জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সহানুভূতির নামে ছাত্রীদের হলে উঠিয়ে টাকা আদায়

Daily Inqilab ওবায়দুল ইসলাম, জবি সংবাদদাতা

১১ জুন ২০২৩, ১১:০৮ পিএম | আপডেট: ১২ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের একমাত্র আবাসিক হল বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হল। ১৬তলা বিশিষ্ট হলে শিক্ষার্থীদের তুলনায় আসন সংখ্যা অপর্যাপ্ত । হলে নিজের সিট নেই কিন্তু হলে থাকেন এমন অনেকেই আছেন। ছাত্রী হলের হর্তাকর্তাদের দাবি যারা আর্থিক সমস্যায় থাকে, পড়াশোনার খরচ চালাতে হিমশিম খায় আমরা তাদেরকে হলে উঠিয়ে সিট ভাগাভাগি করে থাকি। বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরা এই সুযোগ না পেলেও প্রথম বর্ষের বা দ্বিতীয় বষের অনেক শিক্ষার্থীকে হলে উঠানো হয়েছে। প্রথম বর্ষের যারা হলে উঠেছে প্রায় সবার সাথেই টাকা লেনদেনের সম্পর্ক আছে বলে জানা যায়।

এ বিষয়ে একাধিক সাধারণ শিক্ষার্থী বলেন, সাধারণত প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা হলের নিয়মকানুন না জানায় সিনিয়রদের প্ররোচনায় টাকা দিয়ে হলে উঠেন। সিনিয়ররা যাবতীয় সুযোগ সুবিধা দেয়ার কথা বলে নানাভাবে বুঝায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যাদের মাস্টার্সের পরিক্ষা শেষ বা যাদের বিয়ে হয়ে যায়, কেউ দেশের বাইরে চলে যান, আবার কেউ চাকরির জন্য অন্যত্র চলে যান। ফলে তাদের সিটগুলো ফাঁকা থাকে। মূলত এই সিটগুলোতেই নতুন করে ছাত্রী উঠানো হয়। কিন্তু যার নামে সিট, মেয়াদ শেষ না হওয়ার পযর্ন্ত বা আবেদন করে সিট বাতিল না করা পযর্ন্ত তিনিই সিটের মালিক থেকে যায়। অবৈধভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের উঠানো হয় এসব ফাঁকা সিট দেখিয়ে। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এসব সিট হস্তগত করে হলের কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মী।

হলের প্রতিটি তলায় প্রথম বর্ষের ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীই অনেক। সিটের অপ্রতুলতার কারণে একটি রুমে চারটি সিট থাকলেও সেখানে থাকেন আটজন শিক্ষার্থী। যারা রাজনীতি করেন না তারা কিভাবে হলে থাকছেন? এ বিষয়টি অনুসন্ধান করে দেখা যায়, এদের সাথেই মূলত লেনদেনের একটি যোগসাজশ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বা চতুর্থ বর্ষের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বারবার আবেদন করে বিভিন্ন জায়গা থেকে সুপারিশ করেও জোটেনি একটি সিট। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের অনেকেই শুরু থেকেই হলে থাকছেন। হলের প্রতি তলায় একজন হাউজ টিউটর থাকলেও এসব অবৈধ আসন ভোগীদের নজরে আনা কেন সম্ভব হচ্ছে না এ বিষয়েও ধিক্কার জানান সাধারণ শিক্ষার্থীরা।

এ বিষয়ে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষা সানজিদা আক্তার বলেন, আমি দুই তিন বার আবেদন করেও বিভিন্ন জায়গায় সুপারিশ তদবির করেও একটি সিট পেলাম না। অথচ প্রথম বা দ্বিতীয় বর্ষের অনেকেই হলে থাকছেন। এদের নামে তো হলে সিটই নেই কিন্তু হলে থাকেন কেমনে এ বিষয়ে বলেন, তারা বিভিন্ন বড় ভাইদের বা আপুদের সাথে যোগাযোগ করে টাকা পয়সা দিয়ে উঠেন। তারা যেহেতু টাকা দেয় তাদের আর রাজনৈতিক কোনো চাপ থাকে না। কিন্তু হলের হাউজ টিউটর ম্যামরা কি করেন এটাই বুঝে আসে না আমার।

