বৃষ্টি-তাপে বাড়ছে ডেঙ্গু
০১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:৩৫ পিএম | আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:০০ এএম
হঠাৎ বৃষ্টি। মাত্র কয়েক মিনিটের। সর্বোচ্চ আধাঘণ্টার বর্ষণ। আবার সেই রোদ। গরমের তেজ তীব্র ও ভ্যাপসা। তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে ঊর্ধ্বেই থাকছে। যেমন- গতকাল চট্টগ্রামে দিন ও রাতের তাপমাত্রা স্বাভাবিকের তুলনায় যথাক্রমে এক দশমিক ৬ এবং ২ দশমিক এক ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি ছিল। চট্টগ্রামেই শুধু নয়। গেল জুলাই মাসে সারা দেশে তাপমাত্রা ছিল গড়ে স্বাভাবিকের চেয়ে ২ দশমিক ৪ ডিগ্রি সে. বেশি। দেখা যায় কয়েকদিন থেমে থেমে বৃষ্টি। আবারও আগের সেই খরতাপের দহন। আবহাওয়ার এহেন বিপরীতমুখী, খেয়ালী ও এলোমেলো আচরণ প্রকটভাবে লক্ষ্য করা যাচ্ছে গত মে-জুন মাস থেকে এ যাবত। বিশ^জুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি এবং আবহাওয়া-জলবায়ু-প্রকৃতির ক্রমাগত পরিবর্তনের প্রভাবেই এমনটি ঘটছে। একথা বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গবেষণায়। দেশের বিজ্ঞানী-গবেষকগণও বলছেন একই কথা। বৈশি^ক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও জলবায়ুর নেতিবাচক বা ক্ষতিকর ধারায় পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা-সঙ্কট দেখা দিচ্ছে। ঘটছে নতুন নতুন রোগব্যাধির প্রাদুর্ভাব। ইদানীং তীব্র উষ্ণ আবহাওয়ায় এডিস মশা ও ডেঙ্গু রোগের বিস্তার ঘটছে। যার অন্যতম কারণ জলবায়ু পরিবর্তন।
কেননা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে নির্দিষ্ট সময়ে ও সীমিত এলাকায় হঠাৎ বৃষ্টি কিংবা অতিবৃষ্টি হচ্ছে। সেই বৃষ্টির পানি জমে থাকতেই আবার কড়া সূর্যের তীব্র রোদ পড়ছে। রোদের এই উত্তাপ ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার প্রজনন ও বংশ বৃদ্ধির জন্য সহায়ক হচ্ছে। এর ফলে এডিস মশা বৃদ্ধির সাথে সাথে ডেঙ্গু রোগের বিস্তার ঘটছে। এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু বর্তমানে ভয়ানক মহামারী আকারে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশাল মহানগরী ছাড়াও সারা দেশের ৬৪টি জেলায় বিস্তার লাভ করেছে। আবার ডেঙ্গুর নতুন ধরণ, উপ-ধরণ (ভ্যারিয়েন্ট) শণাক্ত হচ্ছে পরীক্ষা-নিরীক্ষায় এবং রোগের লক্ষণ ভেদে। যা অতীতে কখনওই দেখা যায়নি। প্রতিদিনই হাসপাতালে কিংবা বাসাবাড়িতে মারা যাচ্ছে গুরুতর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। চিকিৎসা গ্রহণ ও হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে প্রতিদিনই। আবার ডেঙ্গু, ভাইরাস, টাইফয়েড, ইনফ্লুয়েঞ্জা এসব রোগের লক্ষণ প্রায় একই রকম হওয়ায় ডেঙ্গু নিয়েও সাধারণ মানুষের মাঝে সংশয়, বিভ্রান্তি বিরাজ করছে।
যদিও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ডেঙ্গুর বিভিন্ন ধরনের লক্ষণা দেখলেই রক্ত পরীক্ষাসহ অবিলম্বে চিকিৎসার তাগিদ দিচ্ছেন। গুরুতর হলে রোগীকে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। দেশের সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা সদর ও উপজেলার হাসপাতাল, ক্লিনিকগুলোতে বাড়ছে রোগীর ভিড়। ওষুধ, স্যালাইনসহ মেডিকেল ইউনিট এবং ওয়ার্ড সুবিধা বাড়ানো হয়েছে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য।
গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশ ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এক হাজার ৫৩৪ জন। এ সময়ে মারা গেছেন আরও ৪ জন। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন মোট ৫৯৭ জন। এর মধ্যে ঢাকায় ৪৩৯ জন এবং ঢাকার বাইরে ১৫৮ জন। চলতি বছরের পয়লা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন এক লাখ ২৫ হাজার ৩৪২ জন।
আন্তর্জাতিক গবেষণায় সতর্কতা : বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়ার প্রভাবে বাংলাদেশসহ দেশে দেশে বন্যা-ঘূর্ণিঝড়, তাপদাহের মতো দুর্যোগ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে শুধু তাই নয়। জনস্বাস্থ্য সমস্যা-সঙ্কট ও ঝুঁকিতে পড়েছে বেশিমাত্রায়। চলতি বছর ২০২৩ সালে ‘এল নিনো’ অবস্থা বিরাজমান থাকার কারণে এসব সঙ্কট আরও উসকে উঠেছে। দ্য ইন্টারন্যাশনাল ফেডারেশন অব রেডক্রস রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির (আইএফআরসি) গত ১০ আগস্ট প্রকাশিত সর্বশেষ আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনে এ পরিস্থিতি, পূর্বাভাস ও সতর্কতা তুলে ধরা হয়েছে। ‘এল নিনো’র কারণে প্রশান্ত মহাসাগরে একটি উষ্ণ স্রোত সৃষ্টি এবং এর প্রভাবে বৃষ্টির আবহ রোধ হচ্ছে। বাড়ছে বিশ^জুড়ে বিশেষ করে এশীয় দেশগুলোতে খরা-অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি-বন্যা, বজ্রসহ বৃষ্টি-ঝড়, তাপদাহের মতো চরম ভাবাপন্ন অবস্থা। আইএফআরসি বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে ‘এল নিনো’র প্রভাব যুক্ত হয়ে বিশেষত এশিয়ায় অনেক ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। ডেঙ্গু, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়ের সমস্যার মুখে পড়েছে।
চলতি সেপ্টেম্বর থেকে আগামী বছর ২০২৩ সালের প্রথম দিক পর্যন্ত এসব সমস্যা-সঙ্কট বাড়তে পারে। গেল এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত চার মাসে দেশে স্বাভাবিকের প্রায় ৬৭ শতাংশই কম বৃষ্টিপাত হয়েছে। অন্যদিকে তাপমাত্রা ছিল স্বাভাবিকের চেয়ে ২.৪ ডিগ্রি সে. বেশি। টানা তীব্র উষ্ণতার ভেতর দিয়ে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত হলে তাতে এডিস মশার বংশ বৃদ্ধি এবং ডেঙ্গু বিস্তৃত হয়ে থাকে। ইতোমধ্যে ডেঙ্গুর অন্তত ৫টি ধরণ, উপ-ধরণ শনাক্ত হয়েছে। আইএফআরসি ডেঙ্গু মোকাবিলায় সুষ্ঠু ও সমন্বিত পানি ব্যবস্থাপনার ওপর জোর দিয়ে বলছে, কোথাও পানি জমে থাকা রোধ এবং তা মশার প্রজনন ক্ষেত্রে যাতে না হয় এরজন্য সতর্ক থাকতে হবে। ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার এলাকা হটস্পটগুলো চিহ্নিত ও বিস্তার রোধ করা অপরিহার্য।
বিশিষ্ট কীটতত্ত্ববিজ্ঞানী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের প্রফেসর ড. কবিরুল বাশার এডিস মশা ও ডেঙ্গু বিস্তারের পরিস্থিতি প্রসঙ্গে গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, বৈশি^ক উষ্ণতা বৃদ্ধি ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এডিস মশার বংশ বৃদ্ধি ও ডেঙ্গু বিস্তারে সহায়ক অবস্থা তৈরি হচ্ছে। হঠাৎ তীব্র গরম হঠাৎ প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে আবহাওয়ায় যে পরিবর্তন তার সাথে সাথে মানবসৃষ্ট কারণেও এডিস মশার বংশ বৃদ্ধি ঘটছে। কেননা ক্যান, বোতল, প্যাকেটজাত খাবারের পাত্র যেখানে-সেখানে ব্যাপকহারে পড়ে থাকে। সেখানে পানি জমছে। হঠাৎ বৃষ্টির পরই জমা হওয়া টলটলে স্বচ্ছ পানিতে তীব্র গরমের তেজে এডিস মশা প্রজননে সহায়ক হচ্ছে। মশার বংশ বিস্তার ঘটছে। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের শহরে-নগরে মশা নিধনে আমরা সফল হতে পারছি না। গ্রামে, উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ে এডিস মশা নিধনের কোন ব্যবস্থাই নেই। অবিলম্বে সর্বত্র মশা নিধনে জোর দিতে হবে।
