যুক্তরাষ্ট্র আমদানি কমানোয় শঙ্কায় গার্মেন্টস মালিকরা রাজনৈতিক কারণে যুক্তরাষ্ট্র মুখ ফিরিয়ে নিলে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে দেশের পোশাক খাত :: বেকার হয়ে পড়বেন লাখ লাখ গার্মেন্টস বালিকা :: মার্কিন বাজারে রফতানির নেতিবাচক ধারা বছরের শেষ নাগাদ অব্যাহত থাকবে : শহিদউল্লাহ আজিম :: গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে প্রতিযোগিতামূলকভাবে টিকে থাকতে নীতি সহায়তা প্রয়োজন : ফারুক হাসান

চ্যালেঞ্জের মুখে পোশাক শিল্প

Daily Inqilab অর্থনৈতিক রিপোর্টার

১০ জুন ২০২৩, ১১:৪৪ পিএম | আপডেট: ১১ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম প্রধান খাত গার্মেন্টস পণ্য। আর এই সেক্টরে কাজ করছে প্রায় ৪০ লাখ মানুষ। এদের মধ্যে আবার নারীর সংখ্যাই বেশি। বাংলাদেশের নারীদের বানানো এই পোশাকের একক দেশ হিসেবে সবচেয়ে বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের অনুসারী ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো গার্মেন্টস পণ্যের অন্যতম বাজার। কিন্তু গত ৪ মাসে যুক্তরাষ্ট্র গার্মেন্টস পণ্য আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগেই ঘোষণা দিয়েছে, বাংলাদেশে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হলে ‘জিএসপি প্লাস’ সুবিধা দেয়া হবে; না হলে অন্যচিন্তা। গার্মেন্টস পণ্যের এই ‘দুই বৃহৎ বাজার’ নিয়ে শঙ্কিত গার্মেন্টস শিল্পের মালিকরা। তারা বলছেন, এমনিতেই বিদ্যুৎ-গ্যাসের সংকটে উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটছে, ডলারের সংকটে উৎপাদন খরচ বাড়ছে; তার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র গার্মেন্টস পণ্য আমদানি কমিয়ে দিলে গোটা সেক্টর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবে। নতুন বাজার খুঁজতে গেলে পণ্য উৎপাদন স্বাভাবিক করতে যে গ্যাস-বিদ্যুৎসহ সাপোর্টের প্রয়োজন সেগুলো নেই। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের উৎপাদিত গার্মেন্টস পণ্য থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে মহাসংকটে পড়ে যাবে এই শিল্প খাত। বেকার হয়ে পড়বেন লাখ লাখ নারী শ্রমিক।

সূত্র জানায়, চলতি বছর বিভিন্ন দেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি প্রায় এক-চতুর্থাংশ কমিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও ব্র্যান্ড। এই বাজারে চীন, ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, ভারত ও ইন্দোনেশিয়ার মতো শীর্ষ রফতানিকারক দেশের তৈরি পোশাক রফতানি কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশ পোশাক রফতানিতে যে নির্ভরতা সেটা ভারত ও চীনের নেই। ফলে যুক্তরাষ্ট্র পোশাক আমদানি কমালেও ভারত বা চীনের কোনো সমস্যা হবে না। তবে বাংলাদেশের চরম সংকটে পড়ে যাবে। এ ছাড়াও রাজনৈতিক কারণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘোষণা দিয়েছেন র‌্যাবের ওপর স্যাংশন দেয়া দেশ থেকে কোনো পণ্য ক্রয় করবেন না। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে তাদের মূল এজেন্ডা বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন ও কূটনৈতিক মহলে চলছে উত্তেজনা। এ অবস্থায় বাংলাদেশ গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথ না হাঁটলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য আমদানি করা থেকে বিরত থাকার মতো কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এমন আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন গ্রার্মেন্টস ব্যবসায়ীরা।