প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের একপ্রকার বোকা বানিয়ে কোনঠাসা করে হলে উঠানো হয়। এক্ষেত্রে শুধু ছাত্রী কর্মীরাই নয়, জড়িত আছে শাখা ছাত্রলীগের কর্মী, পাশ্ববর্তী কলেজ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাসহ অনেকেই। মূলত, এসব বড়ভাইরাই হলে উঠানোর জন্য সব কিছু বন্দোবস্ত করে। প্রায় লক্ষাধিক টাকা ভাগবাটোয়ারা হয় এদের মধ্যে। প্রথম বর্ষের ১৫ থেকে ২০ জন শিক্ষার্থী উঠানো হয়েছে। অনুমান করা যাচ্ছে এ বছর প্রায় দেড় লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে হলকেন্দ্রিক এ চক্রটি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী প্রিয়া রাণী দাসকে হলে উঠানোর জন্যে প্রথমে ১৫ হাজার টাকা দাবী করা হয়। কিন্তু সে ১০ হাজার টাকা দিয়ে হলে উঠেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাজমুন নাহার স্বর্ণা পাটোয়ারী তাকে হলের ১৬ তলায় ১৬০৪ নাম্বার রুমে বি২ সিটে তুলেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই কবি নজরুল কলেজের এক ছাত্রলীগ কর্মী পলাশের সাথে স্বর্ণার রাজনৈতিক সম্পর্ক আছে এবং সে হলে উঠিয়ে যাবতীয় দেখভাল করবেন বলে আশ্বাস দিয়ে টাকা নেয়। ছাত্রলীগ কর্মী স্বর্ণার ভাগে টাকা কম পরায় কিছু দিন যেতে না যেতেই প্রিয়া রাণীকে রাজনৈতিক বিভিন্ন মিটিং মিছিলে যাওয়ার জন্য বাধ্য করে স্বর্ণা পাটোয়ারী। বাধ্য হয়ে কিছুদিন গেলেও তারপর আর যেতে রাজি হননি। ফলে ছাত্রলীগের কর্মী স্বর্ণা পাটোয়ারী তাকে একাধিকবার ডেকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ ও চড় থাপ্পড় দেয়। প্রিয়া রাণী প্রথমে এগুলো সহ্য করে নিলেও তারপর আর সহ্য না করে টাকা ফেরত চান এবং হল থেকে বের হয়ে যাওয়া সিদ্ধান্ত নেন। তারপর বিভিন্ন জনের কাছে টাকা উদ্ধারের জন্য সহায়তা চাইলেও কেউ তেমন কোনো সাড়া দেননি। এর মধ্যে তাকে বিভিন্ন মানসিক চাপ দিতেই থাকে। চাপ সহ্য করতে না পেরে এবং সামনে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার কথা চিন্তা করে গত ৩১ মে হল থেকে বের হয়ে যান প্রিয়া রাণী। এ বিষয়ে ফোন রেকর্ড প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে।

এ বিষয়ে ভুগক্তভোগী প্রিয়া রাণী বলেন, আমার কাছ থেকে টাকা নিয়ে হলে তুলেছে আবার আমার সাথে নানা খারাপ ব্যবহার করেছে, মারধর করেছে। আমি টাকা চাইতে গেলে হল থেকে ফেলে দেওয়ার হুমকি দেয়। প্রথম বর্ষের আরও অনেকেই হলে থাকেন কিন্তু ওদের সাথে তো এরকম কিছু হয় নি!
এছাড়াও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী খুশি আক্তারকে হলে উঠানোর আশ্বাস দেয় চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের কর্মী নিপুন। নিপুন তার কাছে ৫ হাজার টাকা দাবী করলে সে টাকা দিতে না পারায় তার কপালেও জোটে নি হলের একটি সিট।

এভাবে সবার অগোচরে কতজন শিক্ষার্থীকে হলে উঠানো হয়েছে তা নির্দিষ্ট করে বলা যায় না। তবে দলীয় প্রভাব বজায় রাখার জন্েয নিজের পিছনে কজন সক্রিয় কর্মী গঠন করার সুবাদে এভাবেই কাছে টানছেন ছিনিয়র ছাত্রলীগকর্মীরা।

এবিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর মোস্তফা কামাল বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মাত্র হল। তারপরও এরকম ঘটনা কাম্য নয়। ভুক্তভোগীরা প্রশাসন বরাবর অভিযোগ করলে সত্যতা যাচাই করে ব্যবস্থা নিব।
ছাত্রীহলের প্রভোস্ট ড. দীপিকা রাণী বলেন, হলের প্রতিটি তলায় হাউজ টিউটর আছেন। উনারা বিষয়গুলো দেখভাল করবেন। কিন্তু একাডেমি পড়াশুনাসহ নানা ব্যস্ততায় হয়তো সময় দিতে পারছেন না। তবে অনৈতিক কোনো ঘটনা ঘটলে আমরা কঠোরভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

সড়ক অবরোধ চাকরিচ্যুত সাবেক সেনাদের, দুই ঘণ্টা পর যান চলাচল স্বাভাবিক
৫ আগস্টের পর বেশ কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক দখল করেছে একটি ইসলামী দল
৩১ ডিসেম্বরের ঘোষণাপত্র লিখিত দলিল হিসেবে থাকবে : সারজিস
ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করেন, ইসলাম মানে তো বারবার মোনাফেকি করা না : রিজভী
৩১ ডিসেম্বর মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচিত হবে : হাসনাত আবদুল্লাহ
আরও

