ঈদে সক্রিয় জাল টাকা চক্র
২৪ জুন ২০২৩, ১১:১৩ পিএম | আপডেট: ২৫ জুন ২০২৩, ১২:০০ এএম
রাজধানীসহ সারা দেশে জাল টাকার ছড়াছড়ি। ঈদকে টার্গেট করে নতুন নতুন কৌশল নিয়ে জাল টাকার চক্রগুলো বাজারে এখন ভীষণ সক্রিয়। ১০০, ৫০০ ও এক হাজার টাকার নোটের পাশাপাশি ২০ ও ৫০ টাকার জাল নোটও ছড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, ভারত থেকে সীমান্ত দিয়ে বিপুল পরিমাণ জাল টাকার নোট ঢুকছে। ভারতীয় চক্রের টার্গেট পশুর হাট। দেশের বড় বড় পশুর হাটে এসব জাল টাকা ছাড়ার চেষ্টা করছে চক্রের সদস্যরা। তবে দেশের বিভিন্ন জেলায়ও তৈরি হচ্ছে জাল টাকা। ভারত ছাড়াও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিক জাল টাকা আনছে ও তৈরি করছে। প্রতারক চক্রের অনেকেই একাধিকবার গ্রেফতার হয়েছে পুলিশের কাছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারবারিরা এতই বেপরোয়া যে ফেসবুকে পেজ খুলে জাল টাকা বেচাকেনার প্রচারণা চালাচ্ছে প্রকাশ্যে। দিচ্ছে হোম ডেলিভারি। চক্রটির প্রধান টার্গেট ঈদ। জাল টাকার সঙ্গে জড়িতরা গ্রেফতার হলেও তাদের আটকে রাখা সম্ভব হয় না। এদের অধিকাংশই এখন মুক্ত। গত ১৫ বছরে জাল টাকা সংক্রান্ত সাড়ে ৫ হাজার মামলা হলেও আসামিদের সাজা হয়নি। যে কারণে জাল টাকার ব্যবসা বেড়েই চলছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, জাল নোট বিক্রির জন্য ফেসবুকে এ গ্রেড জাল নোট, টাকা চাই, জাল নোট, জাল টাকা বিক্রি করি, জাল টাকার ডিলার, জাল টাকা বিক্রয়কেন্দ্র, রিয়েল সেলস্, টাকা বিজনেসসহ বিভিন্ন নামে পেজ ও গ্রুপ খুলে বিজ্ঞাপন দেয়া হয়। এরপর জাল টাকা কিনতে আগ্রহীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সরাসরি সাক্ষাতের মাধ্যমে জাল টাকা ডেলিভারি দিচ্ছিল শাহজাদা আলম ৪০টি চক্র। চক্রটি ইতোমধ্যে জাল টাকার বড় ধরনের ৪টি ডেলিভারি দিয়েছে। সর্বশেষ গত ১৫ জুন ‘এ গ্রেড জালনোট’ গ্রুপে বিজ্ঞাপন দিয়ে পাঁচ লাখ টাকার ৫০০, ২০০ ও ১০০ টাকার জাল নোটের একটি চালান ডেলিভারি দেয় শাহজাদা। পাঁচ লাখ টাকার জাল নোট বিক্রির বিনিময়ে নেন ৯০ হাজার টাকা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন স্থানে যেসব জাল নোট ধরা পড়ে তার সঠিক পরিসংখ্যান কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আসে না। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাইরে জাল নোট ধরা পড়লে তা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানোর বিধান থাকলেও ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্যাশ কর্মকর্তারা তা নষ্ট করে ফেলেন। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যন্ত জাল নোটের হিসাব পৌঁছে না।
এ প্রসঙ্গে মতিঝিলের এক ব্যবসায়ী বলেন, প্রায় দিনই দু-একটি জাল নোট ধরা পড়ে। ঝামেলা এড়ানোর জন্য ক্রেতাকে ভালোভাবে বিদায় দিয়ে থাকি। এ নিয়ে বেশি যাচাই-বাছাই করতে গেলে ব্যবসায় ক্ষতি হবে ভেবে চেপে যাই। গ্রাহকদের অভিযোগ, বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম বুথ থেকেও ইদানীং জাল নোট বেরিয়ে আসছে। বুথ থেকে জাল নোট বেরিয়ে এলে গ্রাহকের পক্ষে তা আর বদলে নেয়া সম্ভব হয় না। তাই এতে গ্রাহকদের শতভাগ ক্ষতি শিকার করতে হয়। যদিও ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হয়, এটিএমে জাল টাকা শনাক্তকরণ মেশিন থাকায় জাল টাকা থাকার প্রশ্ন ওঠে না। ঢাকার বাইরে জাল টাকার চিত্র আরও উদ্বেগজনক। প্রতারক চক্র রাজধানীতে জাল টাকা চালাতে খুব বেশি সুবিধা না করতে পারায় গ্রামাঞ্চলকে বেছে নিচ্ছে। জাল টাকা সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকায় সেখানের