সেপ্টেম্বরে চালু নিয়ে শঙ্কা, ১০ অংশে বড় বড় গর্ত, বেঁকে গেছে বিট, সরে গেছে কংক্রিট

বন্যায় দেবে গেল দোহাজারী কক্সবাজার রেললাইন

Daily Inqilab বিশেষ সংবাদদাতা

১৩ আগস্ট ২০২৩, ১০:৫১ পিএম | আপডেট: ১৪ আগস্ট ২০২৩, ১২:০১ এএম

আগামী সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল যোগাযোগের কথা থাকলেও বন্যায় এখন তা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে রেললাইনের নিচ থেকে মাটি সরে গিয়ে কোনো কোনো অংশ দেবে গেছে নির্মাণাধীন রেললাইন। কোথাও কোথাও বেঁকে গেছে রেললাইনের বিট। এ অবস্থায় আগামী সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারে ট্রেন আসা নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা।

সরেজমিনে পরিদর্শন করে দেখা গেছে, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার কেঁওচিয়া ইউনিয়নের তেমুহনী এলাকায় বন্যার পানিতে রেললাইন ডুবে যায়। টানা অতিবর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সাতকানিয়ার বিভিন্ন এলাকা গত সোমবার সন্ধ্যা থেকে ডুবতে শুরু করে ও মঙ্গলবার ভোরে রেললাইন পানিতে তলিয়ে যায়। পরদিন বুধবার পানি নামতে শুরু করে। এরপরই ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি নজরে আসে। প্রায় তিন কিলোমিটারজুড়ে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে অন্তত ১০টি অংশে বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে।

চলাচল শুরু হওয়ার আগে এমন উদ্ভূত পরিস্থিতির জন্য অপরিকল্পিত রেলপথ নির্মাণকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞ ও এলাকাবাসী। তারা বলছেন, ছোট ছোট যে কালভার্ট রাখা হয়েছে, সেগুলো পানিনিষ্কাশনের জন্য যথেষ্ট নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, রেললাইন নির্মাণের সময় খরা ও বন্যায় স্থানীয় অবস্থা বিবেচনায় নেয়া দরকার ছিল। যে অঞ্চলে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেখান দিয়ে বান্দরবানের পাহাড়ি ঢল ও বৃষ্টির পানি দ্রুত নেমে এসে সাগরে গিয়ে পড়ে। এখন রেললাইন করার ফলে পানিনিষ্কাশনের পথ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এতে বন্যার ব্যাপকতা বেড়েছে। মানুষকে যেমন ভুগতে হচ্ছে, তেমনি রেলের সম্পদ নষ্ট হয়েছে। পানিতে মিশে গেছে সরকারের হাজার কোটি টাকা।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে তাদের এলাকায় এমন ভয়াবহ বন্যা হয়নি। রেললাইনের কারণে পানি নিষ্কাশনের পথ আটকে যাওয়ায় তাদের এলাকার বাড়ি-ঘর ডুবে গেছে। যদি রেললাইনে পর্যাপ্ত কালভার্ট বা সেতু নির্মাণ করা হতো, তাহলে এত ক্ষতি হতো না।

ইতোমধ্যে রেলওয়ের কর্মকর্তারা ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন পরিদর্শন করে বলেন, এক কিলোমিটারজুড়ে রেললাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আবহাওয়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিন-চার সপ্তাহের মধ্যে সংস্কার কাজ শেষ করা যাবে। তাই নির্ধারিত সময়ে ট্রেন চালু নিয়ে সমস্যা হবে না। বন্যার পানিতে রেললাইনের এ অবস্থার কারণে কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে এবং তা সংস্কারে কত অর্থ ব্যয় হবে, তা এখনো পরিমাপ করা হয়নি বলে জানান তারা।

