উদ্বেগ বাড়ছে রফতানিকারকদের
২১ জুলাই ২০২৩, ১১:১৮ পিএম | আপডেট: ২২ জুলাই ২০২৩, ১২:০০ এএম
দীর্ঘদিন থেকে দেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের সংকট বিরাজমান। এ কারণে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মুখে ছিল পোশাক খাত। কারখানা সচল রাখতে প্রতিমাসে অতিরিক্ত হাজার কোটির টাকার বেশি খরচ করতে করতে হচ্ছে মালিকদের। সরকারের কাছে জ্বালানি সমস্যার সমাধান চেয়েও দীর্ঘদিন পাচ্ছে না। জ্বালানি সংকটে সময়মতো অনেক কার্যাদেশ প্রদান করতে না পারায় অনেক প্রতিষ্ঠানকে বিপাকে পড়তে হচ্ছে। অনেকে ইতোমধ্যে কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। আবার এক বছরের বেশি সময় ধরে পশ্চিমা দেশগুলো মূল্যস্ফীতির চাপে থাকায়Ñসেখান থেকে রপ্তানি কার্যাদেশ আসাও কমেছে। ফলস্বরূপ; অন্তত ২০ তাংশ নিম্ন সক্ষমতায় কারখানা চালাতে হচ্ছে পোশাক রপ্তানিকারকদের। তার সঙ্গে দেশে সাম্প্রতিক সময়ের রাজনৈতিক সহিংসতা, গোলযোগ তাদের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতির চাপ কমতে শুরু করলেÑরপ্তানি কার্যাদেশ বৃদ্ধির আশা করেছিলেন রপ্তানিকারকরা। কিন্তু, দেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এখন ব্যবসার জন্য নতুন হুমকি হয়ে উঠেছে। এতে অনেক আন্তর্জাতিক ক্রেতাই সময়মতো তাদের পণ্যের চালান পাওয়ার বিষয়ে সংশয়ী হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। সার্বিক অর্থনীতির ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে এমন আশঙ্কার কথাই জানান তারা।
দেশের একটি অন্যতম পোশাক রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান- প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপ। চট্টগ্রামের রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (সিইপিজেড)-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মোহাম্মদ তানভির বলেন, দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে আমরা আমাদের উৎপাদন ও রপ্তানি চালানের মসৃণ, বাধাহীন কার্যক্রম বজায় রাখতে চাই।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির-ও সহ-সভাপতি তানভির। তিনি বলেন, বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিক্ষুন্ন করেÑএমন কোনো কর্মকান্ডে জড়িত না হতে আমরা দেশের সব রাজনৈতিক দলের প্রতি একান্ত অনুরোধ জানাই।
এমন উদ্বেগ প্রকাশ পেয়েছে বাংলাদেশের নিট পোশাক প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সমিতির (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম এর কথাতেও। তার মতে, বিগত কয়েক বছর ধরে দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকার সুবাদেই রপ্তানি ও অর্থনীতি বিকশিত হতে পেরেছে।
তিনি বলেন, প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের সময় পোশাক রপ্তানিকারকদের কাছে কার্যাদেশ আসা কমে যায়। পাশাপাশি, রাশিয়া-ইউক্রেনের চলমান যুদ্ধও তাদের ব্যবসাকে সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই অবস্থায় যদি দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা চলতে থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক বায়াররা শঙ্কিত হবে, যা আমাদের ব্যবসার পক্ষে মোটেও অনুকূল হবে না। চলমান বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি এই ধরনের আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারবেন না পোশাক রপ্তানিকারকেরা বলে উল্লেখ করেন তিনি।
বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূলতার মধ্যেই ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জন করে দেশের রপ্তানি পৌঁছায় ৫৫ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারে। এর পেছনে মূল অবদান ছিল পোশাক খাতের শক্তিশালী পারফর্ম্যান্সের। মোট রপ্তানি আয়ের ৮৪ শতাংশই আসে এই খাত থেকে। কিন্তু, বৈশ্বিক চাহিদার মন্দা, অর্থনৈতিক অস্থিরতা, ভূরাজনৈতিক সংকট এবং পশ্চিমা অর্থনীতিগুলোতে মূল্যস্ফীতির চাপের কারণে রপ্তানি আয় ৫৮ বিলিয়ন ডলারের উচ্চাকাক্সক্ষী লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪ দশমিক ২৮ শতাংশ কম হয়েছিল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রপ্তানিকারক বলেছেন, চলতি বছরের তৃতীয় প্রান্তিকে তিনি অর্ডার বাড়বে বলে আশা করেছিলেন। কিন্তু, বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে অনেক বায়ার ধীরে সুস্থে অর্ডার দিচ্ছে। কয়েক মাস চেষ্টার পর সম্প্রতি আমরা এক কাস্টমারের থেকে অনুমোদন পাই। কিন্তু, সেই কাস্টমার এখন আমাদের অপেক্ষা করতে বলছে। রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে কোরিয়ার একটি কোম্পানির সাথে যৌথ উদ্যোগের প্রচেষ্টাও স্থবির হয়ে পড়েছে বলে উল্লেখ করেন ওই ব্যবসায়ী।
নাম না প্রকাশের শর্তে দেশের অন্যতম বৃহৎ একটি টেক্সটাইল (বস্ত্র) উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে এই শিল্পের অধিকাংশ ফ্যাক্টরি ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ সক্ষমতায় পরিচালিত হচ্ছে। গ্যাস-বিদ্যুৎসহ বিভিন্ন ইউটিলিটি পরিষেবার মূল্যবৃদ্ধির কারণে তাদের উৎপাদন খরচ দ্বিগুণ হয়ে গেছে। অন্যদিকে, ব্যবসায় মন্দাভাবের কারণে বেশিরভাগ টেক্সটাইল মিল মালিকরা পুঁজি সংকটে রয়েছেন। এরমধ্যে রাজনৈতিক সহিংসতা অব্যাহত থাকলে দেশের অর্থনীতিতে বিপর্যয় সৃষ্টি হবে।
ইউটিলিটি পরিষেবার মূল্যবৃদ্ধির ফলে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও ব্যবসায় গতি না থাকায় পুঁজি সংকটের মতোন নানান চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছেন রপ্তানিকারকরা। একজন রপ্তানিকারক আরও জানান, প্রায় ৪ মাস আগেই জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা দেখা দিতে পারে বলে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু বায়ার তাকে সতর্ক করেছিলেন। একারণে তারা সতর্কভাবে অর্ডার দিচ্ছেন।
সাধারণত জাতীয় নির্বাচনের আগে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে অর্ডার দেয়ার বিষয়ে পশ্চিমা ক্রেতারা বেশি সতর্ক থাকে বলেও জানান তিনি। গত ফেব্রুয়ারি ও মে মাসে বিচ্ছিন্ন কিছু রাজনৈতিক হানাহানির ঘটনা ঘটলেও ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার পর দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শান্তি বজায় ছিল। কিন্তু, বিএনপি বর্তমান সরকারের পতন ও নির্দলীয় নির্বাচন-কালীন সরকার প্রতিষ্ঠার এক দফা দাবি ঘোষণার পর থেকেই পরিস্থিতি বদলাতে থাকে। এ পর্যায়ে উভয় দলের পক্ষ থেকেই পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ও মিছিলের ধারাবাহিকতা শুরু হয়।
এমতাবস্থায়, দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের সাথে সার্বিক অর্থনীতির অবস্থার সম্পর্ক তুলে ধরে বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশনের (এফবিসিসিআই) সভাপতি মো. জসিমউদ্দিন মন্তব্য করেন, রাজনৈতিক পরিবেশ ভালো না থাকলে, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তথা ব্যবসা, বাণিজ্য-ও তার ভুক্তভোগী হবে। তিনি বলেন, একজন ব্যবসায়ী হিসেবে আমাদের মূল উদ্দেশ্য একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশে ব্যবসা পরিচালনা। গত এক দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির ব্যাপক রুপান্তর ও অগ্রগতির কথা তুলে ধরে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা অর্থনীতিতে ব্যাপক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে হরতাল, অবরোধের মতোন কর্মসূচি না নেয়ার ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, দেশের অর্থনীতি বর্তমান অবস্থায় এই ধরনের পুরোনো কৌশলের আঘাত সইতে পারবে না। ‘অর্থনীতি ও ব্যবসার সমৃদ্ধি, বিকাশের জন্য আমরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চাই। নাম না প্রকাশের শর্তে দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বহুজাতিক বায়িং হাউজের হেড অব বিজনেস বলেন, বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচনের আগে, গোলযোগের আশঙ্কা থেকে অনেক বায়ার নিজেদের সরবরাহ চক্রকে সুরক্ষিত রাখতে ভারতমুখী হচ্ছে।’
সব বায়ার-ই একটি স্থিতিশীল দেশ থেকে পণ্য সংগ্রহ করতে চান। এছাড়া, কিছু ব্যক্তি-বিশেষের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা-নীতিও তাদের আরও সতর্ক হতে বাধ্য করেছে। এসব বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতি যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডা অনুসরণ করেÑসেকথাও উল্লেখ করেন তিনি।
অর্থনীতিবিদদের কণ্ঠেও উদ্বেগের সুর
আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদরাও। সকল দলের প্রতি শান্তিপূর্ণভাবে তাদের দলীয় কর্মসূচি, সভা-সমাবেশ পালনের আহ্বান জানিয়ে তারা বলেছেন, নাহলে বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তিক্ষুন্ন হয়ে পতন হবে রপ্তানি আয়ের। গবেষণা প্রতিষ্ঠান- সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, স্থানীয় ও বৈশ্বিক বিভিন্ন প্রতিকূলতার প্রভাব অর্থনৈতিক কর্মকা-ে পড়ায় দেশ এখন এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। সকল রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ করার গণতান্ত্রিক অধিকার এবং স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসনের প্রতি গুরুত্বারোপ করেন তিনি। একইসঙ্গে, সকল নেতিবাচক কর্মকা- থেকে উৎপাদন প্রক্রিয়া ও অর্থনীতিকে সুরক্ষিত রাখার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা পরিচালক ড. এম এ রাজ্জাক বলেন, যেকোনো ধরনের অস্থিতিশীলতাই ব্যবসাবাণিজ্যের জন্য নেতিবাচক। ইতোমধ্যেই সামষ্টিক-অর্থনীতির বিভিন্ন অনিশ্চয়তা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি এবং আমদানির বিধিনিষেধ ব্যবসাবাণিজ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
এই বিভাগের আরও
আরও পড়ুন
হবিগঞ্জের সড়কে প্রাণ গেল তিন নারী পোশাক শ্রমিকের
বরিশালে জাতীয় মহাসড়কের ওপর নির্মিত পাক অপসারণে নগর ভবনকে সড়ক অধিদপ্তরের চিঠি
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হাতাহাতি, আহত ৩
দুইবার আবেদন করেও দুর্নীতির অভিযোগ থাকায় মাল্টার নাগরিকত্ব পায়নি তারিক সিদ্দিকের পরিবার
মাদুরোকে গ্রেপ্তারে ২৫ মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ঘোষণা যুক্তরাষ্ট্রের
এবি পার্টির জাতীয় কাউন্সিল শুরু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে
মায়ের জন্য রান্না করা খাবার নিয়ে হাসপাতালে তারেক রহমান
রাজশাহীতে এবেলা ছাত্রাবাস থেকে রুয়েট শিক্ষার্থীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার
লোহিত সাগরে হুথিদের হামলায় পিছু হটল মার্কিন যুদ্ধজাহাজ
আশুলিয়ায় মেরামতের নাম করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হচ্ছে
'বিয়ের গন্ডগোল' নিয়ে জোভান–তটিনী আত্মপ্রকাশ
ভারতে বসে আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন ফ্যাসিস্টের দোসর আলাউদ্দিন নাসিম
রুশ জ্বালানিখাতে আবারও যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞা
সিরিয়ার দামেস্কের মসজিদে পদদলিত হয়ে নিহত ৪ জন
কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসছে লস অ্যাঞ্জেলেসের দাবানল
খাদ্য পরিস্থিতির ওপর নিয়মিত নজর রাখতে পুনর্গঠন হলো এফপিএমসি
দেশে অস্তিত্বহীন দলবাজরা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করছে: জয়নুল আবদিন ফারুক
ফরিদপুরে যুবককে কুপিয়ে ও চোখ উপড়ে হত্যা
ভারতে কারাভোগ শেষে দেশে ফিরলেন ১২ বাংলাদেশি
লন্ডন ক্লিনিকে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা নিয়ে সবশেষ যা জানা গেল