সহজ-সরল মানুষ খুব বেশি প্রতারিত হচ্ছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ ইনকিলাবকে বলেন, ঈদকে সামনে রেখে জাল নোট কারবারিরা দেশের অর্থনীতির জন্য অভিশাপ। তাদের রুখতে হলে সবাইকে সচেতন হতে হবে। এছাড়া আইনের ফাঁক-ফোকরে যাতে তারা কারাগার থেকে না বেরোতে পারে সেদিকে নজর দেয়া জরুরি। জাল নোট প্রতিরোধ এবং এর সাথে জড়িতদের গ্রেফতারে ডিবি সক্রিয় রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর কদমতলীর রাজবাড়ি, ডেমরার বাঁশেরপুল ফরমান খাঁ মার্কেট এলাকায় অভিযান চালিয়ে জাল টাকার কারখানার সন্ধান মেলে। এছাড়া রামপুরা, মোহাম্মদপুর, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় জাল নোটের কারখানায় অভিযান চালিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। একটি সংঘবদ্ধ চক্র নিয়ন্ত্রণ করছে অন্তত অর্ধশতাধিক গ্রুপ। এর বাইরে আছে আরও অর্ধশতাধিক জাল টাকার ডিলার। প্রত্যেক ডিলারের সঙ্গে কমপক্ষে পাঁচ-ছয়জন বাজারজাতকারী আছেন। এসব কারখানায় ভারতীয় রুপিসহ বিভিন্ন দেশের জাল মুদ্রা তৈরি হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে দেশ-বিদেশে। জাল টাকা তৈরি ও বিপণনের কাজে জড়িত চক্রের সদস্যরা তিন ভাগে বিভক্ত। একটি গ্রুপ অর্ডার অনুযায়ী জাল নোট তৈরি করে, অপর গ্রুপ টাকার বান্ডিল পৌঁছে দেয়, আরেক গ্রুপ এসব টাকা বাজারে ছড়িয়ে দেয়।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ঈদ ও বিভিন্ন অনুষ্ঠান টার্গেট করে জাল টাকার কারবারিরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। সম্প্রতি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় জাল নোট তৈরি ও সরবরাহের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন জায়গায় অভিযানও চালানো হচ্ছে। এছাড়া র্যাবের সাইবার মনিটরিং টিম সার্বক্ষণিক অনলাইনে নজরদারি করছে। অনলাইনে জাল নোট বিক্রি ঠেকাতে কঠোর অবস্থানে রয়েছে র্যাব।
সর্বশেষ গত সোমবার দুই লাখ টাকার জালনোট ডেলিভারির জন্য প্রস্তুতিকালীন সময় টাকা এবং মেশিন- সরঞ্জামাদিসহ উত্তরখান থানাধীন উজাপাড়া (মাস্টারপাড়া) এলাকায় অভিযান চালিয়ে জালনোট প্রস্তুতকারী চক্রের অন্যতম হোতা শাহজাদা আলমকে (৩৩) গ্রেফতার করে র্যাব-৩ এর একটি দল। এ সময় গ্রেফতারকৃত দুই সহযোগী হলেন- মাহেদী হাসান (১৯) ও আবু হুরায়রা ওরফে তুষার (২২)। র্যাব-৩ এর অধিনায়ক (সিও) লে. কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, সম্প্রতি ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিয়ে জালনোটের অবাধ কারবারের তথ্য পাওয়ার পর র্যাব-৩ বিশেষ গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত সোমবার রাতে র্যাব-৩ এর একটি দল তাদের গ্রেফতার করে। এসময় তাদের হেফাজত থেকে ৯০০টি ২০০ টাকার জালনোট এবং ২০০টি ১০০ টাকার জালনোট মিলিয়ে দুই লাখ জাল টাকা উদ্ধার করা হয়।
জাল টাকা তৈরি সম্পর্কে র্যাব-৩ অধিনায়ক বলেন, প্রথমত অনলাইন থেকে বাংলাদেশি বিভিন্ন নোটের ছবি ডাউনলোড করে তাদের ল্যাপটপে সংরক্ষণ ও প্রিন্টারের সাহায্যে প্রিন্ট করে। পরবর্তীতে সেসব ছবিগুলো এ্যাডোবি ইলাস্ট্রেটর ব্যবহার করে এপিঠ-ওপিঠ সমন্বয় করে লিপি গোল্ডের মোটা ও পিচ্ছিল অফসেট কাগজের উপর এক পাতায় চারটি নোট প্রিন্ট করে। এরপর সেই কাগজে তারা গোল্ডেন কালার মার্কার দিয়ে নিরাপত্তা সুতার আদলে মার্কিং করে। সবশেষে তারা স্টিলের স্কেল এবং এন্টিকাটার এর সাহায্যে জাল নোটগুলো কেটে বান্ডেল করে বিক্রয়ের জন্য প্রস্তুত করে।
