খাটের নিচে চাদর মুড়িয়ে চিকিৎসা নেন গুলিতে চোখ উড়ে যাওয়া মোস্তফা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন

তিন হাসপাতাল ঘুরে ৫ হাজার টাকা ঘুষে ভর্তি হন ঢামেকে

Daily Inqilab হাসান-উজ-জামান

২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম | আপডেট: ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০৫ এএম


বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন তখন রূপ নিয়েছে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের পতন আন্দোলনে। দিনটি ছিল ১৮ জুলাই। বিকেল তখন ৩টা। ঘটনাস্থল বগুড়া রেলওয়ে মার্কেট সংলগ্ন বায়তুল রহমান সেন্ট্রাল মসজিদের মোড়। যা তখন আন্দোলনকারীদের অবরোধে। ঠিক এ সময় সেখানে এসে দাঁড়ায় পুলিশের চারটি গাড়ি। পুলিশের গাড়ি দেখে আন্দোলনরতরা মিছিল শুরু করে। আর তখনই মিছিলের মুখোমুখি হয়ে পুলিশ নির্মমভাবে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। মাত্র দু’-এক মিনিটের ব্যবধানে সড়ক তখন রক্তে লাল। চারদিকে শুধু বাঁচাও বাঁচাও বলে আর্তচিৎকার। গুলিবিদ্ধ হয়ে অন্তত জনা পঞ্চাশেক লোক তখন রাস্তায় লুটিয়ে। এদের মধ্যে আমি নিজেও একজন। কথাগুলো বলছিলেন বগুড়া জেলা সদরের চাঁদমুহা হরিপুরের বাসিন্দা ব্যবসায়ী মোস্তফা কামাল। যার ডান চোখ পুলিশের একটি গুলিতে চোখ উড়ে যায়।
মোস্তফা বলেন, একদিকে চিৎকার অপরদিকে গুলির আওয়াজ। কিছুক্ষণ পরে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় বগুড়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু আগে থেকেই হাসপাতালের সামনে অবস্থান নিয়েছিল ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী। যেন সেখানে আন্দোলনরতদের কেউ চিকিৎসা নিতে না পারেন। অ্যাম্বুলেন্সে তুলে ঢাকার চক্ষু হাসপাতালে রেফার্ডপত্র নিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় একটি প্রাইভেট হাসপাতালে। তারা দূর থেকেই ইশারা করে দ্রুত সটকে পড়তে। এরপর সরাসরি চলে আসি ঢাকার চক্ষু হাসপাতালে। তারাও চিকিৎসা করানোর সাহস দেখায়নি। বাধ্য হয়ে চলে আসি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। রাত তখন গভীর। ঢাকা মেডিকেলেও ছাত্রলীগ ও যুবলীগের শক্ত অবস্থান। এরই মধ্যে পাঁচ হাজার টাকা ঘুষের বিনিময়ে একজন ভর্তি নিতে রাজি হন। তিনি নিয়ে যান ঢামেকের চক্ষু বিভাগে। সেখানে নগদ ৫৫ হাজার টাকা দেয়ার পর চিকিৎসা শুরু হয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় পরদিন। প্রতিটি ওয়ার্ডে গিয়ে ছাত্রলীগ খুঁজতে থাকে আন্দোলনে আহত হয়ে আসা রোগীদের। ওয়ার্ডেও ওয়ার্ডেও ঢুকে পড়ে হায়েনার দল। সবার হাতেই ছিল বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র। হাসপাতালজুড়ে দেখা দেয় আতঙ্ক। এমন সময় সেখানের দায়িত্বরত একজন চিকিৎসক আমাকে সিটের নিচে লুকিয়ে থাকতে বলেন। অপর একজন একটি অপরিচ্ছন্ন চাদর দেন। সেটি মুড়ি দিয়ে দীর্ঘক্ষণ সিটের নিচে লুকিয়ে থাকি।