আরও পড়ুন

সড়ক অবরোধ চাকরিচ্যুত সাবেক সেনাদের, দুই ঘণ্টা পর যান চলাচল স্বাভাবিক

সড়ক অবরোধ চাকরিচ্যুত সাবেক সেনাদের, দুই ঘণ্টা পর যান চলাচল স্বাভাবিক

আশুলিয়ায় ভবন মালিকের স্বেচ্ছাচারিতায় অর্ধশত শিক্ষার্থীর লেখাপড়া বন্ধ

আশুলিয়ায় ভবন মালিকের স্বেচ্ছাচারিতায় অর্ধশত শিক্ষার্থীর লেখাপড়া বন্ধ

হাটহাজারী সাংবাদিক ঐক্য পরিষদের প্রতিবাদ সভা

হাটহাজারী সাংবাদিক ঐক্য পরিষদের প্রতিবাদ সভা

৫ আগস্টের পর বেশ কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক দখল করেছে একটি ইসলামী দল

৫ আগস্টের পর বেশ কয়েকটি ইসলামী ব্যাংক দখল করেছে একটি ইসলামী দল

মেহেরপুরে তসলিমা হত্যা মামলায় ২ জন আটক

মেহেরপুরে তসলিমা হত্যা মামলায় ২ জন আটক

ঈশ্বরদীতে ৫ বছরের শিশু কন্যাকে যৌন হয়রানির অভিযোগে সৎ বাবা গ্রেফতার

ঈশ্বরদীতে ৫ বছরের শিশু কন্যাকে যৌন হয়রানির অভিযোগে সৎ বাবা গ্রেফতার

নাসার নতুন সাঁতারু রোবট , ইউরোপায় প্রাণের খোঁজে এক বিস্ময়কর  যাত্রা

নাসার নতুন সাঁতারু রোবট , ইউরোপায় প্রাণের খোঁজে এক বিস্ময়কর যাত্রা

৩১ ডিসেম্বরের ঘোষণাপত্র লিখিত দলিল হিসেবে থাকবে : সারজিস

৩১ ডিসেম্বরের ঘোষণাপত্র লিখিত দলিল হিসেবে থাকবে : সারজিস

ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করেন, ইসলাম মানে তো বারবার মোনাফেকি করা না : রিজভী

ইসলাম নিয়ে রাজনীতি করেন, ইসলাম মানে তো বারবার মোনাফেকি করা না : রিজভী

উখিয়ায় চুরির দায়ে পিটিয়ে এক যুবককে হত্যা, পরিবারের অভিযোগ পরিকল্পিত খুন

উখিয়ায় চুরির দায়ে পিটিয়ে এক যুবককে হত্যা, পরিবারের অভিযোগ পরিকল্পিত খুন

৩১ ডিসেম্বর মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচিত হবে : হাসনাত আবদুল্লাহ

৩১ ডিসেম্বর মুজিববাদী সংবিধানের কবর রচিত হবে : হাসনাত আবদুল্লাহ

বিধ্বস্তের আগে যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন বিমান যাত্রী

বিধ্বস্তের আগে যে বার্তা পাঠিয়েছিলেন বিমান যাত্রী

সিলেটে ‘পানি লাগবো পানি’ স্মারকগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন

সিলেটে ‘পানি লাগবো পানি’ স্মারকগ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন

নতুন বছরের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ায় তাপপ্রবাহ ও ঝুঁকির সতর্কবার্তা

নতুন বছরের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ায় তাপপ্রবাহ ও ঝুঁকির সতর্কবার্তা

নিয়ন্ত্রিত প্রবেশাধিকারে খুলেছে সচিবালয়, ক্ষতিগ্রস্ত মন্ত্রণালয়ের কাজ চলছে অন্যত্র

নিয়ন্ত্রিত প্রবেশাধিকারে খুলেছে সচিবালয়, ক্ষতিগ্রস্ত মন্ত্রণালয়ের কাজ চলছে অন্যত্র

কেশবপুরের পল্লীতে নারকেল গাছ থেকে পড়ে মৃত্যু

কেশবপুরের পল্লীতে নারকেল গাছ থেকে পড়ে মৃত্যু

জকিগঞ্জে বাসের চাপায় স্কুলছাত্র আবিরের মর্মান্তিক মৃত্যু : শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ

জকিগঞ্জে বাসের চাপায় স্কুলছাত্র আবিরের মর্মান্তিক মৃত্যু : শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ

ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে ট্রেইনি চিকিৎসকদের শাহবাগ অবরোধ

ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে ট্রেইনি চিকিৎসকদের শাহবাগ অবরোধ

ইলন মাস্কের উগ্র-ডানপন্থী সমর্থন নিয়ে বিতর্ক

ইলন মাস্কের উগ্র-ডানপন্থী সমর্থন নিয়ে বিতর্ক

বিজিবির সহায়তায় অবশেষে মুহুরী নদীতে সেচ পাম্প চালু

বিজিবির সহায়তায় অবশেষে মুহুরী নদীতে সেচ পাম্প চালু