পুলিশ ও গোয়েন্দার একাধিক সূত্র জানায়, জালিয়াত চক্রের বিশাল সিন্ডিকেট দেশব্যাপী নিয়ন্ত্রণ করছে জাল টাকার ব্যবসা। এর সঙ্গে কয়েকজন বিদেশি নাগরিকও জড়িত রয়েছে। এ চক্রের একাধিক সদস্য কয়েকবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে জাল টাকা ও তৈরির সরঞ্জামসহ ধরা পড়লেও বন্ধ হয়নি তাদের তৎপরতা। জাল টাকার নোট নিজেদের মধ্যে লেনদেন করতে প্রতারকরা বিভিন্ন ধরনের সংকেত ব্যবহার করে থাকে বলে জানা গেছে। জাল এক হাজার টাকার নোটকে জুব্বা, ৫০০ টাকার নোটকে পাঞ্জাবি এবং ১০০ টাকার নোটকে ধোপা বলে ডাকা হয়। অপর এক সূত্র জানায়, জাল টাকা গ্রামগঞ্জে এজেন্টদের কাছে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ কমিশনে বিক্রি করছে এ সংঘবদ্ধ চক্র। ১০০ টাকার জাল নোট ৪০ টাকায়, ৫০০ টাকার জাল নোট ২০০ টাকায় এবং এক হাজার টাকার জাল নোট বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়।
সূত্র আরও জানায়, বাংলাদেশি এজেন্টদের মাধ্যমে ১০ ও ১০০ টাকার নতুন নোট ভারতে পাচার করে সেখান থেকে ১০ টাকার নোটে ৫০ টাকা এবং ১০০ টাকার নোটে ৫০০ টাকা ছাপ দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে জাল নোট। শুধু টাকা নয়, রুপি ও ডলারও জাল হচ্ছে একই ধরনের কৌশলে।
সূত্র জানায়, মাঠপর্যায়ে জাল নোট চালাতে এজেন্টরা লোক নিয়োগ করে থাকে। প্রতারক চক্র জাল টাকা চালানোর জন্য নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন করছে। জাল নোট বাজারে ছাড়ার জন্য একটি গ্রুপে দু-তিনজন করে থাকে। একজনের কাছে জাল টাকার বান্ডিল রাখা হয়। অন্যজন মাত্র একটি নোট নিয়ে পণ্য ক্রয়ের নামে জাল টাকা চালানোর চেষ্টা করে। জাল নোট ধরা পড়লে এ প্রতারক নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে উপস্থাপন করে থাকে। পরিস্থিতি খারাপের দিকে গেলে শরীর চেক করে যেন অন্য কোনো জাল নোট না পাওয়া যায় সে জন্য দ্বিতীয় কোনো জাল নোট তার কাছে থাকে না। এভাবে একেক এলাকায় কিছুক্ষণ অবস্থান করার পর দ্রুত তারা অন্য এলাকায় চলে যায়।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
নাটোরে পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় চালকসহ এক বুদ্ধি প্রতিবন্ধী নিহত
এবার সাদপন্থিদের ১০ দফা দাবি
সা'দ পন্থীদের বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও আশুলিয়া থানায় স্মারক লিপি প্রদান
লক্ষ্মীপুরে পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু
বাংলাদেশ নিয়ে কটুক্তি করা বিজেপি নেতা শুভেন্দুকে জুতাপেটা
সিকদার গ্রুপের ১৫ প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ
শীতের তীব্রতায় বাড়ছে ডায়রিয়ার প্রকোপ,বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা
চিরিরবন্দরে আগাম জাতের আলুর ভালো ফলন ও দাম পেয়ে কৃষকেরা খুশি
‘রেমিট্যান্স এ্যাওয়ার্ড-২০২৪’ পেল হংকংয়ে বসবাসরত ১০ বাংলাদেশি নারী
বিডিআর বিদ্রোহ : ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের কমিশন গঠন
মার্কিন সিইও হত্যাকাণ্ড, সামাজিক মাধ্যমে ভুল তথ্যের বিপজ্জনক প্রভাব
গাজীপুরে কারখানা খুলে দেওয়ার দাবিতে মহাসড়ক অবরোধ
ঝিনাইদহে বেসিক জার্নালিজম বিষয়ক প্রশিক্ষণ শেষে সনদ বিতরণ
বছরখানেক সময় পেলে সংস্কার কাজগুলো করে যাব : উপদেষ্টা আসিফ নজরুল
সান্ধ্য আইন বাতিলের দাবি ইবি ছাত্র ইউনিয়নে
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আওয়ামী সরকারের পুনরাবৃত্তি করবে না আশাবাদ রিজভীর
আফগানিস্তানে ফের দূতাবাস চালু করছে সৌদি
হাজারো বিঘা জমিতে পুকুর খনন: ছোট হয়ে যাচ্ছে সালথা-নগরকান্দার মানচিত্র!
প্রতিবাদ সমাবেশ ও স্মারকলিপি প্রদান, সাদপন্থীদের নিষিদ্ধের দাবি
শুধু মুর্শিদাবাদ-মালদহ নয়, শিলিগুড়িও লক্ষ্যবস্তু