যতার পরিপন্থী হলেও রমযানের সেহরির এত কদর। রমযানে প্রতিটি রোযাদার আল্লাহর মেহমান। শেষ রাতের পুরো আয়োজন তাদের জন্য আল্লাহর তরফে মেজবান। এই মেজবানে দাওয়াত নাই পৃথিবীর অন্য কোনো জাতির বা ভিন্নধর্মের অনুসারীদের। উপরন্তু সেহরি মুসলমান ও অন্য ধর্মের লোকদের ইবাদত উপাসনার মাঝে পার্থক্য নির্ণায়ক। হাদিসের ভাষায়-

হযরত আমর ইবনুল আস (রা.) হতে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, আমাদের রোযা ও আহলে কিতাব (ইহুদি-খ্রিষ্টান)দের রোযার মধ্যে পার্থক্য হলো সেহরি খাওয়া। (মুসলিম, মিশকাত-১৮৮৬)

অন্য ধর্মের লোকেরাও রোযা রাখে। বিশেষ করে ইহুদি-খ্রিষ্টানদের রোযার উল্লেখ হাদিসে এসেছে। রোযা না বলে উপবাসব্রত বলাই উত্তম হবে। কারণ, অন্য ধর্ম বা সভ্যতার উপবাসব্রত মুসলমানদের রোযার মতো এত পূর্ণাঙ্গ, সার্বজনীন ও অর্থপূর্ণ নয়। রমযানে শুধু দিনে উপবাস পালন নয়, ছোট-বড় সবাই মিলে ইফতার, রাতে পবিত্র পূর্ণাঙ্গ ধর্মগ্রন্থ পবিত্রাবস্থায় বিশুদ্ধ উচ্চারণে পাঠ ও সম্মিলিত শ্রবণ, সমাজের গরিব অসহায় মানুষের মাঝে সাহায্য বিতরণের আয়োজন প্রভৃতির সমন্বিত চর্চা অন্য কোনো সংস্কৃতি, ধর্ম বা সভ্যতায় নেই। এ জন্য নবী করিম (সা.) সেহরির আধ্যাত্মিক যেয়াফতকে এক কথায় বলেছেন বরকতময়।

হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, তোমরা সেহরি খাবে। কেননা, সেহরিতে বরকত রয়েছে। (বুখারি-১৯২৩, মুসলিম-১০৯৫, মিশকাত-১৮৮৫)
এই বরকতময় মেজবানে আল্লাহর পক্ষ হতে দাওয়াত দিয়েছেন প্রিয়নবী (সা.) আপন উম্মতকে।
হযরত ইরবায ইবনে সারিয়া হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা রমযানে রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে সেহরি খেতে ডাকলেন এবং বললেন, এসো এই মোবারক খানার দিকে। (আবু দাউদ, নাসায়ীর বরাতে মিশকাত-১৯০০)

প্রিয়নবীর জবানীতে এই খাবার বরকতময়। সেহরি শুধু দিনের বেলা উপবাস পালনকে সহজ করে না; আমাদের রূহের খোরাক রয়েছে এই খাবারে। শেষরাতে আল্লাহ পাক যখন তার প্রিয় বান্দাদের খোঁজেন। কেউ কোনো চাওয়া-পাওয়া নিয়ে তার কাছে আর্জি জানায় কি না, তখন দেখেন তার প্রিয়বান্দরা গ্রীষ্মের দীর্ঘতম দিনে তার নির্দেশ রোযা পালনের, তার প্রতি ভালোবাসার পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। সত্যিই সেহরির এই উপলব্ধি ও চেতনা রোযাদারের মনে ও জীবনে অনাবিল প্রশান্তির পরশ বুলায়, আধ্যাত্মিক শক্তির উজ্জীবন ঘটায়।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

এবার কোরবানিযোগ্য পশু ১ কোটি সাড়ে ২৪ লাখ
ঢাবির সাবেক ভিসি, প্রক্টর, আ.লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে রাশেদ খানের মামলা
আগের তুলনায় গণমাধ্যমের ওপর সরকারি হস্তক্ষেপ অনেক কমে গেছে : নাহিদ ইসলাম
আরও কমলো এলপি গ্যাসের দাম
আরাকানকে ‘মানবিক করিডোর’ দেওয়া চরম ঝুঁকিপূর্ণ : বাংলাদেশ ন্যাপ
আরও
X
  

আরও পড়ুন

আট বছর ধরে বাংলাদেশের নারীদের আর্থিক পথচলার সঙ্গী ব্র্যাক ব্যাংক ‘তারা’

আট বছর ধরে বাংলাদেশের নারীদের আর্থিক পথচলার সঙ্গী ব্র্যাক ব্যাংক ‘তারা’

তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে আয়োজিত পদযাত্রায় জনস্রোত

তিস্তা মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের দাবিতে আয়োজিত পদযাত্রায় জনস্রোত

শিশু সন্তানকে জিম্মি করে বাড়িতে ডাকাতি

শিশু সন্তানকে জিম্মি করে বাড়িতে ডাকাতি

খালেদা জিয়া ফিরছেন ৬ মে, নেতাকর্মীদের যে নির্দেশনা দিলো বিএনপি

খালেদা জিয়া ফিরছেন ৬ মে, নেতাকর্মীদের যে নির্দেশনা দিলো বিএনপি

কুষ্টিয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ আইসক্রিম প্রস্তুতকারককে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা

কুষ্টিয়ায় স্বাস্থ্যঝুঁকিপূর্ণ আইসক্রিম প্রস্তুতকারককে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা

কুয়েটে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরলেও চলেনি একাডেমিক কার্যক্রম

কুয়েটে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরলেও চলেনি একাডেমিক কার্যক্রম

এবার কোরবানিযোগ্য পশু ১ কোটি সাড়ে ২৪ লাখ

এবার কোরবানিযোগ্য পশু ১ কোটি সাড়ে ২৪ লাখ

ঢাবির সাবেক ভিসি, প্রক্টর, আ.লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে রাশেদ খানের মামলা

ঢাবির সাবেক ভিসি, প্রক্টর, আ.লীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতাদের বিরুদ্ধে রাশেদ খানের মামলা

জম্মু-কাশ্মীরে ভারতীয় ৩ সেনা নিহত

জম্মু-কাশ্মীরে ভারতীয় ৩ সেনা নিহত

৪৩তম বিসিএস: গেজেটবঞ্চিতদের অনশনের ৬ দিন, আশ্বাসহীন অপেক্ষা

৪৩তম বিসিএস: গেজেটবঞ্চিতদের অনশনের ৬ দিন, আশ্বাসহীন অপেক্ষা

তিন কারণে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির পদত্যাগ দাবি করলেন শিক্ষার্থীরা

তিন কারণে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির পদত্যাগ দাবি করলেন শিক্ষার্থীরা

টি-টোয়েন্টির নেতৃত্বে লিটন, দলে নেই মিরাজ

টি-টোয়েন্টির নেতৃত্বে লিটন, দলে নেই মিরাজ

কুষ্টিয়া-জামজামি সড়কে দুই সেতুর নির্মাণ শেষ হয়নি ৪ বছরে

কুষ্টিয়া-জামজামি সড়কে দুই সেতুর নির্মাণ শেষ হয়নি ৪ বছরে

১৭ মাস পর বেঙ্গল টেক্সটাইল মিল চালুর উদ্যোগ

১৭ মাস পর বেঙ্গল টেক্সটাইল মিল চালুর উদ্যোগ

অবশেষে মেসির গোল, মায়ামির জয়

অবশেষে মেসির গোল, মায়ামির জয়

সাংস্কৃতিক দলের কেন্দ্রীয় সহসাধারণ সম্পাদক হলেন মজনুর

সাংস্কৃতিক দলের কেন্দ্রীয় সহসাধারণ সম্পাদক হলেন মজনুর

গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলাম আছি এবং থাকব : মির্জা ফখরুল আলমগীর

গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলাম আছি এবং থাকব : মির্জা ফখরুল আলমগীর

টেকসই কূটনৈতিক যোগাযোগের পর বাংলাদেশিদের ভিজিট ভিসা দিচ্ছে আমিরাত

টেকসই কূটনৈতিক যোগাযোগের পর বাংলাদেশিদের ভিজিট ভিসা দিচ্ছে আমিরাত

যবিপ্রবির আইপিই বিভাগের নবীনবরণ ও  বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত

যবিপ্রবির আইপিই বিভাগের নবীনবরণ ও বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত

কাপাসিয়ায় মামলা দিয়ে হয়রানির প্রতিবাদে মানববন্ধনের পর অভিযুক্ত ব্যক্তির পাল্টা মানববন্ধন

কাপাসিয়ায় মামলা দিয়ে হয়রানির প্রতিবাদে মানববন্ধনের পর অভিযুক্ত ব্যক্তির পাল্টা মানববন্ধন