বগুড়ার রেলওয়ে মার্কেটে লেদ কারখানা রয়েছে মোস্তফা কামালের। গত শনিবার রাতে ঢাকার জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে চিকিৎসরত অবস্থায় তিনি বলেন, জুলাইয়ের ওই সময়টায় বগুড়া সদরের অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। বেশির ভাগ মানুষ ছিলেন আন্দোলনমুখী। ঘটনার দিন পুলিশের রাইফেলের একটি গুলি পাশ দিয়ে ঢুকে তার ডান চোখ দিয়ে বের হয়। ঢাকা মেডিকেলে কয়েক দিনের চিকিৎসা নিয়ে তাকে বাড়ি চলে যেতে হয়। বাড়িতে থাকাকালে তিনি মাথাও ব্রেইনেও আক্রান্ত হন। দ্রুত তাকে ভর্তি করা বগুড়ার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ)। কয়েক দিন পরে তাকে রেফার্ড করা হয় ঢাকার সিএমএইচে। সেখান থেকে পাঠানো হয় জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিউিটে। এখানেই তার চোখের সর্বশেষ অপারেশন হয়। হাত থেকে চামড়া নিয়ে লাগানো হয় চোখের পাশে। এক মাস চিকিৎসা নিয়ে তাকে ১৫ দিনের জন্য রিলিজ দেয়া হয়। আবার তিনি ভর্তি হন জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে।
টানা পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে চিকিৎসাধীন মোস্তফা বলেন, ডান চোখে আক্রান্ত হওয়ার কারণে তার বাম চোখেও ঝাঁপসা দেখেন। শুধু তা-ই নয়, চোখের কেমিক্যালের কারণে নষ্ট হতে চলেছে দাঁত। সমস্যা দেখা দিয়েছে মুখেও। শক্ত কিছুই মুখে নিতে পারেন না। এখন তিনি একের পর এক নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। অপারেশন করাতে হয়েছে নাকেও।
দুই সন্তানের জনক মোস্তফা কামাল বলেন, তার সন্তানদের মধ্যে ছেলে রিয়াদ অনার্সের ছাত্র। কম্পিউটার বিভাগে লেখাপড়া করছে। একমাত্র মেয়ে জান্নাত দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী। একদিকে চিকিৎসা খরচ অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। সন্তানদের কারণে স্ত্রীকে পাশে পাচ্ছেন না তিনি। যে কারণে হাসপাতালের স্টাফ ছাড়া তাকে দেখভালের কেউ নেই। জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে এক লাখ টাকা এবং জামায়াতে ইসলাম সংগঠন থেকে পাঁচ হাজার টাকার আর্থিক সহায়তা পেয়েছেন তিনি। তবে আর্থিক সহায়তার চেয়েও তিনি এখন নিজেকে সুস্থ রাখার ব্যবস্থা করতেই সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়ে বলেন, ভাগ্যক্রমে তিনি বেঁচে থাকলেও চোখ থেকে একের পর এক মাথা-ব্রেইন, নাক, দাঁত ও গলা আক্রান্তসহ বিভিন্ন রোগে ভুগছেন। যে কারণে তার সুচিকিৎসাই অতি গুরুত্বপূর্ণ।


