ঢাকা   বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারি ২০২৫ | ২৫ পৌষ ১৪৩১

বিতর্কিতদের নিয়েই কুবি ভিসির বলয়

Daily Inqilab কুবি সংবাদদাতা

০৪ আগস্ট ২০২৩, ১০:৩৯ পিএম | আপডেট: ০৫ আগস্ট ২০২৩, ১২:০২ এএম

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈন ২০২২ সালে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকেই একের পর এক বিতর্কিত ব্যক্তিদেরকে নিয়ে নিজের বলয় তৈরি করেছেন। এদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে বিভিন্ন গণমাধ্যমে। তাঁরা ভিসিকেও বিপথগামী করছেন বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। এর ফলে একের পর এক বিতর্কিত সিদ্ধান্ত দিয়ে সমালোচনার জন্ম দিচ্ছেন। সবশেষ এক অনুষ্ঠানে দেওয়া তাঁর বক্তব্য সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ করায় এক শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করেছেন। যদিও পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য শিক্ষাজীবন সংক্রান্ত শাস্তি দিতে পারেন না বলে মত দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭ম ভিসি হিসেবে যোগদান করেন অধ্যাপক ড. এএফএম আবদুল মঈন। যোগদানের দেড় মাসের মাথায় ২২ মার্চ আইন অমান্য করে ভারপ্রাপ্ত প্রক্টর পদে নিয়োগ দেন ব্যবস্থাপনা শিক্ষা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী ওমর সিদ্দিকীকে। যেখানে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে প্রক্টর পদে ন্যূনতম সহযোগী অধ্যাপককে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। তাঁর নিয়োগের সময় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭২ জন সহযোগী অধ্যাপক এবং ২০ অধ্যাপক কর্মরত ছিলেন। নিয়োগের পর থেকেই ওমর সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে মাদককে প্রশয় দেওয়া, কুবির অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পে ভ‚মি বাণিজ্য ও ক্যাম্পাস অস্থিতিশীল করতে ছাত্রলীগের বিতর্কিত ও হত্যা হামলার আসামিদের মদদ দেওয়ায় অভিযোগ রয়েছে। ভ‚মি বাণিজ্যের তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও একাধিক শিক্ষকের নামও রয়েছে।

ঠিক একমাস পর এপ্রিলের ২০ তারিখ ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স সেল (আইকিউএসি) এর পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন অধ্যাপক রশিদুল ইসলাম শেখকে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অগ্রানোগ্রামে বলা হয়েছে, এ পদে আইকিউএসির অতিরিক্ত পরিচালক অথবা আইকিউএসিতে কর্তব্যরত অধ্যাপক পদমর্যাদার কাউকে নিয়োগ দিতে হবে। তবে রশিদুল ইসলাম এর আগে কখনো আইকিউএসির কোনো দায়িত্ব পালন করেননি।

যোগদানের পর থেকেই একের পর এক নিয়ম ভঙ্গ করে নিয়োগ কাÐ ঘটিয়েছেন ভিসি অধ্যাপক আবদুল মঈন। অভিযোগ ওঠে, মার্কেটিং বিভাগের নির্দিষ্ট এক প্রার্থীকে নিতে অভিনব উপায়ে এক অনুবিধি যোগ করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন তিনি। অনুবিধিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোথাও আলোচিত না হলেও নির্দিষ্ট ওই প্রার্থীর যোগ্যতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে তা প্রকাশ করেন ভিসি। ওই বিজ্ঞপ্তিটি বাতিল করতে শিক্ষকদের মহল থেকে আবেদন গেলেও তিনি তা গ্রাহ্য করেননি। আবেদন যাচাইয়ে অনিয়ম, রাহিদের নিয়োগ পরীক্ষার খাতায় বিশেষ চিহ্ন ব্যবহারে কোনো পদক্ষেপ না নেওয়াসহ বিভিন্ন অনৈতিক পন্থা অবলম্বনের অভিযোগ রয়েছে। শেষ পর্যন্ত ওই প্রার্থীকেই নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। তবে প্রার্থীর মৌখিক পরীক্ষায় এক বোর্ড সদস্য তাকে নেওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানালেও (নোট অব ডিসেন্ট) সে বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেননি তিনি। নিয়মানুযায়ী নিয়োগ বোর্ডে কারও বিষয়ে আপত্তি আসলে বিষয়টি সিন্ডিকেট সভায় উত্থাপন করতে হয়। সিন্ডিকেটে পর্যালোচনা সাপেক্ষে ওই প্রার্থীর নিয়োগ চ‚ড়ান্তকরণ হয়। তবে ৮৬তম সিন্ডিকেট সভায় অংশগ্রহণকারী একাধিক সদস্য জানান, কোনো প্রার্থীর বিষয়ে আপত্তি সংক্রান্ত কোনো আলোচনাই সিন্ডিকেটে হয়নি। নিয়োগের এজেন্ডা আলোচনায় আসলে এক সদস্য সবকিছু ঠিক আছে কিনা জানতে চান ভিসির কাছে। ভিসি হ্যাঁ সম্মতি দিয়েই ওই আলোচ্যসূচিটি সমাপ্ত করেন। সেই নিয়োগকে বৈধতা দিতে নিয়োগের পর ইউজিসির অভিন্ন নীতিমালাও পাশ করিয়ে নেন তিনি। সেই আবু ওবায়দা রাহিদ বর্তমানে প্রশাসনের সহকারী প্রক্টর। ভিসিকে ‘শলা-পরামর্শ’ দেওয়া ব্যক্তিদের অন্যতম তিনি।

আবার নিজের গাড়ি চালককেও নিয়োগ দিয়েছেন নিয়ম ভঙ্গ করে। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী শুধুমাত্র বিভাগীয় এবং সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত প্রার্থীদের ক্ষেত্রে বয়স শিথিলযোগ্যতার কথা বলা হলেও সে চালক সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকার কোনো সনদ দেখাননি। বিজ্ঞপ্তিতে চাহিত বয়সসীমার অন্তত ছয় বছর বেশি বয়স তাঁর।
আবার নিজ জেলা বরিশালের অন্তত ৭ জন কর্মচারীকে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। এসব নিয়োগে বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের মধ্যে জনশ্রুতি রয়েছে।

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনে অধ্যাপকদের মধ্য থেকে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে পালাক্রমে তিন বৎসর মেয়াদে বিভাগীয় প্রধান নিয়োগ দেওয়ার কথা রয়েছে ভিসির। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তত পাঁচটি বিভাগে বিভাগীয় প্রধান নিয়োগের ক্ষেত্রে এ আইন মানা ভঙ্গ করে নিয়োগ দিয়েছে তিনি। বিধি মোতাবেক পদ দিতে ভিসি বরাবর চিঠিও দিয়েছেন একাধিক শিক্ষক।

২০১৬ সালে ছাত্রলীগের অন্তঃকোন্দলে নিহত হোন মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষার্থী খালেদ সাইফুল্লাহ। এ হত্যাকাÐের আসামিদেরকে সাথে নিয়েই বিভিন্ন সভা-সমাবেশ করতে দেখা যায় ভিসিকে। এ হত্যাকাÐের দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন বিপ্লব চন্দ্র দাস। এরপরও তাঁকে সান্ধ্যকালীন কোর্সে ভর্তির অনুমোদন দেয় প্রশাসন। হত্যা মামলার আরেক আসামি ও ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক রেজা-ই-এলাহীকেও কাছে টেনেছেন ভিসি। তাঁদেরকে প্রশ্রয় দিচ্ছেন খোদ ভিসিই। গত ২৭ জুলাই বিপ্লব ও রেজাকে সঙ্গে নিয়ে প্রশাসনিক ভবনে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের জন্মদিনের কেক কাটতে দেখা গেছে ভিসিকে। সে অনুষ্ঠানে ভিসি হত্যা মামলার আসামিদেরকে কেক খাইয়ে দেওয়ার ছবিও ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।

সর্বশেষ গত বুধবার ক্যাম্পাসে ভিসিপন্থি শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের সাথে ভিসির পক্ষের এক মানববন্ধনেও দেখা গেছে তাঁদের। এ ছাড়া রাতের আঁধারে ভিসির বাসভবনে গিয়ে তাঁর সাথে শলা-পরামর্শও করেন বিপ্লব, রেজাসহ তাঁদের সহযোগীরা। এরপর ক্যাম্পাসে আধিপত্য বিস্তার করতে বিভিন্ন সংঘর্ষেও জড়াতে দেখা গেছে তাঁদের।
গত ১০ মাসে বিপ্লব আর রেজার নেতৃত্বেই ছাত্রলীগের মধ্যে অন্তত তিনবার সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। গত ৮ মার্চ বিপ্লব চন্দ্র দাস ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকে ছাত্রলীগের দুই নেতাকে মারধর করেন। এ ঘটনায় আবারও মামলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। সে মামলায়ও জামিন নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তিনি।

এর আগে গত বছরের ১ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টরের সামনে অস্ত্র ও শতাধিক বহিরাগতদের সঙ্গে নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে ককটেল ও ফাঁকাগুলির বিস্ফোরণ ঘটায় বিপ্লব, রেজারা। পুলিশ ও প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা উপস্থিত থাকলেও হামলাকারীদেরকে নিরাপদেই ক্যাম্পাস ত্যাগ করার সুযোগ করে দিতে দেখা গেছে ভিসিপন্থি প্রশাসনকে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. কাজী মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন বলেন, ভিসি হচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অভিভাবক। উনি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই আইনের তোয়াক্কা না করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের সদস্য হিসেবে আমরা খুবই উদ্বিগ্ন, হতাশ। উৎকণ্ঠার মধ্যে আছি।
সার্বিক বিষয়ে ভিসির সাথে কথা বলতে গেলে তিনি এই প্রতিবেদকের ফোনকল কেটে দেন।