জানতে চাইলে বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম ইনকিলাবকে বলেন, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের যে রাজনৈতিক চাপ রয়েছে তা পোশাক খাতে এখনো পড়েনি। তাই পোশাকের রফতানি কমা এখন পর্যন্ত স্বভাবিক বলেই মনে করছি। কারণ তারা পোশাক খাতে এখনো স্বাভাবিকের চেয়ে কম ব্যয় করছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানির নেতিবাচক বছরের শেষ নাগাদ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলেই মনে হচ্ছে। কারণ প্রধান এই বাজারে ভোক্তাদের ক্রয় চর্চায় বড় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। যার পরিপ্রেক্ষিতে ক্রেতারা ক্রয়াদেশ কম দিচ্ছেন। পোশাকে রাজনৈতিক চাপ না থাকলেও ইদানীং বিভিন্ন শর্ত ও শ্রমিক আইন নিয়ে কথা বলছে। তাই আগামীতে কি হবে সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না। তবে আশাবাদী তারা পোশাক খাত নিয়ে কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিবেন না। আর নিলে দেশের গার্মেন্টস শিল্প চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যাবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর বিভিন্ন দেশ থেকে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের পোশাক আমদানি করে থাকে। এর মধ্যে গত বছরও ৯ দশমিক ৮ শতাংশ দখলে রেখেছিল বাংলাদেশ। এর অর্থ যুক্তরাষ্ট্রে বাইরে থেকে রফতানি হওয়া প্রতি দশটি পোশাকের একটি বাংলাদেশ থেকে গেছে। অবশ্য গত বছরের রফতানির ধারা চলতি বছরে নেই। যুক্তরাষ্ট্রের অফিস অব টেক্সটাইলস অ্যান্ড অ্যাপারেল (ওটেক্সা)-এর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের জানুয়ারি-এপ্রিল থেকে চলতি বছরের একই সময়ে রফতানি কমেছে ১৭ দশমিক ৮৮ শতাংশ। গত বছর এই সময়ে বাংলাদেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৩ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করেছিল, কিন্তু এই বছর এটি হয়েছে ২ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি মূল্যমান বিবেচনায় ১৯ শতাংশ এবং আকার বিবেচনায় ৩০ শতাংশ কমেছে। এদিকে গত বছর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি দ্রুত বাড়তে থাকে। গত বছরের জুনে দেশটির মূল্যস্ফীতি চিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। যা ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ফলে নিত্যপণ্য ও জ্বালানি ছাড়া অন্যান্য পণ্য কেনা কমিয়ে দেন দেশটির ভোক্তারা। যদিও দেশটির মূল্যস্ফীতি কমে আসছে। গত এপ্রিলে তাদের মূল্যস্ফীতি কমে ৪ দশমিক ৯ শতাংশে দাঁড়ায়। ফলে আগামী গ্রীষ্ম মৌসুম থেকে দেশটি থেকে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ আসা বাড়তে পারে বলে ধারণা বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের উদ্যোক্তাদের। তবে গত বছর থেকে যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি প্রায় অর্ধেকে নামলেও বাংলাদেশ সেই সুবিধা নিতে পারেনি। আর তাই বাংলাদেশের পোশাক রফতানি কমেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারির অভিঘাত কাটিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে ক্রমেই বাড়ছিল বাংলাদেশের পোশাক রফতানি। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বের সব দেশকেই এখন মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। যার কারণে খাদ্য ও জ্বালানির মতো অতিজরুরি পণ্যের চাহিদা মেটাতে ভোক্তারা বেশি মনোযোগ দিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই কেনাকাটায় অগ্রাধিকারের জায়গা থেকে সরে গেছে পোশাক। ভোক্তাদের এ প্রবণতার কারণে ক্রয় কৌশলে পরিবর্তন এনেছে প্রধান প্রধান রফতানি গন্তব্যের ব্র্যান্ড রিটেইলার প্রতিষ্ঠানগুলোও। ফলে রফতানি কমছে দেশগুলোয়।

পোশাক খাতের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি ফারুক হাসান বলেছেন, ক্রয়াদেশ কমায় বাংলাদেশের বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি কমেছে। গত বছরের দ্বিতীয়ার্ধে মোট রফতানির ভ্যালুতে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। আর তা হয়েছিল ইউনিট প্রাইস ও হাই-ভ্যালু পণ্যের জন্য। বর্তমানে গ্যাস-বিদ্যুতের মূল্য অনেক বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে প্রতিযোগিতামূলকভাবে টিকে থাকতে আমাদের অনেক নীতিসহায়তা প্রয়োজন হবে। দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এমনিই কমে এসেছে। এর ওপর আরো চাপ পড়বে, যদি পলিসি সাপোর্ট নিশ্চিত করা না হয়। পাশাপাশি এনবিআর ও কাস্টমসের প্রক্রিয়াগুলোও সহজীকরণের প্রয়োজন রয়েছে উল্লেখ করে তিনি। বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি কমলেও নিত্যপণ্য ও জ্বালানি ছাড়া অন্যান্য পণ্য এখনও কম ক্রয় করছেন দেশটির ভোক্তারা। তাই সেখানে বাংলাদেশের পোশাকের রফতানিও কমছে। যা আরও কয়েক মাস স্থায়ী হতে পারে। তবে আশা করি, আগামী ডিসেম্বর নাগাদ পোশাক রফতানি ঠিক হয়ে যাবে। ফারুক হাসান আরও বলেন, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রফতানি মূল্যমান বিবেচনায় ১৯ শতাংশ এবং আকার বিবেচনায় ৩০ শতাংশ কমেছে।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, জনগণের স্বপ্ন পূরণে নতুন পুলিশ সদস্যরা কাজ করবে- অ্যাডিশনাল আইজি

বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা, জনগণের স্বপ্ন পূরণে নতুন পুলিশ সদস্যরা কাজ করবে- অ্যাডিশনাল আইজি

ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় দফায় ভোটগ্রহণ, আবারও এগিয়ে মিলানোভিচ

ক্রোয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দ্বিতীয় দফায় ভোটগ্রহণ, আবারও এগিয়ে মিলানোভিচ

ঢাবিকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার আশ্বাস প্রধান উপদেষ্টার

ঢাবিকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার আশ্বাস প্রধান উপদেষ্টার

পোপ ফ্রান্সিসকে বাইডেনের প্রেসিডেনশিয়াল মেডাল প্রদান

পোপ ফ্রান্সিসকে বাইডেনের প্রেসিডেনশিয়াল মেডাল প্রদান

লিটনকে বাদ দেওয়ার যে ব্যাখ্যা দিলেন প্রধান নির্বাচক

লিটনকে বাদ দেওয়ার যে ব্যাখ্যা দিলেন প্রধান নির্বাচক

টেকনাফ জিবির অভিযানে ২লাখ ৫০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার

টেকনাফ জিবির অভিযানে ২লাখ ৫০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার

মোংলায় স্কুল থেকে ফেরার পথে ট্রেনে কাটা পড়ে শিক্ষার্থী নিহত

মোংলায় স্কুল থেকে ফেরার পথে ট্রেনে কাটা পড়ে শিক্ষার্থী নিহত

পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এমডি ও পিডিকে অপসারণ সহ ৯ দফা দাবিতে ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তদের মানববন্ধন

পায়রা তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের এমডি ও পিডিকে অপসারণ সহ ৯ দফা দাবিতে ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্তদের মানববন্ধন

পাকিস্তানিদের জন্য ভিসা সহজ করল বাংলাদেশ

পাকিস্তানিদের জন্য ভিসা সহজ করল বাংলাদেশ

ওজন কমাও মাসুদ, না হলে মানুষ মাংস কেটে নেবে!

ওজন কমাও মাসুদ, না হলে মানুষ মাংস কেটে নেবে!

৭৫-এর বীরদের নিয়ে যে বার্তা দিলেন সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন

৭৫-এর বীরদের নিয়ে যে বার্তা দিলেন সাংবাদিক ইলিয়াস হোসেন

সম্মেলন নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষে বিএনপি সভাপতি নিহত

সম্মেলন নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষে বিএনপি সভাপতি নিহত

কিশোরগঞ্জে অটোরিকশা চালকের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার

কিশোরগঞ্জে অটোরিকশা চালকের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার

জামায়াতের ৫-১৫% বেশি ভোট নিয়ে আমার সন্দেহ আছে, যা বললেন ফাহাম

জামায়াতের ৫-১৫% বেশি ভোট নিয়ে আমার সন্দেহ আছে, যা বললেন ফাহাম

বিকাশের দোকানে হামলা করে ১০ লাখ টাকা নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ

বিকাশের দোকানে হামলা করে ১০ লাখ টাকা নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ

ঝালকাঠিতে চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যদের মানববন্ধন

ঝালকাঠিতে চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যদের মানববন্ধন

মাগুরায় সরিষা ক্ষেতে মৌমাছির মাধ্যমে মধু আহরণ জনপ্রিয় হচ্ছে

মাগুরায় সরিষা ক্ষেতে মৌমাছির মাধ্যমে মধু আহরণ জনপ্রিয় হচ্ছে

নগরকান্দায় বাস-ট্রাক সংঘর্ষে দুইজন নিহত

নগরকান্দায় বাস-ট্রাক সংঘর্ষে দুইজন নিহত

হাত বদলে দাম বাড়ে সবজিতে, নিরুপায় ক্রেতা

হাত বদলে দাম বাড়ে সবজিতে, নিরুপায় ক্রেতা

সিরিয়ার পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামির

সিরিয়ার পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামির