আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ ৩ জনের যাবজ্জীবন
১০ মে ২০২৪, ১২:১৫ এএম | আপডেট: ১০ মে ২০২৪, ১২:১৫ এএম
নব্বই দশকের চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যাকা-ের ঘটনায় ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই ওরফে আব্দুল আজিজসহ ৩ জনের যাবজ্জীবন, ৬ জনকে খালাস দিয়েছেন আদালত। গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারক অরুণাভ চক্রবর্তী এই রায় ঘোষণা করেন। এর আগে গত ২৯ এপ্রিল রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে এ মামলায় রায় ঘোষণার দিন বৃহস্পতিবার ধার্য করেন আদালত। মামলায় বাকি দুজন হচ্ছেন- বনানীর ট্রাম্প ক্লাবের মালিক আফাকুল ইসলাম ওরফে বান্টি ইসলাম ও আদনান সিদ্দিকী। তিনজন পলাতক। যাবজ্জীবনের পাশাপাশি তিন জনকে ২ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। অনাদায়ে ১ মাস কারাদ- ভোগ করতে হবে তাদের। বাকি ছয় আসামি খালাস পেয়েছেন তারা হলেন-সেলিম খান, হারুন অর রশীদ ওরফে লেদার লিটন ওরফে বস লিটন, আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী, তারিক সাঈদ মামুন, ফারুক আব্বাসী ও সানজিদুল ইসলাম ইমন। আশীষ রায় চৌধুরী ওরফে বোতল চৌধুরী, তারিক সাঈদ মামুন ও ফারুক আব্বাসী জামিনে আছেন। আর কারাগারে আছেন সানজিদুল ইসলাম ইমন। ১৯৯৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানীতে ট্রাম্পস ক্লাবের নিচে সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় তার ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী গুলশান থানায় মামলা করেন। সোহেল চৌধুরী নিহত হওয়ার পরপরই এই হত্যাকা-ে চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে।
ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিচারক অরুণাভ চক্রবর্ত্তী মামলার রায় ঘোষণার সময় পর্যবেক্ষণে বলেন, চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার কেস ডকেট গায়েব করা হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীরা নিজেদের গা বাঁচিয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। রায় ঘোষণার সময় আদালত বলেছেন, সোহেল চৌধুরী কোনো অখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন না। সোহেল চৌধুরী গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। সাক্ষীরা সত্য গোপনের চেষ্টা করেছেন। আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর পূর্বশত্রুতা ছিল। সাক্ষীদের জবানবন্দি রেকর্ডকারী ম্যাজিস্ট্রেটদের আদালতে উপস্থাপন করা হয়নি। মানুষ তো অসীমকাল বিচারের জন্য অপেক্ষা করতে পারে না। প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির আত্মা বিচার চায়।
রাষ্ট্রপক্ষ বাধ্য হয়ে তাদের বৈরী সাক্ষী ঘোষণা করে জেরা করেন। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীর গাড়িচালকসহ গুরুত্বপূর্ণ ১১ জন সাক্ষী মারা গেছেন। আবার গুরুত্বপূর্ণ ১২ সাক্ষীকে খুঁজে বের করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। রায় ঘোষণার সময় আদালত আরও বলেন, আসামি আদনান সিদ্দিকী নিজের গা বাঁচিয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আসামি আজিজ মোহাম্মদ ভাই আদনান সিদ্দিকী ও বান্টি ইসলাম খুনের সঙ্গে জড়িত বলে প্রমাণিত হয়েছে। এই তিন আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেওয়া হলো।