 


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

আরও পড়ুন

নোয়াখালীতে বাসচাপায় শ্রমিকের মৃত্যু,আহত ২

নোয়াখালীতে বাসচাপায় শ্রমিকের মৃত্যু,আহত ২

মৃদু শৈত্যপ্রবাহের কবলে নওগাঁ

মৃদু শৈত্যপ্রবাহের কবলে নওগাঁ

নির্বাচনের রোড ম্যাপ দেন অতিসত্বর : আবুল কালাম আজাদ

নির্বাচনের রোড ম্যাপ দেন অতিসত্বর : আবুল কালাম আজাদ

উত্তর কোরিয়ায় নিষিদ্ধ করা হল ‘হট ডগ’

উত্তর কোরিয়ায় নিষিদ্ধ করা হল ‘হট ডগ’

সিংগাইরে ১ সপ্তাহে আত্মহত্যা-৬

সিংগাইরে ১ সপ্তাহে আত্মহত্যা-৬

মির্জাপুরের অবৈধ সেই ৭ ইটভাটা ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে

মির্জাপুরের অবৈধ সেই ৭ ইটভাটা ভেঙে গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে

সীমান্তে সাহসী বাংলাদেশিরা, অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে পুরো দেশকে

সীমান্তে সাহসী বাংলাদেশিরা, অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে পুরো দেশকে

দাবানলে পুড়ছে প্যারিস হিলটন, অ্যান্টনি হপকিন্সের কোটি টাকার বাড়ি

দাবানলে পুড়ছে প্যারিস হিলটন, অ্যান্টনি হপকিন্সের কোটি টাকার বাড়ি

‘অতিথি দেবতার মতো’, এই নীতিতে হাসিনার ভিসার মেয়াদ বাড়ালো ভারত

‘অতিথি দেবতার মতো’, এই নীতিতে হাসিনার ভিসার মেয়াদ বাড়ালো ভারত

ভূরুঙ্গামারী মহিলা কলেজের গভর্ণিং বডির সদস্য নির্বাচনে মনোনয়ন পত্রের মূল্য ১০ হাজার টাকা

ভূরুঙ্গামারী মহিলা কলেজের গভর্ণিং বডির সদস্য নির্বাচনে মনোনয়ন পত্রের মূল্য ১০ হাজার টাকা

গোয়ালন্দে পাখিদের নিরাপদ আবাসনে গাছে গাছে মাটির হাঁড়ি বসাচ্ছেন একদল যুবক

গোয়ালন্দে পাখিদের নিরাপদ আবাসনে গাছে গাছে মাটির হাঁড়ি বসাচ্ছেন একদল যুবক

নভোএয়ার এর ১২ বছরের সাফল্য উদযাপন

নভোএয়ার এর ১২ বছরের সাফল্য উদযাপন

ফরিদপুরে বিল্ডিংয়ের দরজার পাশে পড়েছিল কেয়ারটেকারের হাত-পা বাঁধা মরদেহ

ফরিদপুরে বিল্ডিংয়ের দরজার পাশে পড়েছিল কেয়ারটেকারের হাত-পা বাঁধা মরদেহ

ডিএমপির ১২ ডিসিকে বদলি

ডিএমপির ১২ ডিসিকে বদলি

আবারও অস্ট্রেলিয়ার নেতৃত্বে স্মিথ

আবারও অস্ট্রেলিয়ার নেতৃত্বে স্মিথ

‘৪৩তম বিসিএসে বাদ পড়া ২২৭ জনের বেশিরভাগই চাকরিতে যোগ দিতে পারবে’

‘৪৩তম বিসিএসে বাদ পড়া ২২৭ জনের বেশিরভাগই চাকরিতে যোগ দিতে পারবে’

বিএনপির ২২৭৬ নেতাকর্মীকে ক্রসফায়ারে হত্যার অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে

বিএনপির ২২৭৬ নেতাকর্মীকে ক্রসফায়ারে হত্যার অভিযোগ ট্রাইব্যুনালে

ভোটার এবার আগের মত ভোট হবে না-মৌলভীবাজারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ. এম. এম. নাসির উদ্দিন

ভোটার এবার আগের মত ভোট হবে না-মৌলভীবাজারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ. এম. এম. নাসির উদ্দিন

ইহুদি খ্রিস্টানদের স্বর্গরাজ্য পুড়ে ছাই হচ্ছে!

ইহুদি খ্রিস্টানদের স্বর্গরাজ্য পুড়ে ছাই হচ্ছে!

জালিয়াতির প্রশ্ন তুলে শিরোপা হারালেন মিস ইউনিভার্স

জালিয়াতির প্রশ্ন তুলে শিরোপা হারালেন মিস ইউনিভার্স