এদিকে রেল কর্তৃপক্ষ কক্সবাজার রেললাইনে ২৪৫টি কালভার্ট ও ৩৯টি ব্রিজ নির্মাণের কথা জানালেও সাতকানিয়া মৌলভীর দোকানের দুই পাশে দুই কিলোমিটারজুড়ে মাত্র দুটি কালভার্ট দেখা গেছে। অপরিসর এসব কালভার্টের নিচ দিয়ে পানি খুব কমই নামছে। এতে দু-এক দিনের বৃষ্টিতে পানি জমে বাড়ি ঘরে উঠে যাচ্ছে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ প্রকল্প সরকারের অগ্রাধিকার (ফাস্ট ট্র্যাক) প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এখন পর্যন্ত এই প্রকল্পের অগ্রগতি ৮৮ শতাংশ। ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে ৮৮ কিলোমিটার অংশে রেললাইন বসানোর কাজ শেষ হয়েছে। এখন বাকি আছে ১২ কিলোমিটার।

কক্সবাজার রেল প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, এক থেকে দেড় কিলোমিটার রেললাইন সামান্য ক্ষতি হয়েছে। পানি নেমে গেলে সংস্কার করা হবে। রেললাইনের কারণে পানি ওঠার দাবিটি সঠিক নয় বলে জানান তিনি। বাস্তবতার আলোকে অপরিকল্পিত রেলপথের কারণে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে বলে এলাকাবাসী অভিযোগ মানতে নারাজ রেলওয়ের প্রকল্প বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তারা। প্রকল্প পরিচালক মফিজুর রহমান বলেন, সম্ভাব্যতা যাচাই থেকে শুরু করে সব ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই প্রকল্প নেয়া হয়েছে। ১০০ বছরের বন্যার বিষয়টিও হিসেবে রাখা হয়েছিল। যে অংশে রেললাইন ডুবেছে, সেখানে প্রায় ২০ ফুট উঁচুতে লাইন করা হয়।

কর্মকর্তাদের মতে, এবার অস্বাভাবিক বৃষ্টি হয়েছে বলে রেললাইন ডুবে গেছে। ১০০ কিলোমিটার রেললাইনের মধ্যে মাত্র এক কিলোমিটার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এলাকাবাসীর অভিযোগের বিষয়ে মফিজুর রহমান বলেন, পানি নিষ্কাশনের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কালভার্টের সংখ্যাও বাড়ানো হয়েছে। তার দাবি, যদি রেললাইনের কারণে বন্যা হতো, তাহলে এক পাশে পানি থাকত, অন্য পাশে থাকত না। কিন্তু এবার তো দুই পাশে সমান সমান পানি ছিল।
প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা বলেন, আগামী সেপ্টেম্বরে রেললাইন চালু হওয়ার সম্ভাব্য সময়। এর আগেই সংস্কারকাজ শেষ করতে হবে। এ জন্য ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইন ঠিক করতে অন্তত পাঁচশ থেকে এক হাজার বাড়তি জনবল যুক্ত করতে হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবহন বিশেষজ্ঞ এম শামসুল হক বলেন, দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইনে ছোট ছোট কালভার্ট রাখা হয়েছে। কিন্তু তা পানিনিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত নয়। এই অঞ্চল দিয়ে পাহাড়ি এলাকার ঢল দ্রুত নেমে এসে সাগরে গিয়ে পড়ে। পানিনিষ্কাশনের পথে রেললাইনের মাধ্যমে বাঁধ দেয়ায় পানি নামতে পারেনি। যেহেতু রেললাইন হয়ে গেছে, তাতে সংশোধনের তেমন কোনো সুযোগ নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এখন এ ধরনের বৃষ্টি আরও হবে। তখন রেললাইন আবার ডুববে। এতে স্বাভাবিকভাবেই মানুষ প্রশ্ন তুলবেন রেলওয়ে পরিকল্পিতভাবে রেললাইন নির্মাণ করা হয়নি।

 