২৫ বছর আগে রাজধানীর বনানীর তৎকালীন ট্রাম্প ক্লাবের সামনে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের অভিযোগ প্রমাণের জন্য ৩৩ জন সাক্ষীর মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে মাত্র ১০ সাক্ষীকে আদালতে হাজির করা হয়। এই ১০ জনের মধ্যে আবার ৩ জন সোহেল চৌধুরীকে খুনের অভিযোগ সমর্থন করে আদালতে সাক্ষ্য দেননি। রাষ্ট্রপক্ষ বাধ্য হয়ে তাদের বৈরী সাক্ষী ঘোষণা করে জেরা করেন। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীর গাড়িচালকসহ গুরুত্বপূর্ণ ১১ জন সাক্ষী মারা গেছেন। আবার গুরুত্বপূর্ণ ১২ সাক্ষীকে খুঁজে বের করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ। রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী পাবলিক প্রসিকিউটর সাদিয়া আফরীন বলেন, আদালত থেকে ১২ জন সাক্ষীকে খুঁজে বের করার জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কিন্তু তাদের খুঁজে বের করা সম্ভব হয়নি। বাধ্য হয়ে ১০ সাক্ষীর সাক্ষ্য উপস্থাপন করতে হয়েছে।
১৯৯৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর রাজধানীর বনানীর ট্রাম্প ক্লাবের সামনে সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। পরে ডিবির তদন্তে উঠে আসে, ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাই, ট্রাম্প ক্লাবের মালিক বান্টি ইসলাম ও আশীষ রায় চৌধুরীর সঙ্গে বিরোধের জের ধরে ভাড়াটে খুনিদের দিয়ে সোহেল চৌধুরীকে খুন করা হয়। খুন হওয়ার পরের বছর আশীষ রায় চৌধুরীসহ নয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এর দুই বছর পর (২০০১ সাল) বিচার শুরু হয়। তবে এক আসামি উচ্চ আদালতে গেলে আটকে যায় বিচার কার্যক্রম। রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট হাইকোর্ট রুল ডিসচার্জ (খারিজ) করেন এবং এর আগে দেওয়া স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে রায় দেন। এরপর খুনের ২৩ বছর পর ২০২২ সালে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়।
মামলায় প্রথম সাক্ষ্য দেন চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীর ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি আদালতকে বলেন, আমি এই মামলার এজাহারকারী। ১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর ভোর ৪টার দিকে আমার ছোট ভাই সোলায়মান চৌধুরী ওরফে সোহেল চৌধুরীর চালক সেলিম আমার তৎকালীন বাসার দারোয়ানকে ঘুম থেকে ওঠান। সেলিম আমার দারোয়ানকে জানান, আমার একমাত্র ছোট ভাই সোহেলকে রাত ৩টার সময় বনানীর ১৭ নম্বর সড়কের আবেদীন টাওয়ারের নিচে ট্রাম্প ক্লাবের কলাপসিবল গেটের সামনে আততায়ীরা গুলি করেছে। দারোয়ান এ ঘটনা আমাকে জানালে আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, সোহেলকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেছেন। এরপর আমি জরুরি বিভাগে ছুটে যাই। সেখানে আমি আমার ভাইকে মৃত অবস্থায় দেখতে পাই। কর্তব্যরত চিকিৎসক আমাকে জানান, ময়নাতদন্ত শেষে বেলা ১১টার দিকে সোহেল চৌধুরীর লাশ আমার কাছে হস্তান্তর করা হবে। তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, এরপর আমি বাসায় চলে যাই। সেখানে আমি সোহেল চৌধুরীর গাড়িচালক সেলিমকে জিজ্ঞাসা করি। সেলিম আমাকে জানায় যে রাত ৩টার দিকে বা তার আগে সোহেল চৌধুরী তিনজন সঙ্গীকে নিয়ে ট্রাম্প ক্লাবের উদ্দেশে যায়। ট্রাম্প ক্লাবের কলাপসিবল গেট পর্যন্ত তারা যায়। তখন কতিপয় আততায়ীর বাধার সম্মুখীন হয়। আততায়ীর হাতে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল।
তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, একপর্যায়ে আততায়ীর একজন কালামের পেটে উপর্যুপরি দুবার গুলি করে। সে সময় অলির ভাই সোহেল চৌধুরী আততায়ীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে জড়ায় এবং বাধা দিতে থাকে। সে সময় অলির ভাই সোহেল চৌধুরীর বুকে পিস্তল ঠেকিয়ে উপর্যুপরি দুবার গুলি করে। আততায়ীদের নিশানা ও আচরণ হতে বোঝা যায়, তারা পেশাদার খুনি। এরপর আসামিরা ফাঁকা গুলি করতে করতে ঘটনাস্থল ত্যাগ করে। তবে ঘটনার সময় বেশ কিছু লোক জড়ো হয়। তাদের সংখ্যা ৩০ থেকে ৪০ জন হতে পারে। এলোপাতাড়ি গুলি চলা অবস্থায় ট্রাম্প ক্লাবের দুজন কর্মকর্তা আহত হয় বলে সেলিম আমাকে জানায়। ১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর আমি মামলা দায়ের করি। আততায়ীদের মধ্যে একজন আদনান সিদ্দিকীকে পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শী লোকজন আটক করে। সোহেলের সঙ্গী গুলিবিদ্ধ কালাম আততায়ীদের চিনতে পারে। সোহেল চৌধুরীর চালকের কাছ থেকে জানতে পারি, পূর্বশত্রুতার জের ধরে সোহেল চৌধুরীকে খুন করা হয়েছে।