বিভাগ : জাতীয়


মন্তব্য করুন

HTML Comment Box is loading comments...

এই বিভাগের আরও

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার ফোনালাপ
অযোগ্য হবেন হাসিনা?
উত্তরবঙ্গে একটি আন্তর্জাতিক মানের স্টেডিয়াম নির্মাণ করা হবে
প্রত্যেক ধর্মের শান্তির বাণী নিজের মধ্যে স্থাপন করতে হবে: ড. ইউনূস
প্রকৃত তথ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সংবাদ করুন: প্রেস সচিব
আরও

আরও পড়ুন

অতিসত্বর নির্বাচন হওয়ার দরকার : আমীর খসরু

অতিসত্বর নির্বাচন হওয়ার দরকার : আমীর খসরু

দুর্নীতিগ্রস্ত লুটেরা মাফিয়াদল যাতে বাংলাদেশে আর ফেরত না আসতে পারে : মেজর হাফিজ

দুর্নীতিগ্রস্ত লুটেরা মাফিয়াদল যাতে বাংলাদেশে আর ফেরত না আসতে পারে : মেজর হাফিজ

বঞ্চিত ৭৬৪ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিচ্ছে সরকার

বঞ্চিত ৭৬৪ কর্মকর্তাকে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিচ্ছে সরকার

ক্যাডার বর্হিভূত রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান শিক্ষা ক্যাডারের

ক্যাডার বর্হিভূত রাখার সুপারিশ প্রত্যাখ্যান শিক্ষা ক্যাডারের

শেখ হাসিনাসহ ৬৩ জনের নামে মামলা

শেখ হাসিনাসহ ৬৩ জনের নামে মামলা

অভিযানের খবরে পালাল শ্রাবণধারা কারখানার পরিচালক-ম্যানেজার

অভিযানের খবরে পালাল শ্রাবণধারা কারখানার পরিচালক-ম্যানেজার

সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নেই আশানুরূপ সাড়া

সর্বজনীন পেনশন স্কিমে নেই আশানুরূপ সাড়া

একতাই পারবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে

একতাই পারবে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা করতে

তিতাস গ্যাস টি.এন্ড ডি. পিএলসি’র ৫% নগদ লভ্যাংশ অনুমোদিত

তিতাস গ্যাস টি.এন্ড ডি. পিএলসি’র ৫% নগদ লভ্যাংশ অনুমোদিত

ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল্লামা সাজিদুর নির্বাহী সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ

ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আল্লামা সাজিদুর নির্বাহী সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ

‘আপনারা আমার খালেদকে ফেরত এনে দেন’ : নিখোঁজ সহ-সমন্বয়কের বাবা লুৎফর

‘আপনারা আমার খালেদকে ফেরত এনে দেন’ : নিখোঁজ সহ-সমন্বয়কের বাবা লুৎফর

২৮ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলাফত মজলিসের অধিবেশন প্রেস ব্রিফিংয়ে নেতৃবৃন্দ

২৮ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে খেলাফত মজলিসের অধিবেশন প্রেস ব্রিফিংয়ে নেতৃবৃন্দ

ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা

ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা

ইনসেপ্টার বিক্রয় প্রতিনিধির ২২টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ

ইনসেপ্টার বিক্রয় প্রতিনিধির ২২টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ

পিকে হালদারের পাঁচ সহযোগীর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের নির্দেশ

পিকে হালদারের পাঁচ সহযোগীর ব্যাংক হিসাব ফ্রিজের নির্দেশ

ভূমধ্যসাগরে ৮ বাংলাদেশি নিহত

ভূমধ্যসাগরে ৮ বাংলাদেশি নিহত

মুক্তি পেলেন ভারতের সমুদ্রসীমায় গ্রেফতার ১২ বাংলাদেশি

মুক্তি পেলেন ভারতের সমুদ্রসীমায় গ্রেফতার ১২ বাংলাদেশি

আ.লীগকে পুনর্বাসনকারীদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়বে গণঅধিকার পরিষদ

আ.লীগকে পুনর্বাসনকারীদের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়বে গণঅধিকার পরিষদ

অন্তর্বর্তী এ সরকারের মধ্যে দুটি সরকার রয়েছে : মাহমুদুর রহমান মান্না

অন্তর্বর্তী এ সরকারের মধ্যে দুটি সরকার রয়েছে : মাহমুদুর রহমান মান্না

হাসিনার নভোথিয়েটার দুর্নীতি মামলার পুনঃতদন্ত শুরু

হাসিনার নভোথিয়েটার দুর্নীতি মামলার পুনঃতদন্ত শুরু