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে : তারেক রহমান
ঋণখেলাপিরা যাতে মনোনয়ন না পায় চেষ্টা করবো : মির্জা ফখরুল
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় ১৫০ কোটি টাকা অনুদান
কী আছে তৌফিকার লকারে?
চট্টগ্রামসহ সারা দেশের পাহাড় ও টিলা কাটা বন্ধ করা হবে: পরিবেশ উপদেষ্টা
আরও

আরও পড়ুন

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে : তারেক রহমান

মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরতে হবে : তারেক রহমান

ঋণখেলাপিরা যাতে মনোনয়ন না পায় চেষ্টা করবো : মির্জা ফখরুল

ঋণখেলাপিরা যাতে মনোনয়ন না পায় চেষ্টা করবো : মির্জা ফখরুল

অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর না হলে রাজনৈতিক সংস্কার টেকসই হবে না : বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি

অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর না হলে রাজনৈতিক সংস্কার টেকসই হবে না : বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি

টিসিবি’র এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর মধ্যে ৩৭ লাখই ভুয়া: বাণিজ্য উপদেষ্টা

টিসিবি’র এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারীর মধ্যে ৩৭ লাখই ভুয়া: বাণিজ্য উপদেষ্টা

ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিশ্চিতে কারখানা পরিদর্শন ভোক্তা অধিকারের

ভোজ্যতেলের সরবরাহ নিশ্চিতে কারখানা পরিদর্শন ভোক্তা অধিকারের

গণপরিবহনে শৃঙ্খলায় কাউন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা

গণপরিবহনে শৃঙ্খলায় কাউন্টার স্থাপনের পরিকল্পনা

রাজধানীর তিন পার্কে ভেন্ডারের চুক্তি : শর্ত ভঙ্গের তদন্তে ডিএনসিসি

রাজধানীর তিন পার্কে ভেন্ডারের চুক্তি : শর্ত ভঙ্গের তদন্তে ডিএনসিসি

বাবা-মায়ের পুরোনো বাড়িতে যাই : শফিকুল আলম

বাবা-মায়ের পুরোনো বাড়িতে যাই : শফিকুল আলম

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় ১৫০ কোটি টাকা অনুদান

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতদের চিকিৎসায় ১৫০ কোটি টাকা অনুদান

২০২৪ সালে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

২০২৪ সালে ৩১০ শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

ভারতীয় ৭২ গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য প্রচার

ভারতীয় ৭২ গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য প্রচার

লেবানন থেকে দেশে ফিরলেন আরো ৪৭

লেবানন থেকে দেশে ফিরলেন আরো ৪৭

প্লাটফর্ম বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

প্লাটফর্ম বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত

শক্তিশালী অর্থনীতি ও গর্বিত জাতি গড়তে শহীদ জিয়ার দর্শন ধারণ করতে হবে : আমির খসরু

শক্তিশালী অর্থনীতি ও গর্বিত জাতি গড়তে শহীদ জিয়ার দর্শন ধারণ করতে হবে : আমির খসরু

কী আছে তৌফিকার লকারে?

কী আছে তৌফিকার লকারে?

ঘটনার তিনদিন পর থানায় মামলা

ঘটনার তিনদিন পর থানায় মামলা

অনিয়ম ঢাকতে তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের পাঁয়তারা

অনিয়ম ঢাকতে তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের পাঁয়তারা

শেবাচিম হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের দুরবস্থা

শেবাচিম হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের দুরবস্থা

৯৬টি সিএনজি ভাঙ্গাড়ি হিসাবে সাড়ে ১১ লাখ টাকায় বিক্রি

৯৬টি সিএনজি ভাঙ্গাড়ি হিসাবে সাড়ে ১১ লাখ টাকায় বিক্রি

৩১ দফা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে রূপগঞ্জে বিএনপির সমাবেশ

৩১ দফা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে রূপগঞ্জে বিএনপির সমাবেশ