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. নূর মোহাম্মদ ইনকিলাবকে জানান, এবারের ডেঙ্গুর ধরণ, উপ-ধারণ অতীতের চেয়ে ভিন্ন ধরনের। ঢাকায় ডেঙ্গুর জিনোম সিকোয়েন্সে বেশ কয়েকটি ধরণ শনাক্ত হয়েছে। চট্টগ্রামে এ ধরনের জিনোম সিকোয়েন্সিং হওয়া প্রয়োজন। তাহলে ডেঙ্গুর ধরণ আরও নিখুঁতভাবে চিহ্নিত করে সুনির্দিষ্ট চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা যাবে। তিনি বলেন, রোগীর জ্বর, ক্লান্তি, পাতলা পায়খানা, বমি, শ^াসকষ্ট, শরীরে ব্যাথা এধরনের লক্ষণ দেখা দিলেই উপযুক্ত কোন ডাক্তারের মাধ্যমে চিকিৎসা দ্রুত শুরু করতে হবে।
কোয়াক বা হাতুড়ে ডাক্তারের গিয়ে বেশিরভাগই রোগী নাজুক অবস্থায় হাসপাতালে আসে। শরীরে জ্বর কমে গেলে কিন্তু অন্য লক্ষণ থাকলে নিশ্চিন্তে ঘরে বসে থাকা যাবে না। চিকিৎসকের কাছে কিংবা হাসপাতালে সময়মতো চিকিৎসা নিতে হবে। ডেঙ্গু রোগীর সুচিকিৎসা ও ওষুধের পাশাপাশি বিশ্রাম গ্রহণ, স্যুপ, ভাতের মাড় জাতীয় খাবার গ্রহণের ওপর তিনি গুরুত্ব দেন। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জানান, চমেক হাসপাতালে কর্তৃপক্ষ আগেই পৃথক ডেঙ্গু রোগীর ওয়ার্ড, চিকিৎসক-নার্সের সমন্বয়ে তিনটি পূর্নাঙ্গ ইউনিট সার্বক্ষণিক নিয়োজিত রেখেছে। প্রয়োজনীয় প্রত্যেকটি ওষুধ-স্যালাইন ইত্যাদি বিনামূল্যে প্রদান করাসহ ডেঙ্গু সুচিকিৎসায় স্পেশাল সার্ভিস প্রদান নিশ্চিত করছে।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
সিলেটকে কঠিন লক্ষ্য দিল চট্টগ্রাম
পীরগনজ ৫০ শয্যা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ২৫ চিকিৎসক সহ ৫৫ পদ শূন্য - সেবা ব্যহত
মেহেরপুর সমাজসেবা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালকের বদলির দাবিতে মানববন্ধন
কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদের প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে বরখাস্ত
হাসিনাসহ অন্যদের পাওয়া কলরেকর্ড ফরেনসিক পরীক্ষার নির্দেশ
মেয়েসহ সাবেক আইজি বেনজীরের আয়কর নথি জব্দের নির্দেশ
শেখ রেহানাসহ ৩ সন্তানের বিরুদ্ধে ৩ মামলা, ‘সহযোগী’ শেখ হাসিনা
গাজার শরনার্থী শিবিরে ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত ৫ ফিলিস্তিনি
মিজানুর রহমান আজহারীর ব্যাখ্যা
বিতর্কিত চিন্ময় কাণ্ড: আত্মসমর্পণের পর জামিন পেলেন ৬৩ আইনজীবী
শরীয়তপুরে ১০ বছরেও নির্মাণ হয়নি আদালত ভবন
শুভেন্দুর হুঙ্কার : ‘বাংলাদেশকে জবাব দিতে পাঁচ-সাতটি ড্রোনই যথেষ্ট’
ষড়যন্ত্র ও হয়রানির বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের আবেদন বঞ্চিত বিধবার
মার্কিন মুদ্রার বিপরীতে ভারতীয় রুপির সর্বনিম্ন রেকর্ড
দোয়ারাবাজারে অভিযুক্ত বাঁধে বালু অপসারণ!
তালেবান শাসনকে বৈধতা না দেওয়ার আহ্বান নোবেলজয়ী মালালার
ফের সচিবালয়ের সামনে অবস্থান অব্যাহতি পাওয়া এসআইদের
ঢাকার বাইরে প্রথম নরসিংদীতে রয়েল এনফিল্ড লঞ্চ
ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমেই দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধিত করা সম্ভব
অন্তর্বর্তী সরকার নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে না : হাইকোর্ট