মামলার ২ নম্বর সাক্ষী হলেন রফিকুল ইসলাম ম-ল। তিনি আদালতকে বলেন, আমি আবেদীন টাওয়ারে অবস্থিত ইপিক ডিজাইনার্স লিমিটেডের পিয়ন পদে কর্মরত ছিলাম। আমি সেদিন সকাল নয়টায় অফিসে আসি। আবেদীন টাওয়ারের নিচতলার কলাপসিবল গেটের পশ্চিম দিকে ৫ থেকে ৬ গজ দূরে আমি একটা পিস্তলের গুলির খোসা পেছনে লাল রং দেখত পাই। আবেদীন টাওয়ারের পূর্ব পাশের কলাপসিবল গেটের পূর্ব পাশের রাস্তায় আমি রক্ত দেখতে পাই। এরপর আমি তৃতীয় তলায় আমার অফিসে যাই। সিকিউরিটি অফিসার আনোয়ার রশিদকে খুঁজি। তাকে না পেয়ে ষষ্ঠ তলায় যাওয়ার জন্য সিঁড়ি দিয়ে পঞ্চম তলা থেকে ষষ্ঠ তলায় যাওয়ার সময় সিঁড়িতে গুলির মাথার অংশ সিসা দেখতে পাই।
রফিকুল ইসলাম ম-ল আরও বলেন, ষষ্ঠ তলায় যাওয়ার পর সিকিউরিটি অফিসার আনোয়ার রশিদের সঙ্গে আমার দেখা হয়। তখন গুলির বিষয়ে আমি তাকে জানাই। তখন আনোয়ার রশিদ আমাকে নিয়ে নিচে নামেন। তিনি গুলির খোসা দেখতে পান এবং রক্ত দেখেন। তখন আমি লোকজনকে জিজ্ঞাসা করি। তারা এরূপ জানান, রাত ৩টার সময় আবেদীন টাওয়ারের নিচতলায় গোলাগুলি হয়েছে। এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে সোহেল চৌধুরী মারা যান। একজন লোককে স্থানীয় লোকজন ধরেছেন। সেদিন সকাল ১০টা ৫ মিনিটের দিকে পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে। পুলিশ প্রথমে রক্ত, রক্তমাখা বালু সিগারেটের কাগজ দিয়ে সংগ্রহ করে। পরে পুলিশ আমাকে সঙ্গে নিয়ে একটি গুলির খোসা সংগ্রহ করে। পরে পুলিশ ভবনের সিঁড়ি থেকে গুলির সিসা সংগ্রহ করে।
মামলায় অভিযোগ করা হয়, হত্যাকা-ের কয়েক মাস আগে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে সোহেল চৌধুরীর কথা কাটাকাটি হয়। এর প্রতিশোধ নিতে সোহেল চৌধুরীকে হত্যা করা হয়। ঘটনার রাতে সোহেল তার বন্ধুদের নিয়ে ট্রাম্পস ক্লাবে ঢোকার চেষ্টা করেন। তাকে ভেতরে ঢুকতে বাধা দেয়া হয়। রাত আড়াইটার দিকে আবারও তিনি ঢোকার চেষ্টা করেন। তখন সোহেলকে লক্ষ্য করে ইমন, মামুন, লিটন, ফারুক ও আদনান গুলি চালান।
বিভাগ : জাতীয়
মন্তব্য করুন
আরও পড়ুন
লৌহজংয়ে রাত পোহালে ভোট, ৬১ কেন্দ্রের মধ্যে ৪৭টা ঝুঁকিপূর্ণ
দোয়ারাবাাজরে বজ্রপাতে নিহত ২
বিশ্বকাপ প্রস্তুতির সিরিজে আইপিএল নিয়ে ব্যস্ত উইন্ডিজ ক্রিকেটাররা
কোপার ব্রাজিল দল থেকে ছিটকে গেলেন এদেরসন
সমুদ্রে মাছ শিকার বন্ধ, নোয়াখালীর হাতিয়ায় তীরে ফিরেছেন জেলেরা
চৌদ্দগ্রামে বিদেশ প্রত্যাগত অভিবাসী কর্মীদের পুনঃএকত্রীকরণে সেমিনার অনুষ্ঠিত
দখল দূষণ ও ফারাক্কার প্রভাবে মরা খালে পরিণত ঝিনাইদহের ১২ নদী
বরগুনায় সাংবাদিকদের নিয়ে এলজিইডির জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠিত
আগামীকাল বরগুনা সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনঃ ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা
রাইসির এমন মৃত্যুতে উদ্বিগ্ন মুসলিম বিশ্ব
রাইসির মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা জানিয়ে হামাসের বিবৃতি
আধুনিক যুদ্ধেও কেন রাশিয়া দেড়শো বছরের পুরনো মোর্স কোড ব্যবহার করছে?
রাইসির মৃত্যুকে ‘ঐশ্বরিক ন্যায়বিচার’ বললেন ইহুদি পুরোহিতরা
লামায় শেষমুহুর্তে জমে উঠেছে ভোটের লড়াই
ইব্রাহিম রাইসি ছিলেন আমার প্রিয় একটি ভাই : এরদোগান
কুষ্টিয়া-রাজবাড়ী সড়কের বেহাল দশা।। প্রতিদিনই ঘটছে দুর্ঘটনা
নোয়াখালীর হাতিয়াতে ৩০ কেজি হরিণের গোশত জব্দ
জরুরি বৈঠক ডেকেছে ইরানের মন্ত্রিসভা
রাঙ্গামাটিতে চলছে ইউপিডিএফের সড়ক ও নৌপথ অবরোধ
রাইসির হেলিকপ্টার বিধ্বস্তের স্থানে তাপের উৎস খুঁজে পেল তুর্কি ড্রোন